আবার সিকিম

আমায় থাকতে দে-না আপন মনে ….। সেই প্রথম যৌবন থেকে মনের গভীরে একটাই সখ, একটাই আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধে আছে, আর সেটা গোটা দেশটাকে ঘুরে দেখার। সময়, সুযোগ, অর্থনৈতিক ও শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী সেই সাধ মেটাবার চেষ্টাও চালিয়ে গেছি। চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার পর শারীরিক ক্ষমতা কিছু দুর্বল হয়ে পড়লেও, সময় ও সুযোগের কিছুমাত্র অভাব না রেখে, বেশ ঘুরেও বেড়াচ্ছিলাম। ‘এই নিয়ে আজ দিনের শেষে একা চলি তার উদ্দেশে’, কিন্তু আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিলো সকলি ফুরায়ে যায়  মা। তরুণ ও তার পরিবারকে সঙ্গী করে দু’-একটা ট্রেক সমেত, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মনের আনন্দে দিব্য ঘুরেও বেড়াচ্ছিলাম, কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আরও সবার মতো আমার এই মাখনের মতো মসৃণ যাত্রাপথের সামনে বাধা হয়ে এসে দাঁড়ালো, ভয়াল ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাস। অন্যান্য বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও, ২০১৮ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি পূর্ব ও উত্তর সিকিম, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমে ভুটান, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের একবারে শেষে মধ্যপ্রদেশ ঘুরে এসে, আমার জীবনীশক্তি, আমার বেঁচে থাকার রসদ, আমার অক্সিজেনসম সাত বছরের নাতনিকে নিয়ে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, দিন তিনেকের জন্য হাতের কাছে পাশের জেলার বগুড়ান জলপাই থেকে বনের পাখির মতো ঘুরে এসেই, লকডাউন নামক এক খাঁচায় বন্দী হয়ে গেলাম।

ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন, হয়তো বা কয়েকটা মাসের ব্যাপার, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এ এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। চেনা পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনকে এই মারণ রোগে পরপারে যেতেও দেখতে হলো। তবু এই বন্দী জীবন অসহ্য হয়ে ওঠায়, গৃহবন্দী আমি, ঝুঁকি নিয়েও মুখোশ টুখোশ পরে গাড়িবন্দী হয়ে কাছাকাছি দু’-চারটি স্থানে ঘুরে দেখলাম, এমনকী আদরের নাতনিটিকেও সঙ্গে নিয়ে একবার সমুদ্র দর্শনেও গেলাম। কিন্তু শেষে একদিন বুঝলাম, এইভাবে নন্দলালের মতো মনে ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না, সম্ভবও নয়। মাঝ থেকে দেশও দেখা হবে না, প্রাণপাখিও যে আরও অনেকের মতো আমায় ছেড়ে নিজেই বেড়াতে বেরবে না, তারই বা স্থিরতা কোথায়? অতএব বেরিয়ে পড়ো। বছর আড়াই আগে সিকিমের পূর্ব ও উত্তর অংশের বেশ কিছু স্থান ঘুরে এসে ইচ্ছা হয়েছিলো, সিকিমের পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশের কিছু স্থান ঘুরে দেখার। অবশেষে সব বাধা সব ভয় ত্যাগ করে, মনে মনে ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’ আওড়ে, যা হয় হোক, হলে দেখা যাবে ভেবে, এবার সিকিম ঘুরে দেখা পাকা করে ফেলা গেল।

নভেম্বরের শেষে নতুন চাকরি পাওয়ায়, অন্যান্য বারের মতো তরুণ ও তার স্ত্রী, সীমার সাথে তাদের  কন্যা সম্পূর্ণার এবার আর যাওয়ার কোন সুযোগ ছিলো না, তবে তরুণের বেয়াই মশাই, বিপত্নীক হিমাদ্রিদা,  এবার আমাদের দলে যোগ দিলেন। যদিও তিনি মূলত আবু ধাবিতে বসবাস করেন, কিন্তু ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসে লকডাউনের চক্করে পড়ে আর ফিরে যেতে পারেননি। আমাদের সাথে তাঁর খুব যাওয়ার সখ, তবে তাঁর সিকিম দেখার থেকেও, দু’দিন কোন হোমস্টেতে থাকার ইচ্ছাটা অনেক প্রবল। আগে কখনও তাঁর হোমস্টেতে থাকার সৌভাগ্য হয়নি, আমাদের কাছে সিকিমের বিভিন্ন হোমস্টের অতীত অভিজ্ঞতার কথা শুনে, তাঁর এই ইচ্ছা আরও ঘনীভূত হয়েছে।

সে যাইহোক, প্রাথমিক ভাবে যাওয়ার ব্যাপারটা পাকা হওয়ার সাথেসাথেই, অক্টোবর মাসের নয় তারিখে,  তরুণ পাঁচশ’ সাতষট্টি কিলোমিটার দূরত্বের নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার ও ফেরার ০২৩৪৩ শিয়ালদহ-এনজেপি স্পেশাল, ও ০২৩৪৪ এনজেপি-শিয়ালদহ স্পেশাল ট্রেনের যথাক্রমে বারোই ডিসেম্বর ও একুশে ডিসেম্বর তারিখের বাতানুকুল টু-টায়ারের পাঁচটা কনফার্ম টিকিট কেটে ফেললো। যদিও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য নামে কিছু পরিবর্তন এনে ও নামের শেষে লেজের মতো ‘স্পেশাল’ তকমাটা জুড়ে দিলেও, এই ট্রেনটি আদপে কিন্তু সেই বিখ্যাত দার্জিলিং মেল, এবং আমরা ট্রেনে চাপার সময় মেকআপ তুলে আবার আগের মতোই ০২৩৪৩ এর পরিবর্তে ‘১২৩৪৩ দার্জিলিং মেল’ বোর্ড লাগানো আছে চোখে পড়লো। মহাকবি যতই বলে থাকুন না কেন, যে নামে কি বা আসে যায়? বাস্তবে কিন্তু অবশ্যই আসে যায়, অনেকেই হয়তো Zনতি পারো না। স্পেশাল তকমার সৌজন্যে তিনজনের জন্য একটা টিকিটের মূল্য ৫,১১০.০৭ টাকা, অর্থাৎ মাথাপিছু ১,৭০৩.৩৫ পয়সা, ও দুজনের জন্য অপর একটি টিকিটের মূল্য ৩,৪১৪.৫৮ টাকা, অর্থাৎ মাথাপিছু ১,৭০৭.২৯ টাকা দিতে হলো। অথচ দার্জিলিং মেলের, বাস্তবে যে নামের ট্রেনে আমাদের যেতে হচ্ছে, তার টিকিটের মূল্য কিন্তু মাথাপিছু ১,৩২৫.০০ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু টিকিটের মূল্যে কারও প্রায় চারশ’ টাকা পৌষ মাস হলেও, আমাদের মাথাপিছু ওই মূল্যের সর্বনাশ, হয়তো বা সাড়ে সর্বনাশ হয়ে দাঁড়ালো।  

আমরা সাধারণত মোবাইল ফোনে বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন হোটেলের সাথে কথা বলে ও ছবি দেখে একটা প্রাথমিক পছন্দ করে থাকলেও, আগে থেকে কোন হোটেল বুক করে যাই না। এবারও যাওয়ার বেশ আগে, অক্টোবর মাসের পঁচিশ তারিখে, একমাত্র পেলিংয়ের ব্লু বেন হোটেলে অনেক দর কষাকষির পর, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফেসিং দুটো ডিলাক্স ও একটি প্রিমিয়াম ঘরের কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্ট সহ বুকিং, প্রতিদিন যথাক্রমে সতেরোশ’ ও উনিশশ’ টাকা করে, ও এনজেপি রেলওয়ে স্টেশন থেকে হোটেলে যাওয়ার জন্য একটি ছয়জন বসার ভালো গাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা পাকা করে, হোটেলের নির্দেশমতো মাত্র এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অন্যান্য জায়গায় কিছু হোটেল ও হোমস্টের সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নিলেও, টাকা পাঠানো বা বুকিং করা হলো না। যাওয়ার প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত, এবার শুধু শুভদিনে বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা।

যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে, অর্থাৎ বারোই ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে, রাতে আমরা একটু আগেভাগেই শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে ট্রেনটিও অনেক আগে প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলো। পাশাপাশি দুটো বগিতে আমাদের সবক’টা লোয়ার বার্থ পড়লেও, পারস্পরিক বোঝাপড়ায় একই কিউবিকলের মধ্যে আমাদের সবার বার্থের ব্যবস্থাও হয়ে গেলো। অন্যান্য বারের মতো এবারেও সীমা আলুর পরোটা করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমার উনি আলু-ফুলকপির চচ্চরি করে নিয়ে গেলেও, খাওয়ার সময় দেখা গেল, বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার সময় আর সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে গেলেও, খুব ভালো ও স্বুস্বাদু জয়নগরের মোয়া ও তিলের নাড়ুর বাক্সটা বাড়িতেই ফেলে আসা হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলেও, নলেন গুড়ের সন্দেশ দুঃখটাকে কিছু প্রশমিত করলো। নির্দিষ্ট সময়, অর্থাৎ রাত দশটা পাঁচ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে দিলো। এবার আবার মালের দায়িত্ব আরোহীর মতো বিছানার দায়িত্ব আরোহীর ওপর বর্তেছে। যাইহোক, আমরা আরও কিছুক্ষণ গুলতানি করে, যে যার বিছানা নিলাম।   

প্রথমে ভেবেছিলাম চারশ’ টাকা করে অতিরিক্ত দেওয়ার জন্য, ভারতীয় রেল খুশি হয়ে আমাদের একটু বেশি সময় ট্রেনে চাপার সুযোগ দিচ্ছে, পরে শুনলাম রেল লাইনে মেরামতির কাজ চলার জন্য ট্রেন কিছু বিলম্বে ছুটছে। যে কারণেই হোক, আমরা শেষপর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ের দু’ঘন্টা সাতচল্লিশ মিনিট পরে, অর্থাৎ ছ’শত দশ মিনিটের যাত্রাপথ সাত শত সাতাত্তর মিনিটে সমাপন করে, বেলা এগারোটার পরে সুস্থ শরীরে এনজেপি স্টেশনে এসে অবতরণ করতে সক্ষম হলাম। আজ আমাদের পেলিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। সেইমতো ব্লু বেন হোটেলের সাথে ফোনে কথা বলে, সময়মতো একটি ছ’জন বসার মতো ভালো গাড়িকে এনজেপি রেলওয়ে স্টেশনে হাজির থাকার ব্যবস্থাও করা ছিলো।

গতবারে যখন এনজেপি স্টেশনে গিয়েছিলাম, তখন স্টেশনের বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় সবরকম গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। স্টেশনে নেমে এবার আমাদের জন্য পাঠানো SK 01 Z 0498  ইনোভা গাড়িটির ড্রাইভার, রামাকে ফোন করে জানা গেল, যে সে স্টেশনের বাইরে সিকিমের গাড়ি পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গায় তার গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মালপত্র নিয়ে স্টেশনের বাইরে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় গিয়ে দেখলাম, পাশাপাশি দুটো জায়গায় পশ্চিম বঙ্গ ও সিকিমের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। অল্প বয়সি তরতাজা চেহারার রামা নামক ছেলেটি এগিয়ে এসে সমস্ত মালপত্র গাড়িতে গুছিয়ে তুলে ফেললো। জলখাবারের জন্য অহেতুক সময় নষ্ট না করে, গাড়ি এগিয়ে চললো। ঠিক হলো রাস্তায় কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে জলখাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেওয়া যাবে।

আশিঘর মোড়, বাণেশ্বর মোড়, ইস্টার্ন বাইপাস রোড ধরে একসময় সেবক রোডের একটা ধাবায়, কড়মড়ে বাটার টোস্ট, ডিমের অমলেট ও কফি সহযোগে জলখাবারের পর্ব সাঙ্গ করে গাড়িতে গিয়ে বসা হলো। এবার এগিয়ে যাবার পালা। যাওয়ার পথে বাম দিকে মংপু ও ডান দিকে কালিংপঙ্গ যাওয়ার পথনির্দেশ চোখে পড়লো। তিস্তা ও রঙ্গীতকে পাশে নিয়ে আমরা একসময় রাফ্টিং পয়েন্টের কাছে এসে পৌঁছলাম। আরও কিছু পথ পার হয়ে মাল্লি বাজার। এখানেই মাল্লি চেকপোস্ট, সিকিমের প্রবেশ পথ। রাস্তা বেশ ভালোই, তবে এবার বৃষ্টির সময় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ও বৃষ্টির পরিমাণ কিছু অধিক হওয়ায়, স্বাভাবিক ভাবেই কোন কোন স্থানে রাস্তা কিছু ভাঙাচোরা। একসময় আমরা জোরথাং এসে হাজির হলাম। এখানে সামনের আরও কিছু গাড়ির মতো আমাদের গাড়িকেও রাস্তার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। দাঁড় করানোর কারণ, সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী, প্রেম সিং তামাং এই পথে যাবেন। অল্প সময়ের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির কনভয় চলে যাওয়ার সাথেসাথেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি মিললো। ভালো লাগলো দেখে, যে এখানকার পুলিশ বিকালে ভি.ভি.আই.পি. যাবেন, বা কখন যাবেন সঠিক না জেনেও, দুপুর থেকে সাধারণ জনগণের গাড়ির যাতায়াত বন্ধ করে রাখেন ন। যাইহোক, শেষপর্যন্ত আক্কর ব্রিজ হয়ে লেগশিপের ওপর দিয়ে বিকালের প্রায় শেষভাগে আমরা আপার পেলিংয়ের ব্লু বেন হোটেলের সামনে এসে হাজির হলাম। আসার পথে লেগশিপ নামক স্থানটিতে দেখলাম রঙিন আলো দিয়ে সাজানো বেশ বড় মেলা বসেছে।  

হোটেলটিতে ঢুকেই বাঁপাশে সাজানো গোছানো রিসেপশন কাউন্টার, ডানপাশে বোর্ডারদের বসার জন্য কয়েকটি সোফা পাতা। রিসেপশন কাউন্টারে বসা অল্প বয়সি স্মার্ট ব্যক্তিটির নাম, নন্দন ছেত্রী। সুন্দর চেহারার সাথে মানানসই তার সুন্দর ব্যবহার। জানা গেল, যে তিনি ও তাঁর দাদা সুদন ছেত্রী মিলে হোটেলটি চালান। হোটেল ও গাড়ি বুকিংয়ের ব্যাপারটা বড়ভাই সুদনই দেখাশোনা করেন, যদিও তিনি সম্ভবত শিলিগুড়িতে থাকেন। ছোটভাই নন্দন, হোটেলের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারটা দেখভাল করেন। রেজিস্টারে সকলের নাম ধাম ইত্যাদি লেখার সময় আধার কার্ড ও কোভিড-19 ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেটের জেরক্স কপি জমা দিতে হলো। যাইহোক, কাজ মিটিয়ে নিজেদের ঘরের কাছে গিয়ে দেখলাম, আমাদের মালপত্র আগেই নিয়ে এসে দরজার কাছে জড়ো করা হয়েছে। দোতলায় কাঞ্চনজঙ্ঘামুখো একশ’ এক ও একশ’ তিন নম্বর দুটোই ঘর আছে। সেগুলো ডিলাক্স রূম এবং একটা তরুণদের ও অপরটা আমার ঘর। এই ঘরদুটোর কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকটায় সিমেন্টের দেওয়াল থাকলেও, মাঝখানে দেওয়ালের প্রায় সমস্ত অংশটাই, কাচের তৈরি গরাদহীন বিশাল জানালা থাকায়, জানালা দিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘার শোভা অবলোকন করা সম্ভব। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে বিছানায় শুয়ে, কাচের দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে, অথবা ব্যালকনিতে বসে দৃষ্টিপথে বাধাহীন কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায়। হিমাদ্রিদার দুশো এক নম্বর কাঞ্চনজঙ্ঘামুখো প্রিমিয়াম ঘরটি তিন তলায়। ভাড়া বেশি, তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঘরটি ডিলাক্স ঘরগুলোর মতো হলেও, অনেক বেশি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো গোছানো। হোটেলের যে কর্মচারীটি আমাদের মালপত্র বয়ে নিয়ে এসে যার যার ব্যাগ তার তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল, তার নামটা মনে নেই, তবে তার পদবি ভুটিয়া, এবং তার বয়স অল্প এবং উচ্চতা ছয় ফুটের ওপর, যেটাকে হয়তো ওই এলাকায় ব্যাতিক্রম বলা যেতেই পারে। এই ছেলেটির ব্যবহারও খুব সুন্দর।

আমি আর তরুণ একতলার রিসেপশন কাউন্টারে এসে পেলিং ঘুরে দেখার জন্য একটা ভালো গাড়ির ব্যবস্থা করার কথা বলতে নন্দন আবার জানালেন, যে গাড়ির ব্যাপারটা যেহেতু তাঁর দাদা, সুদন দেখাশোনা করেন, তাই আমরা যেন তাঁর দাদার সাথে ফোনে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করি। হাতে সময় বড় কম, কাল সকালেই গাড়ির প্রয়োজন, তাই ডানপাশের সোফায় বসে সুদনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলো। আগামীকাল ও পরশু পেলিংয়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরিয়ে, ষোলো ও সতেরো তারিখ রাভাংলা ও নামচি ঘুরে দেখিয়ে, আঠারো তারিখে রাভাংলার হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে রিংচেনপং পৌঁছে দেবার মতো একটা ভালো গাড়ির ব্যবস্থা করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হলে তিনি জানালেন, যে কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে নেবেন। কিছুক্ষণ পরে সুদন ফোন করে জানালেন, যে আজকের গাড়িটাই এই কাজটা করে দেবে, তবে প্রতিদিন চার হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হবে। দলের সকলের ষাটোর্ধ্ব বয়স হওয়ায় ও হাঁটুর সমস্যা থাকায়, গাড়ি ছাড়া উপায়ও নেই। আজকের গাড়িটা ও তার চালক রামাকে আমাদের সকলেরই পছন্দ হওয়ায়, শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। এখন পর্যন্ত সেই এক হাজার টাকা ছাড়া একটা পয়সাও, এমনকী আজ এখানে আসার গাড়িভাড়া বাবদ চার হাজার তিনশ’ টাকাও এখন দিতে হলো না। নন্দন জানালেন, যে ষোলো তারিখ হোটেল ছেড়ে যাবার সময় তিনি সমস্ত টাকা জুড়ে বিল দিয়ে টাকা নিয়ে নেবেন। একটা বড় সমস্যার সমাধান হওয়ায়, মানসিকভাবে বেশ আশ্বস্ত হওয়া গেল।

আজ আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় বা সুযোগ, কোনটাই নেই। এখানে রীতিমতো ঠান্ডা, তবু সকালে স্নান করা হয়নি তাই রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে, একে একে গরম জলে বেশ করে স্নান করে চা বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, একতলার ডাইনিং হলে খেতে গেলাম। এখানকার রান্না বেশ ভালো, বাড়ির বাইরে বা ভিনরাজ্যে আছি বলে মনে হবে না। গতকালের ট্রেন জার্নি ও আজকের বেশ কয়েকঘন্টা মোটর জার্নি করে আজ সকলেই মোটামুটি ক্লান্ত, তার ওপর আবার এরকম ঠান্ডা ও সাথে সাদা ঝকঝকে বিছানা ও সুন্দর কম্বল ও লেপ। তাই খুব বেশি রাত না করে, আজ সবাই একটু তাড়াতাড়িই বিছানায় আশ্রয় নিলো। আগামীকাল সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরের কাচের জানালার পর্দা সরিয়ে বিছানায় শুয়ে বা ব্যালকনির চেয়ারে বসেই তার দর্শন পাওয়া যাবে। আমি বা তরুণ না নিলেও,  হিমাদ্রিদা কিন্তু ঠান্ডার ভয়ে ওনার ঘরের জন্য প্রতিদিন তিন শত টাকা ভাড়ায় একটা রূম হিটার নিয়ে নিলেন। মোবাইলে ভোর সাড়ে চারটেয় অ্যালার্ম দিয়ে, মোবাইল ও ক্যামেরা চার্জে বসিয়ে, লেপের তলায় আশ্রয় নিলাম।

আজ চোদ্দই ডিসেম্বর, ভোর বেলার রক্তিম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দর্শনের লোভেই সম্ভবত মোবাইলে অ্যালার্ম বাজার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা থেকে উঠে কাচের জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম। চারিদিক ঘোর অন্ধকারে ঢাকা, সূর্য উঠতে কিছু দেরি আছে। তবে মনে হলো, আকাশের অবস্থা খুব একটা পরিষ্কার নয়। আবার শুয়ে পড়লাম। অ্যালার্ম বাজলো, কিন্তু এখনও বেশ অন্ধকার। পাছে ঘুমিয়ে পড়ি, তাই দশ মিনিট পরে আবার অ্যালার্ম দিলাম। আবার অ্যালার্মের সময় পিছিয়ে দিতে হলো। এইভাবে বারকতক অ্যালার্ম বাজার পর, অবশেষে তিনি দেখা দিলেন। তবে কোথাও কোথাও কিছুটা অংশ পরিষ্কার হলেও, বেশিরভাগ অংশই মেঘে ঢাকা। ধীরে ধীরে ঘুমন্ত বুদ্ধ খণ্ডে খণ্ডে আলোকিত হলেন বটে, তবে তাতে মন ভরলো না। ঘরের জানালা থেকে, তিনতলার ব্যালকনি থেকে, এমনকী ছাদ থেকেও অনেক ছবি তুলে ঘরে ফিরে এলাম। বেড টি দিতে দেরি আছে, তবে তরুণ ও সীমা যতদিন আমার ভ্রমণ সঙ্গী আছে, এই শর্মা হোটেলের বেড টি’র পরোয়া করে না। ঘরের কেটলিতে সীমা চা তৈরি করে ফেলেছে। তরুণ এসে চা দিয়ে গেল। শীতের ভোরে বিছানায় লেপ চাপা দিয়ে আধশোয়া হয়ে গরম চা পান করে তৃপ্ত হলাম। শুধুমাত্র এই সার্ভিসটার জন্য আমার অবশিষ্ট আয়ুর অর্ধেকটা আমি বিনা দ্বিধায় সীমাকে এন.ই.এফ.টি. করে পাঠিয়ে দিতে নির্দ্বিধায় রাজি আছি।

এক সময় ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে একতলার ডাইনিং হলে বিনিপয়সার প্রাতরাশ সারতে গেলাম। কেউ পুরি সবজি, কেউ আবার আধা ব্রেড বাটার আধা ব্রেড জ্যাম টোস্ট, সাথে অমলেট দিয়ে প্রাতরাশ সেরে সাথে গরম চা পান করে চাঙ্গা হয়ে, বেরবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম। রামা রাতে কোথায় ছিলো জানি না, তবে সে তার গাড়ি নিয়ে হোটেলের সামনে হাজির হয়ে গেছে। আজ আর সাথে মালপত্র নেওয়ার হাঙ্গামা নেই। জলের বোতল, ক্যামেরার ব্যাগ, ও টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

রামা জানালো, যে আজ প্রথমেই আমরা রিম্বী জলপ্রপাত, রিম্বী নদী, ও রিম্বী কমলা লেবু বাগান দেখতে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে একসময় আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। মাথাপিছু কুড়ি টাকা করে টিকিট কেটে, ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো পথ ধরে ভিতরে ঢুকতে হয়। এই ওয়াটার ফলটি খেচিওপালরি লেক ও ইয়কসাম যাওয়ার পথে অবস্থিত। ওয়াটার ফলটি ছোট এবং বর্ষাকালে এর প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। রিম্বী নদীটি এর নীচে, এবং পাশেই ছোট হলেও, কমলা লেবুর একটি বাগান আছে, আর তার ঠিক পাশেই, ‘অরেঞ্জ ভিলেজ হোম স্টে’ নামে একটি হোম স্টে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে, কুড়ি টাকা দিয়ে চারটে লেবু কিনে আমরা গাড়িতে ফিরে এলাম।

রামা জানালো, এবার আমরা খেচিওপালরি লেক দেখতে যাচ্ছি। এই লেকটিকে সকলেই আনন্দময় স্বর্গের পাহাড়, ও একটি অত্যন্ত পবিত্র লেক হিসাবে বিশ্বাস করে থাকেন। জানা গেল, লেকটির প্রকৃত নাম খাচোটপালরি, অর্থাৎ গুরু পদ্মসম্ভব’র স্বর্গ। তবে এই লেকটি খেচিওপালরি গ্রামের কাছ অবস্থিত হওয়ায়,  খেচিওপালরি লেক নামেই অধিক পরিচিত। এই লেকটিতে প্রবেশ করার জন্য গাড়ি পার্কিংয়ের চার্জ সমেত পাঁচজনের জন্য একশ’ সত্তর টাকার টিকিট কাটতে হলো। লেকের কাছে যাওয়ার আগে বেশ খানিকটা বাঁধানো জায়গায় বসবার বেঞ্চি, একটি বুদ্ধ মূর্তি বা চোরতেন থাকলেও, এখান থেকে খুব ভালভাবে লেকটিকে দেখা যায় না। লেকটির কাছে যেতে গেলে সরু কাঠের তক্তা পাতা একটা রাস্তা দিয়ে সামান্য কিছুটা পথ যেতে হয়। পথটি শুকনো ও শ্যাওলাহীন হলেও ভীষণ পিচ্ছিল, একটু অসাবধান হলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। হিন্দু ও বৌদ্ধ, উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই পবিত্র এই লেকটির একটি বিশেষত্ব আছে বলে প্রচলিত আছে। এই লেকের জল কাচের মতো পরিষ্কার, ও লেকের জলে কোন গাছের পাতা পড়লেই,  পাখি সেটা জল থেকে তুলে লেকের বাইরে ফেলে দেয়। চল্লিশ বছর আগে রূপকুণ্ড যাওয়ার সময় ঠিক এই চরিত্রের একটি লেকের কথা গোয়ালদামে শুনেছিলাম। গোয়ালদাম থেকেই যেতে হয়, তবে ভিন্ন পথ, তাই ইচ্ছা থাকলেও যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এই লেকটির কাছে যাওয়ার পথের ঠিক পাশে জংলি গাছে পরিপূর্ণ হলেও, এবং অপর পাড়ে বিশাল বিশাল গাছে ঘেরা হলেও, লেকের জল সত্যিই খুব পরিষ্কার। এই লেকে বিশাল আকৃতির মাছে পরিপূর্ণ। অনেকেই সঙ্গে করে মাছের খাবার নিয়ে এসেছেন। ফলে খাবারের লোভে ওই মাছেরা কাঠের রাস্তার ঠিক পাশে, লেকের জলে দাপিয়ে বেড়ায়। লেকের জলে আর আছে হাঁস জাতীয় বেশ কিছু পাখি। সম্ভবত এরা এই বিশাল আকৃতির মাছদের বেশ ভয় পায়। লেকের জলে খাবার ছিটিয়ে দিলেই মাছেদের লাফালাফি বৃদ্ধি পায়। দেখে মনে হলো মহাশোল জাতীয় মাছ, যদিও অনেকেই বললো রুই কাতলা। তবে যে মাছই হোক, আরও অনেক জায়গার মতো এগুলো তেলাপিয়া জাতীয় মাছ কখনই নয়। ওই সময় লেকের জলে ভেসে থাকা এই পাখিরা মাছকে দেওয়া খাবারের লোভে কিছুটা খুব দ্রুত সাঁতার কেটে, কিছুটা উড়ে এসে কোনমতে সামান্য খাবার মুখে নিয়েই, একই প্রক্রিয়ায় দূরে চলে যায়। অনেকক্ষণ সেখানে কাটালেও, দৃষ্টিপথের মধ্যে লেকের জলে কোন গাছের পাতা পড়ে থাকতে বা পড়তে দেখিনি, তাই পাখিদের পাতা তুলে লেকের জল পরিষ্কার রাখার ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। হয়তো হাঁস জাতীয় ওই পাখিগুলোই এই কাজটা সমাধা করে থাকে। দেখার সুযোগ হয়নি ভালোই হয়েছে, তা নাহলে নিত্য পুকুরের জলে প্লাস্টিকে মুড়ে ফুল, আবর্জনা, প্লাস্টিক বোতল ফেলতে দেখা অভ্যস্ত আমাদের মতো পাবলিকের হয়তো লজ্জায় ওই লেকের জলেই ডুবে মরবার ইচ্ছা জাগতো। তবে পরিপূর্ণ লেকটাকে ভালভাবে দেখা যায় না, বা ছবি তোলা যায় না, যেটা নাকি আগে সম্ভব হতো। অনেকটা সময় কেটে গেল, ওপরের বাঁধানো জায়গায় ফিরে এসে বেঞ্চিতে বসে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, গাড়ির উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। এবার আমাদের গন্তব্যস্থল, বিখ্যাত কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়াটার ফল।

ধীরে ধীরে একসময় আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাতের কাছে এসে পৌঁছলাম। এই জলপ্রপাত দেখতে গেলে বা কাছে যেতে গেলে, মাথাপিছু কুড়ি টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। দলে আমরা পাঁচজন আছি, তাই একশ’ টাকার একটি নোট দিলাম। প্রভু করুণাময়, তাঁরই ইচ্ছায় সম্ভবত এই দীনকে করুণা করে কুড়ি টাকা ফেরৎ দিয়ে জানালেন, ‘কনসেশন’। যদিও আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এখানকার মলগুলোর মতো বাই ফোর গেট  ওয়ান ফ্রী দীক্ষায় দিক্ষিত। যাইহোক, দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো। ধীরে ধীরে কিছুটা ওপরে উঠে এর রূপ দেখতে পাওয়া গেলেও, সম্পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য আরও কিছুটা খাড়াই পথ ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। কিছুটা ওপরে ওঠার পরে বোঝা গেল, জলধারাটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রথম ভাগটি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই দেখা যায়। এই ধারাটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল, ও এটি প্রায় নদীর আকারে নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে আরও, আরও নীচে। মূল জলধারাটি বড় বড় পাথরের ওপর প্রবলভাবে আছড়ে পড়ছে। এটির সৌন্দর্য কিন্তু সত্যিই অতুলনীয়। একবারে জলের কাছে দেখলাম বেশ কিছু ছেলেমেয়ে হইচই করছে, তবে অনেককেই দেখলাম ফলস্ দেখার চেয়ে সেলফি তোলায় বেশি আগ্রহী। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার পথে একটু নীচে নেমে এসে চা পান করে আরও নীচে এসে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। 

এবার আমাদের আজকের শেষ দ্রষ্টব্য ইয়কসাম যাবার কথা, যা একসময়ের রাজধানী ছিলো এবং অনেকেই আবার রাজবাড়ি নামে পরিচয় দেন। যথা সময়ে ইয়কসামের সেই বিখ্যাত করোনেশন থ্রোন অফ নরবুগাং-এ এসে হাজির হওয়া গেল। এখানেও মাথাপিছু কুড়ি টাকা করে টিকিট কাটতে হলো। তবে টিকিট বিক্রেতা অল্প বয়সি মহিলাটির ফুলের মতো শিশুটির ঢালু রাস্তার ওপর দিয়ে টলমল পায়ে ছোটাছুটি দেখে, একই সাথে মুগ্ধ ও আতঙ্কিত হলাম। কাছেই বিখ্যাত Danny Denzongpa নামক চলচ্চিত্রাভিনেতার জন্মস্থান ও রিসর্ট, কাজেই জায়গার মাহাত্ম্যে এই শিশুটির মধ্যেও যে বেশ ভালো পরিমাণে অভিনয় দক্ষতা স্থান পেয়েছে, তা তার ছবি তোলার সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজে থেকেই বিভিন্ন পোজ দেখে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না।

এই ইয়কসাম, যার অর্থ নাকি তিন সাধুর সাক্ষাৎস্থল। প্রচলিত আছে, লাথসুন চেম্পোর নেতৃত্বে তিব্বত থেকে আগত তিন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এখানে মিলিত হন, এবং এনারা ফুন্টসোং নামগায়ালকে সিকিমের প্রথম রাজা হিসাবে মান্যতা দিতে সহমত পোষণ করেন। ১৬৪২ সালে এই শাসককে চোগিয়াল বা ধর্মীয় রাজার উপাধি দেওয়া হয়েছিল। প্রধান সন্ন্যাসী নাথসুন চেম্পো তাঁর নামগিয়াল পদবিটি ফুন্টসোং রাজার নামের শেষে যুক্ত করে দেন, এবং সেই থেকে প্রথম রাজা ফুন্টসোং, ফুন্টসোং নামগিয়াল নামে পরিচিত হয়ে রাজত্ব শুরু করেন। এরপর পেলিং থেকে তেত্রিশ কিলোমিটার দূরের এই ইয়কসামে নরবুগাংয়ের চোরতেন তৈরির কাজ শুরু হয়, এবং এই কাজের জন্য সমস্ত সিকিমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাটি, পাথর, ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। এখানেই রাজ সিংহাসন স্থাপন করা হয়। এরপর এই চোগিয়াল বংশ নাকি তিনশ’ তেত্রিশ বছর রাজত্ব করে। এখানে Thangtong gyalpo নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, যিনি আটান্নটি লোহার চেন দ্বারা নির্মিত সাসপেনশন ব্রিজ, তিব্বত ও ভুটানে তৈরি করেছিলেন, যার অনেকগুলি নাকি এখনও কার্যকরী অবস্থায় বিরাজ করছে, যাঁকে একাধারে যোগী, চিকিৎসক, কর্মকার, স্থপতি, অগ্রগামী বাস্তু প্রযুক্তিবিদ, ইত্যাদি বিভিন্ন গুণসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা ও সম্মান করা হয়ে থাকে, তাঁর একটি বড় মূর্তি আছে। আর আছে পাথর দিয়ে মন্দিরের মতো আকৃতির একটি বাঁধানো জায়গায় সুবিশাল বহু প্রাচীন একটি অর্ধমৃত গাছ, যেটি নাকি প্রথম থেকে এই জায়গায় অবস্থান করছে। এছাড়া বিভিন্ন রঙের রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো বেশ কয়েকটি মন্দির বা পূজার্চনার জায়গা ও ফুল গাছ, জায়গাটির সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য অবশ্যই অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। এই ইয়কসাম থেকেই বিভিন্ন ট্রেকিং পথের শুরু হওয়ায়, এখানে ট্রেকিং প্রিয় পর্যটকের যথেষ্ট আগমন লক্ষ্য করা যায়। যাইহোক, এবার ফেরার পালা। যাওয়ার পথে দূর থেকে হলেও হেলিপ্যাড ও অভিনেতা ড্যানির রিসর্টটি দেখে নেওয়া গেল। ধীরে ধীরে নীচে নেমে গাড়িতে গিয়ে বসলাম, গাড়ি ছেড়ে দিলো।

আজ ডিসেম্বর মাসের চোদ্দ তারিখ, আজ ভ্রাতৃপ্রতিম ভ্রমণসঙ্গী বন্ধু, তরুণ ও তার স্ত্রী সীমার বিবাহ বার্ষিকী। এর মাত্র কয়েকদিন আগেই অবশ্য আমার নিজের এই ব্যাপারটা চুকে গেছে। ওদের সাথে আমরা প্রথম যেবার বাইরে বেড়াতে যাই, অর্থাৎ ২০১১ সালের ডিসেম্বরের গুজরাট ট্যুরের মাঝে আমাদের দুজনেরই এই দিনটি পড়ায় একপক্ষ অপরপক্ষকে হোটেলে খাইয়ে দিনটি উদযাপন করেছিলাম। এবার আমি বেঁচে গেলেও ও বেচারা ফাঁদে পড়েছে। সকাল থেকেই ওর পিছনে লেগেছিলাম। একসময় শোনা গেল, হিমাদ্রিদা কেক কাটার ব্যবস্থা করবেন। তারপর থেকে এই বিষয় নিয়ে নতুন করে আর আলোচনা হয়নি। আজ সারাদিন বিশেষ কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। বিকালের পরে হোটেলে ফিরে সবার খিদে পেয়ে গেছে জেনে চাউয়ের অর্ডার দেওয়া হলো, সাথে রাতের খাবারেরও অর্ডার দিয়ে দেওয়া হলো। চাউ খেয়ে পেট যখন ভর্তি, তখন জানা গেল, যে ঘুরতে যাওয়ার আগে হিমাদ্রিদা হোটেলের সেই ছ’ফুট লম্বা ছেলেটাকে দিয়ে বহুদূরের কোন এক দোকান থেকে একটা ভালো কেক কিনে আনার ব্যবস্থা করে গেছিলেন, এবং এখন সেই কেক হোটেলে এসে উপস্থিত। এইমাত্র চাউ ভক্ষণের পরে এখন আর কেক খাওয়ার ক্ষমতা নেই। আবার কিছুক্ষণ পরে কেক কাটা ও খাওয়া হলে, রাতের খাবার নষ্ট হবে, কারণ একে পাহাড়ি জায়গা তার ওপর ভীষণ ঠান্ডা পড়ায় রাত সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যেই নীচে ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার জন্য ডাক পড়ে। যাইহোক, শেষপর্যন্ত ডাইনিং হলে কেক কাটার ব্যবস্থা হলো। শুধু কেকই কাটা হলো না, পুরোদস্তুর মোমবাতি জ্বালানো, ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভানো, একে অপরকে কেকের টুকরো খাওয়ানো, ইত্যাদি পর্বও রীতি মেনে সাঙ্গ হলো। কেকের প্রায় চল্লিশ শতাংশ, ছ’ফুট লম্বা ভুটিয়া নামক ছেলেটিকে ডেকে তার হাতে দিয়ে, তাদের ভাগ করে খেয়ে নিতে বলা হলো। আমাদের ব্যবহারে তারাও খুশি আমরাও খুশি।

আজ একটু পরেই আবার রাতের খাবার খেতে নীচে যাওয়া হলো বটে, তবে কেউই সেরকম খেতে পারলো না। ঘরে ফিরে এসে গতকাল রাতের মতোই মোবাইল ও ক্যামেরা, চার্জে বসিয়ে দেওয়া হলো। আজ কিন্তু মোবাইলে ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দেওয়া হলো। সারাদিন বাইরে বাইরে কেটেছে, হাঁটাও হয়েছে যথেষ্ট, সর্বোপরি ঠান্ডাও পড়েছে বেশ তীব্র। অতএব আর সময় নষ্ট না করে, যে যার লেপ কম্বলের নীচে আশ্রয় নেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করলো।  

আজ পনেরোই ডিসেম্বর। আজও ঘুম ভাঙলো অ্যালার্ম বাজার কিছু আগে। জানালার পর্দা সরিয়ে অন্ধকারেই হালকা অস্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিললো, তবে বেশ বোঝা গেল আকাশ আজ একবারে পরিষ্কার। লেপ চাপা দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই শকুনের দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর নজর রাখলাম। ধীরে ধীরে হালকা আলো ফুটলো, তবে এখনও সূর্যোদয় হয়নি। কাঞ্চনজঙ্ঘা এখন যথেষ্ট স্পষ্ট, ওই ঠান্ডায় কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর বরফরঙা ঘুমন্ত বুদ্ধকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। এরপর আর শুয়ে থাকা যায় না, ভালো করে চাদর মুড়ি দিয়ে, ক্যামেরা ও মোবাইল হাতে ব্যালকনির চেয়ারে গিয়ে পা তুলে বাবু হয়ে বসলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যোদয় দেখা যায় না, তবে সূর্যদেবের ঘুম ভাঙছে বোঝা গেল, কারণ বুদ্ধদেবের শরীরের বিভিন্ন অংশ ধীরে ধীরে রক্তিম আকার ধারন করলো। একসময় ঘুমন্ত বুদ্ধের সম্পূর্ণ শরীর রক্তিম আকার ধারণ করে আমার চোখে ধরা পড়লো। গতকালের মতোই ঘরের জানালা, দোতলা ও তিনতলার ব্যালকনি, এমনকী ছাদে উঠেও বিভিন্নভাবে ছবি নিলাম। সফল ব্যক্তির ক্ষেত্রে বহুপ্রচলিত একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, এরপর আর তাঁকে পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। আমাদের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা ঘটবে আশা করিনি। পূর্ণাঙ্গ স্লিপিং বুদ্ধের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হলেও, সিকিম ছেড়ে চলে আসা পর্যন্ত প্রতিদিন দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি।  

সীমার হাতের চা পান করে একে একে তৈরি হয়ে একসময় আমরা নীচের ডাইনিং হলে প্রাতরাশ সারতে গেলাম। আজ এক উপাদেও আলুর পরোটা ও গরম গরম চা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে একসময় আমরা ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকে জানালায় চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। ১৯৮৫ সালে সান্দাকফু ও ফালুটের পরে কাঞ্চনজঙ্ঘার এই রূপ আগে আর কোথাও দেখার সুযোগ হয়নি। রামা তার গাড়ি নিয়ে হোটেলের সামনে হাজির হয়ে গেছে, অযথা সময় নষ্ট না করে, বাধ্য হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি এগিয়ে চললো।   

আজ আমরা প্রথমে বিখ্যাত স্কাই ওয়াকের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। শুনলাম স্কাই ওয়াক নাকি সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। যাওয়ার আগে অনেকের কাছ থেকেই শুনেছিলাম, যে সপ্তদশ শতাব্দিতে সেই লাথসুন চেম্পোর তৈরি পেলিংয়ের অন্যতম প্রাচীন মন্যাস্টারি, সাঙ্গাচোয়েলিং মন্যাস্টারিটির অত্যন্ত ভগ্নদশা হওয়ায় ওই মন্যাস্টারিটিই নতুন করে প্রস্তুত করা হয়, এবং এখানেই ভারতবর্ষের কাচ নির্মিত প্রথম স্কাই ওয়াকটি তৈরি হওয়ায়, এটি স্কাই ওয়াক নামেই অধিক পরিচিত, এবং পেলিংয়ের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। আগে এই সাঙ্গাচোয়েলিং মন্যাস্টারিটি দেখতে গেলে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার খাড়াই পথ হেঁটে আসতে হতো। যাইহোক, কিছু স্থানীয় লোকের কাছ থেকেও এই তথ্য জানতে পারলেও, কোথাও কোন লিখিতভাবে এই তথ্য দেখার বা পড়ার সুযোগ হয়নি। স্কাই ওয়াকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও কোথাও এই তথ্য সম্বলিত কোন বোর্ড আমার চোখে পড়েনি। আমার নজরে পড়েনি এমন ঘটনা অবশ্য হতেই পারে ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে শুনলাম ওটা সাঙ্গাচোয়েলিং মন্যাস্টারি নয়, সেটি পূর্বের জায়গাতেই এখনও স্বমহিমায় বিরাজ করছে।

সে যাইহোক, সাত হাজার দুশো ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, ভারতবর্ষে কাচের তৈরি প্রথম এই স্কাই ওয়াকটির দূরত্ব, পেলিং শহর থেকে খুব একটা বেশি নয়, হয়তো আড়াই বা তিন কিলোমিটার হবে। জানি না প্রযুক্তিগত কোন অসুবিধা আছে কী না, তবে পেলিং শহরের প্রধান আকর্ষনীয় এই দ্রষ্টব্য স্থলটিতে যাওয়ার  রাস্তাটি তুলনামূলক ভাবে বেশ খাড়াই ও অপ্রশস্ত। পুরাতন বা দুর্বল ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ি নিয়ে এপথে পাড়ি দিলে, অসুবিধা দেখা দিলেও দিতে পারে। মূল দ্রষ্টব্য স্থলটির বেশ কিছুটা নীচে গাড়ি পার্ক করার জায়গা। মাথাপিছু একশ’ টাকা করে টিকিট কেটে ওপরে যেতে হয়। ১৩৭ ফুট উচ্চ বুদ্ধ মূর্তি সহ স্কাই ওয়াক এলাকাটি বেশ কিছুটা উচ্চতায় অবস্থিত হলেও, ওপরে ওঠার জন্য খুব একটা পরিশ্রম বা কষ্ট হয় না। ওপরে ওঠার পরে একদিকে স্কাই ওয়াকের ওপর যাওয়ার সিঁড়ি, ও অপর দিকে কিছুটা দূরে বেশ খানিকটা উচ্চতায় চেনরেজিগ স্ট্যাচু, অর্থাৎ বিশাল আকারের বুদ্ধ মূর্তিটি অবস্থিত। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই দর্শনীয় স্থানটি বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে দেখে ও ছবি তুলে আমরা স্কাই ওয়াকে ওঠার জন্য অগ্রসর হলাম। বেশ কিছুটা ওপরে ফাঁক ফাঁক স্টিলের পাতের ওপর ছয় বা সাত ফুট মতো চওড়া স্বচ্ছ কাচের হাঁটা পথটিতে ওঠার আগে জুতো খুলে যেতে হয়। অনেকটা উচ্চতায় অবস্থিত কাচের তৈরি এই হাঁটাপথটি বেশ খানিকটা অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। এই রাস্তাটার উভয় দিকেই প্রায় কোমর সমান উচ্চতা পর্যন্ত কাচেরই তৈরি রেলিং দেওয়া থাকায়, শিশুদের পক্ষে তো বটেই, বয়স্কদের পক্ষেও যথেষ্ট নিরাপদ। এখান থেকে বরফাচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা, সুবিশাল চেনরেজিগ স্ট্যাচু ছাড়াও, বহুদূরের গাছপালা আচ্ছাদিত বড় মনোরম দৃশ্য দেখার সুযোগ মেলে।  

এখানে আসার সময় মাথাপিছু একশ’ টাকা করে টিকিট কাটার সময় মনে হয়েছিল, চার্জটা একটু বেশিই, কিন্তু বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে দেখে ও এই স্কাই ওয়াকের ওপর পদার্পণ করে, ধারণাটা বদলাতে বাধ্য হলাম। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সর্বত্র যেভাবে ধুলো নোংরা আবর্জনাহীন ঝাঁচকচকে করে রাখা হয়েছে, খালিপায়ে বা মোজা পরে এত লোকের হাঁটা চলার পরেও স্কাই ওয়াকের কাচের তৈরি হাঁটাপথ ও রেলিং এতটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যে পথের ওপর বসতে বা শুয়ে থাকতেও দুবার চিন্তা করতে হয় না। বাস্তবে অনেকেই এই কাচের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ও হাঁটাপথের ওপর শুয়ে বসে ছবি তুলছে, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। কাজেই এই বিস্তীর্ণ এলাকা এরকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাও বিপুল খরচাসাপেক্ষ। এটা ঘটনা, যে এখানকার টিকিটের মূল্য বাবদ অর্জিত অর্থ আত্মসাৎ, অপচয়, বা নিজভোগে ব্যয় করা হয় না। তবে যেটা খারাপ লাগলো, স্কাই ওয়াকের জৌলুস ও আকর্ষণে, স্বয়ং বুদ্ধদেবের অস্তিত্ব যেন বেশ কিছুটা ম্রিয়মাণ ও অবহেলিত বলে মনে হলো।

স্কাই ওয়াকের ওপর দীর্ঘক্ষণ ঘুরেফিরে, ছবি তুলে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটিয়ে, যে পথে ওপরে গেছিলাম সেই পথেই আবার মূল চত্বরে ফিরে এলাম। এবার কাছ থেকে বুদ্ধমূর্তিটি দেখতে যাবো। ওখানে কিন্তু জুতো পরে যাওয়ায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। জুতো পরে মূর্তিটির দিকে এগিয়ে গেলাম। বাঁধানো অঞ্চলের ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে অনেকটা চওড়া ছাইরঙা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। একবারে ওপরে ওঠার সময় ও ফেরার পথে গুনে দেখলাম, ১৬৯টা সিঁড়ি ভাঙতে হলো। যদিও সংখ্যাটা সীমা বা তরুণের সাথে মিললো না, ওদের কথামতো সংখ্যাটা নাকি ১৭০ বা ১৭১ হবে। তবে সিঁড়ির প্রতিটি ধাপের উচ্চতা খুব একটা বেশি না হওয়ায়, ওঠার কষ্ট সিঁড়ির সংখ্যা অনুযায়ী অনেকটাই কম। এই সিড়ির দুপাশে সাদা পাঁচিলের মতো দেওয়া, তার ওপরে একবারে শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত পরপর সোনালি রঙের বড় বড় প্রেয়ার হুইল, এবং তারও ওপরে আগাগোড়া টালি রঙের ছাদের মতো করা আছে। কাছে গেলে বুদ্ধমূর্তিটির বিশালত্ব অনুধাবন করা যায়। গেট দিয়ে ঢুকে একটি সুন্দর ঘরের মতো, তার ছাদের ওপরে চকোলেট রঙের একটি গোলাকার বিশাল ফুলের মতো। এই গোলাকার বিশাল ফুলের মতো অংশটির ওপরে একই রকম চকোলেট রঙের বুদ্ধমূর্তিটি, যদিও মূর্তিটির মাথা ও মাথার মুকুটটি সোনালি রঙের, বাবু হয়ে বসে আছেন। মূর্তিটির কিন্ত চারটি হাত, তার মধ্যে বামদিকের একটি হাতে একটি লাল রঙের ফুল সমেত ফুলগাছ বা ওই জাতীয় কিছু। ডানদিকের একটি হাতে একটি জপের মালা। বাম ও ডানদিকের অপর দুটি হাতে নমস্কার করার ভঙ্গিতে, সম্ভবত সাদা রঙের একটি শঙ্খ ধরা। যার ওপর এই বিশাল মূর্তিটা ফুলের ওপর বসে আছেন, সেই ছাদের মতো অংশটির সামনের দুদিকে দুটি নীল রঙের মূর্তি, অনেকটা অ্যাটলাসের ভঙ্গিমায় দুহাতে মাথার ওপর ধরে আছে।

যাইহোক, এখানে দীর্ঘক্ষণ সময় ব্যয় হয়ে গেল। আগামীকাল আমাদের পেলিং ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা, এবং আজ আমাদের আরও অনেকগুলো দ্রষ্টব্যস্থল ঘুরে দেখতে হবে, তাই আর সময় নষ্ট না করে নীচে নেমে এসে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিলো, রামা জানালো, যে সে এবার আমাদের ডেনটাম ভ্যালি নিয়ে যাচ্ছে। পাশেই একটা হেলিপ্যাড আছে, রামা গাড়ি দাঁড় করালো। দেখার মতো খুব একটা ব্যাপার না হলেও দেখলাম, ছবি তুললাম, তারপর আবার ডেনটামের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম।   

একসময় আমরা ডেনটাম ভ্যালি এসে পৌঁছলাম। না, ঠিক বলা হলো না। আমরা রাস্তার একপাশে একটা ছোট চা কফি ও স্ন্যাক্সের দোকানের পাশে এসে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ডেনটাম ভ্যালি অঞ্চলটি অনেক নীচে ও দূরে, তবে এই জায়গাটাকে ডেনটাম ভ্যালির ভিউ পয়েন্ট বলা যেতেই পারে, কারণ খাদের দিকে রেলিং দেওয়া বাঁধানো এই স্থানটিতে ডেনটাম ভ্যালি ভিউ পয়েন্ট লেখা একটা বড় বোর্ড লাগানো আছে শুধু নয়, দেখলাম আমাদের মতো আরও কিছু পর্যটক এখানে আগেই এসে উপস্থিত হয়ে বহু নীচে ভ্যালিতে অবস্থিত গাছপালা ঘেরা সামান্য কিছু ঘর বাড়ি নিয়ে তৈরি সুন্দর ছোট্ট গ্রামটির সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। বাড়িগুলোর পিছনে বড় বড় গাছের গভীর জঙ্গল ও সামনের অংশ বিভিন্ন রকম সবুজ রঙের ছোট ছোট চাষের জমি। একটি ছেলে, সম্ভবত পাশের দোকানটির মালিক, এগিয়ে এসে আমাদের জায়গাটাকে দেখবার ও জানবার সাহায্য করলো। সে জানালো, ওই অঞ্চলে প্রচুর পাখির দেখা পাওয়া যায় এবং গোটা অঞ্চলটি রডডেনড্রন ফুলের গাছ দিয়ে ঘেরা। আকাশ একবারে পরিষ্কার, ফলে এখান থেকে বরফাচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আবার একবার দর্শন লাভের সুযোগ হলো। নীচে বহুদূরে রাস্তা তৈরির কাজ হচ্ছে বলে মনে হলো। ছেলেটি জানালো, ওখানে নাকি ন্যাশনাল হাইওয়ে তৈরির কাজ চলছে, যদিও তথ্যটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না। তবে ছেলেটি আর একটি কথা জানালো, যে ওই অঞ্চলটির গঠন অনেকটা ভারতর্ষের মানচিত্রের মতো। সে আঙুল দিয়ে মানচিত্রের গঠনটি বোঝাবার চেষ্টাও করলো। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট একটি জায়গা অন্য কোন কিছুর সাথে মোটামুটি একটা মিল থাকতেই পারে। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে দেখে দেখলাম,  জায়গাটায় ভারতবর্ষের মানচিত্রের আদল সত্যিই খুঁজে পাওয়া যায়। জায়গাটা বেশ ভালো লাগায় আমরা আরও কিছু সময় এখানে থেকে, সিংশোর সাসপেনশন ব্রিজের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। ফেরার পথে রাস্তার পাশে বিশাল একটা পাথর দেখিয়ে রামা জানালো, যে একদিন ওই পাথরটা পাহাড়ের অনেক ওপর থেকে গড়িয়ে এসে রাস্তায় পড়ে। রাস্তা থেকে পাথরটাকে সরাবার জন্য নানাভাবে ভাঙার চেষ্টা করা সত্ত্বেও, বাস্তবে সেটা সম্ভব না হওয়ায় রাস্তার ওপরেই পড়ে আছে।  

রামা নামক ছেলেটির একটি বিশেষ গুণ, পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাবার সময় সে কখনও ট্রাফিক আইন ভাঙে না, অহেতুক জোরে বা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় না, এবং অকারণে যাত্রীদের তাড়া দেয় না। শেষপর্যন্ত একসময় আমরা একশ’ মিটার উচ্চ দুশো চল্লিশ মিটার লম্বা সেই সিংশোর সাসপেনশন ব্রিজের সামনে এসে পৌঁছলাম, যা নাকি সিকিম রাজ্যের উচ্চতম ব্রিজ। গাড়ি এই পারেই দাঁড়িয়ে রইলো। ব্রিজে ওঠার আগে আমাদের পাঁচজনের জন্য ত্রিশ টাকা নেওয়া হলেও কোন টিকিট দেওয়া হলো না, কাজেই এটা ব্রিজে ওঠার টিকিট, না গাড়ির পার্কিং চার্জ, ঠিক বোধগম্য হলো না। মোটা মোটা তারে বাঁধা দীর্ঘ এই ব্রিজটির দুপাশে স্টিলের ফ্রেমে মজবুত জালের তৈরি রেলিং দেওয়া। হাঁটা বা গাড়ি চলাচলের রাস্তাটি লোহা বা স্টিলের পাত ফেলে তৈরি। এই পথে গাড়ি চলাচল করতে দেওয়া হয় বটে, তবে সেটা ঘন্টায় সর্বোচ্চ মাত্র দশ কিলোমিটার গতিতে শুধুমাত্র লাইট ভেহিকলের জন্যই অনুমোদিত। তারের তৈরি এই জাতীয় ঝুলন্ত ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কি কি করা উচিত আমার সঠিক জানা নেই, তবে এই ব্রিজটির তারের বাঁধনের জায়গায় ও নাট বল্টুতে পুরু করে গ্রিস লাগানো আছে দেখে মনে হলো, দুহাজার সালে তৈরি এই ব্রিজটির স্বাস্থ্য রক্ষার্থে হয়তো যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হয়।   

ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে, ছবি তুলতে তুলতে, আমরা দুই পাহাড়ের সংযোগকারী এই ঝুলন্ত ব্রিজটির অপর পারে চলে গেলাম। ব্রিজ পার হয়ে এসে, এপারে রাস্তা বেঁকে গেছে। বেশ বোঝা গেল, যে এই ব্রিজটি তৈরি হওয়ার ফলে যাত্রীদের যাতায়াতের সময় ও কষ্ট, উভয়ই অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এই পারটায় কিন্তু অনেক বেশি সবুজের আধিক্য চোখে পড়লো। গাড়ি চলার সময় দেখলাম, ব্রিজটা বেশ দোলে। মনে পড়ে গেল ভুটানের পুনাখার কথা। সেখানকার এই জাতীয় ঝুলন্ত ব্রিজটি অবশ্য অনেক বেশি সুন্দর বলে মনে হয়েছিলো। সেই ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় ব্রিজটা বেশ জোরে দোলে। জানি না ঝড় বা বৃষ্টির সময় সেটার অবস্থা কি দাঁড়ায়, কারণ উভয় ব্রিজের ক্ষেত্রেই সেই আবহাওয়া প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার ভাগ্যে জোটেনি। শেষপর্যন্ত বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে আবার এপারে এসে গাড়িতে বসলাম। এবার আমাদের গন্তব্য পঁচিশ কিলোমিটার দূরের পেমায়াঙসে মন্যাস্টারি।   

গাড়ি ছেড়ে দিলো বটে, তবে পেমায়াঙসে মন্যাস্টারি যাওয়ার পথে রামা তার গাড়ি নিয়ে গিয়ে একটা ওয়াটার ফলের সামনে দাঁড় করালো। সিকিমে ওয়াটার ফলসের সংখ্যা প্রচুর। গতবার পূর্ব ও উত্তর সিকিম ঘোরার সময় ও এবার এখন পর্যন্ত ছোট বড় অনেক ওয়াটার ফলস্ দেখেছি। যাইহোক, এই ওয়াটার ফলসটার আকার ও সৌন্দর্য, কোনটাই বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়। ফলসের কাছে কোন বোর্ড বা আর কোন পর্যটকও নজরে পড়লো না, ফলে ফলসের নাম জানার জন্য রামার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় রইলো না। রামার উচ্চারণ বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হয়, তবে তার কথা অনুযায়ী ওই ফলসটির নাম, ছাঙ্গে জলপ্রপাত। এখানে বিশেষ সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না, তাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আমরা আবার এগিয়ে চললাম।  

যথাসময় আমরা পেমায়াংসে মন্যাস্টারির কাছে এসে হাজির হলাম। সিকিমের প্রাচীন মন্যাস্টারিগুলোর মধ্য এটিও একটি উল্লেখযোগ্য মন্যাস্টারি এবং ১৬৪৭ সালে, নিজের পরিকল্পনা ও নকশামাফিক এটিও প্রতিষ্ঠা করেন সেই লামা লাথসুন চেম্পো। রাস্তার পাশে রীতিমাফিক রঙিন উজ্জ্বল প্রেয়ার ফ্ল্যাগের সারি। শুধুমাত্র এই প্রেয়ার ফ্ল্যাগগুলোই এই জাতীয় মন্যাস্টারিগুলোর সৌন্দর্য বহগুণ বৃদ্ধি করে বলে আমার মনে হয়। মাথাপিছু ত্রিশ টাকা করে টিকিট কেটে এই মন্যাস্টারির ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। একবারে নিস্তব্ধ, বহু প্রাচীন এই মন্যাস্টারির ভিতর প্রবেশ করে বোঝা গেল, এটি তিনটি তলায় বিভক্ত। মূল উপাসনা কক্ষটি একতলায়। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে দোতলা ও তিনতলায় উঠে গেলাম। ওপরের তলাগুলোয় সংগ্রহশালা আছে। কাচ দিয়ে ঘেরা দেওয়াল আলমারির মতো জায়গায়, সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতাব্দির বহু ভাস্কর্য, ছবি, মূর্তি, বাসনপত্র, শঙ্খ, ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। আর আছে হাজার হাজার বহু প্রাচীন পুঁথি। স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ পুঁথির অবস্থা খুব ভালো না হলেও, কি যত্ন সহকারে সেগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যতদূর জানা গেল, তিব্বতি বৌদ্ধ দ্বারা পরিচালিত এই প্রাচীন মন্যাস্টারিটিতে সিকিমের ভুটিয়া সম্প্রদায় থেকে সন্ন্যাসী নিয়োজিত হয়ে থাকেন। এখানে গুরু পদ্মসম্ভব ও গুরু রিনপোচের মূর্তিও আছে দেখা গেল।  

দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে প্রতিটি তলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম। মন্যাস্টারির ঠিক সামনে বেশ কিছুটা অংশ সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা মাঠের মতো। মাঠের প্রান্তে মন্যাস্টারির ঠিক সামনে একটা বাঁধানো স্ল্যাবের ওপর নীল রঙের একটা তুলসী মঞ্চের মতো করা আছে, যার ওপর বসানো একটা অনেক উঁচু লম্বা পিলারের একবারে ওপর থেকে মঞ্চের কিছুটা ওপর পর্যন্ত একটা রঙিন পতাকা মতো লাগানো আছে। মাঠের একপাশে আদ্যপ্রান্ত লাল রঙের আলখাল্লার মতো পোশাক পরিহিত কিছু লামা বসে আছেন। এদের মধ্যে কিছু শিশু ও কিশোরও আছে যারা মনে হয় ছাত্র, কারণ মাঠের ডানদিকে স্কুলবাড়ির মতো বেশ লম্বা একটি একতলা বাড়ি আছে। এই বাড়িটির ভিতর থেকে একসময় এরকমই লাল আলখাল্লা পরিহিত অনেক শিশু ও কিশোরকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। বেলা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। এখান থেকে রাবডেনসে যাবো, ইচ্ছা ছিলো সিকিমের দ্বিতীয় রাজধানীর ধ্বংসাবশেষটা একবার ঘুরে দেখে আসার, তবে তার জন্য দেড় কিলোমিটার বা তার কিছু বেশি পাহাড়ি পথ হেঁটে যেতে হবে এবং বেশ কিছুটা অতিরিক্ত সময়ও ব্যয় করতে হবে। ফলে এখানে আর অহেতুক সময় অপচয় করা উচিত হবে না, তাই আর সময় নষ্ট না করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিলো।  

একসময় আমাদের গাড়ি রাবডেনসে এসে হাজির হলো, দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। বাম হাতে বার্নিশ করা কাঠের খাটের মাথা বা পায়ের দিকের অংশের মতো দেখতে একটা কাঠামোতে দেখলাম, SIDKEONG TULKU BIRD PARK, RABDENTSE GEYZING, WEST SIKKIM লেখা আছে। এরই পাশ দিয়ে হাঁটাপথে পুরাতন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষের কাছে যেতে হয়। আর কেউ এই হাঁটাপথে যেতে রাজি না হওয়ায়, আমি ও তরুণ এগিয়ে গেলাম, বাকিরা গাড়িতে বসে আমাদের ফেরার অপেক্ষায় রইলো। আমি আর তরুণ ধীর পায়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পরে, পক্ষীরালয়ের বোর্ড ও একটা ছাউনির নীচে প্রমাণ সাইজের দুটো সিংহের মূর্তি দেখলাম। পক্ষীরালয়টি সম্ভবত বন্ধ আছে বা কোন মেরামতির কাজ চলছে বলে মনে হলো। তবে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচুর পাখির আনাগোনা আছে বলেই মনে হয়। রাস্তা খুব বেশি নয়, খুব একটা চড়াই উতরাইয়ের ঝামেলাও নেই, তবে প্রায় দু’-দুটো বছর করোনার থাবার ভয়ে ও লকডাউনের চক্করে হাঁটাহাঁটি একপ্রকার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ইদানিং মনে হয় বয়সটা যেন হঠাৎ বেশ কয়েক বছর বেড়ে গেছে। চড়াই ভাঙতে এখন বেশ কষ্ট হয়।

নির্জন রাস্তাটা খুব একটা কষ্টকর বলবো না, তবে আগেই উল্লেখ করেছি, যে ইদানিং পার্বত্য খাড়াই রাস্তায় হাঁটার সময় আমার বেশ অসুবিধা ও কষ্ট হয়। এর আগে কোনদিন কোন হাঁটা পথে যা চোখে পড়েনি, এই সামান্য দেড় কিলোমিটার রাস্তায় তা চোখে পড়লো। কিছুদূর অন্তর অন্তর, আর মাত্র সাড়ে চারশ’ মিটার দূরত্ব, আর মাত্র আড়াইশ’ মিটার দূরত্ব, বা আর মাত্র দুশো মিটার পথ বাকি লেখা নীলচে রঙের উৎসাহবর্ধক বোর্ড চোখে পড়লো। আমার কিন্তু নিজের শারীরিক কষ্টের চেয়ে, সিকিমের প্রাক্তন চোগিয়াল বংশের রাজারাজরাদের কথা ভেবে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। সেই কোন অতীত ১৬৭০ সালে প্রথম চোগিয়াল, ফুন্টসগ নামগিয়ালের পুত্র তেনসুং নামগিয়াল ১৬৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইয়কসাম থেকে স্থানপরিবর্তন করে এখানে দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার নতুন রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ ও চোরতেন থেকে কিভাবে তাঁরা অন্যত্র যাতায়াত করতেন তাঁরাই জানেন, তবে ১৬৭০ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত এত কষ্ট করে রাজত্ব চালানোর পরেও গুর্খা আক্রমনে এই রাজপ্রাসাদ শেষপর্যন্ত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। এখন সেখানে শুধুমাত্র রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ও চোরতেন ছাড়া আর কিছুই নেই।  

যাইহোক, আমরা দুজনে কিছুক্ষণ ওই এলাকায় ঘুরেফিরে, ছবি তুলে, ফেরার পথ ধরলাম। কোন বয়স্ক মানুষের দেখা পেলাম না, তবে বেশ কিছু যুবক যুবতীকে দেখলাম, অবশ্য তাদের ঘুরে দেখার থেকে বিভিন্ন পোজে ফটো ও সেলফি তোলার আগ্রহ অনেক বেশি। উৎসাহ উত্তেজনার আতিশয্যে, তাদের রাজবাড়ির ভাঙা অংশের ওপরে উঠেও নিজেদের ছবি তুলতে দেখলাম। একজনকে বার বার চিৎকার করে তাদের পাঁচিল বা ধ্বংসস্তুপের ওপর থেকে নেমে আসতে নির্দেশ দিতেও শুনলাম। এই জাতীয় পর্যটকের আমাদের দেশে কিছুমাত্র অভাব নেই, সংখ্যায় এরাই হয়তো বা অধিক হবে। বেশ কিছুদিন আগে ভুটানের দোচুলা পাসের একটি পবিত্র স্থানে জুতো পরে উঠে দাপাদাপি ও ছবি তোলার ঘটনা হয়তো অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন। বাস্তবে এই সেলফি তোলার রোগটি এখন করোনার চেয়ে অনেক বেশি ছোঁয়াচে ও ভয়ঙ্কর বলে আমার মনে হয়। যাইহোক, ধীরে ধীরে আমরা নীচে নেমে এসে গাড়িতে বসলাম। হোটেলের উদ্দেশ্যে গাড়ি এগিয়ে চললো।

আগের দুটো দিনের মতোই হোটেলে এসে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে চা জলখাবার খেয়ে, একটু রাতে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরে এসে মোবাইল ও ক্যামেরা চার্জে বসিয়ে, বেশ কিছুক্ষণ আমার ঘরে সবাই মিলে বসে গুলতানি করে সময় কাটলো। কাল সকালে আমাদের পেলিং ছেড়ে রাভাংলা চলে গিয়ে সেখানে দুটো দিন থাকার কথা। সকালে সময় হবে না, তাই প্রায় তিনদিনের ছড়ানো ছেটানো জিনিসপত্র আজ রাতেই সুটকেসবন্দী করতে হবে। একে একে যে যার ঘরে চলে গেলে মোটামুটি কাজটা সম্পন্ন করে লেপের তলায় আশ্রয় নিলাম।

আজ ডিসেম্বর মাসের ষোলো তারিখ। আজও অন্ধকার থাকতে ঘুম ভেঙে গেল। আগের দুদিনের মতোই ঠিক সময় জানালা ও ব্যালকনি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রচুর ছবি তুললাম। নির্মল আকাশ, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আজও পরিষ্কার দেখার সুযোগ মিললো। প্রাতরাশ খেয়ে উঠে হোটেলের ঘর ভাড়া, খাওয়ার খরচ, এবং আগামীকাল পর্যন্ত রামার গাড়ি ভাড়া বাবদ সমস্ত টাকা জুড়ে নন্দনের দেওয়া বিল মিটিয়ে, যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম। ইচ্ছা ছিলো, আজ ও কালকের দিনটা রাভাংলায় থেকে যা যা দেখার দেখে নিয়ে, পরশু, অর্থাৎ আঠারো তারিখে রামার গাড়িতেই রিংচেনপঙ চলে গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেবো। কিন্তু আঠারো তারিখে  শিলিগুরি থেকে নতুন কিছু পর্যটককে নিয়ে আসার বুকিং থাকায়, রামা তার গাড়ি নিয়ে আমাদের ওইদিন রিংচেনপঙ পৌঁছে দিতে পারবে না জানতে পারায়, ঠিক হয়েছে সতেরো তারিখ রাভাংলার আশেপাশের ও নামচির দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরিয়ে, সে আমাদের রাভাংলার হোটেলে ছেড়ে দিয়ে শিলিগুড়ি চলে যাবে। এখন পর্যন্ত সিকিম যাওয়ার আগে পাঠানো সেই এক হাজার টাকা ছাড়া, ব্লু বেন হোটেলকে আর একটা পয়সাও দেওয়া হয়নি, তাই আজ একটু বেশি অঙ্কের বিলটা মেটাতে, বেশ গায়ে লাগলো। নন্দন ও সেই ছ’ফুট লম্বা ছেলেটি আমাদের বিদায় জানালো। বিদায় পেলিং, এক অসামান্য অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতা নিয়ে তোমায় ছেড়ে চললাম, জানি না এই জীবনে আর কখনও তোমার কাছে আসার সুযোগ হবে কী না।

গাড়ি এগিয়ে চললো, এবং একসময় চা খাওয়ার জন্য রামা একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো। প্রথমে লক্ষ্য করিনি, কিন্তু রাস্তার উলটো দিকে গাছপালা আগাছার জঙ্গলে ঢাকা একটা পাথরের কিছুটা অংশ পরিষ্কার করে সাদা রঙ করে, বড় বড় হরফে WELCOME TO TREE HOUSE লেখাটা দেখে, ভালো করে দোকানটার দিকে নজর দিলাম। রাস্তার ওপর SUMI TREE HOUSE CAFÉ লেখা ছোট্ট দোকানটা কয়েকটা গাছের ঠিক ডানপাশে অবস্থিত হওয়ায়, গাছগুলোর ওপরে কি সুন্দরভাবে একটা বেশ লম্বা চওড়া কাঠের দোকান ঘর তৈরি করা হয়েছে। চায়ের নেশায় নয়, চরম বিষ্ময়ে রাস্তা ছেড়ে ছোট্ট দোকানটার ভিতরে ঢুকে বাঁশ ও কাঠের তৈরি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলাম। ওপরের লম্বা চওড়া কাঠের তৈরি অংশটা পরপর দুটো ঘরের মতো অংশে বিভক্ত। দোকানটা গাছের ওপর অবস্থিত এটা খুব বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, গাছের ওপরে তৈরি ওই দুই অংশ কিভাবে বেতের সোফা, টেবিল চেয়ার, শো পিস্, গাছের টব, ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে পাকাপোক্তভাবে তৈরি করা হয়েছে। তবে এর সৌন্দর্য ও আকর্ষণ কিন্তু শতগুণে বাড়িয়েছে, সেই তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। জানালা দিয়ে বাধাহীন দৃষ্টিপথে কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায়। আমরা বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা দোকান, তাও আবার একটা চায়ের দোকান দেখার জন্য ব্যায়  করলাম। স্বীকার করছি, যে এটা তৈরি করতে দোকানের মালিককে বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, নিজের দোকানের জন্য সেটা তো অনেকেই করে থাকেন, কিন্তু সামান্য একটা চায়ের দোকানের জন্য, তাও আবার মনুষ্য বসবাসহীন এরকম একটা নির্জন এলাকায় এত খরচা করতে দেখা মানুষ, চিরুনি তল্লাশি করেও কতজনকে পাওয়া যাবে, সন্দেহ থেকেই যায়। ইচ্ছা ও রুচিবোধ যে একটা অতি সাধারণ জিনিসকে কতটা অসাধারণ রূপে পরিবর্তিত করতে পারে, এটা অবশ্যই তার একটা উদাহরণ। আমরা ওপরে বসে চা খেলাম। ভেবেছিলাম চায়ের মূল্য নিশ্চই অনেকটাই বেশি হবে, হওয়াই উচিত ও স্বাভাবিক, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এর আগে খাওয়া বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন দোকানের মতো এখানেও প্রতিকাপ কুড়ি টাকা দরেই নেওয়া হলো। আমরা এই দোকানে এতটা সময় ব্যয় করার জন্য দোকানদার খুব খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে হাত মেলালো। আমরা রাভাংলার পথে এগিয়ে চললাম।   

বেশ কয়েক বছর আগে আমার কন্যা এই রাভাংলায় বেড়াতে এসেছিলো। আমরা যাওয়ার আগে সে জানালো, যে তারা বুদ্ধ পার্কের ঠিক সামনেই, রেড পান্ডা নামে একটা হোটেলে উঠেছিলো। হোটেলটা খুব একটা উল্লেখযোগ্য না হলেও, ব্যবহার বেশ ভালো ও হোটেলের ঘর থেকেই বুদ্ধমূর্তিটা পরিষ্কার দেখা যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার সোনালি আলোয় আলোকিত বুদ্ধমূর্তিটি অসাধারণ দেখতে লাগে। পেলিং ছাড়া আমরা আর কোথাও কোন হোটেল বা হোমস্টে বুক করে যাইনি। রাভাংলায় পর্যটকের সংখ্যা অনেক হলেও, হোটেলের সংখ্যাও যথেষ্ট, তাই সেখানে পৌঁছে দেখেশুনে একটা মনমতো হোটেল খুঁজে নিলেই চলবে। যাওয়ার পথে কয়েকটা হোটেলে ফোন করে ঘরের সন্ধান নেওয়া হলো। কিছু হোটেলে ঘর ফাঁকা না থাকায়, বা কিছু হোটেল বুদ্ধপার্কের সামনে অবস্থিত না হওয়ায়, শেষপর্যন্ত সেই রেড পান্ডা হোটলেই ফোন করে তিনটি ঘর রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিলাম। অবশেষে বেশ দুপুরের দিকে একসময় আমরা রাভাংলায় এসে পৌঁছলাম। বুদ্ধপার্কের আশেপাশে রাস্তার ওপর গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়েও, রেড পান্ডার সন্ধান পেলাম না। কিছু পথচারীকে জিজ্ঞাসা করেও বিশেষ সুবিধা হলো না। কেউ জানে না বললো, কেউ আবার উলটো পথ দেখালো। শেষে বুদ্ধপার্ক লাগোয়া বুদ্ধ পার্ক রেসিডেন্সিতে যাওয়া হলো। হোটেলটার ঘরগুলো দেখে বেশ পছন্দ হলো। দর কষাকষির পর আমরা প্রতি ঘর আঠারোশ’ টাকা করে দিতে রাজি আছি বলায়, কাউন্টারের বান্টি নামক ছেলেটি মালকিনকে ফোন করে সম্মতি জানালো। এই হোটলে দেখলাম, ম্যানেজারি থেকে শুরু করে বোর্ডারের লাগেজ বওয়া বা ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ও ডিনারের খাবার সার্ভ করা পর্যন্ত কাজটা বান্টি ও শুভাশীষ নামে অল্পবয়সি দুটো ছেলে সামলে থাকে, এবং এরা দুজনেই বাঙালি। ঘরগুলো সত্যিই বেশ বড়, সুন্দর, ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হোটেলটা বুদ্ধপার্কের লাগোয়া হওয়ায়, তিনটি ঘরের জানালা থেকেই হাতের কাছের বুদ্ধমূর্তিকে পরিষ্কার দেখা যায়। হোটেল রেজিস্টারে সই সাবুদ করে, আমরা দুদিনের জন্য হোটেলটা বুক করলাম। এখানেও হিমাদ্রিদা তাঁর ঘরের জন্য একটা রূমহিটার নিলেন। পেলিংয়ের মতো এখানেও কোন অগ্রিম টাকা নেওয়া হলো না। রাস্তার লেভেলে আমাদের ঘরগুলো হলেও, ডাইনিং হলটি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যেতে হয়। বান্টি জানালো, যে পার্কের মূল গেটটি দিয়ে পার্কে ঢোকার সময় পঞ্চাশ টাকার টিকিট কাটতে হয়। অন্যান্য যেকোন হোটেলের বাসিন্দাদের এই চার্জ দিতে হলেও, এই হোটেলের ডাইনিং হলের ডানপাশের দরজা দিয়ে পার্কে যাওয়া যায়, এবং এই হোটেলের বোর্ডারদের ক্ষেত্রে সেই চার্জ লাগে না। প্রথমে ভেবেছিলাম, বুদ্ধপার্ক নির্মান বা পার্ক রক্ষণা বেক্ষণের জন্য হোটেলটি হয়তো বড়সড় কোন টাকা স্পনসর করেছে, পরে শুনলাম, যদিও হোটেলটি এখন লিজ দেওয়া আছে, তবু বুদ্ধপার্কের মতো হোটেলটিও সিকিম সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়, তাই এই বিশেষ সুবিধা। বুদ্ধপার্কটি ঘুরে দেখতে অনেক সময় লাগবে, তাই আমরা ঠিক করলাম, যে লাঞ্চের পর আজ পুরো দিনটাই পার্কে কাটিয়ে আগামীকাল নামচি গিয়ে, দ্রষ্টব্য যা কিছু আছে দেখে আবার রাভাংলায় ফিরে আসা যাবে।   

যাইহোক, দুপুরের খাবারের কথা বলতে বান্টি জানালো, সবই পাওয়া যাবে তবে আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট মতো সময় লাগবে। এখানেই আমরা একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেই খাবারের অর্ডার দিয়ে বুদ্ধপার্ক দেখে এসে খাওয়া দাওয়া করলে, বা এই হোটেলের বোর্ডারদের যখন পার্কে ঢুকতে পয়সা লাগে না, তখন ঘন্টা খানেক পরে একবার ডাইনিং হলে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার পার্কে গেলে সুবিধা হতো। হাতে যথেষ্ট সময় আছে, ও ডাইনিং হলের দরজা খুললেই যখন পার্কের জমিতে পা দেওয়া যায়, তখন কোন অসুবিধা ছিলো না। আমরা ঠিক করলাম, যে এবেলাটা সামনের কোন হোটেলে খেয়ে নেবো। এই হোটেলে আসবার আগে কয়েকটা বাড়ি আগে রাস্তার অপর পারে চক্রবর্তী হোটেল নামে একটা হোটেল চোখে পড়েছিলো। রামাকে নিয়ে সেই হোটেলে খেতে যাওয়ার আগে হোটেলটা কিরকম জিজ্ঞাসা করায় বান্টি জানালো যে, যে হোটেলেই খান না কেন, একটু দেখে শুনে খাবেন। কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে জানালো, কে কিরকম খাবার দেয় তার কি কিছু ঠিক আছে? তার বক্তব্যের নিগূঢ় অর্থ তখন অনুধাবন করতে পারিনি। রামাকে নিয়ে যাওয়ার সময় রামা জানালো, দুদিন এই রাভাংলায় না কাটিয়ে আগামীকাল আমাদের নামচিতে থাকলে, ঘুরে দেখতে ও পরশু রিংচেনপোঙ যেতে সুবিধা হবে। এতে আমাদেরও বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, তাই বান্টিকে সেইমতো জানিয়ে দিয়ে আমরা চক্রবর্তী হোটেলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।  

চক্রবর্তী হোটেলে প্রবেশ করার সময় একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম। জানি না রেড পান্ডা হোটেলটি এই চক্রবর্তীই চালান কী না, তবে এই বাড়িটিরই দোতলায়, রেড পান্ডা হোটেলের একটি ছোট সাইন বোর্ড চোখে পড়লো। ঘরগুলো কেমন হবে জানি না, তবে এই হোটেলটির অবস্থান বুদ্ধপার্কের ঠিক অপরদিকে, ও হোটেল থেকে বুদ্ধমূর্তি পরিষ্কার দেখা যায়। যাইহোক, ভিতরে প্রবেশ করে জানা গেল, যে ভেজ থালি মিলবে। হিমাদ্রিদা ও রামা ছাড়া আমরা চারজন ভাতের পরিবর্তে রুটি নিলাম, এবং প্রত্যেকের জন্য ডিমের অমলেট। ভাতটা কেমন ছিলো জানি না, তবে খাবার সার্ভ করার পরে দেখা গেলো, মোটা মোটা চারটে করে ঠান্ডা ও শক্ত রুটি, সেটা আজ তৈরি নাও হয়ে থাকতে পারে, চা চামচের এক চামচ করে মূলো শাক ভাজা, এক টেবিল স্পুন করে তেল মাখা নরম আলুভাজা, ও সমপরিমাণ স্কোয়াশের তরকারি। এই পরিমাণ তরকারি বা ভাজা দিয়ে আর যাই হোক, চারটে রুটি গলাধঃকরণ করা অসম্ভব। চক্রবর্তীবাবুও বোধহয় ভালো করেই জানেন, যে তাঁর হোটেলের রুটি, চারটে তো দূরের কথা, দুটো খাওয়ার লোকও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ফলে প্রত্যেকের ভাগের ফেরত যাওয়া দুটো রুটির সাথে আরও দুটো রুটি যোগ করে নতুন একজন খদ্দেরকে দিব্যি পরিবেশন করা যাবে। তরকারি জাতীয় কিছু চাইতে অবশ্য আবার সেই আগের মাপের মূলো শাক ভাজা ও আলুভাজা পাওয়া গেল। বান্টির বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ এখন বেশ বুঝতে পারছি। রাভাংলায় প্রচুর বাঙালি পর্যটক ভিড় করেন, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা বাঙালি খাবার পছন্দ করে থাকেন। হোটেলের নাম চক্রবর্তী দেখে পিপীলিকার মতো চক্রবর্তীর আগুনের দিকে ছুটবার আগে দুবার ভাবলে উপকৃত হবেন বলে মনে হয়। জানি না দোতলার রেড পান্ডার স্ট্যান্ডার্ড এরকম কী না, তবে এখন মনে হচ্ছে তাকে খুঁজে না পেয়ে বোধহয় মঙ্গলই হয়েছে।  

ফিরে আসার পরে কন্যার কাছে শুনেছিলাম, যে ওরা ২০০৭ সালে এক প্রবল বর্ষণের মধ্যে রাভাংলায় পৌঁছে বিশেষ খোঁজ খবর না করে, রেড পান্ডা হোটেলে আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর ছিল, যে সন্ধ্যার পর বুদ্ধমূর্তিতে আলো জ্বালার পরে, ওরা রাস্তার অপর পারে বুদ্ধমূর্তির অবস্থান বুঝতে পারে। যাইহোক, রেড পান্ডার ঘর ও সার্ভিস সম্বন্ধে জানার সুযোগ হয়নি, কাজেই এই হোটেলটি সম্বন্ধে ভালো বা মন্দ কোন মন্তব্য করা অনুচিত হবে। তবে চক্রবর্তী হোটেলের একটা খারাপ প্রভাব যে রেড পান্ডা হোটেলকে কলুষিত করবে,  পর্যটকদের মনে যে একটা খারাপ ধারণা জন্মাবে, এটা বলা যেতেই পারে। 

যাইহোক, এখানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ পার্ক ও মূর্তিটাকে দেখে, ছবি তুলে, আমরা নিজেদের হোটেলে ফিরে গেলাম। নিজেদের ঘরে না ঢুকে রিসেপশন কাউন্টারের ঠিক পাশ দিয়ে নীচের ডাইনিং হলে এসে উপস্থিত হলাম। বাম দিকে বেশ কিছু টেবিল চেয়ার পাতা ও বড় কোন অনুষ্ঠান হলে প্রয়োজনে বুফের ব্যবস্থা করার আয়োজন। তারও পরে দরজা পেরিয়ে কিচেন। ডানদিকে একটা দরজা, সেই দরজা দিয়ে বেরলেই বুদ্ধপার্কের জমিতে চলে যাওয়া যায়। কিছুটা হেঁটে গিয়ে পার্কের প্রধান গেট, অর্থাৎ যে গেট দিয়ে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হয়, আমি সোজা তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। শুনেছিলাম এখন নাকি পার্কের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য টোটোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রুত ওই গেটের কাছে হাজির হওয়ার কারণ একটাই, ওখানে পাশাপাশি দুটো সাদা রঙের খালি টোটো দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল চত্বর নিয়ে পার্ক, আমি ও তরুণ ছাড়া দলের আর তিনজন হাঁটুর সমস্যায় জর্জরিত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু পর্যটক আছে, কাজেই আগে গিয়ে টোটোটার ব্যবস্থা করতে হবে। গেটের পাহারাদারের কাছে জানা গেল, যে দুটো টোটো একজনই চালায় এবং সে এখন খেতে গেছে। একটা লোক দুটো টোটো চালায় কি করে বুঝলাম না। যাইহোক অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টোটো চালক ফিরে আসায়, পাহারাদারের নির্দেশে দুশো টাকা দিয়ে টোটোটা বুক করে তাতে চেপে বসলাম। টোটো পিছু দুশো টাকাই ভাড়া, তবে ইচ্ছা করলে আরও দু’-তিনজন লোককে নেওয়া যেতেই পারতো। গাছপালা দিয়ে সাজানো সবুজ মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে একসময় আমাদের মূর্তির পাদদেশে নামিয়ে দিয়ে, আগে নিয়ে আসা একটা দলকে ফিরিয়ে নিয়ে চললো।

এটাই রীতি, তবে এখন একটা পয়সাও ভাড়া নেওয়া হলো না।‍ বুদ্ধদেবের ২৫৫০ তম জন্মদিনে প্রায় ১৩০ ফুট উচ্চ এই বুদ্ধমূর্তিটি ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময় নিয়ে তৈরি করা হয় এবং এটি তৈরি করতে প্রায় ষাট টন তামা ব্যবহার করা হয়। সিকিম সরকারের তত্বাবধানে ও সিকিমের সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছায়, ধর্মীয় কারণে ও পর্যটন শিল্পের উন্নতি সাধনে এই পার্কটি প্রধানত স্থাপিত হয়, এবং ২০১৩ সালের পঁচিশে মার্চ দলাই লামা মূর্তিটি উন্মোচন করেন। আজ আর দ্বিতীয় কোন স্থানে যাবার তাড়া নেই, হাতেও অনেকটাই সময় আছে, তাই আমরা খুব ধীরে এই বিশাল বৌদ্ধ মঠটি যা তথাগত সাল নামেও পরিচিত, ঘুরে দেখার সুযোগ পেলাম। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে ধীরে ধীরে বৌদ্ধ মঠটির ভিতর প্রবেশ করার সময় দেখলাম একজন সিকিউরিটি গার্ড প্রত্যেককেই একটা কথা বলছেন, মন্দিরের ভিতরে ছবি তুলবেন না। তাঁর বলার কথা তিনি বলছেন বটে, তবে তাঁর সামনেই অনেককে দেখলাম দিব্যি ছবি তুলে যাচ্ছে। ভদ্রলোক বোধহয় ‘মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই, তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই’ গোত্রের মানুষ, তাই তিনিও কোন পর্যটককে কিছু বলেন না, আর কোন পর্যটকও তাঁর কথার কোন মূল্য দেন না।   

গেট দিয়ে ঢোকার মুখে দরজার সামনে একটা সুন্দর কারুকার্য করা গোলাকৃতির বিশাল চৌবাচ্চার মতো পাত্র রাখা আছে। বিশাল এই মঠটির চারপাশে আরও বেশ কয়েকটি এই একই রকম পাত্র রাখা আছে। জানি না এগুলো সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণে না কোন ধর্মীয় কারণে রাখা হয়েছে, তবে পাত্রগুলির  রঙ ও কারুকার্য সত্যিই সুন্দর অস্বীকার করার উপায় নেই। মঠটির ভিতরটা সুউচ্চ হলঘরের মতো। সামনেই সুবিশাল ঘেরা জায়গায় বুদ্ধদেবের মূর্তি ও অনেক ছবি। প্রথামাফিক এই অঞ্চলে প্রবেশ করা বা ছবি তোলা নিষেধ। ভিতরে কাউকে প্রবেশ করতে না দেখলেও, ছবি তোলার লোকের অভাব দেখলাম না। এই ঘেরা জায়গার বাইরে দিয়ে ঘুর ঘুরে দোতলায় ওঠার রাস্তা। দোতলা হলেও উচ্চতায় সেটি প্রায় আড়াই তলা বা তার কিছু বেশি হলেও হতে পারে। এই হাঁটা রাস্তায় দেওয়ালের গায়ে পর পর অসাধারণ সব রঙিন ছবি আঁকা। একতলা বা দোতলা থেকেও এই ছবিগুলি পরিষ্কার দেখা যায়। বেশ কিছু সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে, একসময় আমরা আবার নীচে নেমে এলাম। গেট দিয়ে বেরবার সময় বুদ্ধদেবের মূর্তির সেই ঘেরা জায়গাটার সামনে একবারে হাতের কাছে একটি সবুজ রঙের প্রায় আঠারো বিশ ইঞ্চি লম্বা বুদ্ধমূর্তি চোখে পড়লো। যাওয়ার সময় কোনভাবে চোখ এড়িয়ে গেছিলো। মাথার কাছে মুকুটের ওপর লাল রঙের পাথর বা কাচ বসানো। ছেলেবেলায় রঙিন জল ভরা কাচের তৈরি একরকম পশুপাখি ঘর সাজানোর জন্য বিক্রি হতে দেখতাম। ছোট্ট বেদির ওপর দাঁড়ানো এই বুদ্ধমূর্তিটাকেও ওই জাতীয় কিছু ভেবেছিলাম। তরুণ জানালো, এত বড় ও বিখ্যাত একটা বৌদ্ধ মঠে কাচের তৈরি একটা মূর্তি রাখা হবে বলে মনে হয় না, এটা সম্ভবত পান্নার তৈরি মূর্তি। পান্না আমি চিনি না, এটি একটি মূল্যবান পাথর পান্না সম্বন্ধে এর বেশি আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। কৌতুহলবশত সেই সিকিউরিটি গার্ডটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, যে মূর্তিটি কিসের তৈরি। তিনি জানালেন, যে মূর্তিটি পান্নার তৈরি, থাইল্যান্ড থেকে এই মূর্তিটি উপহার দেওয়া হয়েছে। এবার বোঝা গেলো, যে মূর্তিটা যদি মহামূল্য পান্নার তৈরি হয়, তাহলে মুকুটের লাল বা অন্যান্য পাথরগুলোও নিশ্চয় চুনি বা অন্যান্য পাথরের তৈরি। বাইরে বেরবার সময় একটা কথাই মনে হলো, যতই সি সি টিভির আওতায় থাকুক, এই জাতীয় একটা দুর্মূল্য সম্পদকে এনারা কোন সাহসে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রেখেছেন।  

বাইরে এসে মন্দিরের চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে যে গোটা এলাকাটাকে রাখা হয়েছে ভাবা যায় না। মঠের বাইরে ছবি তোলায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, তাই বেশ কিছু ছবি তুলে একসময়

সিঁড়ি ভেঙে নীচে এসে দেখলাম টোটোটা দাঁড়িয়ে আছে। তাতে চেপে আবার মূল গেটের কাছে ফিরে এলাম। এবার কিন্তু দুটো টোটো, অথচ একজনই চালকের রহস্য উন্মোচন হলো। অপর টোটোটা এতক্ষণ চার্জে বসানো ছিলো। আমাদের কাছ থেকে ভাড়া বাবদ দুশো টাকা নিয়ে, ভদ্রলোক এই টোটোটাকে চার্জে বসিয়ে অপর টোটোটা করে নতুন যাত্রীদের নিয়ে বুদ্ধমূর্তির উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন। আমি আর তরুণ ছাড়া আর তিনজনই মাঠের পাশে বেঞ্চিতে বসে থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি ও তরুণ আবার হেঁটে হেঁটে মূর্তির দিকে এগলাম। বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে যে কি সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ভাবা যায় না। আগে লক্ষ্য করিনি, এখন চোখে পড়লো মূর্তিটির কিছুটা আগে একটা ফোয়ারা আছে। ফোয়ারার জলে আলো পড়ে রামধনু দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে দেখে ছবি তুলে ফেরার রাস্তা ধরলাম। ঠান্ডাও বেশ পড়েছে, সঙ্গীরা আমাদের অপেক্ষায় হোটেলের কাছেই মাঠের একপাশে বেঞ্চিতে বসে আছে। ফিরে গিয়ে দেখলাম, ওনারা এই সুযোগে কিছু কেনাকাটাও করে ফেলেছেন। আমরা ডাইনিং হলের দরজা দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

কথা ছিলো আজ ও আগামীকাল আমরা রাভাংলাতেই কাটাবো, কিন্তু রামার কথায় আগামীকাল আমরা নামচি চলে গিয়ে দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে দেখে নামচিতেই থেকে যাবো। কাজেই আজই রাভাংলায় আমাদের শেষ দিন, কাল সকালে রামা তার গাড়িতে নামচি নিয়ে গিয়ে স্পটগুলো দেখিয়ে নামচির কোন হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে, এনজেপি থেকে নতুন পর্যটক আনতে শিলিগুড়ি চলে যাবে। শুনেছিলাম নন্দনের দাদা সুদন শিলিগুড়িতে থাকে। সকালের দিকের কোন ট্রেনে যাত্রী আসার কথা থাকলে, আগের রাতে রামা সুদনের বাড়িতেই থেকে যায়। এছাড়া উপায়ও নেই। এনজেপি থেকে অত সকালে আমাদের আনবার জন্য আগের রাতেও সে শিলিগুড়িতে সুদনের বাড়িতেই ছিলো। রামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নামচি থেকে রিংচেনপোঙ যাওয়ার জন্য একটা বড় গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে তো? উত্তরে রামা জানিয়েছিলো, নামচি দক্ষিণ সিকিমের জেলার ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার, কাজেই সেখানে হোটেল বা গাড়ি, কোন কিছুরই অভাব নেই। এরপর আর কথা থাকতে পারে না, কাজেই একপ্রস্ত চা জলখাবার খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ নির্ভেজাল আড্ডা চললো। একসময় রাতের খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য ডাক পড়লো। অনেক আগেই পছন্দ মতো খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিলো। নিজেদের ঘর থেকে ও ডাইনিং হল থেকে, সোনালি আলোয় আলোকিত বুদ্ধমূর্তির মোবাইলে অনেক ছবি তুললাম, কিন্তু দক্ষতার অভাবে বুদ্ধদেবের ছবি বলে বুঝতে পারলেও, একটা ছবিও ভালো উঠলো না। ডাইনিং হলের দরজা দিয়ে একবার ভেবেছিলাম কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলবো, কিন্তু কোন বাধানিষেধ আছে কী না জানি না, তার ওপর এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আর কত ভালোই বা ছবি উঠতে পারে। কাজেই খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার ঘরে ফিরে গেলাম।   

সকাল বেলায় তৈরি হয়ে নিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে, রাস্তায় এসে রোদে দাঁড়ালাম। রামা তার গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। গাড়ির ছাদে একটা একটা করে সুটকেস সাজিয়ে তুলে, সে তার চালকের আসনে বসলো। বান্টি ও সুভাশীষও বাইরে এসে হাত মেলালো। আমাদের গাড়ি ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরের নামচি শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

যাওয়ার পথে, ষোলো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টেমি চা বাগানের পাশে রামা গাড়ি দাঁড় করালো। এই চা বাগানটি নাকি সিকিমের একমাত্র চা বাগান, এবং ১৯৬২ সালে সিকিম সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই চা বাগানটির উৎপাদিত চায়ের মানও নাকি খুবই উন্নত। বর্তমানে এই চা বাগানটি নিয়ে সাধারণ পর্যটকদের মধ্যে একটা মাতামাতি, ভালবাসা ও ভাললাগা তৈরি হলেও, সত্যি কথা বলতে কি এই চা বাগানটি কিন্তু আমায় সেইভাবে আকর্ষণ করেনি। হতে পারে হয়তো চায়ের গুণগত মানের দিক থেকে অনেক চা বাগানের থেকে এগিয়ে, কিন্তু সৌন্দর্যের দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এর সৌন্দর্য যতই বৃদ্ধি করুক না কেন, এই চা বাগানের স্থান আশেপাশের অনেক চা বাগানের পিছনে থাকতে বাধ্য। কুড়ি টাকা করে টিকিট কেটে মহিলাদের নিয়ে কিছুটা নীচ পর্যন্ত নেমে আবার ফিরে এলাম, কারণ সেই একই, হাঁটুর সমস্যা। বেশ মনে পড়ে, ১৯৮৫ সালে সান্দাকফু ফালুট যাওয়ার সময় একটা গোটা দিন শিলিগুড়িতে কাটিয়ে ছিলাম। পীযুষদা আমার সাথে গেছিলেন, তিনি ছিলেন আমার ব্র্যাঞ্চের ডেপুটি ম্যানেজার। ওনার দাদা, তুষার কান্তি দে ছিলেন টি বোর্ডের অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর এবং তিনি তখন ওই বিস্তীর্ণ চাবাগান অধ্যুষিত এলাকায় টি বোর্ডের সর্বোময় কর্তা হিসাবে ওই অঞ্চলে পোস্টেড ছিলেন। ওনার সৌজন্যে সকালে একটা ও রাতে একটা প্রাইভেট চা বাগানের গেস্ট হাউসে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আজ যেন মনে হলো, সেই চা বাগান, বা কেরালার মুন্নারের চা বাগানের পাশে, টেমি চা বাগানটি বড়ই অনুজ্জ্বল ও অতি সাধারণ। তবে চা বাগানের মধ্যে লাল ছাদযুক্ত সাদা রঙের চেরি রিসর্টটির গুণে, এর সৌন্দর্য সত্যিই অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা অবশ্য সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মত, যা আর পাঁচজনের সাথে মিলতে নাও পারে। যাইহোক, এখান থেকে শিল্ড প্যাকেটে চা কেনা হলো, সামনের দোকানে বসে চা খাওয়া হলো, এবার সামদ্রুপসের পথে এগিয়ে যাওয়ার পালা।  

ধীরে ধীরে একসময় আমরা সামদ্রুপসে এসে পৌঁছলাম। সামদ্রুপসে কথার অর্থ নাকি ইচ্ছা পূরণের পাহাড়। নামচি শহর থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। দক্ষিণ সিকিমের এই নামচি শহরটি ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার হলেও, শহরটি বেশ ছোট ও জনসংখ্যাও খুব কম। এই সামদ্রুপসেতেই গুরু পদ্মসম্ভবের, যিনি গুরু রিনপোচে নামেও খ্যাত, একটি মূর্তি স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ পদ্মসম্ভবের এই মূর্তিটি প্রায় ১৩৫ ফুট উচ্চ এবং এই বিশাল মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাইশে অক্টোবর, ১৯৯৭ সালে স্বয়ং দলাই লামা এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৪ সালের আঠারোই ফেব্রুয়ারী, শ্রী পওন চামলিং, তাঁর ও সিকিমবাসীর স্বপ্নের মূর্তিটির উদ্বোধন করেন। বহুদূর থেকে এই মূর্তিটি দেখা যায়। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে টিকিট কাটতে হলো। জানা গেল, সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই মূর্তির কাছে যাওয়ার অনুমতি মেলে। বিশাল আকৃতির মূর্তিটির কাছে যাওয়ার পথটিও ভারী সুন্দর। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ভাবে লাল নীল সাদা ও সবুজ রঙের বেশ বড় বড় কাপড়ের তৈরি উজ্জ্বল ফ্ল্যাগগুলি রাস্তার সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করেছে ও পরিবেশটাই পালটে দিয়েছে।  

ধীরে ধীরে আমরা সিঁড়ি ভেঙে মূর্তিটির কাছে গেলাম। অনেকটা তামার মতো রঙের বিশাল এই মূর্তিটি অসাধারণ সুন্দর এবং তিনি যেন ওখানে বসে বহুদূর পর্যন্ত নজর রাখছেন। মূর্তিটি উজ্জ্বল তাম্রবর্ণের হলেও, মুখটি কিন্তু স্বর্ণবর্ণের। এছাড়া বুকের কাছে মূর্তির সাথে মানানসই বিশাল একটা লকেটের মতো গহনা, যার মাঝখানে আবার নীল রঙের বেশ বড়সড় একটি পাথর। এটা সোনার তৈরি হলেও হতে পারে। এছাড়াও যে আসনে তিনি বসে আছেন, তার ঠিক নীচে দুপাশে বেশ বড় বড় দুটো সোনালি রঙের কারুকার্য করা ফলক  আছে। ফলে মূর্তিটির ওপর সূর্যালোক পড়লে, চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো ঔজ্জ্বল্যের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে মঠটির ভিতরে ও বাইরে দেখলাম, ছবি তুললাম।

এবার বিদায় নিতে হবে। ধীরে ধীরে পুরানো পথ ধরে গেটের বাইরে চলে এলাম। এখানে একপাশে দেখলাম একটি রোপওয়ে আছে। এটি পরিত্যক্ত, না বর্তমানে অকেজো হয়ে আছে জানি না, তবে জানা গেলো, যে এই রোপওয়ে নামচি থেকে সামদ্রুপসের মধ্যে যাতায়াত করতো। ২০১৬ সালের পয়লা অগাস্ট, সিকিম সরকারের স্পীকার, শ্রী কে এন রাই, এবং সিকিম সরকারের পর্যটন মন্ত্রী, শ্রী উজেন টি গ্যাসো, এই রোপওয়েটির উদ্বোধন করেন। আমাদের গাড়িটা ছাদে মালপত্র নিয়ে এখানেই এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। এবার অন্য কিছু দেখতে যাওয়ার আগে, রাতে থাকার একটা মাথাগোঁজার আশ্রয়ের ব্যবস্থা আগে করা দরকার। কার পার্কিং চার্জ হিসাবে পঞ্চাশ টাকা মিটিয়ে দিয়ে আমরা হোটেলের সন্ধানে এগিয়ে গেলাম।    

ছোট্ট শহর নামচি, কাজেই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নামচি মার্কেট অঞ্চলে এসে হাজির হলাম। এখানে গাড়ি দাঁড় করানোয় যথেষ্ট সমস্যা আছে। এই অঞ্চলে হোটেল কিন্তু নজরে পড়লো না। যাও বা এক-আধটা খুঁজে বার করা গেলো, চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার নীচে কোন ঘর এইসব হোটেলে নেই। মনে হলো, ছোট্র শহরের প্রাণকেন্দ্র এই মার্কেট প্লেসে আসার জন্য, এত বেশি ভাড়া চাইছে। রামাকে বললাম, মার্কেট থেকে বেরিয়ে অন্যত্র হোটেলের খোঁজ করতে।   

রামা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার পথে আরও একটা হোটেলের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খোঁজ নেওয়া হলো বটে, তবে বিশেষ কোন সুবিধা হলো না। নামচি শহরটা ছোট, লোক সংখ্যাও খুব কম, সম্ভবত হোটেলের সংখ্যাও খুবই কম, অথবা নামচি শহরটা সম্বন্ধে রামার সম্যক ধরণা নেই। পর্যটক নিয়ে এই শহরে এসে,  দ্রষ্টব্য স্থলগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে আবার ফিরে যায়। আমাদেরও আজ রাভাংলার হোটলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। আজই রামা গাড়ি নিয়ে শিলিগুড়ি চলে যাবে, তাই ওর সাথে আমাদের সম্পর্কও আজই শেষ হবার কথা। রাভাংলা থেকে আগামীকাল অন্য কোন গাড়ির ব্যবস্থা করে আমাদের রিংচেনপঙ চলে যাওয়ার কথা। মনে হয় নামচি শহরে আমাদের ছেড়ে দিতে পারলে, ওর বিশেষ কোন সুবিধা হয়, যেটা সে মুখ ফুটে আমাদের বলতে পারছে না। এখনও সব দ্রষ্টব্য স্থল ঘুরে দেখা হয়নি, তাই এখানে হোটেলের সন্ধানে আর বৃথা সময় নষ্ট না করে তরুণকে বললাম, রাভাংলার হোটেলটার সাথে যোগাযোগ করে তিনটে ঘরের ব্যবস্থা করার কথা বলতে। তরুণ জানালো, আর একটু খুঁজে দেখুক, না পেলে ফোন করবে।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়িটাকে নিয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, আমরা চারধাম দেখতে যাচ্ছি। এও জানা গেল, যে চার ধাম ঘুরে দেখতে মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে। চার ধাম ঘুরে দেখার পরে হোটেল খোঁজার ঝুঁকি নেওয়াটা নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। রাভাংলার হোটেলটা সত্যিই বড় ভালো ছিলো। হোটেলটায় ভিড়ও হয় যথেষ্ট, কাজেই অযথা সময় নষ্ট না করে তরুণকে বললাম, এই মুহূর্তে ফোনে কথা বলে তিনটে ঘর রেখে দেওয়ার কথা বলতে। তরুণ ফোন করে বান্টি বা সুভাশীষ, কার সাথে যেন কথা বলা শুরু করে দিলো। অসুবিধা নেই, কারণ গতকাল একটি দিনের পরিচয়েই তাদের দুজনের সঙ্গেই আমাদের একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। জানা গেল, তিনটি ঘরই পাওয়া যাবে বটে, তবে সেগুলো তিনতলায়। একটা রাতের ব্যাপার কাজেই খুব একটা অসুবিধা হবার কথা হয়তো নয়, তবু সকলের বয়স ও হাঁটুর অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তরুণ একবার কিছু একটা ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানালো। রাভাংলায় থাকার ব্যবস্থা পাকা, কাজেই রামাকে জানানো হলো, যে আজ রাভাংলার পুরাতন হোটেলেই আমরা ফিরে যাবো। রামা চুপ করে থাকলো, না থেকেও উপায় নেই, কারণ কথামতো আজ সারাদিন আমাদের নামচি শহর ও তার দ্রষ্টব্য স্থল ঘুরিয়ে দেখিয়ে, আমাদের রাভাংলায় ছেড়ে দিয়ে তার ফিরে যাওয়ার কথা, এবং সেইমতো পেলিংয়ের ব্লু বেন হোটেলের মালিক, নন্দনকে পুরো টাকা মেটানো আছে। দ্বিতীয়ত, রামা নিজেও বোধহয় এতক্ষণে বুঝে গেছে, যে সে রাভাংলার ভাড়ায় এখানে কোন হোটেলের হদিশ করে উঠতে পারবে না। কাজেই সে কোন উত্তর না দিয়ে, চার ধামের উদ্দেশ্যে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললো। এমন সময় রাভাংলা থেকে বান্টি ফোন করে জানালো, যে মালকিন আমাদের আগের দিনের তিনটি ঘরই অ্যালট করতে বলেছেন, এবং সেটা আগের দিনের মতো ভাড়াতেই। কাজেই আমাদের জন্য আগের দিনের তিনটি ঘরই রাখা থাকবে জানিয়ে, সে ফোন কেটে দিলো।  

একসময় আমরা চার ধামের গেটের সামনে এসে হাজির হলাম। এতদিনে বার্ধক্যের প্রথম সুযোগটা পাওয়া গেল। মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে টিকিটের মূল্য হলেও, কাউন্টারের ভদ্রলোক আমাদের কাছ থেকে মাথাপিছু পঁচিশ টাকা করে টিকিটের মূল্য ধার্য করলেন। মাত্র কয়েক বছর আগে সল্পক পাহাড়ের ওপর এই চার ধাম,  বা সিদ্ধেশ্বর ধাম প্রতিষ্ঠিত হলেও, কয়েক বছরের মধ্যে সেটি যেরকম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বা করছে, তাতে আশা করা যায়, যে অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ পর্যটক ও ধর্মীয় তীর্থযাত্রী, উভয়ের জন্যই এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট হিসাবে বিবেচিত হবে। চার ধাম বলতে সকলেই গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ, ও বদ্রীনারায়ণকে বুঝলেও, বদ্রীনারায়ণ ধাম, দ্বারকা ধাম, রামেশ্বরম ধাম, ও জগন্নাথ ধাম, এই চারটি মন্দিরকে একত্রে চার ধাম বলা হয়। গাছপালা দিয়ে সাজানো ঝকঝকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর এই চার ধাম ছাড়াও, কেদারনাথ, নাগেশ্বর, বিশ্বনাথ, ঘৃষ্ণেশ্বর, মহাকালেশ্বর, বৈদ্যনাথ, ওঙ্কারেশ্বর, সোমনাথ, ত্র্যম্বকেশ্বর, ভীমশঙ্কর, মল্লিকার্জুন, রামেশ্বরম, নামক দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রতিরূপ ধার্মিক অধার্মিক, সকলকেই আকর্ষণ করে। এখানে একটি সাদা রঙের বিশাল শিব মূর্তি আছে, যদিও মূর্তিটির সঠিক উচ্চতা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ শুনলাম। সম্ভবত মূর্তিটির উচ্চতা সাতাশি ফুট। দর্শকদের বিশ্বাস, এখানে এলে ভগবান বিষ্ণু, ভগবান কৃষ্ণ, জগন্নাথ দেব, এবং সর্বোপরি ভগবান শিব বা মহাদেবের আশীর্বাদে সমস্ত পাপ তাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। সাজানো গোছানো বিস্তীর্ণ এলাকায় একসাথে এতগুলো স্থানের মন্দিরের প্রতিরূপ থাকায় দেখতে হয়তো ভালোই লাগে, তবে মন্দিরগুলো প্রতিরূপ হলেও, অবিকল প্রতিরূপ সম্ভবত হয়নি। শিবের বিশাল মূর্তিটিও আরও অনেক নিখুঁত ও সুন্দর হতেই পারতো। সামান্য দূরের পদ্মসম্ভব বা রাভাংলা ও স্কাই ওয়াকের বুদ্ধমূর্তির সাথে তুলনা করলে একথা মনে আসবেই। এখান থেকে দূরের চারপাশের সৌন্দর্য কিন্তু সত্যিই অতুলনীয়। আমরা ঘুরে ঘুরে প্রতিটি মন্দির দেখে, আরও বেশ কিছুক্ষণ ছবি তোলার পিছনে ব্যয় করে, সামনের ক্যাফেটারিয়ায় কিছু জলখাবার খেয়ে গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি রাভাংলার পথে এগিয়ে চললো। ফেরার পথে বাইচুং ভুটিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত বাইচুং স্টেডিয়ামটি এক ঝলক দেখে, একসময় রাভাংলার সেই পরিচিত বুদ্ধ পার্ক রেসিডেন্সির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। রামা গাড়ির ছাদ থেকে মালপত্র নামিয়ে দিলে তাকে কিছু টিপস্ বা বকশিশ দিলাম। সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। বান্টি ও সুভাশীষ আমাদের মালপত্র যার যার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এলো।   

হাতে বিশেষ সময় নেই, তাই সময় নষ্ট না করে আগামীকাল সকালে রিংচেনপোঙ নিয়ে যাওয়ার জন্য বান্টিকে একটা ছ’জন বসার মতো ভালো গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। বান্টি জানালো, যে সে কথা বলে দেখছে, গাড়ির ব্যবস্থা করে সে আমাদের জানাবে। এই হোটেল থেকে সকালে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে চার ধামের কাফেটারিয়ায় একটা করে পনির রোল ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কারও পেটে কিছু পড়েনি। ফলে বান্টিকে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে, এখন কিছু ভেজ পকোড়া ও কফি, আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। একসময় রামা হঠাৎ ফোন করে তরুণকে অনুরোধ করলো, যে আগামীকাল এই হোটেল থেকে কেউ যদি শিলিগুড়ি যায়, তাহলে তাকে যেন একটু জানানো হয়, কারণ আজ সে আর শিলিগুড়ির পথে এগয়নি। কাল সকালে সে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

আমার ঘরে সবাই মিলে গুলতানি করে সময় কাটাচ্ছি, এমন সময় বান্টি পকোড়া ও কফি নিয়ে এসে হাজির হলো। তাকে আগামীকাল সকালের গাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করায় সে জানালো, যে সে মালকিনকে বলেছে। গাড়ির ব্যবস্থা হলে তিনি জানাবেন বলেছেন। শেষপর্যন্ত গাড়ির ব্যবস্থা করতে না পারলে কি করবো ভেবে একটু চিন্তায় পড়লাম। ধীরে ধীরে সময় কাটতে লাগলো, গাড়ির সংবাদ কিন্তু এসে পৌঁছালো না, পরিবর্তে রাতের খাবার খেতে যাওয়ার ডাক এসে পৌঁছলো। নীচে নেমে ডাইনিং হলে খেতে গিয়ে রাতের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বুদ্ধদেবকে আবার মোবাইল ক্যামেরায় বন্দী করার প্রচেষ্টা চালালাম। খাবার পরিবেশনের সময় বান্টি জানালো, একটা খুব ভালো কন্ডিশনের বোলেরো গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে, তবে সাড় চার হাজার টাকা ভাড়া পড়বে। এখান থেকে রিংচেনপোঙয়ের দূরত্ব উল্লেখযোগ্য কিছু বেশি নয়, কিন্তু রিংচেনপোঙ যেহেতু কোন শহর নয়, ফেরার পথে গাড়িটাকে তেল পুড়িয়ে ফাঁকা আসতে হবে। চার হাজার টাকা হলে ভালো হতো, একটু দর কষাকষি করলে হয়তো শ’দুয়েক টাকা কমও করা যেত, কিন্তু তার জন্য আবার মালকিনকে বলতে ইচ্ছা করলো না। সকাল বেলা গাড়ির প্রয়োজন, এখানে কে যে গাড়ি ভাড়া দেয় তাও জানা নেই, এই ঠান্ডার রাতে কোথায় বা গাড়ির খোঁজ করতে যাবো, তাই রাজি হয়ে গেলাম। যাইহোক কাল সকালে উঠে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে যাওয়া, তাই আজ আর সুটকেসটা বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি করা হলো না। আজ দীর্ঘ সময় বাইরে বাইরে কেটেছে, কাল সকালে আবার নতুন জায়গায় যাওয়ার আছে, তাই অযথা বেশি রাত না জেগে একসময় বিছানায় আশ্রয় নিলাম।    

আজ ডিসেম্বর মাসের আঠারো তারিখ, ঘুম ভাঙলো বেশ সকালে। ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে একসময় আমরা নীচের ডাইনিং হলে গেলাম প্রাতরাশ সারতে। খাওয়া হয়ে গেলে ওপরে এসে বান্টিকে হোটেল ভাড়া ও খাবারের দাম হিসাব করে জানাতে বলে, ঘর থেকে মালপত্র বার করে ঘর খালি করে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বোলেরো প্লাস গাড়ি এসে হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। বান্টি ও সুভাশীষ আমাদের মালপত্র গাড়ির কাছে নিয়ে আসলে, অল্প বয়সি, সম্ভবত সুরেশ নামে ড্রাইভারটি গাড়ির ছাদে সমস্ত মালপত্র গুছিয়ে তুলে ফেললো। গতকাল সকালের মতো আজও হোটেলের বিল মিটিয়ে সুভাশীষ ও বান্টির সাথে হাত মিলিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

রিংচেনপোঙ পৌঁছাতে কত সময় লাগতে পারে ঠিক বোঝা গেলো না। তবে আজ সেখানে পৌঁছে আর কোথাও যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। পেলিংয়ে নেট ঘেঁটে তরুণ রিংচেনপঙয়ের কয়েকটা হোমস্টের নাম ও মোবাইল নাম্বার জোগাড় করে দুজায়গায় ফোন করলে, শেষে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ হোমস্টে নামক হোমস্টের সাথে কথা বলে মন্দ লাগলো না। মালিক ভদ্রলোকের নাম, ফুরবা লেপচা। আন্দাজে আন্দাজে আগে থেকে না দেখে হোমস্টে বুক করার মধ্যে ঝুঁকির পরিমাণ যথেষ্ট। ঘর যেমনই হোক এক আধদিনের ব্যাপার চালিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু হোমস্টের মানুষগুলোর ব্যবহার খারাপ হলে থাকার আনন্দই নষ্ট হয়ে যায়। তবে আজ পর্যন্ত উত্তর সিকিমের লাচুংয়ে অবস্থিত ‘বিগ মাউন্টেন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামের হোমস্টের মতো একাধারে খারাপ ব্যবহার, খারাপ ও নোংরা ঘর, ও তার সাথে মানানসই অখাদ্য খাবার পরিবেশন আজ পর্যন্ত কোথাও কোন হোমস্টেতে কপালে জোটেনি।

ভদ্রলোক জানালেন, আমাদের পাঁচজনকে তিনটি দুই শয্যার ঘর দেওয়া হবে। চব্বিশ ঘন্টা গরম জল পাওয়া যাবে, থাকা খাওয়া বাবদ মাথাপিছু এগারোশ’ টাকা করে খরচা পড়বে। এবার নতুন সহযাত্রী হিসাবে হিমাদ্রিদা আমাদের সাথে এসেছেন। আগে কখনও হোমস্টেতে উনি কাটাননি, আমাদের কছে হোমস্টের অতীত অভিজ্ঞতা শুনে ওনার খুব হোমস্টেতে থাকার সখ। তবে আমাদের মতো ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে মানসিকতার মানুষ উনি নন, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার ওনাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি, যে হোটেলের সমস্ত সুযোগ সুবিধা কিন্তু হোমস্টেতে পাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু অনেকটাই কম। হোমস্টেতে অনেক কিছুই মানিয়ে নিয়ে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে। যাইহোক, রিংচেনপঙ, কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ হোম স্টে, ও ফুরবা লেপচার মতো তিনটি মিষ্টি নাম একই জায়গায় খুঁজে পাওয়ায় ওখানেই থাকার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলা হলো। ফুরবা সাহেব অবশ্য একবার অ্যাডভান্স হিসাবে কিছু টাকা পাঠাবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তরুণ তাঁকে জানায়, যে একে এখানে নেট খুব স্লো ও আমরা পাঁচজনই যথেষ্ট বয়স্ক হওয়ায় ওইভাবে ফান্ড ট্রান্সফার করত পারি না। আপনি তিনটি ঘর রেখে দিন, আমরা নির্দিষ্ট দিনে ঠিক সময় পৌঁছে যাবো।

যাইহোক, গাড়ি ছাড়ার পরে ফুরবা সাহেবকে আমাদের রওনা হওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের গাড়ি একসময় লেগশিপ নামক জায়গা থেকে ডানদিকে পেলিং যাওয়ার রাস্তা না ধরে সোজা রিংচেনপঙ যাওয়ার রাস্তা ধরে রেশি টানেলের ভিতর দিয়ে গিয়ে সামনে এগিয়ে চললো। রাস্তা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করায় বেশ বুঝলাম যে এই খতরনক রাস্তার হাত থেকে নিজের নতুন ও দামি গাড়িকে রক্ষা করার জন্য রামা আজকের ট্যুরটাকে এড়িয়ে গেছে। রিংচেনপঙ এলাকায় পৌঁছে আমরা বেশ বুঝতে পরছি, যে আমরা এসে গেছি। তবে একবারে শেষের দিকে রাস্তার ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে ভয় হচ্ছিলো যে চালক ছেলেটি না আমাদের এখানেই নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে যায়। শেষে দুপুরের দিকে আমরা রিংচেনপোঙ এসে হাজির হলাম। একটা মোবাইলে বাম দিকের একটা পথের কথা নির্দেশ করছিলো। বামদিকে বেশ কিছুটা জায়গার ওপর একটা বেশ বড় বাড়ির দেখাও মিললো, তবে জানা গেল যে সেটা কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ হোমস্টে নয়। আমাদের হোমস্টেটি এর পরের বামদিকের রাস্তায়। পরের রাস্তা দিয়ে এসেও কিন্তু কোন হোমস্টের দর্শন মিললো না। নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুরবা সাহেবকে আমাদের পৌঁছানো সংবাদ জানিয়ে দিয়ে, সম্ভবত সুরেশ নামে গাড়ির চালককে মোবাইলটা ধরিয়ে দেওয়া হলো। দুজনের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কিছু কথোপকথনের পরে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে কয়েকহাত পিছিয়ে এসে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হলো। অল্প সময়ের মধ্যে এক ব্যক্তি অনেক ওপর থেকে গাছপালা জঙ্গলে রাস্তা ভেঙে আমাদের গাড়ির কাছে নেমে এলেন। এনার চেহারা দেখে এনার বয়স অনুমান করা সামান্য দূরত্বের নামচি শহরের সাতাশি ফুট উচ্চতার মহাদেব বা রাভাংলা শহরের একশ’ ত্রিশ ফুট উচ্চতার বুদ্ধদেব, উভয়ের পক্ষেই অসম্ভব। ইনিই ফুরবা লেপচা, আমাদের হোমস্টের মালিক। তিনি আমাদের সাথে হাত মেলালেন বটে, তবে হোমস্টেটির দর্শন এখনও মেলেনি। এখনো তারে চোখে দেখিনি, শধু বাঁশি শুনেছি। মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়েও হয়তো ফেলতাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে ফুরবা সাহেব হাতের ইশারায় ওপর দিকে দেখালেন। না, সেখানে কোন বাড়ি ঘরদোর নেই, পরিবর্তে রাস্তা থেকে প্রায় আকাশ পর্যন্ত মইয়ের মতো একটা পাথরের সরু সিঁড়ি উঠে গেছে। কাজেই মন প্রাণ আর দিয়ে ফেলার সুযোগ হলো না। আমাদের সবার মুখের অবস্থা দেখে ফুরবা সাহেব হয়তো বা একটু ঘাবড়ে গেলেন। ইতিমধ্যে আরও একজন সেই আকাশচুম্বি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এসেছেন। মহিলা দুজন ও হিমাদ্রিদাকে নিয়ে চিন্তায় পড়লাম। সীমাকে বললাম আগের থেকে তো সিঁড়ির গল্প বা মালিকের ব্যবহার বোঝার কোন উপায় থাকে না, কাজেই তরুণের পক্ষেও জানার কোন সুযোগ ছিলো না। একটা ব্যাগও আমাদের বইতে না দিয়ে ওনারা দুজন ওই ভাড়ি ভাড়ি সুটকেসগুলো নিয়ে ওপরে ওঠার সময় আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ভয় পাবেন না সামান্যই পথ। সত্যিই তাই, বাঁদিকে গভীর বাঁশগাছের জঙ্গল, ডানদিকে উঁচু জমির মাঝখান দিয়ে সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠে, দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি ডানদিকে বেঁকে চোখের আড়ালে চলে গেলেন। একসময় আমরাও ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে হোমস্টের কাছে চলে এলাম, এবং শুধু মন প্রাণ দেওয়া নয়, গভীর প্রেমে পড়লাম।   

স্বর্গারোহণ করার পাথরের সিঁড়িটা আরও অনেকটা উঠে গেছে। সম্ভবত এই সিঁড়ির শেষপ্রান্তে এখানে আসার পথে দেখা বড় রিসর্টটা অবস্থিত। সিঁড়ির মাঝপথে সিঁড়ির ঠিক পাশ থেকে হেলিপ্যাডের মতো অনেকটা জায়গা গাছপালা দিয়ে সাজানো। একবারে নীচের রাস্তা থেকে এই হোমস্টের জমি তিনটি স্তরে বিভক্ত। একবারে নীচ থেকে অনেকটা ওপরে কিছুটা সমতলভূমি অবস্থিত। সেখানেও একটি হোমস্টে আছে। এর থেকে কিছুটা ওপরে ফুরবা সাহেবের জমিদারি। সিঁড়ি থেকে আমাদের জমিতে পা দিয়েই বাঁপাশে পাশাপাশি দুটো ঘর, তবে এখনও বোর্ডার এসে পৌঁছয়নি। পাশ দিয়ে ফুলগাছ ও বাহারি গাছের জমি পার হয়ে এসে আবার পর পর পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে ঘেরা বারান্দা। এইদুটো আমার ও তরুণদের ঘর। আর কয়েক পা এগিয়ে গেলে আর একটি মাত্র ঘর, এটা হিমাদ্রিদার। এরপরে আর সমতল জমি নেই। হিমাদ্রিদার ঘরের বাঁপাশে, ডাইনিং হল কিচেন ও ফুরবা সাহেবের সপরিবারে থাকার ব্যবস্থা। আমাদের দুজনের ঘরগুলোর প্রায় ঠিক সামনে চারিপাশ খোলা একটা ছাউনি মতো করা আছে। তক্তা পেতে বেঞ্চি মতো করা এই ছাউনিটায় খড় জাতীয় কিছু দিয়ে ছাদের মতোও করা আছে। ঘরে বা বারান্দায় না বসে, এখানে বসেও দীর্ঘক্ষণ সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে কাটিয়ে দেওয়া যায়। এখান থেকে বহুদূরের স্কাই ওয়াকের বুদ্ধমূর্তিটা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের ঘর অ্যালট্ করে দেওয়ার পরে আমি ফুরবা সাহেবকে একটু চায়ের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করলে, একটু পরে তিনি চা দিয়ে বলে গেলেন, যে দুপুরের খাবার প্রস্তুত, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগে আমরা যেন ডাইনিং হলে গিয়ে খেয়ে নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ডাইনিং হলে গিয়ে বড় ভালো লাগলো। হটপটে করে খাবার দাবার ঢাকা দিয়ে খাবার টেবিলে রাখা আছে। পরিবেশন নিজেরাই করে নিলেও আমাদের আর কিছু লাগবে কী না, ফুরবা সাহেব বার বার খোঁজ নিয়ে যচ্ছেন। সাধারণ খাবার, কিন্তু খুব ভালো রান্না। 

খাওয়া শেষে ফুরবা সাহেব তাঁর কিচেনে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কিচেনটাতে দেখলাম সেই ভদ্রলোক রান্না করছেন, এখানে আসার সময় আমাদের মালপত্র ওপরে বয়ে আনার ব্যাপারে যিনি ফুরবা সাহেবকে সাহায্য করেছিলেন। জানা গেল, ইনি ফুরবা সাহেবের ভগ্নিপতি, এখানেই কুকের কাজ করেন। ফুরবা সাহেব তাঁর স্ত্রী ও সম্ভবত বোনের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। ফুরবা সাহেব জানালেন, যে তাঁর জন্ম নীচের বস্তিতে। ২০১৮ সালে তিনি এই হোমস্টেটি চালু করেন। এই হোমস্টের ব্যবসা ছাড়া তিনি ছোটখাটো  কন্ট্রাক্টরির ব্যবসাও করেন।

এখানে ঘরের বারান্দায় ও ছাউনির বেঞ্চে বসে সামনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। একবারে সামনের দুটো ঘরেও বোর্ডার এসে গেছে। সান্ধ্যকালীন চা ছাড়াও ছাউনিতে বসে আর একপ্রস্ত চা খেলাম। ধীরে ধীরে আকাশের রঙ পরিবর্তন হয়ে এখন গভীর অন্ধকার। বহুদূরে পাহাড়ের মাথায় স্কাই ওয়াকের বুদ্ধমূর্তি সোনালি আলোয় ঝলমল করছে। আজ কোথাও যাওয়ার উপায় ছিলো না বটে, তবে আগামীকাল আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য ফুরবা সাহেব তিন হাজার টাকা ভাড়ায় একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কালকের দিনটাই আমরা এখানে থাকবো, পরশু এখান থেকে সিটং চলে যাবো। আগামীকালের গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে, তাই অনেকটাই নিশ্চিন্ত। আরও বেশ কিছুক্ষণ গুলতানি করে কাটিয়ে, রাতের খাবার খেতে গেলাম। এখানে দেখলাম, স্থানীয় মুরগি রান্না করা হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর আর কিছুই করার নেই। ফুরবা সাহেবকে আমাদের ঘরের জন্য খাবার জল পাঠাতে বলে, ঘরে চলে এলাম। এখানে ঠান্ডার প্রকোপ অত্যন্ত বেশি, তাই বোধহয় একটু পরে তিনি একটি জগে করে ও একটি বড় ফ্লাস্কে করে মোটামুটি বেশ গরম জল দিয়ে গেলেন। ক্যামেরা ও মোবাইল চার্জে বসিয়ে, গরম জল খেয়ে, কম্ফোর্টারের নীচে আশ্রয় নিলাম।

আজ ডিসেম্বর মাসের উনিশ তারিখ। ঘুম ভাঙলো বেশ সকালে। আজ এখান থেকে প্রাতরাশ সেরে আমাদের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা। কয়েকটা দেখবার স্থান থাকলেও, জানা গেল, যে সময় খুব একটা বেশি লাগার কথা নয়। জলখাবার খেয়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। ফুরবা সাহেব জানালেন, নীচে গাড়ি এসে গেছে। আজ যদিও সবাই প্রায় খালি হাতে যাচ্ছে, তবু ফুরবা সাহেব দুজন মহিলা ও হিমাদ্রিদাকে নিরাপদে নীচের রাস্তা পর্যন্ত নামতে সাহায্য করার জন্য আমাদের সাথে চললেন। অল্পবয়সি ড্রাইভার ছেলেটিকে আমাদের আগামীকাল সিটং পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে সে জানালো, যে সিটং যাওয়ার জন্য হয় পশ্চিম বঙ্গের গাড়ি, নাহয় সিকিম ও পশ্চিম বঙ্গ উভয় রাজ্যে চলার অনুমতি প্রাপ্ত কোন গাড়ির সাথে কথা বলতে হবে। তার গাড়ির বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গে ঢোকার অনুমতি না থাকায়, তার পক্ষে গাড়ি নিয়ে সিটং যাওয়া সম্ভব হবে না। যাইহোক, আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম, গাড়ি ছেড়ে দিলো।

প্রথমেই আমরা ছায়া তালে গিয়ে হাজির হলাম। জায়গাটা কিন্তু খুব সুন্দর। জায়গাটার নাম ছায়া তাল, গেটের বাইরে এখানে একটি ছোট্ট তাল বা লেকও আছে বটে, তবে বর্ষার সময় ছাড়া অনেক সময়েই এই লেকের জল শুকিয়ে যাওয়ায়, এই লেকটি শুখিয়া পখরি নামেও স্থানীয় মানুষদের কাছে পরিচিত। এখানে গেট দিয়ে প্রবেশ করার জন্য ত্রিশ টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। গেট দিয়ে ঢুকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুল ও অন্যান্য গাছপালা, লাইট দিয়ে সাজানো পাহাড়ের পাশ দিয়ে লাল রাস্তা অনেকটা ওপর পর্যন্ত উঠে গেছে। ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠা বা নীচে নামার সময়, বার বার কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন, অবশ্য একটা উপরি পাওয়া। একবার ওপরে Mahatma Teyoengsi Sirijunga নামে এক ব্যক্তির একটি বেশ বড় মূর্তি আছে। ওপরে ওঠার রাস্তাটি চক্রাকারে পাক খাইয়ে খাইয়ে এত ধীরে বহু ওপরের মূর্তিটির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যে বয়স্ক মানুষদের পক্ষে তো বটেই, হাঁটুর সমস্যায় জর্জরিত মানুষের পক্ষেও ধীরে ধীরে একবারে মূর্তিটির কাছে বিশেষ শারীরিক কষ্ট ছাড়াই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।

জানা গেল, যে শহীদ সিরিজুঙ্গা সতেরোশ’ চার সালের বারোই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন লিম্বু সম্প্রদায়ের একজন ঐতিহাসিক, দার্শনীক, পণ্ডিত, ভাষাবিদ ও শিক্ষাসংস্কারক। তিনি প্রাচীন লিম্বু ভাষার সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সতেরোশ’ একচল্লিশ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও, মৃত্যুটা ছিল অস্বাভাবিক। গাছের সাথে বেঁধে বিষাক্ত তীর মেরে তাঁকে হত্যা করা হয়। সম্ভবত তিব্বতি লামা বা ভুটিয়া সৈনিকদের দ্বারা তিনি নিহত হন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখে সিকিমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, শ্রী পওন কুমার চামলিং এই বিশেষ ব্যক্তিটির তিন শত তেরো জন্ম বার্ষিকীর প্রাক্কালে, এই মূর্তিটির উদ্বোধন করে জনসাধারণকে উপহার দেন।   

যাইহোক, এবার আমরা হী গ্রামে অবস্থিত, হী পুল ও হী ওয়াটার গার্ডেন দেখতে এলাম। রিংচেনপঙ থেকে এর দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। নদীটির ওপর একটি বেশ লম্বা ব্রিজ আছে। ব্রিজটির ঠিক পাশ দিয়ে আমরা এই ওয়াটার গার্ডেনে প্রবেশ করলাম। এই ওয়াটার গার্ডেন বা ওয়াটার পার্কটির অবস্থা আদৌ সুবিধার নয়, বিশেষ কেউ এই পার্কটি দেখতে আসেন বলেও মনে হলো না। টিকিট কেটে ঢুকতে হয় কী না সঠিক বোঝা গেল না, তবে আমাদের দেখে একটা বাচ্চা ছেলে টিকিট হিসাবে দশ টাকা করে দাবি করলো, যদিও তার হাতে কোন টিকিট না থাকায়, স্বাভাবিকভাবেই সে কোন টিকিট দিতেও পারলো না। তবে এটা বেশ বোঝা গেল, যে অনেকদিন পরে আমাদের পার্কের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে, সে খুব খুশি হয়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যথেষ্ট সুন্দর, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ফুলগাছও আছে, নদীটিরও একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ তো আছেই। কিছুটা এগিয়ে গেলে একটি সুইমিং পুলের ব্যবস্থাও আছে দেখলাম, তবে তাতে জল নেই। ‘দ্বীপ ছিল শিখা ছিল, শুধু তুমিই ছিলে না বলে আলো জ্বললো না’। বাধ্য হয়ে, পুলের পাশে বসে মনের দুঃখে, ‘সুইমিং পুল ছিল ইচ্ছাও ছিল, শুধু জল ছিল না বলে নামা হলো না’ গেয়ে ফিরে এলাম। জায়গাটা সুন্দর সন্দেহ নেই, তবে এত অবহেলিত কেন বোঝা গেল না।  

এখানে অযথা আর সময় ব্যয় করার কোন অর্থ হয় না। আমরা বার্মিয়ক হয়ে, কালুক হয়ে, একটা মন্যাস্টারির সামনে এসে দাঁড়ালাম। তোরণের মতো গেট পেরিয়ে সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেলে, এই মন্যাস্টারিটির কাছে যাওয়া যায়। জানা গেল, যে সতেরোশ’ ত্রিশ সালে তৈরি এটাই সিকিমের তৃতীয় পুরাতন রিংচেনপঙ মন্যাস্টারি। মন্যাস্টারিটি খুবই সুন্দর, কিন্তু মন্যাস্টারিটির কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া না থাকলেও, গেটটি টেনে বন্ধ করা আছে। পাশেই একটি বেশ বড় ও সুন্দর চোরতেন আছে। আরও জানা গেল, যে এটিকে নাকি ভুটিয়া মন্যাস্টারিও বলা হয়ে থাকে, এবং এটি এখন বন্ধ আছে। বিকাল চারটের সময় এর গেট আবার খুলবে। কোলাপসিবল গেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু ছবি নিয়ে ও চোরতেনের কিছু ছবি নিয়ে ফিরে আসার সময় দেখলাম, বিস্তীর্ণ মাঠে ও গাছের ডালে এই মন্যাস্টারির লামা বা অন্যান্য কর্মীদের রঙিন কাপর কেচে শুকতে দেওয়া হয়েছে। শুনলাম এখানে লামাদের স্কুল আছে, যেখানে প্রায় একশত বিভিন্ন বয়সের লামা বসবাস করে। এখানে লোকজন বা পর্যটক খুব একটা চোখে পড়লো না বটে, তবে ফেরার পথে তোরণের মতো গেটটার পাশে কিন্তু হোটেল ল্যান্ডস্কেপ নামে তিনতলা একটা বেশ বড় হোটেল চোখে পড়লো। জানি না এখানে হোটেল ভাড়া নিয়ে কে থাকে, কেনই বা থাকে। মন্যাস্টারিটার অন্য নাম সত্যই ভুটিয়া মন্যাস্টারি কী না, সঠিক ভাবে তাও জানা সম্ভব হলো না।   

গাড়ি এগিয়ে চললো। একসময় আমরা গাছপালা জঙ্গলে ঘেরা পয়জন লেকের পাশ দিয়ে ব্রিটিশ বাংলোতে এসে হাজির হলাম। শোনা যায়, যে উনবিংশ শতাব্দিতে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই ছোট্ট শান্ত গ্রামটি, একজন সিকিমিজ রানী শাসন করতেন। তিনি তাঁর গ্রাম বা দেশকে খুবই ভালবাসতেন। সম্ভবত আঠারোশ’ ষাট সালে, অত্যাচারী ব্রিটিশ সেনা আধিকারিকরা যখন এই শান্তশিষ্ট রিংচেনপোঙ গ্রামে ব্রিটিশ সৈনসামন্ত পাঠান, তখন তাঁদের থাকা ও ব্যবহারের জন্য একটি বাংলো নির্মান করা হয়। বাংলোর জলের প্রয়োজন মেটাতে, তাঁরা পাশের লেকটির সাথে সরাসরি বাংলোর যোগাযোগ স্থাপন করেন। নিদা নামক এই লেকটিই ছিলো সমগ্র গ্রামটির পানীয় জল সরবরাহের একমাত্র উৎস। এই গ্রামটির ভূমিপুত্র লেপচারা নিজেদের স্বাধীনতা হারিয়ে, ব্রিটিশদের অত্যাচার ও প্রচণ্ড জলসঙ্কটে বিপর্যস্ত হয়ে, অত্যাচারী ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য, শেষপর্যন্ত ওই লেকের জলে হিমালয়ের ভেষজ বিষ মিশিয়ে দেন। এরপর ওই লেকের জল ব্যবহারের ফলে নাকি বহু ব্রিটিশ সৈনিকের মৃত্যু হয়, এবং শেষপর্যন্ত উভয়পক্ষের মঙ্গলের জন্য একটি চুক্তিপত্রে সাক্ষর করতেও তাঁরা বাধ্য হন এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এই এলাকা পরিত্যাগ করে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এই ব্রিটিশ বাংলোটি বর্তমানে পি.ডাবলিউ.ডি গেস্ট্ হাউস হিসাবে পরিচিত। পয়জন লেকটির অস্তিত্ব বর্তমানে আর নেই বললেই চলে। এটিকে বর্তমানে জঙ্গলে ঘেরা প্রায় জলশূন্য একটি পুকুর বলা যেতে পারে। তবে আজ এতগুলো বছর পরেও কিন্তু নিদা নয়, পয়জন লেক হিসাবেই তার খ্যাতি আজও বিরাজমান। স্থানীয় মানুষ নাকি বিশ্বাস করেন, যে এই লেকের জল আজও বিষাক্ত। ঘটনার সত্যতা ঠিক কতটা আমার সঠিক জানা নেই, তবে বর্তমানে রাসায়নিক যুদ্ধ নিয়ে আমরা চায়ের কাপে যতই ঝড় তুলি না কেন, রাসায়নিক যুদ্ধের ধ্যান ধারণা যে নতুন নয়, অন্যায় অত্যাচারের শিকার সাধারণ দরিদ্র মানুষগুলোর মনেও যে আত্মরক্ষার্থে সেই চিন্তা এসেছিল, এটা তারই উদাহরণ। এই ঘটনা তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল নিদর্শনটা আজও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যাইহোক, বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে ব্রিটিশ বাংলোকে বাইরে থেকে দেখে ও ছবি তুলে, ও দূর থেকে পয়জন লেকের কিছু ছবি তুলে, একসময় আমরা ধীরে ধীরে নিজেদের গাড়িতে এসে বসলাম।   

আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো। একসময় আমরা একটা মন্যাস্টারির সামনে গাড়ি থেকে নামলাম। এই মন্যাস্টারিটি যদিও খোলা আছে, তবু এখানেও সঠিকভাবে মন্যাস্টারিটার নাম জানার সুযোগ পেলাম না, বা কোন বোর্ডও দেখলাম না। তবে শুনলাম, যে এটির নাম নাকি গুরুং মন্যাস্টারি। মন্যাস্টারিতে প্রবেশ করার আগে, একপাশে জুতো খুলে রাখার সময় এক ভদ্রলোককে দেখলাম একা দাঁড়িয়ে থাকতে, ও অপর দুই যুবককে দেখলাম একটা বেশ বড় কায়দা কানুন করা ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে। বুঝলাম, এনারা ভালো ফটোগ্রাফার। জুতো খুলে খালি পায়ে মন্যাস্টারির ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরের মূর্তিগুলো একবারে ঝাঁচকচকে করে রাখা হয়েছে। পর পর অনেকে বসে ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করার ব্যবস্থা করা আছে দেখলাম। আর দেখলাম একপাশে অনেকগুলো  সানাইয়ের মতো উজ্জ্বল বাঁশি দাঁড় করানো আছে। এগুলো কারা বাজান, কখনই বা বাজান, জানার সুযোগ হলো না। যাইহোক, মন্যাস্টারির ভিতরে ও বাইরে কিছু ছবি তোলার পর জুতো পরার সময় সেই একা দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, যে আমরা বাঙালি কী না। তাঁকে জানালাম, যে আমরা পশ্চিম বঙ্গ থেকে এসেছি এবং আমরা বাঙালি। এবার তিনি বললেন, সামনেই একটা রবীন্দ্র নাথের নামে স্মৃতি ফলক আছে, আমরা জানি কী না। আমরা জানালাম, যে আমাদের জানা নেই। তিনি এবার বেশ উৎসাহিত হয়েই বললেন, যে সামনে কিছুটা দূরেই একটা ভিউ পয়েন্ট মতো আছে, যেখানে বসে রবীন্দ্র নাথ গীতাঞ্জলি লিখেছিলেন, সেটা আমরা জানি কী না। হিন্দিতে কথা বলার মধ্যে আমার অনেক সমস্যা আছে, তবু তাঁকে কোনমতে বললাম, যে গীতাঞ্জলি কোন একদিন বসে, বা নির্দিষ্ট কোন এক স্থানে বসে, আদৌ লেখা হয়নি। রবীন্দ্র নাথ বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন লেখা, তাঁর গীতাঞ্জলিতে স্থান দিয়েছিলেন।  তিনি অবশ্য জানালেন, যে এটা তাঁর জানা ছিলো না। আমি ও তরুণ রবীন্দ্র স্মৃতি ফলকের সন্ধানে এগিয়ে গেলাম।  

এই মন্যাস্টারিটার পাশেই আর একটা ঠিক মন্যাস্টারির মতো দেখতে বাড়ি। জানা গেল, ওটা একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ভিতরে পালিশের কাজ হচ্ছে। এই বাড়িটির ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল না। বাইরে থেকে ছবি তুলে রবীন্দ্র স্মৃতি ফলক ও ভিউ পয়েন্টের খোঁজে এগলাম। রাস্তার পাশে সাদা পাথরের ফলকটি চোখে পড়লো, যদিও বর্তমানে লেখাগুলো অনেকাংশেই অস্পষ্ট। ২০০০ সালের পাঁচই জুন, সিকিম সরকারের স্যোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের মাননীয় মন্ত্রী, শ্রী ডি.টি.লেপচা এটি উদ্বোধন করেন। দেখলাম, ছবি নিলাম, এবং ভিউ পয়েন্টের সন্ধানে এগিয়ে গেলাম। এখানে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, ফটোগ্রাফার দুজন রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে ফটো তোলায় ব্যস্ত। একসময় আমরা রঙিন কাজ করা ছোট একটা মন্দিরের মতো জায়গায় এসে হাজির হলাম। জানা গেল, যে এটিই সেই ভিউ পয়েন্ট। অল্প বয়সি কয়েকটি ছেলে মেয়ে এখানে গুলতানি করছে দেখলাম। যে ভদ্রলোক আমাদের বলেছিলেন, যে এখানে বসে কবিগুরু গীতাঞ্জলি লিখেছিলেন, এবার তিনি তাঁর পরিচয় দিয়ে জানালেন, যে সিকিম সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছে, এবং অপর দুজন ফটোগ্রাফারকে দিল্লি থেকে রবীন্দ্র স্মৃতি ফলক ও ভিউ পয়েন্টের নতুন করে সংস্কার করে একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরির ব্যাপারে সার্ভে করতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আমাদের যেকোন একজনের একটা সাক্ষাৎকার রেকর্ড করতে চান। শুনে তো আমি বেজায় ঘাবড়ে গেলাম, রবীন্দ্র নাথের ওপর আমি হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দিলে, সেই প্রকল্প অঙ্কুরেই বিনাশ হতে বাধ্য। যাইহোক, শেষপর্যন্ত তরুণের জামার সাথে ছোট্ট মাউথ পিস লাগিয়ে, ক্যামেরা ফিট করে, পাশের অল্প বয়সি ছেলে মেয়েদের কথা বলতে বারণ করে, বেশ কিছুক্ষণের একটা বক্তব্য রেকর্ড করা সম্পন্নও হলো। ভাবতেও ভালো লাগলো, যে আমরা যখন বাঙালি হয়েও শান্তি নিকেতনের পাঁচিল ভাঙায় ব্যস্ত, পাশের রাজ্য তখন কবিগুরুর স্মৃতি নতুন করে উদ্ধারের চেষ্টায় আগ্রহী। 

যাইহোক, অনেক বেলা হয়ে গেছে, এবার ফিরতে হবে। নীচে নেমে এসে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। একসময় ফুরবা সাহেবের ডেরায় পৌঁছানোর সাথে সাথে, ফুরবা সাহেব আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আগে খেয়ে নিতে বললেন। তিনি জানালেন, যে আমাদের হাঁটার সুবিধার্থে তিনি আমাদের পাঁচজনের জন্য, বাঁশবন থেকে পাঁচটা মজবুত কঞ্চির লাঠি কেটে রেখেছেন। গাড়ির ড্রাইভার বিদায় নিয়ে চলে গেল।   

আমরা সাধারণত বাইরে বেড়াতে গেলে পারতপক্ষে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেই। দুপুরবেলা ভাত বা রুটি কিছু একটা খেতেই হবে, তাও মনে করি না। টুকটাক খাবারের ওপর থেকে, আমরা কিন্তু বেশ ভালোই থাকি। গতকাল আমরা এখানে আসার আগেই ফুরবা সাহেবের দুপুরের রান্না প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায়, দুপুরে সকলেই ভাত খেয়েছিলাম। রাতে অবশ্য হিমাদ্রিদা ছাড়া আর সকলেই রুটি খেয়েছিলাম। আজ এই ঠান্ডায় এত বেলায় আর ভাত খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু রুটির কথা বলে না যাওয়ায়, সকলের জন্যই ভাতের ব্যবস্থা হয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং হলে গিয়ে হাজির হলাম এবং খাবার টেবিলে হটপটের ভিতর প্রতিটা খাবারই উত্তপ্ত দেখে বিষ্মিত হলাম। যাইহোক, আজ আর কোথাও যাওয়ারও নেই, তাই খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ ঘরের বারান্দায় ও সেই ছাউনিতে বসে কাটালাম। আগামীকাল সকালে প্রাতরাশ সেরে ফুরবা পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আমাদের কমলা লেবুর রাজ্য, সিটংয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার কথা। ফুরবা সাহেব এসে হাজির হলেন, তাঁকে গাড়ির ব্যাপারটা আবার একবার স্মরণ করিয়ে দিলে, তিনি আমাদের চিন্তা করতে বারণ করে জানালেন, যে গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমরা আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে, একটু বিশ্রামের আশায় একে একে যে যার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

অন্যান্য জায়গার হোমস্টেগুলোর মতো এখানে দেখলাম, সন্ধ্যায় কোন পকোড়ার ব্যবস্থা করা হয় না। সকাল ও সন্ধ্যায় চায়ের সাথে যথেষ্ট পরিমাণে হাইড অ্যান্ড সীক জাতীয় একটা বিস্কুট দেওয়া হয়। অপর দুটি ঘর যারা ভাড়া নিয়ে এসেছে, তাদের অল্প বয়স ও দলেও বেশ কয়েকজন হওয়ায়, তারা তাদের ঘরের পাশে বন ফায়ার ও চিকেন বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা করলেও, আমরা পাঁচ বুড়োবুড়ি এবার সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলাম। ফুরবা সাহেবের একটা সাদা রঙের ছোট্ট কুকুর আছে। গতকাল সন্ধ্যায়, আজ ভোরে, এবং আজ সন্ধ্যায়ও দেখলাম, চা বিস্কুট দিয়ে গেলে, সে আমাদের সুপ্রভাত ও শুভ সন্ধ্যা জানাতে ঠিক চলে আসে। তবে সে কিন্তু ভুলেও ঘরের ভিতর প্রবেশ করে না। আজ দেখলাম, সে আমাদের শুভ সন্ধ্যা জানিয়ে,  পাশের দলটার বারবিকিউ রান্নায় সাহায্যের পা বাড়াতে সেখানে গিয়ে হাজির হলো।  

সন্ধ্যার পর ফুরবা সাহেব এসে হাজির হয়ে যে দুঃসংবাদটা শোনালেন, তাতে মাথা ঘুরে গেল। তিনি জানালেন, যে তিনি সিটং যাওয়ার গাড়ির ব্যাপারে একজনের সাথে ফোনে কথা বলেছেন বটে, তবে সে সাত হাজার টাকা ভাড়া চাইছে। আমরা তো ঘাবড়ে গেলাম, না গেলেও নয়, আবার অতগুলো টাকা ভাড়া দেওয়াও বাস্তবে সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য আমাদের চিন্তা করতে বারণ করে আমাদের সামনেই একে একে কয়েকজনকে ফোন করলেন। তিনি জানালেন, যে গাড়ির ব্যাপারে যা কথাবার্তা হবে, সেটা আমাদের সাথে বা আমাদের সামনে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যাইহোক, শেষপর্যন্ত একজনের সাথে পাঁচ হাজার টাকায় MOU চুক্তি করতে বাধ্য হলাম। সে জানালো, যে সিটং প্রায় ১৪৫-১৫০ কিলোমিটার রাস্তা, এবং রাস্তার অবস্থাও খুবই খারাপ, সে যেহেতু কাল এনজেপি যাবে, তাই আমাদের সিটং পৌঁছে দিয়ে যাবে, তবে তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া পড়ে যাবে। ছোট্ট জায়গা গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যাও যথেষ্ট কম, তার ওপর রাত বাড়ছে, তাই বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত রাজি হতেই হলো। 

রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ছাউনির ভিতর বসে অনেকক্ষণ দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে কেটে গেল। আকাশ একবারে পরিষ্কার, তাই দূরের পাহাড়ের গায়ে অজস্র আলো, এমনকী স্কাই ওয়াকের আলোকিত বুদ্ধমূর্তিকে পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাওয়া গেল। এই ফুরবা পরিবারের আন্তরিকতার তুলনা হয় না। রিংচেনপঙয়ের এই ফুরবা সাহেবের মধ্যে কোথায় যেন শ্রদ্ধেয় বনফুলের গল্পের, সেই সুদূর হরিদ্বারের বিশ্বাস মশাইয়ের ছায়া দেখতে পেলাম।

আজ ডিসেম্বর মাসের বিশ তারিখ, আজ আমাদের সিকিম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে কিন্তু খুব খারাপ লাগছে। এর আগে পেলিং বা রাভাংলা ছেড়ে চলে আসার সময় এত খারাপ লাগেনি। এই জায়গাটার মতো আগের দুটো জায়গাও তো বেশ সুন্দর ছিল। হয়তো ঘরের বিলাসিতা, স্বাচ্ছন্দ্য, ও আরাম আয়েশের পরিমাণ সেখানে কিছু বেশিই ছিলো, তবু আন্তরিকতা ও ভালবাসা যে অনেক সময় আর সবকিছুকে ছাপিয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, এই দরিদ্র ফুরবা সাহেব চোখে আঙুল দিয়ে আজ আবার একবার দেখিয়ে ও শিখিয়ে দিলেন।

সীমা বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও, আমরা রাভাংলা বা রিংচেনপঙয়ের মতো, সিটংয়েও কোন থাকার জায়গা পাকা করিনি। শেষে দিন তিনেক আগে ফোন করে দেখা গেল, যে অহলদারা ভিউ পয়েন্টের হোমস্টে তো দূরের কথা, কোন হোমস্টেতেই থাকার জন্য জায়গা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো, যে শেষে সিটংয়ের পরিবর্তে কালিম্পং বা কার্সিয়াংয়ে থাকার কথা চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করতে হলো। শেষে সিটং তিন-এর শেলপুতে নেচার লাভার হোম স্টের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল, যে তারা দুটো চারশয্যার ঘর, আমাদের পাঁচজনের জন্য ব্যবস্থা করতে পারেন। থাকা খাওয়া বাবদ মাথাপিছু প্রতিদিন দেড় হাজার টাকা করে ভাড়া পড়বে। শেষপর্যন্ত কথা বলে মাথাপিছু এক হাজার চারশ’ টাকায় ভাড়াটা নামিয়ে আনা গেল। ঠিক হলো, আজ কুড়ি তারিখে আমরা সোজা সিটং চলে যাবো। আজকের দিনটা সেখানে কাটিয়ে, আগামীকাল আমরা বিভিন্ন স্পট দেখতে দেখতে এনজেপি গিয়ে রাত আটটার দার্জিলিং মেল ধরবো।

একসময় প্রাতরাশ পর্বও সমাপ্ত হলো। জানা গেল, যে নীচে আমাদের রথও এসে উপস্থিত। ফুরবা সাহেব আমাদের সবাইকে একজায়গায় দাঁড়াতে অনুরোধ করলেন। প্রথমে ভেবেছিলাম স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে হয়তো ছবি নিতে চান, কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, ফুরবা সাহেব তাঁর গোটা পরিবার বা হোমস্টের সমস্ত সদস্য সদস্যাকে নিয়ে আমাদের উত্তরীয় জাতীয়, যাকে ওনারা খাদা বলেন, গলায় পরিয়ে বিদায় জানালেন। ফুরবা সাহেব জানালেন, যে এটা নেপালি খাতা, এটা কিন্তু বাই বাই এর জন্য নয়, এটা ওয়েলকামের জন্য করা হলো। এবার কিন্তু সত্যিই একটা মন খারাপের ভাললাগা আমাদের গ্রাস করলো। হোমস্টের বাগানে কিছু ক্যাকটাস্ ও বাহারি গাছ দেখে আমার স্ত্রীর খুব পছন্দ হয়েছিল। সে ফুরবা সাহেবের কাছে দু’-একটা গাছ নিয়ে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, যদিও আমি জানিয়েছিলাম, যে এখান থেকে গাছ নিয়ে গিয়ে বাঁচানো সম্ভব নয়, তবু এখন ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে দেখা গেল, ফুরবা সাহেবের স্ত্রী ঠিক মনে করে কিছু গাছ ছিঁড়ে কাগজে মুড়ে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে দিলেন। সুখের কথা, সেই গাছগুলো কিন্তু স্মৃতি রক্ষার্থে আজও জীবিত আছে।

এবার সত্যিই বিদায় নেওয়ার পালা। বিদায় রিংচেনপঙ, বিদায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ হোমস্টে, বিদায় ফুরবা সাহেব, মাত্র দুটো দিনে তুমি যে আত্মীয়তার সৃষ্টি করলে, সারা জীবনে তা ভোলার নয়। তোমরা ভালো থেকো। নীচে নামার সময় তিনি কষ্ট লাঘব করতে সবার হাতে একটা করে কঞ্চি ধরিয়ে দিলেন। সমস্ত মালপত্র ওনারাই নীচে গাড়ির কাছে পৌঁছে দিলেন। দীপ্তেশ নামে গাড়ির ড্রাইভারটি গাড়ির ছাদে মাল গুছিয়ে রেখে নিজের আসনে বসলো। একসময় গাড়ি ছেড়েও দিলো।

একসময় আমাদের গাড়ি রঙ্গীত নদীর পাশ দিয়ে দিয়ে গিয়ে, রেশি টানেলের ভিতর দিয়ে, আক্কর ব্রিজের ওপর দিয়ে, জোরথাং এসে পৌঁছলো। যাওয়ার সময় এইপথে যে আনন্দ ও উত্তেজনা বোধ করেছিলাম, এখন আর তার লেশমাত্র নেই। নেই, তার কারণ আমরা ফিরে যাচ্ছি, আজই আমাদের এই ট্যুরের শেষ রাত্রি, আগামীকাল রাতটা আমাদের ট্রেনে কাটবে। মাল্লি বাজার অঞ্চলে ঢুকবার আগে দীপ্তেশ আমাদের মাস্ক পরে নিতে বললো। এখানে দেখলাম মাস্ক নিয়ে কিছু কড়াকড়ি ও ধরপাকড় চলছে। তিস্তার পার দিয়ে গিয়ে একসময় সেই রাফ্টিং পয়েন্টের কাছে এসে পৌঁছলাম। সিটংয়ের রাস্তা দেখলাম ক্রমে খারাপ হচ্ছে। রাস্তাও যেন আর শেষ হয় না। সিটংকে সম্ভবত এক দুই ও তিন, তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমাদের হোমস্টে সিটং তিন-এ অবস্থিত বলে কিনা জানি না, ড্রাইভার কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারছে না। হোমস্টের মালিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে দীপ্তেশকে ফোনটা ধরিয়ে দেওয়া হলো। হোমস্টের মালিক জানালেন, যে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি, তিনি নাকি আমাদের গাড়িটা দেখতেও পাচ্ছেন, অথচ তাঁকে এগিয়েও আসতে দেখলাম না, পথও আর শেষ হয় না। রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ, যে দীপ্তেশ বেশ বিরক্তও হচ্ছে। একবার তো মনে হলো পাঁচ হাজার টাকা নয়, পনেরো হাজার টাকা চাইলেও, সে বিশেষ অন্যায় করতো না। ভয় হলো, শেষে ভিক্ষা চাই না তোর কুত্তা সামলা, রইলো তোর সিটংয়ের হোমস্টে, আমার টাকা চাই না, আমি ফিরে চললাম বলে না আমাদের নামিয়ে দেয়। শেষপর্যন্ত হোমস্টের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো।

হোমস্টের মালিক তাঁর হোমস্টের সামনেই একটা চেয়ারে বসেছিলেন। তাঁর ঠিক সামনে চারটে বাচ্চা মেয়ে একটা বেশ বড় দোলনায় দোল খেতে ব্যস্ত। প্রথম দর্শনে কিন্তু হোমস্টে, হোমস্টের মালিক, বা আশেপাশের পরিবেশ, কোনটাই বিশেষ পছন্দ হলো না। হোমস্টের গঠনটাও একটু গোলমেলে। রাস্তা থেকে দরজা দিয়ে ঢুকে একটা কমোন বৈঠকখানা মতো, এর ডানপাশে পাশাপাশি দুটো ঘর, সেগুলোয় হাওড়ার দুটো পরিবার রয়েছেন। বৈঠকখানার মধ্যে দিয়ে ওপরে সিঁড়ি উঠে গেছে, সেখানে সরু কমোন ব্যালকনি এবং পাশাপাশি দুটো ঘর। ঘরগুলো বেশ ছোট, তবে জায়গা থাক বা না থাক, জোর করে দুটো ডবলবেড পেতে দেওয়ায়, এগুলোই চারশয্যা ঘরের তকমা লাভ করেছে। দোতলা বা একতলার ঘরগুলো অবশ্য অ্যাটাচড বাথ। এই ব্যালকনি থেকে দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায়। রাস্তা থেকে একতলার কমোন বৈঠকখানায় না ঢুকে,  ডানপাশের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলে, চেয়ার টেবিল পাতা হোমস্টের খাওয়ার জায়গা। এখানে বসে পাহাড়ের শোভা দর্শন করতে করতে দিব্যি খাওয়ার সুযোগ মেলে। ডাইনিং স্পেসের ঠিক পাশে, ছোট্ট একটা চা বাগানও করা হয়েছে দেখলাম। এখানে বসে চায়ের স্বাদ না পাওয়া গেলেও, চা বাগানের সৌন্দর্য দর্শন অবশ্যই পূরণ করে। ডাইনিং স্পেসের অন্যপাশে আরও একটি চারশয্যার ঘর। এই ঘরটা হয়তো দোতলার ঘরটার তুলনায় কিছু বড়ই হবে, তবে এটা হিমাদ্রিদাকে একা দেওয়া হলো। দোতলার ঘরটায় আমি ও তরুণ পরিবার নিয়ে থাকলাম। এতে আমাদের উভয় পরিবারেরই কিন্তু কোনদিনই বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না। অতীতে ভালো ঘর নিজেদের দখলে রেখেও, ভ্রমণসঙ্গীদের অশান্তি করতে দেখেছি, অথচ বেশ মনে পড়ে, মধ্যপ্রদেশ ট্যুরে উজ্জয়িনীতে একটা বড় ঘরে পরপর পাঁচজন শোয়ার জায়গায়, তরুণরা মেয়ে নিয়ে তিনজন ও আমরা দুজন পাশাপাশি দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আসলে তরুণ আমার নিজের ভাইয়ের মতো, এবং সীমার সাথে সম্পর্কটা কোনদিনই বন্ধুস্ত্রী নয়, অনেক ছোট বোনের মতো। সম্পর্কটা কোনপক্ষই কোনদিন ভাশুর ভাদ্র বউয়ের পর্যায়ে আনতে দেইনি। কাজেই এবারেও ছোট্ট ঘরটায় চারজনে দিব্যি নিজ নিজ সংসার পেতে গুছিয়ে বসলাম।  

মালপত্র গুছিয়ে রেখে, নীচে নেমে এসে চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম। বাচ্চাগুলো এখনও দোলনা নিয়ে ব্যস্ত। ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটা একতলার বাঙালি পরিবারদের সাথে এসেছে। হোমস্টের মালিক পরিষ্কার বাঙলায় কথা বললেও, তাঁকে দেখে সিকিম বা পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বলে মনে হলো না। আলাপ হলো, ভদ্রলোকের নাম মহেশ প্রসাদ, বাড়ি বিহারের পূর্ণিয়ায়। কথাপ্রসঙ্গে ভদ্রলোক জানালেন, যে ছোটখাটো কন্ট্রাক্টারি ব্যবসার কাজে আরও অনেক জায়গার মতো আঠাশ বছর আগে এখানে এসে উপস্থিত হন, তারপর থেকে আর ফিরে না গিয়ে, এখানকার এক মহিলাকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যান, এবং ধীরে ধীরে এই হোমস্টেটি গড়ে তোলেন। ভদ্রলোক জানালেন, যে আমাদের দুপুরের খাবার প্রস্তুত, কাজেই আমরা যেন হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার জায়গায় চলে আসি।

খাওয়ার জায়গায় টেবিলের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছু অপ্রতুল হওয়ায়, এবং একতলার দুটো ঘরের সেই বোর্ডাররা বাচ্চাটাকে নিয়ে খেতে বসায়, আমাদের দলের দুজন মহিলাকে একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে, আমাদের তিনজনকে একটু এগিয়ে একটা বড় হলঘরের মতো জায়গায় টেবিল পেতে খাওয়ার জায়গা করে দেওয়া হলো। এটা হোমস্টের রান্না সংক্রান্ত সবকিছু রাখার জায়গা, এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত বোর্ডারদের সম্ভবত খাওয়ার জায়গা হিসাবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাশেই বেশ বড় ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর। এই স্থানটিরই একদিকে, সম্ভবত মহেশজী তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। এখানে দেখলাম, কাঁসার থালায় খেতে দেওয়ার চল আছে। এর আগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে, পূর্ব মেদিনীপুরের চাঁদপুরের রিসর্টিতে এই ব্যবস্থা লক্ষ্য করেছিলাম, তবে সেখানকার থালা গ্লাস বাটি সবকিছুই ছিল কাঁসার, ও অনেক বেশি উজ্জ্বল। যাইহোক, খাওয়া শুরুর আগে দেখলাম মহেশজীর পুত্র, আমাদের হলুদ রঙের উত্তরীয় গলায় পরিয়ে দিয়ে অভ্যর্থনা করে খেতে বসালেন। ব্যাপারটা খুব একটা খরচা বা ঝামেলাসাপেক্ষ নয়, কিন্তু বোর্ডারদের মনে এটা যে একটা বিশেষ প্রভাব ফেলে, অস্বীকার করি কিভাবে?

মহেশজী স্বয়ং সারাক্ষণ আমাদের তিনজনের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে, আমাদের খাওয়ার তদারকি করে গেলেন। এখানে খাওয়া দাওয়াটাও কিঞ্চিৎ রাজকীয় বলে মনে হলো। মহেশজী জানালেন, যে নদীর টাটকা মাছ পাওয়া গেছে, তাই তিনি আমাদের জন্য মাছের ব্যবস্থা করেছেন। ভাত, ডাল, শাকভাজা, আলুভাজা, ফুলকপির তরকারি, নদীর টাটকা কাতলা মাছের ঝোল, পাঁপড় ভাজা, টক দই, না রসগোল্লা না দানাদার জাতীয় একটা মিষ্টি, ও আপেল দিয়ে আহার সেরে উঠে দাঁড়ালাম। দলের আর সবাই এহেন আহারের পরে একটু শবাসন বা যোগনিদ্রার ব্যবস্থা করতে গেলেও, আমি ও তরুণ একটু পাড়া চরতে বেরোলাম।

মাটির কাঁচা রাস্তা, দুপাশে গাছপালা জঙ্গল। বাঁপাশে বহুদূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এখনও তাঁর সাদা পোশাক পরিবর্তন করেননি। সামান্য কয়েক পা এগিয়েই, বাঁপাশে একটা গোয়ালঘরে দুটো গরু বাঁধা আছে দেখলাম। কাছেপিঠে দ্বিতীয় বাড়ি নেই, কাজেই এরা সম্ভবত মহেশজীরই সম্পত্তি। এরাই সম্ভবত আজ টক দই খাইয়ে আমাদের তৃপ্ত করেছিলো। মহেশজী কাজের লোক, ভালো লাগলো দেখে। আজই ওনার এখানকার ঠেক খুঁজে পেতে দীপ্তেশের মতো দক্ষ ড্রাইভারকেও হিমশিম খেতে হয়েছে, অথচ আঠাশ বছর আগে বিহারের কোন সুদূর পূর্ণিয়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এখানে এসে জরু গরু, সবকিছুর ব্যবস্থা করে, কিরকম গুছিয়ে বসেছেন। এনার পাশে কলম্বাসের কৃতিত্ব? নস্যি, স্রেফ নস্যি। আমরা শুধু ‘অবাঙিলিরা এসে বাংলায় রাজত্ব শুরু করেছে, এ উড়ে, সে মেড়ো, আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে’ ইত্যাদি তর্জন গর্জন করে, ও এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা করে কত সুখে আছি।

সামনেই কমলা লেবু বাগান। রাস্তা থেকেই যথেষ্ট দেখা যায়, গাছ থেকে পাড়তে দিলে একার পক্ষে সব ফল পাড়া সম্ভব নয়। তবু একবার বাগানের ভিতরটা ঘুরে দেখার সাধ হয় বইকি। লেবু বাগানের উলটো দিকে, রাস্তার ওপর এক বৃদ্ধ বাস করেন, ইনি সম্ভবত এই বাগানের কেয়ার টেকার। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে মনে হলো, বাগানে ঢুকে দেখতে দেওয়া তো কোন ছাড়, পঞ্চাশটা টাকা দিলে তিনি গোটা বাগানটাই লিখে দিতে প্রস্তুত। তরুণ অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ত্রিশ টাকা দিয়ে ভিতরে ঢোকার অনুমতি আদায় করলো বটে, কিন্তু এবার তিনি বললেন, দুজন আছো আর একজনের ত্রিশ টাকা কোথায়? যাইহোক, আমরা কিছুক্ষণ বাগানের ভিতর ঘুরে ফিরে ফটো তুলে বেরিয়ে আসার সময় বৃদ্ধ আমায় বললেন, আর একজন কোথায়? এর বেশি সময় ভিতরে থাকলে ডবল্ চার্জ লাগবে। যতক্ষণ বাগানের ভিতর ছিলাম, বৃদ্ধের পুত্রটিকে দেখলাম বাগান থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে একটার পর একটা লেবু খেয়ে যাচ্ছে। সে একা যতগুলো লেবু খেলো, বিক্রি করলে হয়তো তাদের পরিবারের সংসার খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। কেউ মরে বিল ছেঁচে, কেউ খায় কই বোধহয় একেই বলে। এখানেই রাস্তার পাশে আঁস্তাকুড়ের মধ্যে তাঁর দেখা পেলাম। দেখেই মনে হলো এর স্থান এখানে হওয়া উচিত নয়, এর স্থান হওয়া উচিত মুখের অনেক কাছে, ডাইনিং টেবিলের ওপরে, কিন্তু দুপুরবেলা পাকস্থলীর ওপর অত্যাচারটা একটু বেশিই হয়ে যাওয়ায়, সেই চিন্তা ত্যাগ করে হোমস্টের পথ ধরলাম।   

বিকালের দিকে একবার চা বিস্কুট, সন্ধ্যার পর পকোড়া ও কফি, ইত্যাদি দিয়ে বেশ ভালোই কাটলো। আগামীকাল আমাদের এনজেপি যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্পট ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মহেশজীকে একটা ভালো গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। গাড়ির পেছনে এটাই শেষ খরচ, তাছাড়া এ যা জায়গা, গাড়ি তো দূরের কথা একটা সাইকেলও জোগাড় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মহেশজী একটা বোলেরো প্লাস গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ভাড়া লাগবে সাড়ে চার হাজার টাকা। রাতের খাবারটাও বেশ জোরদার হলো। এখানে দেখলাম টক দই ও আপেলের টুকরো খাবারের পাতে দেওয়ার একটা চল আছে। ঘর ছোট ক্ষতি নেই, বিছানা তো বড়। আজ আবার চারজনে একঘরে ঢুকেছি, কাজেই খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বেশি রাত পর্যন্তই গুলতানি করে শুয়ে পড়া গেল।

আজ ডিসেম্বর মাসের একুশ তারিখ। ঘুম ভাঙলো বেশ সকালেই, কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ আমাদের ফিরে যাওয়ার দিন, আবার কবে বেরতে পারবো, আদৌ বেরতে পারবো কী না, কে বলতে পারে। একে একে তৈরি হয়ে নিয়ে নীচের ডাইনিং স্পেসে প্রাতরাশ সারতে গেলাম। রান্নাঘর ও খাবার ব্যবস্থা মহিলারা সামলালেও, আমাদের খাওয়ার সময় কিন্তু মহেশজী ঠায় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খাবারের ও প্রয়োজনের দেখভাল করে গেলেন। গাড়ি এসে হাজির হলো, বিল মিটিয়ে গাড়ির কাছে এসে হাজির হলাম। মহেশজী ও ওনার পুত্র, আমাদের মালপত্র গাড়ির কাছে এনে জড়ো করলেন। হাত মিলিয়ে, একসাথে ছবি তুলে, বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। বোলেরো প্লাস গাড়িটার অবস্থাই শুধু উত্তম নয়, গাড়ির চালকটির নামও উত্তম। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

প্রথমেই আমাদের গাড়ি কমলা লেবুর বাগানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। গতকাল আমি ও তরুণ বাগানে এসে ঘুরে গেলেও, হিমাদ্রিদা বা মহিলা দুজন দেখেনি। রাস্তার পাশে এত গাছ, ও তাতে এত লেবু হয়ে আছে, যে বাগানে ঢোকা তো দূরের কথা গাড়ি থেকে নামারও প্রয়োজন হয় না। অনেকেরই ইচ্ছা ছিলো কিছু কমলা লেবু কিনে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু শিলিগুড়ি মার্কেট থেকে গিফ্ট্ আইটেম কেনার পরিকল্পনা থাকায়, লেবুর হাত থেকে এই যাত্রা সহজেই মুক্তি পেলাম। গাড়ি এগিয়ে চললো, একসময় সিঙ্কোনা চাষের জমির পাশ দিয়ে গিয়ে,  অহলদারা ভিউ পয়েন্টের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলাম।

প্রথম দর্শনেই যে কোন মানুষ অহলদারার প্রাকৃতিক রূপ দেখে মুগ্ধ হতে বাধ্য, আমিও তার ব্যতিক্রম অবশ্যই নই। জায়গাটার সৌন্দর্য অনেক গুণ বৃদ্ধি করেছে, এখানকার হোমস্টের ঘরগুলোর অবস্থান ও সৌন্দর্য। ভিতরে ঢুকে দেখার সুযোগ ছিলো না, কিন্তু বাইরে থেকে দেখেই আপশোস হলো। নিজেদের মূর্খামি ও গোঁয়ার্তুমির জন্য এই স্বাদ গ্রহণ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত হতে হলো। এখানে দেখলাম, প্রচুর লোকের ভিড়। জায়গাটাতে অনেকক্ষণ ব্যয় করা যায়, আমরাও ঘুরে ফিরে ফটো তুলে, বেশ অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। তবে একটা ব্যাপার বেশ বুঝতে পারছিলাম। রান্না যথেষ্ট সুস্বাদু হলেও, আজ যেন রান্নায় কিরকম নুনের পরিমাণ বেশি বলে মনে হচ্ছে। আর তো মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরেই তো সেই ট্রেন যাত্রা, আর ট্রেন যাত্রার শেষেই আবার সেই থোড় বড়ি খাড়ার জীবন, সাথে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো লকডাউনের গর্ভযন্ত্রণা।

একসময় এগতেই হলো। গাড়িতে গিয়ে বসলাম, উত্তম নামে চালকটির ব্যবহারও সত্যিই বেশ উত্তম। গাড়ি ছেড়ে দিলো। ফেরার পথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে সিঙ্কোনা গাছের সাথে আমাদের ভালভাবে পরিচিত হবার সুযোগ করে দিলো। অল্প কিছুক্ষণ পরেই সে নামথিং পোখরি নামে একটা লেকের কাছে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো। জায়গাটা রাস্তা থেকে অনেকটা নীচে, তবে জল দেখলাম না। গোটা এলাকাটার সৌন্দর্য সত্যিই মনমুগ্ধকর। উত্তম জানালো, যে চুরুঙ্গি নামে কোন নদী নাকি এর জলের উৎস। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই লেকটি বর্ষার সময় প্রায় দশ-বারো ফুট জলের তলায় থাকে, ও গোটা এলাকাটা প্লাবিত করে। তবে অক্টোবর মাসের পর থেকে বৃষ্টির অভাবে ক্রমে ক্রমে এটি প্রায় জলশূন্য আকার ধারণ করে। জানা গেল, যে লাটপাঞ্চার অঞ্চলের এই প্রাকৃতিক লেকটির অবস্থান প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার ফুট উচ্চতায়।  বিলুপ্তপ্রায় বিরল প্রজাতীর উভচর হিমালয়ান সরীসৃপ, সালাম্যান্ডারের এটি আবাসস্থল। আগে এখানে সালাম্যান্ডার পালন হতো, এখনও হয়, তবে অনেকটা ভিতরে ও দূরে। সালাম্যান্ডারের সাথে আমরা বিশেষ পরিচিত নই বুঝতে পেরে, সে তার মোবাইল থেকে জীবটির সাথে আমাদের পরিচিতি করাবার চেষ্টাও করলো। উত্তম আরও জানালো, যে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতীর পাখি ও প্রজাপতির দেখা পাওয়া যায়। এখানে অনেকটা সময় কাটানো যায়, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, জায়গাটার শোভা দেখে ও ছবি তুলে,  অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। একসময় গাড়িতে গিয়ে বসতেই হলো, গাড়ি ছেড়ে দিলো।

গাড়ি এসে একটা চা বাগানের কাছে দাঁড়ালো। পাশে দেখলাম বিভিন্ন রকম চায়ের শিল্ড প্যাকেট বিক্রির ব্যবস্থাও আছে। চা বাগানটার নাম সম্ভবত থামদারা চা বাগান। সিঙ্গি বা মাগুর মাছ বিক্রির সময় মাছ যেমনই হোক, মাছগুলো যে হাইব্রিড নয় বোঝাবার প্রতি মাছ বি্রেতার আগ্রহ যেমন অনেক বেশি প্রকাশ পায়, এখানেও দেখলাম এগুলো অর্গানিক চা এটা বোঝাবার জন্য চায়ের প্যাকেট বিক্রেতার আগ্রহের বিন্দুমাত্র অভাব নেই। কমলা লেবু বাগানে ও আশেপাশের রাস্তার ওপর বসা লেবু বিক্রেতাদের কাছেও এই একই গল্প শুনে এসেছি। তরুণকে দেখলাম অতি উৎসাহের সাথে চা কিনতে। হিমাদ্রিদা বোধহয় টেমি টি হাউস থেকে চা কিনেছিলেন, এখানেও বোধহয় কিনলেন। আমি চা গাছের কাণ্ড ও ভেজাল খাওয়া পাবলিক, আমার শরীরে অনভ্যস্ত অর্গানিক চা শেষে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে ভেবে ভয় পেয়ে, আর কিনতে সাহস করলাম না। শেষপর্যন্ত গাড়ি এগিয়ে চললো।

একসময় আমাদের গাড়ি যোগিঘাট ব্রিজ পার হয়ে এসে দাঁড়ালো। এখানে দেখলাম বহু পর্যটকের ভিড়, রাস্তার পাশে লাইন দিয়ে গাড়ি রাখা আছে। ইস্পাতের তৈরি এই ব্রিজটি সিটঙ ও মংপুর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। রিয়াং বা রিয়াংখোলা নদীর ওপর চুয়াত্তর মিটার লম্বা ও পাঁচ মিটার চওড়া ব্রিজটি তৈরি করতে নাকি প্রায় সাত কোটি আঠাশ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিলো, এবং ২০১৫ সালের আঠারোই এপ্রিল, রামদেব নাকি এটির উদ্বোধন করেন। পাশ দিয়ে পুরাতন পরিত্যক্ত ঝুলন্ত ব্রিজটাকে এখনও দেখা যায়। নতুন ব্রিজটার পাশ দিয়ে নদীর কাছে যাওয়ার জন্য একটা কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে। নদীর কাছেও কিছু মানুষের জটলা চোখে পড়লো। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ও ফটো তুলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছেই মংপু, পতঞ্জলির থেকে গীতাঞ্জলি, বা রামদেবের থেকে গুরুদেবের আকর্ষণ আমার কাছে অনেক বেশি। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

অবশেষে মংপু রবীন্দ্র ভবনের কাছে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। সিঙ্কোনা কারখানার প্রবেশ পথের ঠিক উলটো দিকের এই বাড়িতেই ছিলো কর্মকর্তা শ্রী মনমোহন সেনের বাংলো। শ্রী মনমোহন সেন ছিলেন শ্রদ্ধেয়া মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী, এবং মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে ১৯৩৮ সালের পঁচিশে এপ্রিল, কবি এখানে প্রথম এসেছিলেন। ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে কবি এই বাংলোতে চারবার এসে বাস করে গেছেন। এই বাড়িতেই মৈত্রেয়ী দেবীর অনুরোধে কবি তাঁর আশিতম জন্মদিনে ‘জন্মদিন’ কবিতাটি রচনা করেন। সম্ভবত ২০০৯ সালে এই বাড়িটির নতুন নামকরণ, রবীন্দ্র ভবন করা হয়। হেরিটেজ বাংলো হিসাবে ঘোষিত এই বাংলোটিতে মেরামতির কাজের জন্য বর্তমানে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ভিতরে কবির স্মৃতিবিজড়িত বহু ছবি, হাতের লেখা, কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হলো। এখানেই আলাপ হলো, শিশির রাউথ নামে এক ভদ্রলোকের সাথে। ভদ্রলোককে দেখলাম গেটের বাইরে পর্যটকদের সাথে আলাপ করতে, এবং কথার ফাঁকে খোলা গলায় রবীন্দ্র সংগীত গাইতে। গান হয়তো তিনি শেখেননি, তবে ভালবাসার টানে তিনি রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে থাকেন, এবং বেশ ভালোই গান। ওনার সাথে গলা মিলিয়ে বেশ তৃপ্তি লাভ করলাম। জানা গেল, তিনি নেপালের লোক এবং তাঁর মাতৃভাষা নেপালি। আমাদের বাংলোর ভিতরে প্রবেশ করতে না দিতে পারার জন্য, তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। তবে কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, যে এই বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায় মনে হলো, তিনি সম্ভবত কেয়ার টেকার। তিনি হঠাৎ বললেন, আমি বেঁচে থাকতে এটা কিছুতেই নষ্ট হতে দেবো না। কেন একথা বললেন জানি না। জানি না, মেরামতির প্রয়োজনে এই হেরিটেজ বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে, না বাড়িটি অবহেলার শিকার। সত্যি মিথ্যা জানি না, জানার উপায়ও ছিলো না, তবে শুনলাম, ভিতরে নাকি বিশেষ রঙে রং করা হচ্ছে। আমরা ফেরার পথ ধরলাম।

লোহাপুল হয়ে, সেবক হয়ে, একসময় আমরা এনজেপি স্টেশনের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। এতদিন কারও জন্য কোন গিফ্ট্ কেনা হয়নি, এটা মানুষ খুনের থেকেও অনেক বড় অপরাধ। এতদিনে সেই পাপস্খালন করার সময় ও সুযোগ এসেছে। আমি ও তরুণ কুলির সাথে সমস্ত মালপত্র নিয়ে আপার ক্লাস ওয়েটিং রূমে গিয়ে হাজির হলাম। এক জায়গায় সবার সব মালপত্র সাজিয়ে রেখে, আমায় পাহারাদার হিসাবে বসিয়ে রেখে তরুণ ছুটলো স্টেশনের বাইরে অপেক্ষারত বাকি তিনজনকে নিয়ে অটো করে শিলিগুড়ি গিয়ে, তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে। যাইহোক, সকলের সব মনস্কামনা পূরণ করে একসময় সকলকে বগলদাবা করে তরুণ সুস্থ শরীরে ফিরে এলো। ওদেরকে মালপত্রের জিম্মাদার করে বসিয়ে, আমি ও তরুণ গেলাম রাতের খাবার কিনতে। যাওয়ার সময় আমার উনি জানালেন, যে চারজনের জন্য চারটে হাতব্যাগ নাকি কেনার সুযোগ হয়নি। একজন আবার নভি মুম্বাই থাকে, জানি না, আসা ও যাওয়ার প্লেন বা ট্রেন ভাড়া দিয়ে, সে কবে এখানে পঞ্চাশ টাকার ব্যাগ নিতে আসবে।

ভালো কেক, গুচ্ছের কলা, ডিম সিদ্ধ, ও মিষ্টি, সাথে চার চারটে ব্যাগও এলো। অনেক আগে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দিয়ে দিলো। কুলিরা এসে আমাদের মালপত্র ট্রেনে তুলে দিলো। মালপত্র গুছিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে আরাম করে বসলাম। তরুণের এক শালা, সম্ভবত এয়ার পোর্টের কাছে থাকে। সে তার দিদি জামাইবাবুর সাথে স্টেশনে দেখা করতে আসবে বলেছিলো। সে আসার পর অনেকক্ষণ ছিলো। কথাবার্তার ফাঁকে একসময় গাড়ি ছেড়ে দিলো। সে বিদায় নেওয়ার বেশ কিছু পরে, আমরা রাতের খাবার খেয়ে বিছানা নিলাম।

আজ ডিসেম্বর মাসের বাইশ তারিখ। শিয়ালদহ স্টেশনে আমাদের ট্রেন সকাল ছটায় ঢোকার কথা ছিলো, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সকাল ছটার কিছু আগেই আমরা শিয়লদহ পৌঁছে গেলাম। সময় নষ্ট না করে, স্টেশন থেকে বেরিয়ে, প্রিপেড ট্যাক্সি নিয়ে সোজা বাড়ি। ‘সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে’, বাড়ি ফিরেই ছুটলাম দুধ বাজার ইত্যাদি উদরপূর্তির উপকরণের সন্ধানে।

সুবীর কুমার রায়

১৯-০১-২০২২

অন্ধ স্নেহের পরিণতি

সোমনাথ বাবু বেশ ভালো একটি সরকারি চাকরি করায়, স্ত্রী নমিতা দেবী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। সচ্ছল অবস্থা, পিতা মাতা ভক্ত বাধ্য তিন সন্তানকে নিয়ে তাঁর বেশ সুখের সংসার। পিতা মাতার কাছে তাঁদের সব সন্তানই সমান প্রিয় বা আদরের, কথাটা যতই শোনা বা পড়া যাক না কেন, বাস্তবে কিন্তু দেখা যায়, কোন একজন সন্তানের প্রতি স্নেহ ভালবাসার মাত্রাটা একটু অধিকই হয়ে থাকে। সাধারণত জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ সন্তানের কপালেই এই প্রাপ্তিযোগ ঘটে থাকে। আবার নিক্তিতে পরিমাপ করলে এক সন্তানের প্রতি পিতার, ও অপর কোন এক সন্তানের প্রতি মাতার স্নেহ ভালবাসার পাল্লাটা একটু ভারী, এই ঘটনারও অভাব দেখা যায় না।

সোমনাথ বাবু ও নমিতা দেবী, উভয়ের ক্ষেত্রেই সন্তান স্নেহের লক্ষণটা যে প্রথম প্রকারের ছিলো, এটা বোঝার জন্য কোন দাঁড়িপাল্লার প্রয়োজন হতো না। তাঁদের উভয়েরই স্নেহ ভালবাসার ভাগটা অনেকটা, ছেলেবেলায় কষা অঙ্কের সেই চোদ্দটা লজেন্স তিন পুত্রের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করিয়া দাও, যাতে কনিষ্ঠ পুত্র দুইটি লজেন্স অধিক পায় জাতীয় ছিলো। এক্ষেত্রে সেটা যে শুধু কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ার সুবাদে, তা কিন্তু নয়। ছোটবেলা থেকেই এই পুত্রটির পিতা মাতার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার পরিমাণ একটু বেশি ও অস্বাভাবিক ছিলো। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার ছাড়া, সকালে ঘুম থেকে উঠেই পিতা মাতাকে প্রাতঃপ্রণাম করে পায়ের ধুলো না নিয়ে সে কোন কাজ তো দূরের কথা, প্রাতরাশ পর্যন্ত করতো না। ব্যাপারটা অনেকের কাছে একটু অস্বাভাবিক বা বাড়াবাড়ি মনে হলেও, পিতা মাতার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও গর্বের বিষয় ছিলো। ফলে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার ছোট ছেলের হাতের স্পর্শ পিতা মাতার চরণে, ও পিতা মাতার হাতের স্পর্শ ছোট ছেলের মাথায়, একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো।

দিন যায়। ধীরে ধীরে প্রথামাফিক একদিন সোমনাথ বাবু চাকরি থেকে অবসরও নেন। আজও তাঁর সেই সংসার আছে, আছে তিন সন্তানও। তবে যুগের হাওয়ায়, সন্তানদের মধ্যে পূর্বের সেই সুসম্পর্ক আর চোখে পড়ে না। ছোট ছেলে একটু অধিক নেশাগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেও, তার কিন্তু পিতা মাতার ওপর ভক্তি শ্রদ্ধা এতটুকু হ্রাস পায়নি। আগের মতো পিতা মাতার হাতের স্পর্শ তার মাথায় প্রাত্যহিক না পড়লেও, নেশাগ্রস্ত ছোট ছেলের হাতের স্পর্শ কিন্তু পিতা মাতা এখনও মাঝেমধ্যেই পেয়ে থাকেন, তবে সেটা গতি ও স্থান পরিবর্তন করে পায়ের পরিবর্তে গালে।

সুবীর কুমার রায়

১৪-০৯-২০২১

বলি

দীর্ঘ প্রায় পনেরো বছর পর পূজোর ছুটিতে সপ্তাখানেকের জন্য নিজ রাজ্যে ফিরে, পঞ্চমীর দিন ভোরবেলায় খবরটা শুনেই অসীমবাবু সুবিমলবাবুর বাড়ি ছুটে গেলেন। এই একই পাড়ায় তাঁদের উভয়েরই দীর্ঘদিনের বাস। চাকরিসূত্রে বছর পনেরো আগে সপরিবারে ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার পর থেকে, অসীমবাবুর এখানে আর আসার সুযোগ হয়নি। সুবিমলবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখেন প্রচুর লোকের ভিড়, পুলিশের উপস্থিতিও তাঁর চোখ এড়ালো না। সুবিমলবাবুর একমাত্র সন্তান, সৈকতের স্ত্রী আজ ভীষণভাবে আগুনে পুড়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নানা কথা কানে এলো। কেউ বলছে মেয়ের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে শাড়িতে আগুন ধরে গেছে, কেউ বলছে অর্থপিশাচ সুবিমল বাবু মনোমতো পণ না পাওয়ায়, এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কারণ যাই হোক না কেন, অসীমবাবুর ভীষণ খারাপ লাগলো, কারণ অনেক বছর আগে এই পূজোর সময়, এই মেয়েটিকেই শিশু বয়সে এই বাড়িতে অন্য রূপে অন্যভাবে তিনি দেখেছিলেন। তাছাড়া এখন আর তার কতই বা বয়স হবে, বছর চারেক আগেই তো ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েও, সময় ও সুযোগের অভাবে তাঁর আসা হয়ে ওঠেনি। 

ভিড় কাটিয়ে তিনি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন। ভুসোকালি ও জলে থইথই ডানপাশের রান্নাঘরটার ওপর চোখ পড়ায়, তিনি আঁৎকে উঠলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি সুবিমলবাবুর ঘরে গিয়ে বসলেন। ঘরে আর কেউ নেই। শোকস্তব্ধ বাড়ির আর সকলে সম্ভবত ভিতরের অন্য কোন ঘরে আছেন। সুবিমলবাবু কান্না জড়ানো ধরা গলায় জানালেন, “ছেলে অফিসের কাজে বাইরে গেছে, এদিকে আজ ভোরের দিকে নাতনির জন্য গ্যাসে দুধ গরম করতে গিয়ে, বৌমার শাড়িতে আগুন ধরে যায়। ওর চিৎকারে ছুটে গিয়ে জল দিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও, বৌমা ভীষণভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যাওয়ায়, পাড়ার ছেলেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে”। ঘরের একপাশে দেখলাম, আগের মতোই অষ্টধাতুর তৈরি উজ্জ্বল দুর্গামূর্তিটা সিংহাসনের ওপর শোভা পাচ্ছে। আজ পঞ্চমী, পূর্বের ন্যায় এবারেও এই ঘরেই পূজার আয়োজন সম্পন্ন হলেও, পূজা বন্ধ রাখতে হয়েছে।

বাড়ির বাইরে উত্তেজিত জনতার প্রচণ্ড কোলাহল, তাই আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে সুবিমলবাবুকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি উঠতে যাবেন, এমন সময় একদল যুবক ঘরের ভিতরে ঢুকে, সুবিমলবাবুকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো।

উত্তেজিত এতগুলো ছেলের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার সাহস বা ক্ষমতা, কোনটাই অসীমবাবুর নেই, তবু সুবিমলবাবুকে মারধর না করার জন্য তিনি তাদের একবার অনুরোধ করলেন। তাঁর অনুরোধে কর্ণপাত না করে তারা জানালো, যে হাসপাতাল থেকে এইমাত্র খবর এসেছে, সুবিমলবাবুর পুত্রবধু মারা গেছে এবং মারা যাওয়ার আগে সে ডাক্তার ও পুলিশকে জানিয়েছে, যে তার বাবা তার বিয়েতে চাহিদা মতো পণ দিতে না পারায়, তার শ্বশুরমশাই প্রথম দিন থেকেই তার ওপর অত্যাচার করে আসছেন। আজ ভোরে রান্নাঘরে মেয়ের জন্য গ্যাসে দুধ গরম করতে গেলে, শ্বশুরমশাই পিছন থেকে তার শাড়িতে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। তার চিৎকার ও আর্তনাদেও তিনি রান্নাঘরের দরজা খোলেননি। বাড়ির কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। শেষে তার চিৎকারে পাড়ার ছেলেরা  এসে জল দিয়ে আগুন নেভায়। এরপর আর পাড়ার ছেলেদের হাত থেকে সুবিমলবাবুকে উদ্ধার করার প্রবৃত্তি বা সাহস, কোনটাই তাঁর হয় না।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুর্গামূর্তিটার ওপর তাঁর আবার চোখ পড়লো। প্রতি বছর দুর্গা পূজার সময় চার দিন ঘটা করে এই মূর্তি পূজিতা হন, এবারেও তার আয়োজন সম্পন্ন। অনেক বছর আগে এই বাড়িতেই একটি শিশু কন্যাকে ফুল মালা চন্দন দিয়ে সাজিয়ে কুমারী দুর্গা হিসাবে পূজা করে, সুবিমলবাবু এই দুর্গা মূর্তিকে খুশি করতে চেয়েছিলেন। আজ এতগুলো বছর পরে এই পঞ্চমীর দিনে সামান্য অর্থের লোভে, সেই একই বাড়িতে তিনি সেদিনের সেই শিশুটিকেই নিজহাতে বলি দিয়ে, এবং আর একটি শিশুকে মাতৃহারা করে, একই মূর্তির বোধন পর্ব সমাধা করলেন। শোনা যাই এই মূর্তিটি নাকি খুব জাগ্রত। পূর্বে বহুবার অসীমবাবু এই মূর্তিটি দেখে থাকলেও, আজ কিন্তু জাগ্রত মূর্তির মুখে কোন প্রতিক্রিয়া তাঁর চোখে পড়লো না। একটাও কথা না বলে, তিনি মনমরা হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, ও মেয়েটির বাড়ির লোকের অভিযোগে, পুলিশ সুবিমলবাবুকে থানায় তুলে নিয়ে গেলো।

কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পরে অসীমবাবু আর তাঁর খোঁজ রাখার কোনদিন প্রয়োজন বোধ করেননি।

সুবীর কুমার রায়

০২-১১-২০২১

কার্তিকাতঙ্ক

কার্তিক পূজার দিন সন্তানহীন দম্পতির বাড়ির দরজার সামনে বন্ধুবান্ধবদের কার্তিক মূর্তি বসিয়ে রেখে যাওয়া, যাকে সবাই কার্তিক ফেলে গেছে বলে উল্লেখ করে, সম্ভবত কারও অজানা নয়। এই ঘটনা আগেও ছিলো, এখনও আছে। নির্ভেজাল আনন্দ ও পেট পূজার সুযোগ ছাড়া, এইসব বন্ধুবান্ধবদের কপালে নাকি কিছু অর্থাগমের সুযোগ ঘটে বলেও শোনা যায়। বিবাহের দীর্ঘদিন পরেও যাদের কপালে সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ হয়নি, তাদের অনেকেই মনে মনে তার বাড়িতে কার্তিক মূর্তি ফেলা হোক আশা করে, ও মূর্তি ফেলে গেলে খুশি হয়ে সন্তান কামনায় ধুমধাম করে পূজাও করে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তাদের, যাদের ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস বা আস্থা নেই, এবং বিবাহের পরে যাদের এখনও সন্তান লাভের সময়ই আসেনি। বর্তমানে ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যে বৈশাখ মাসে বিবাহিত দম্পতির দরজার সামনে মাত্র ছ’মাস পরে কার্তিক পূজোর আগের রাতে কার্তিক মূর্তি রেখে যেতে, এমনকী এক জোড়া কার্তিক রেখে যেতেও, এইসব বন্ধুবান্ধবরা একবার চিন্তা করারও প্রয়োজনবোধ করে না। বাস্তবে দেখা যায়, মূর্তি আবাহনের থেকে মূর্তি বিদায়, লাশ পাচারের মতো অনেক বেশি সমস্যা ও ঝামেলা সাপেক্ষ। ফলে কার্তিক পূজার আগের রাতে নব বিবাহিত দম্পতিদের বেশ চিন্তায় ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়েই বিনিদ্র নিশি যাপন করতে হয়। বহু বছর আগে বাড়িতে এরকমই এক মূর্তির আগমনে, আমাকেও বেশ আতঙ্কগ্রস্ত ও ঝামেলায় পড়তে হয়েছিলো, তবে সেই আতঙ্কের চরিত্র ছিল, একেবারেই ভিন্নধর্মী।

বিবাহের বছর দেড়েক পরে এক সকালে আমার বছর চারেকের ভাইঝি তার আধোআধো বুলিতে আমায় ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে সুসংবাদ দেয়, “রাঙা কাকা আমাদের বাড়িতে কে দুটো ঠাকুর রেখে গেছে”। গত জন্মে সম্ভবত পেচক ছিলাম, তাই এই জন্মে চিরটাকাল আমার গভীর রাতে শোয়া ও অনেক বেলায় ওঠা অভ্যাস। সকালের দিকের ঘুমটাই আমার বড় প্রিয়, তাই আধো ঘুমে আধো জাগরণে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “ঠিক আছে”। সে কিন্তু এতবড় সুসংবাদটা আমায় না শুনিয়ে ছাড়বে না, তাই আমায় ধাক্কা দিয়ে আবার বললো, “ও রাঙাকাকা, আমাদের বাড়িতে কে যেন দুটো ঠাকুর রেখে গেছে”। খবরটা শুনে এবার ধড়মড় করে উঠে, একপ্রকার ছুটেই বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য এগলাম। কেউ নিশ্চই কার্তিক ফেলে গেছে ভেবে ভয় পেলাম। একবারও মনে হলো না, যে আমার বাড়িতে কার্তিক মূর্তি ফেলার মতো আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই, কারণ ফেললেও সেই মূর্তিকে যে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হবে, সেটা সবাই জানে, সর্বোপরি এটা কার্তিক মাস তো নয়ই, আশ্বিন কিংবা অগ্রহায়ণ মাসও নয়।

আমাদের বাড়ি ও ঠিক পাশের নির্মলদার বাড়ির সীমানা বোঝার জন্য, একটা এক-দেড় ফুট উঁচু পাঁচিল ছিলো। পাঁচিলের শেষপ্রান্তে নির্মলদাদের অংশে, নালার নোংরা জল ফেলার জন্য বেশ খানিকটা মাটি খুঁড়ে, সোকপিটের মতো একটা কাঁচা কুয়োর মতো করা ছিল। তাদের বাড়ির আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থও তাতে ফেলা হতো। আর তার ঠিক পাশে দেড় ফুট পাঁচিলের এপাশে আমাদের অংশে, বেশ কিছু অব্যবহৃত ইট  সাজিয়ে রাখা ছিলো। এক ছুটে বাইরে গিয়ে মূর্তি দেখে একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। বড় তো নয়ই, রীতিমতো ছোট দুটি মূর্তি, এবং সেটা কার্তিক চন্দ্রের নয়। দোকানে যেমন লক্ষ্মী ও গণেশের ছোট ছোট মূর্তি রেখে, নিত্য ফুলের মালা দেওয়া হয় ও পূজা করা হয়, ঠিক সেরকম একটা একবারে ছোট লক্ষ্মী ও গণেশের মূর্তি। ছোট হলেও অবশ্য ভারী সুন্দর ও চকচকে মূর্তি।

এবার রীতিমতো চিন্তায় পড়লাম, এবং সেই চিন্তা কার্তিক মূর্তি ফেলার শতগুণ বেশি। সেই সময় বাচ্চাদের খেলনা, বল, পুতুল, পরিত্যক্ত ব্যাগ, বা ওই জাতীয় যেকোন জিনিস রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে, হাত না দেওয়ার জন্য রেডিও টিভি বা খবরের কাগজে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিলো। ওইসব সামগ্রীতে হাত দেওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটে বেশ কিছু মানুষ, বিশেষ করে শিশুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, এমন ঘটনা যত্রতত্র আকছার ঘটছে। আমাদের বাড়িতে আবার একজন বছর দশেকের এবং একজন বছর চারেকের শিশু আছে। এই অবস্থায় এই মূর্তিদুটোকে রেখে দেওয়া উচিত হবে না। তখনও টেলিফোন ব্যবস্থা সেইভাবে চালু হয়নি, কাজেই অনেক দূরের থানায় গিয়ে জানানোও সম্ভব নয়। আর জানালেও তারা যে এই ঘটনার কতটা গুরুত্ব দেবে, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একটু পরেই তো অফিসে বেরিয়ে যেতে হবে, কাজেই তারপরে কি হবে ভেবে পেলাম না। কোন বদ উদ্দেশ্য না থাকলে, এই সাতসকালে মূর্তিদুটো কেউ রেখেই বা যাবে কেন? হাতে করে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করা উচিত নয়, ফেলতেও সাহস হচ্ছে না।

শেষে সাহস করে তখনকার যুবকদের এক হিরোর ভূমিকা নেওয়া ছাড়া, দ্বিতীয় কোন সমাধানের পথ খুঁজে পেলাম না। এন্টার দি ড্রগনের ব্রুস লি’র কথা মনে পড়লো। সিনেমাটা দেখে অবাক হয়েছিলাম। পত্রপত্রিকায় পড়েছিলাম, তিনি নাকি লাইটের সুইচ অফ করার পরে লাইট নেভার আগেই নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে পারতেন। আমাকেও মূর্তি বিদায়ের কাজটা সেই দক্ষতায় ও ক্ষিপ্রতায় খুব দ্রুত সারতে হবে। বাচ্চাদুটোকে বাড়ির ভিতর পাঠিয়ে দিয়ে মনে মনে রেডি স্টেডি গো আওড়ে, একছুটে গিয়ে পেলে বা গ্যারিঞ্চার স্টাইলে অতি দ্রুত এক কিকে মূর্তিদুটোকে পাশের সোকপিটে চালান করে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটার আগেই ব্রুস লি’র মতো দ্রুত ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করলাম। না, কোনরকম বিস্ফোরণ তো দূরের কথা, বিনা প্রতিবাদে দেবতাযুগল টুঁ শব্দটি না করে, পাশের সোকপিটে নিমজ্জিত হলেন।

অযথা সময় নষ্ট না করে আমি নিজের বিছানায় ফিরে এসে আবার যোগনিদ্রায় মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করলাম। সবে একটু তন্দ্রা মতো এসেছে, লক্ষ্মীদির গলা পেলাম। লক্ষ্মীদির বাড়ি উলুবেড়িয়ায়, সে আমাদের বাড়ি ঠিকে কাজ করে। লক্ষ্মীদি মা’র কাছে জানতে চাইছে, যে অন্য এক বাড়িতে নতুন লক্ষ্মী ও গণেশের মূর্তি কেনায়, তাকে আগের একটা লক্ষ্মী ও একটা গণেশের মূর্তি উলুবেড়িয়ার গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার জন্য দিয়েছিলো। সকালে যখন এই বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলো, তখন বাইরে ইটের পাঁজার ওপর মূর্তিদুটো রেখে গেছিলো। এখন নিতে গিয়ে দেখছে সেখানে নেই। মূর্তিদুটো কেউ সরিয়ে রেখেছে কিনা। আমি আর কি করি, গোটা গল্পটা তো আর তাকে বলা যায় না। বাধ্য হয়ে বললাম, তুমি চিন্তা করো না, মূর্তিদুটোকে আমি ঠিক জায়গায় বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। আর শুয়ে থাকা গেলো না, বাধ্য হয়ে উঠে পড়ে মুখ ধুয়ে বিপম্মুক্ত আমি, চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম।

সুবীর কুমার রায়

১৮-১১-২০২১

ভোম্ববলদার বড়দা

মল্লিক বাজারের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা, ভদ্র নম্র ঠান্ডা চরিত্রের শীতল বাবুকে পাড়ার সকলেই চেনে, শ্রদ্ধা করে। তিন বছর হলো ভারতীয় রেলের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে, তিনি বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। তবে এযাবৎ তাঁর নিজের সভ্য ভদ্র সুন্দর ব্যবহারের জন্য তিনি পাড়ার সকলের পরিচিত হলেও, ইদানিং গোটা পাড়ায় তাঁর পরিচিতি, ভোম্বলের পিতা হিসাবে।

পুত্র সন্দীপ, যে ভোম্বল নামেই অধিক পরিচিত, কিন্তু বাবার চরিত্র আদপেই পায়নি। ছোটখাটো একটা অফিসে অতি সাধারণ একটা কাজ করলেও এবং বাড়িতে সংসার খরচের জন্য কোন টাকা দিতে না হলেও, হোটেল, সিনেমা, দামি মোবাইল, মোটর বাইকের পিছনে গার্লফ্রেন্ডকে বসিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ব্যয় তার আয়কে ছাপিয়ে যায়। ফলে অধিক আয়ের জন্য তাকে অন্য ধান্দা করতেই হয়। বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় বিশেষ না থাকায়, তাকে আয়ের সবচেয়ে সহজ রাস্তা, মাস্তানি ও লোক ঠকানোর মসৃণ পথেই বিচরণ করতে হয়। নানা কায়দায়, নানা অজুহাতে, সে পাড়ার লোকেদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।

একদিন সে খবর পেলো, যে নবাবগঞ্জের ত্রিকালদর্শী বিপদভঞ্জন বাবা নাকি সকল বাধা বিপদ কাটিয়ে, অতি সহজেই অনেকের ভাগ্য আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছেন। তিনি নাকি তারাপীঠ না কোথাকার শ্মশানে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে কঠিন তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে, দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের সেবায়, নবাবগঞ্জে এক চেম্বার খুলে বসেছেন। এরপরে আর ঘরে বসে থাকা চলে না, যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে থাকে। ফলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ও পাড়ার লোক ঠকানো ব্যবসা সাময়িক মুলতুবি রেখে, সে ছুটলো নবাবগঞ্জে বিপদভঞ্জন বাবার ডেরায়।

বাবার আশ্রমটির সামনে বহু মানুষের ভিড়। সকলের মুখেই এক কথা, বাবা নাকি ত্রিকালদর্শী, কঠিন সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে তিনি সর্বশক্তিমান। যেকোন সমস্যার আশু সমাধান বাবার নাকি বাঁহাতের খেল। বাবার ত্রিকাল দর্শন ও সর্বশক্তিমান হওয়া নিয়ে ভোম্বলের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা বা আগ্রহ, কোনটাই নেই। তার আগ্রহ শুধু ইহকালে প্রচুর অর্থাগমের সুযোগ, এবং সেই ব্যবস্থা করে দিলেই সে খুশি।

যাহোক, দীর্ঘক্ষণের অপেক্ষার পর সে বাবার সাক্ষাৎ পাওয়ার সুযোগ পেলো। বাবাকে প্রণাম করে বসার সাথে সাথেই বাবা তার হাতের তালুটা নিজের চোখের সামনে টেনে নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, “কি নাম, কোথায় থাকা হয়”? এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ভোম্বল জানালো, “আঁজ্ঞে আমার নাম সন্দীপ চন্দ্র মিত্র, অবশ্য আমাকে সবাই ভোম্বল নামেই চেনে। বাবা রেলের চাকরি করার সময়েই মল্লিক বাজারে বাড়ি করেন। বাবার নাম শ্রী শীতল চন্দ্র…”। তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বাবা বললেন, “ওরে ছোঁড়া এবার থাম, এতকথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করেছে? সবই যদি তুই বলবি, তাহলে আমি বলবো কী? হাতের রেখায় তো দেখছি, বুলটি নামে তোর তো একটা বিবাহিতা বোনও আছে। তোর বাবা অবসর নেওয়ার আগেই তার বিয়েও দিয়ে দেয়”। একটু থেমে আবার বললেন, “আচ্ছা, তোর ভগ্নিপতি কি পোস্ট অফিসে কাজ করে”?  

ভোম্বল তো অবাক, শুধুমাত্র হাতের রেখা দেখে এতকিছু বলে দেওয়ার ক্ষমতা তো স্বয়ং ঈশ্বরও রাখেন বলে মনে হয় না। গদগদ হয়ে ভোম্বল বললো, “হ্যাঁ স্যার, মানে প্রভু। আমার ভগ্নিপতি চন্ডীপুর পোস্ট অফিসে কাজ করেন। ওদের বেশ সচ্ছল অবস্থা, শুধু আমারই কিছু হলো না। আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন প্রভু, কথা দিচ্ছি, আমার একটা ভালো চাকরি হলে, আমি আপনার এই চেম্বার মার্বেলে মুড়ে ঝাঁচকচকে করে দেবো”।

“মূর্খ। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে আমি এই কাজ করি। মায়ের নির্দেশে নিজের সামান্য চার্জ ছাড়া, একটা পয়সাও অধিক নেওয়ার অধিকার আমার নেই, আর তুই এসেছিস আমায় লোভ দেখাতে? এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করে বেরিয়ে যা। তোর উপকার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তুই বরং অন্য কারও কাছে গিয়ে সাহায্য ভিক্ষা কর”।

বাবার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা টমা চাওয়ায়, বাবা তাঁকে বলেন, “আমার নির্দেশ যদি অক্ষরে অক্ষরে ত্রুটিমুক্ত ভাবে পালন করিস, তাহলে তোর সব সমস্যা মিটে যাবে। তবে কয়েকটা মাস সময় লাগবে। এবার জানবি তোর সমস্যার সমাধান তোর হাতে। বল্ আমার নির্দেশ ঠিকমতো মেনে চলতে পারবি তো”?

চোখের সামনে ভোম্বল তার সুদিন আসার ও মনোবাঞ্ছা পূরণের ছবিটা দেখতে পেলো। কতদিনের সখ একটা দামি আই ফোন কেনার। নিজের ওই লজঝড়ে মোটর বাইকে নিজের চলে গেলেও, সুইট হার্ট অনামিকাকে পিছনে বসিয়ে নিয়ে যেতে লজ্জা করে। একটা দামি মোটর বাইক না কিনলেই নয়। অনামিকাকে ভালো একটা গয়না কিনে দেওয়ার ইচ্ছা তার বহুদিনের। বেচারা মুখ ফুটে চাওয়ার পরেও, পয়সার অভাবে কিনে দিতে পারেনি। নাঃ, সে আর ভাবতে পারছে না। অতি বিনয়ের সাথে সে বললো, “নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমি সব করতে প্রস্তুত প্রভু, আপনি আমায় শুধু আদেশ করুন, পথ বাতলান”।

বাবা এবার একটা তাবিজ ও ভাঁজ করা কাগজ তার হাতে দিয়ে বললেন, তোকে একটা সংকটমোচন তাবিজ দিচ্ছি। তুই মাথা মুড়িয়ে, ভালো করে গঙ্গা স্নান করে, নতুন ধুতি ও গেঞ্জি পরিধান করে, লাল রঙের কার দিয়ে ডান বাহুতে কোন সৎ ব্রাহ্মণকে দিয়ে বেঁধে নিবি। পারলে এই পোশাকে একটা মাস অন্তত কাটাবি। পূর্ব দিকে মুখ করে বসে, দুবেলা নিরামিষ আহার করবি। আর কাগজে লেখা মন্ত্রটা সকাল সন্ধ্যায় পাঠ করবি। যাঃ, আমার প্রণামীর পাঁচ হাজার টাকা ওই প্রণামির বাক্সে রেখে দিয়ে বিদায় হ, আর বিরক্ত করিস না। পাঁচমাস পরে নতুন জীবন নিয়ে দেখা করে যাস।

টাকার অঙ্ক শুনে ভোম্বল ভিরমি খেলো। পাঁচ হাজার টাকা মানে তো তার এক মাসের মাইনে, তাছাড়া এত টাকা সে সঙ্গে করে নিয়েও আসেনি। অথচ এই সুযোগ হাতছাড়াও করা যায় না। শেষে তার অসুবিধার কথা বাবাকে খুলে বলে, মায়ের স্বপ্নাদেশের পাঁচ হাজার টাকার সাড়ে চার হাজার টাকা আপাতত দিয়ে, পাঁচমাস পরে বাকি পাঁচশ’ টাকা দিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলো।

বাবা-মা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও নেড়া হওয়ার ব্যাপারে সকলের ঘোর আপত্তি অগ্রাহ্য করে, একদিন সে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে মাথা মুড়িয়ে, নতুন বস্ত্র পরিধান করে বাড়ি ফিরে এলো। পাড়ার এক পুরোহিত ব্রাহ্মণকে দিয়ে ডান বাহুতে তাবিজ বাঁধার পর্বও সম্পন্ন হলো, অবশ্য তার জন্য আবার কিছু খরচাও করতে হলো। প্রকৃত ঘটনা শীতল বাবুর জানা নেই, তবে উচ্ছন্নে যাওয়া পুত্রের এহেন সন্ন্যাসীসুলভ আচরণে, তিনি হয়তো মনে মনে একটু খুশিই হলেন।

নিয়মিত পূর্ব দিকে মুখ করে ধুতি পরে বসে, দুবেলা নিরামিষ আহার ও মন্ত্র পাঠ করে দিন কাটতে লাগলো। নেড়া মাথায় এই পোশাকে অফিস যাওয়া ও গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে মোটর বাইকে ঘোরাও মাসখানেক বন্ধ রইলো। ফলে চাকরিটি গেলো। টাকার অভাবে মোটর বাইকটাও বেচে দিতে হলো। সবই হলো, শুধু টাকার আগমন হলো না। এইভাবে পাঁচ-পাঁচটা মাস কেটে গেলো।

শেষে একদিন তার বন্ধু সুবিমল তার বাড়িতে এসে শীর্ণ কঙ্কালসার ভোম্বলকে দেখে তো অবাক। সুবিমলের বাবা শীতল বাবুর সাথে একই অফিসে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করতেন। ভোম্বলের মুখে সব ঘটনা শুনে, সে পরের দিনই তাকে নিয়ে নবাবগঞ্জে বিপদভঞ্জন বাবার চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখা গেলো বাবার চেম্বার বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, বিপদভঞ্জন তাঁর আসল নাম নয়। তাঁর প্রকৃত নাম শান্তিরঞ্জন চাকলাদার, রানাঘাটের কাছে কোথায় যেন তাঁর বাড়ি। তিনি রেলে কাজ করতেন, এবং যে অফিসে কাজ করতেন, সেখানেই সুবিমল ও ভোম্বলের বাবা কাজ করতেন। দিনের পর দিন লোক ঠকানোর ব্যবসায় অতিষ্ঠ হয়ে, একদিন বেশ কিছু প্রতারিত মানুষ তাঁর চেম্বার ভাঙচুর করে তাঁকে মারধোর করে এখান থেকে তাড়িয়ে দেয়।

ভোম্বল তাঁকে চিনতে না পারলেও, সুবিমল তাঁকে ঠিক চিনতে পেরেছে। সুবিমল ভোম্বলকে বললো, “তুই লোকটাকে চিনতে পারলি না? তোর বোন, বুলটির বিয়েতে তো সে তোদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতেও এসেছিলো। তোর ঠিকানা ও বাবার নাম তাকে বলায়, সে তোকে চিনতে পেরে তোর পারিবারিক ইতিহাস শুনিয়ে তোকে সম্মোহন করেছে।

চাকরি নেই, গার্ল ফ্রেন্ড নেই, মোটর বাইক নেই, আগের মতো মাস্তানি করে লোক ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনের শারীরিক বা মানসিক শক্তিও নেই। ভোম্বল এখন পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ে সবজি বিক্রি করে।

সুবীর কুমার রায়

০৫-১০-২০২১

শঙ্কর

আজ হঠাৎ শঙ্করের কথা খুব মনে পড়ছে। আমি তখন প্রমোশন নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরীতে একটা সরকারি ব্যাঙ্কে রুরাল ডেভেলপমেন্ট্ অফিসার, অর্থাৎ ফিল্ড অফিসার হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছি। স্থানীয় মানুষের ভাষায় ফিল্ড অফিসার নয়, ফিলটার বাবু। শহরাঞ্চলের মতো এখানেও বিভিন্ন লোনের জন্য নিয়মমতো বীমা করাতে হতো। বীমা করানোর মতো লোনের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও, আমি এখানে এসে কাজে যোগ দেওয়ার পরে দেখি, যে নিয়মমাফিক বীমা করার প্রয়োজনীয় লোনগুলো ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে বীমা করানো হতো, এবং শঙ্কর প্রসাদ দাস নামে একটি ছেলে এই লোনগুলো বীমা করার কাজটা করতো।

আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট এই শঙ্কর নামে শান্ত নম্র ভদ্র ও সদাহাস্যময় ছেলেটি, ওই বীমা কোম্পানির এজেন্ট ছিলো। এই জাতীয় লোনের কাজের সাথে আমার পূর্বে কোন পরিচয় না থাকায়, আমিও পূর্বের ট্র্যাডিশনই বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলাম। দিন যায়, যদিও আমাদের শাখা থেকে তার বিশেষ কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ, তবু সে তার নিজের স্বার্থে মাঝেমধ্যে ব্র্যাঞ্চে ঘুরে যেতো। আমি কাঁথীতে একটা লজে থাকতাম, এবং সেখান থেকেই অফিস যাতায়াত করতাম। তারও বাড়ি যেহেতু কাঁথীতেই ছিলো, তাই সন্ধ্যার পর তার সাথে মাঝেসাঝে দেখা হতো।

বছর শেষ হওয়ার মুখে সে একদিন আমার ব্র্যাঞ্চে এসে বেশ কয়েকটা ডায়েরি বার করে তার থেকে একটা বেশ বড়সড় সুন্দর ডায়েরি আমায় দিতে গেলো। লক্ষ্য করলাম, যে ডায়েরিগুলোর একটাও তাদের বীমা কোম্পানির নয়। অর্থাৎ ব্যবসায়িক স্বার্থে সে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন অফিসার বা ম্যানেজারকে খুশি করবার জন্য নিজের পকেটের পয়সায় ডায়েরিগুলো কিনেছে। আমার তখন লেখালেখির ঝোঁক বিশেষ ছিলো না। অনেকের মতো ডায়েরিতে দিনলিপি লেখার অভ্যাস আমার কোনকালেই ছিলো না, আজও নেই। সবথেকে বড় কথা, অনেকের মতো বিনা পয়সায় ফলিডল পেলেও খাই জাতীয় স্বভাব আমার কোন কালেই না থাকায়, তাকে বললাম, “ডায়েরি লেখার সময় ও অভ্যাস কোনটাই আমার না থাকায়, এটা আমার কাছে পড়ে থেকে নষ্ট হবে। তার থেকে বরং যার এটা কাজে লাগবে, বা যাকে দিলে তোমার ব্যবসার কিছু সুবিধা হবে, তাকে এটা দিও”। ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “আপনি এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। আপনাদের অন্যান্য ব্র্যাঞ্চের অনেকেই কিন্তু আমাকে ভালো ডায়েরি নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসার জন্য হুকুম তামিল করেছে”। যাদের নাম শুনলাম, তাদের অনেককেই চিনতাম, আজও চিনি বা পরিচয় আছে। কেউ আবার ব্যাঙ্ক থেকে অবসর নেওয়ার পরে, এখন সেই ব্যাঙ্কেরই অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ঠেকা নিয়ে গাঁয় মানে না আপনি মোড়ল হয়ে নেতা বনে বসেছে।

আমাকে আরও তিন-চারজন স্টাফের সাথে কাঁথী থেকে নড়বড়ে রাস্তায় আরও নড়বড়ে বাসে প্রায় চোদ্দ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিত্য রসুলপুর ঘাটে যেতে হতো, সেখান থেকে রসুলপুরের নদী পাড় হয়ে আবার প্রায় চার কিলোমিটার পথ বাসে বা ভ্যান রিকশায় যেতে হতো। এমন অনেকদিন গেছে, যেদিন বাসের গোলমাল থাকায় অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে আমাকে তিন-চারজন স্টাফকে সঙ্গে নিয়ে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে রসুলপুর ঘাটে যেতে হয়েছে। আবার এরকমই অনেক দিনে তার সাথে দেখা হওয়ায়, আমাদের বিনা অনুরোধেই সে তার মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে আমাকে ও যেকোন একজন স্টাফকে তেল পুড়িয়ে যাতায়াতে আঠাশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রসুলপুর ঘাটে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।

দিন যায়, ব্যাঙ্কের কাজে ভালমন্দ নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটতে থাকে। হঠাৎ একদিন একজন ঋণগ্রহীতা কাগজে মোড়া কি একটা জিনিস নিয়ে এসে, মোড়ক থেকে বার করে আমার টেবিলে রাখলো। চুনমাখা গয়না পরা লোমশ কি একটা পদার্থ দেখে, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি?

“শুয়োরের কান বাবু, শুয়োরটা মরে গেল, তাই কানটা কেটে নিয়ে এলাম। আপনি যা ব্যবস্থা করার করেন”। 

শুয়োরের লোন দেওয়ার সময় বীমা করাতে হয়। বীমা কোম্পানি থেকে প্রতিটা শুয়োরের কানে একটা করে ট্যাগ পাঞ্চ করে লাগিয়ে দিয়ে যায়। কোন কারণে শুয়োর মরে গেলে, ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ওই ট্যাগ সমেত দরখাস্ত করে ক্ষতিপুরণ চাইতে হয়। গরু পালনের মতো শুয়োর পালনের জন্যও আমাকে লোন দিতে হয়েছে, তাই আমার মতো শুয়োর বিশেষজ্ঞ একজন দক্ষ ফিলটারবাবুর, শুয়োরের জীবনচক্র সম্বন্ধে হাতের তালুর মতো পরিষ্কার ধারণা থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। একটা শুয়োর কত বছর বয়সে বাচ্চা দেয়, এক একবারে কতগুলো বাচ্চা হয়, কতদিন অন্তর শুয়োরের বাচ্চা হয়, বাচ্চা কত বড় হলে কেটে খাবার উপযুক্ত হয় বা বিক্রি করা লাভজনক হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি, আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

একটা কাগজে কানের ট্যাগটার নাম্বার লিখে রেখে, যদিও সেটা ঋণ গ্রহীতার লেজারের পাতায়ও লেখা আছে, কাটা কানটা একটা ছোট খামে ঢুকিয়ে, আঠা দিয়ে মুখ বন্ধ করে সেই খামটা আবার অপর একটা খামে রেখে, সেটার মুখও বন্ধ করে দিলাম। শাখার আর্মড গার্ড, নীমা তামাং কার্সিয়াং-এর বাসিন্দা। তার সাথে আমার বেশ মধুর সম্পর্ক। সে আমায় বললো, তাদের ধর্মে শুয়োর ছোঁয়া নিষিদ্ধ, তা নাহলে সে পোস্ট অফিসে গিয়ে বীমা কোম্পনিতে সেটা পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে আসতো। অন্য কেউ এই উৎকৃষ্ট কাজটা করতে না চাওয়ায়, বাধ্য হয়ে খামটা তখনকার মতো আমার অফিস ব্যাগে পুরে রাখলাম।

পরের দিন থেকে শুয়োরের কানটা আমার সাথে আমার ব্যাগের ভিতর করে চোদ্দ কিলোমিটার বাস, তারপরে নদী পার হয়ে চার কিলোমিটার রাস্তা ভ্যান রিকশায় যাতায়াত শুরু করলো। কানটাকে যথাস্থানে আর পাঠানোর সময় করে উঠতে পারি না। শেষে একদিন সম্ভবত কানের দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে, অফিস আসার পথে কান সমেত ব্যগটা আমায় না জানিয়ে আমায় ছেড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে গেল। মহা ঝামেলায় পড়লাম। আবেদন পত্রের সাথে ট্যাগ সমেত কান জমা না দিলে তো ক্ষতিপুরণ পাওয়া যাবে না। ব্যাগ ফিরৎ পাওয়ার আশায় ও কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই, আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল।

বীমা কোম্পানির এজেন্ট, এই শঙ্করের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক থাকায় তাকে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বললাম। সে আমাকে পরামর্শ দিল, যে আমি যেন ব্যাঙ্কের প্যাডে ঋণ গ্রহীতার নাম, ট্যাগ নম্বর উল্লেখ করে, আমার কাছ থেকে ট্যাগটা হারিয়ে গেছে জানিয়ে ইনসুরেন্স কোম্পানিকে একটা চিঠি লিখি। যেহেতু আজ পর্যন্ত কোন ক্লেম এই শাখা থেকে করা হয়নি, তাই তারা ক্ষতিপুরণের টাকা দিয়ে দিতেও পারে। তাই করা হলো, এবং শেষপর্যন্ত টাকা পাওয়াও গেল। টাকা না পাওয়া গেলে আমার পকেট থেকেই টাকাটা গুনাগার দিতে হতো।

সেবার নির্বাচনের সময় আরও অনেকের মতো আমারও ভোটে ডিউটি পড়লো। বিদেশ বিভুঁইয়ে ভোটের ডিউটি দিতে যাওয়ার আমার আদৌ ইচ্ছা ছিলো না। কোনভাবেই যখন ভোটের ডিউটির জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলাম না, তখন এই শঙ্করই এগিয়ে এসে আমাকে চিন্তা করতে বারণ করে জানালো, যে তার বাবা কাঁথী এস.ডি.ও. অফিসে কাজ করেন, কাজেই সে তার বাবাকে দিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করবে। বাস্তবে সে অবশ্য কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি, এবং ঘটনাচক্রে আমাকে সেবার ভোটের ডিউটিতেও যেতে হয়নি, কাজেই সেকথা এখানে নিষ্প্রোয়জন, কিন্তু একমাত্র এই শঙ্করই কিন্তু নিজে থেকে এগিয়ে এসে সেদিন আমার জন্য চেষ্টা করেছিলো।

এরমধ্যে একদিন সে জানালো, যে সে তার বীমা কোম্পানিতে ডেভেলপমেন্ট্ অফিসার বা ওই জাতীয় কোন পোস্টে চাকরির সুযোগ পেয়েছে, কাজেই সে আমাকে একদিন খাওয়াতে চায়। আমাদের ব্র্যাঞ্চের আরও দুজন স্টাফও দলে ভিড়ে গেলো। দিন ঠিক করে ফেলে সে একদিন আমাদের জানালো, যে সে সব আয়োজন করে ফেলেছে, কাজেই আমরা যেন অতি অবশ্যই সাতটার মধ্যে অফিস থেকে ফিরে কাঁথীর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তার সাথে দেখা করি। তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। সেদিনই আবার অফিস থেকে ফেরার পথে বাসের গোলমাল দেখা দেওয়ায় কাঁথী ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। বাস থেকে নেমে দেখি, যে সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যাইহোক, তার সাথে গিয়ে শেষপর্যন্ত তার পছন্দের একটা ঝুপড়ির বেঞ্চে তো বসা হলো। সে নিজেও আমাদের সাথে নৈশভোজে আসন গ্রহণ করলো। শুনলাম এই দোকানের রান্না নাকি অতি উপাদেয়, সে মাঝেমধ্যে এই দোকানে পদধুলি দিয়ে থাকে।

অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। ‘সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর’। খাদ্য তালিকা সীমিত হলেও পরিমাণে অসীম, এবং তাতে বর্ণ গন্ধের সত্যিই লেশমাত্র অভাব নেই। হালকা বাসন্তী রঙের পোলাও, মুণ্ডহীন নাবালিকা আস্ত মুরগির রোস্ট, ও একটা চাটনি। ভালো খাবার খেতে ভালবাসলেও আমার খাওয়ার পরিমাণ চিরকালই বেশ কম, কাজেই এই পরিমাণ খাদ্য আমার তিনদিনের খাবার বুঝতে পেরে শঙ্করকে খাবার অনেকটা কমিয়ে নিতে বললাম। শঙ্কর দোকানদারকে পোলাও কমিয়ে দিতে বলে আমায় বললো, “মুরগির রোস্টটা এ বড় ভালো করে, তাছাড়া ওটা ভেঙে কমিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। তাড়া নেই সময় নিয়ে খেয়ে নিন। শেষপর্যন্ত একান্তই না পারলে আমি নিয়ে নেবো”। বাকি দুজন চুপ করে থেকে, খাওয়া শুরু করলো। সত্যিই সুন্দর খেতে, কিন্তু অনেকটা খাওয়ার পর আমার গা গুলাতে লাগলো। শঙ্করকে পাত থেকে তুলে দিতে ইচ্ছা করলো না, আবার এত দাম দিয়ে কেনা খাবার নষ্ট করতেও বিবেকে লাগলো, তাই অনেক সময় নিয়ে বহু কষ্টে মোটামুটি খেয়ে খাওয়ার পরিসমাপ্তি ঘটালাম। শঙ্কর হাতমুখ ধুয়ে দোকানদারকে দাম মিটিয়ে ওরকমই দুটো আস্ত মুরগির রোস্ট প্যাকেটে করে নিয়ে আমাদের সাথে রাস্তায় পা রাখলো। আমার গা গুলাচ্ছিলো বলে উলটো দিকের একটা গুমটি থেকে পান কিনবার সময় সে পান খাবে কী না জিজ্ঞাসা করায় সে বললো, “পাগল, এখন কেউ পান খায়, তাহলে আর বাড়ি গিয়ে খেতে পারবো না”। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “রাতে তুমি আবার খাবে”? উত্তরে সে শুধু বললো, “রাতে আমি একটা আর বাবা একটা খাবে বলে দুটো এক্সট্রা মুরগির রোস্ট নিলাম দেখলেন না? গরম থাকতে থাকতে খেতে হবে নাহলে ভালো লাগবে না। এখন পান চিবোলে আর বাড়ি পৌঁছে খাওয়া যাবে না”।

জানি না বীমা কোম্পানিতে তার কাজের অতীত কর্মদক্ষতার সঙ্গে এই প্রমোশনের কোন সম্পর্ক আছে কী না,

থাকলেও এই ব্যাপারে আমার কোন অবদান নেই, কারণ আমার কাছ থেকে তার অতি সামান্যই ব্যবসা পাওয়ার সুযোগ ছিলো। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার এই, যে আমি ছাড়া অন্য কোন শাখার অফিসার, যাদের কাছ থেকে সে যথেষ্ট ব্যবসা পায়, বা পাওয়ার সুযোগ আছে, তাদের একজনকেও কিন্তু এই আসরে চোখে পড়লো না। আসলে শুধু আর্থিক সুবিধা বা স্বার্থ নয়, ব্যবহার ও নিজেদের মধ্যে নিঃস্বার্থ সুসম্পর্ক দুজন মানুষকে হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে।

এরও প্রায় সতেরো বছর পরে, তখন আমি কর্মসূত্রে এগরায় বাড়িভাড়া নিয়ে থাকি। একদিন স্ত্রীকে নিয়ে বিকালের দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বাসে এগরা যাওয়ার পথে কাঁথী থেকে বেশ কিছুটা পথ আগে নাচিন্দার কাছাকাছি কি একটা কারণে দেখি রাস্তার দুদিকে লাইন দিয়ে অজস্র বাস ট্রাক মোটর ইত্যাদি দাঁড়িয়ে আছে। একমাত্র বাইকগুলো দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে এঁকেবেঁকে কাটিয়ে যাতায়াত করছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম এই অবস্থা দীর্ঘক্ষণ ধরে চলছে। বুঝলাম এগরা পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। সতেরো বছর আগে আমি কাঁথীতে বছর আড়াই-তিন থাকলেও, বিপদের সময় কিন্তু পরিচিত সবাইকে ছেড়ে শঙ্করের কথাই মনে পড়লো। তাকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা জানাতে সে বললো, “আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমি বাইকে করে আপনাদের কাঁথীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো। রাতটা আমার বাড়ি কাটিয়ে আগামীকাল এগরা চলে যাবেন”। শেষপর্যন্ত তার আর প্রয়োজন হয়নি, কিছুক্ষণ পরেই গাড়ির চাকা  গড়াতে শুরু করলে তাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম। আমরাও সুষ্ঠুভাবে এগরা পৌঁছেছিলাম।

আজ প্রায় চৌঁত্রিশ বছর আগে তার সাথে আলাপ। চাক্ষুষ না হলেও, তার সাথে আজও মোবাইল বা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ আছে। জেনেছিলাম, যে সে ওই বীমা কোম্পানির অ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার হয়েছে। সুসম্পর্কের জন্য শুধুমাত্র রক্তের বা স্বার্থের প্রয়োজন হয় না, আরও অনেক কিছু আছে, যা দুটো মানুষের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে সক্ষম। ভালো থেকো শঙ্কর, সুস্থ থেকো, তোমাকে আমি আজও ভুলিনি।

 

সুবীর কুমার রায়

০২-০৯-২০২১

বড়দিনের শুভেচ্ছা {লেখাটি ভালোবাসা, ও গল্পগুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

71946068_1338812139627865_3484388348838019072_n

আজ পঁচিশে ডিসেম্বর, আজ বড় শুভদিন। একে বড়দিন, তার ওপর প্রভু যীশুর জন্মদিন। এই দিনটি নিয়ে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একটু লোক দেখানো মাতামাতি করার অভ্যাস আছে। বাড়িতে ডাঁটা চচ্চরি খেলেও, সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে গিয়ে কিছু খেয়ে ছবিসহ তাৎক্ষণিক প্রচার না করলে, সমাজে নাকি স্টেটাস রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ে, সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ও হয়তো থাকে। আজ এই শুভদিনে হঠাৎ একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, তিনি প্রভু যীশু নন, কোন বন্ধুবান্ধব বা পরমাত্মীয়ও নন। একটি অচেনা অজানা অপরিচিতা অল্পবয়সি মেয়ে, যার মুখটা আজ আর মনেও পড়ে না।

আজ থেকে ঠিক এগারো বছর আগে, অর্থাৎ পঁচিশে ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে আজকের সন্ধ্যায় আমাকে কলকাতার মুকুন্দপুরে একটি হাসপাতালের আই.সি.সি.ইউ. বেডে কাটাতে হয়েছিল। ঠিক দুদিন আগে আমার বাইপাস অপারেশন হয়েছে, প্রচণ্ড যন্ত্রনায় চিৎ হয়ে শোয়ার ক্ষমতা নেই। হেলান দিয়ে আধ বসা আধ শোয়া অবস্থায় বাড়ির লোকের আসার অপেক্ষায় আছি। দিনে ঠিক দুজনকে আমার সাথে দেখা করতে দেওয়া হবে, তাও আবার অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাড়ির লোকের দেখা নেই। এরপর ভিজিটিং আওয়ার্স পার হয়ে গেলে হয়তো দেখা করতেও দেবে না। যাইহোক, শেষপর্যন্ত আমার কন্যা ও জামাতা এসে উপস্থিত হলো। জানা গেল, যে সায়েন্স সিটিতে মান্না দে ও সন্ধ্যা মুখার্জীর সঙ্গীতানুষ্ঠান থাকায় রাস্তা বেশ জ্যাম ছিল, তাই এতো বিলম্ব।

এই হাসপাতালটিতে অনেক নার্স বা অন্যান্য কর্মচারী খৃস্টান ধর্মাবলম্বী, কেরালার অধিবাসী। আমার বেডের ঠিক পাশেই একটি টেবিলে একজন নার্সের পোষাক পরিহিতা একটু বয়স্কা ভদ্রমহিলা বসে আছেন, বাকি কয়েকজন অল্পবয়সি নার্স রোগীদের দেখভাল করছে। অন্যান্যদের কথায় বুঝতে পারছি যে, যে মেয়েটি মূলত আমায় দেখভাল করছে, সে খৃস্টান ধর্মাবলম্বী। সন্ধ্যার পর একে একে প্রায় সব নার্স চলে গেলেও, এই মেয়েটি চলে যেতে পারছে না। সম্ভবত এর রিলিভার না আসায়, বা অন্য কোন কারণে সে বাড়ি যেতে পারছে না। এই মেয়েটির আজ উৎসব, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। অন্যান্য নার্সরা মৌখিক সহানুভতি দেখালেও, তার সাহায্যে কাউকে কিন্তু এগিয়ে আসতে দেখিনি। সারাদিন তার কাজ, রোগীদের প্রতি তার সাহায্য ও সহানুভুতি, আমায় মুগ্ধ করেছিল। ধীরে ধীরে অনেক সময় কেটে গেল, এই মেয়েটি একাই সব সামলাচ্ছে। ওই অবস্থাতেও আমার মেয়েটির জন্য বড় মায়া হোল, কষ্ট হলো। আর সকলের তো বছরে অনেক উৎসবের দিন আছে, এই মেয়েটির কিন্তু সারাবছরে এই একটিই উৎসবের দিন, অন্তত প্রধান উৎসবের দিন। তাদের একজনও কি পারতো না, একটা দিন নিজে একটু বেশিক্ষণ থেকে এই মেয়েটিকে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দিতে? মেয়েটি ঠায় আমার বেডের পাশে একটা টুল নিয়ে বসে থাকলো। শেষে আমি তাকে বললাম, “তুমি চলে যেতে পারো, আমার কোন অসুবিধা হবে না। সে বললো, “আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি এটাই করতাম”। আরও অনেক পরে অন্য কয়েকটি নার্স এসে উপস্থিত হওয়ায়,  এই মেয়েটি মুক্তি পেলো ও আমার ভালো থাকার কামনা করে, শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল।

পরের দিন সকালে আমাকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত করা হলো, ফলে তার সাথে আর আমার দেখা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় ইচ্ছা ছিল তাকে কিছু টাকা     উপহার হিসাবে দেওয়া। কিন্তু ওই  

হাসপাতালের কর্মচারীদের রোগী বা রোগীর বাড়ির লোকের কাছ থেকে কোন টাকা নেওয়া শুধু খাতাকলমে বারণ ছিল না, বাস্তবে এটাই ঘটনা ছিল। তাছাড়া মেয়েটির নামও জানতাম না, তাই উপহার নাহোক সামান্য একটা শুকনো ধন্যবাদ জানাবার সুযোগও হয়নি। অনেকে হয়তো বলতেই পারেন, যে এই টাকা দেওয়াটা ঠিক নয়, এতে ওদের চাহিদা ও লোভ বেড়ে যায়। আমিও তাই মনে করি, কারণ বহুবার সরকারি হাসপাতাল বা নামীদামি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর কথা ভেবে বাধ্য হয়েছি উপহার নয়, ঘুষ হিসাবে টাকা দিতে। একবালপুরের এক নামী হাসপাতাল নামের নার্সিং হোম থেকে, মার মৃতদেহ নিয়ে আসার সময়েও এই চাহিদার হাত থেকে মুক্তি পাইনি।

মেয়েটির নাম জনি না, তার মুখ বা চেহারাটাও আজ এতগুলো বছর পরে আর মনে করতে পারি না। তবু আমার সেই অতি কষ্টের একটি দিনে, তার সেবা যত্ন সহানুভুতির কথা এই দীর্ঘ এগারো বছরেও ভুলতে পারলাম কই? আজ সেই একই উৎসবের দিনে তাকে আমার প্রাণভরা স্নেহ, ভালবাসা, শুভেচ্ছা, এমনকী শ্রদ্ধা জানালাম। সে ভালো থাকুক, সুখে থাকুক, আনন্দে থাকুক।

সুবীর কুমার রায়

২৫-১২-২০১৯

মাস্ক বিভ্রাট {লেখাটি প্রতিলিপি বাংলা, বইপোকার কলম, ভলোবাসা, ও গল্পগুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

44227056_1089998187842596_993178936290574336_n

শান্তশিষ্ট স্বভাবের নারায়ণকাশিতবাবু মানুষটিকে আশেপাশের সকলেই খুব পছন্দ করতেন। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হলেও, তিনি কারও কাছে কোনদিন সাহায্য চেয়েছেন, যদিও তাঁর কোন শত্রু নেই, তবু থাকলে তিনিও হয়তো একথা স্বীকার করতেন না। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই টাকার অভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও, তিনি সবসময় তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী নগদে বাজার দোকান করতেন। বাজারের সবজি বা মাছ বিক্রেতারাও তাঁকে কোনদিন ধার চাইতে ও দরাদরি করতে না দেখায়, তাঁকে বেশ পছন্দও করতেন। কতবার পছন্দের মাছ কিনতে গিয়ে দাম শুনে পিছিয়ে আসায়, মাছ বিক্রেতা তাঁকে সুবিধা মতো পরে দাম দিয়ে যেতে বলে, মাছটা নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু নারায়ণবাবুর যুক্তি হচ্ছে, তিনি নুন ভাত খেয়ে থাকতেও রাজি আছেন, কিন্তু বাকিতে কিছু কিনতে তিনি রাজি নন। ধার করে ঘি খাওয়া তিনি আদপেই পছন্দ করেন না।

এরমধ্যে শুরু হলো করোনার ঝামেলা। বিপদটার গুরুত্ব কতখানি বোঝা না গেলেও, আশেপাশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বেশি করে চাল, আটা, তেল, নুন, মশলাপাতি, ও বাজার করে বাড়িতে জমা করে রাখার কথা বলে সতর্ক করে জানালেন, যে যেকোন মুহুর্তে বাজার দোকান সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরের দিনই নারায়ণবাবু বাজারে গিয়ে সমস্ত বাজার করে, এক মাছ বিক্রেতার কাছে যান। লোকটা ভালো, সঙ্গে তার ছেলেকে নিয়ে বসে মাছ বিক্রি করে, কিন্তু তিনি মাছ পছন্দ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে  মাটিতে পড়ে গেলেন। বাজারের সকলেই তাঁকে চেনেন, তাই অনেকেই ছুটে এসে তাঁকে তুলে চোখেমুখে জল দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে তুললেন। ওই মাছ বিক্রেতা তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু মাছ তাঁর মাছের ব্যাগে দিয়ে, বাজারের ব্যাগ ও মাছের ব্যাগ সমেত তাঁকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সময় বললো, “সাবধানে বাড়ি ফিরে যান। সুস্থ হয়ে যখন আবার বাজারে আসবেন, তখন মাছের দাম সাতশ’ টাকা দিয়ে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে শরীর খারাপ নিয়ে এরমধ্যে যেন মাছের দাম দিতে আসবেন না”। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নারায়ণবাবু এই প্রথম বাকিতে কিছু কিনতে বাধ্য হলেন।

রিকশাচালক তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে, তাঁর স্ত্রীকে আজকের সমস্ত ঘটনার কথা বলে ফিরে গেল। ডাক্তার দেখানো হলো এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধপত্রও খাওয়া শুরু হলো। একটু সুস্থ হয়েও কিন্তু তাঁর পক্ষে বাজারে গিয়ে মাছের দাম পরিশোধ করা সম্ভব হলো না, কারণ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে সত্য সত্যই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের চিন্তায় অসুস্থ নারায়ণবাবু আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

দিন পনেরো পরে স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করেই তিনি বাজারে চললেন ঋণ পরিশোধ করতে। বাইরে গিয়ে তাঁর বহু বছরের চেনা শহরটাকে কেমন যেন অপরিচিত মনে হলো। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় কোন টোটো বা রিকশা নেই, মানুষজনও প্রায় নেই বললেই চলে। যে ক’জন মানুষকে দেখা যাচ্ছে, তাদের সকলের মুখেই মাস্ক বাঁধা, সহজে চেনার উপায় নেই। তাঁর মনে হলো মাস্ক ছাড়া তাঁর রাস্তায় বেরোনোটা উচিৎ হয়নি। তিনি ঠিক করলেন ফেরার সময় মাস্ক কিনে নিয়ে যাবেন। অন্যান্য দিন যেটা বিশেষ দেখা যায় না, আজ দেখলেন রাস্তার দুপাশে কিছু সবজি বিক্রেতা সামান্য কিছু সবজি নিয়ে মুখে মাস্ক বেঁধে বসে আছে। দু’-চারজন মাছ নিয়েও বসেছে। নিজেকে মাস্কহীন অবস্থায় নিজেরই যেন কিরকম অস্বস্তিবোধ ও লজ্জা করতে লাগলো। নারায়ণবাবুর আজ মাছ বা বাজার, কোনটারই প্রয়োজন নেই, তাই দ্রুত পা চালালেন। এমন সময় রাস্তার বাঁপাশ থেকে মুখে বেশ শক্তপোক্ত মাস্ক পরা একজন চিৎকার করে বললো, “বাবু কেমন আছেন? মাছ লাগবে নাকি? নিয়ে যান, একবারে টাটকা মাছ আছে”। নারায়ণবাবু লক্ষ্য করলেন, যে তাঁর পরিচিত সেই মাছ বিক্রেতা আজ এখানে বসে মাছ বিক্রি করছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে তাকে বললেন, “আজ এত লোক মাছ ও সবজি নিয়ে রাস্তার দুপাশে কেন বসেছে”? উত্তরে মাছ বিক্রেতা মাস্কের ভিতর থেকে অস্পষ্ট গলায় জানালো, “বাজারে সবাইকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তার দুপাশে বসেছে”। নারায়ণবাবু আর কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে সাতশ’ টাকা বার করে দুবার গুণে নিয়ে তার হাতে দিয়ে বললেন, “শরীরটা সুবিধের নেই বলে কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোইনি। আজ তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম, সেদিনের মাছের দামটা রেখে দাও”। মাছ বিক্রেতা হাসি মুখে টাকাটা পকেটে রেখে দিলো। নারায়ণবাবু একবার বললেন, “টাকাটা গুণে নাও”। উত্তরে মাছ বিক্রেতা বললো, “কি যে বলেন বাবু, আপনার মতো মানুষ আমাকে কম টাকা দিয়ে ঠকাবে”?

এই মাস্ক বিক্রেতার মাস্কটা তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে, এরকমই একটা মাস্ক কেনার জন্য তিনি ওষুধের দোকানের দিকে পা চালালেন। বাজারের কাছে এসে অভ্যাসবশত মাছের বাজারের কাছে গিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন। তাঁর পরিচিত মাছওয়ালার ছেলেটা কাছা পরে সামান্য কিছু মাছ নিয়ে বসে আছে। তিনি ভাবলেন, বাড়িতে এরকম একটা অঘটন ঘটেছে, অথচ ওর বাবা তো কিছু বললো না? দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোর এরকম পোশাক কেন, কে মারা গেছে”? ছলছল চোখে ছেলেটা উত্তর দিলো, “বাবা মারা গেছে”। নারায়ণবাবুর চোখের সামনে গোটা পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো। চোখে অন্ধকার দেখে তাঁর  মাথাটা কিরকম ঘুরতে শুরু করলো। কোনরকমে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কি করে মারা গেল? কবে মারা গেল”? ছেলেটি উত্তর দিলো “গত শনিবার রাতে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে, আগামী রবিবার কাজ। বাবা আপনাকে খুব ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন, আপনি তো আমাদের বাড়ি চেনেন, ওইদিন আপনি যদি একবার আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন, তাহলে বাবার আত্মা শান্তি লাভ করবে”।

মানিব্যাগ হাতড়ে ছেলের হাতে সাতশ’ টাকা দিয়ে, তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। মনে মনে ভাবলেন, এমাসে আর মাস্ক কিনে কাজ নেই, যেটুকু টাকা পড়ে আছে, সামনের রবিবার ফুল ও ধুপকাটি কিনতে চলে যাবে। যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে আগের সেই মাছ বিক্রেতা বসার জায়গাটা আড়চোখে একবার দেখলেন। জায়গাটা ফাঁকা, দুটো কুকুর নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমচ্ছে।

সুবীর কুমার রায়

২০-০৬-২০২০

হাসি {লেখাটি প্রতিলিপি-বাংলা, ও গল্পগুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

72478165_1338803969628682_6661569837455638528_n

হারাধন বাবুর পঁয়ত্রিশ বছরের উপর শিক্ষকতার জীবনে বহুবার তাঁর স্কুলটির গঠন পালটেছে, প্রতিবছর পাস করে চলে যাওয়া, ও নতুন নতুন ছাত্রের আগমনে ছাত্র সংখ্যা ও ছাত্রদের চরিত্র পালটেছে, পালটেছে স্কুল পরিচালনার নিয়ম কানুন। কিন্তু যেটা কখনোই পালটায়নি, সেটা তাঁর হাসিখুশি স্বভাব ও ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তাঁর রসিকতা বোধ ও কথা বলার ধরণ, সকলকে হাসতে বাধ্য করতো। তাঁর মতে প্রাণখুলে হাসতে পারলে, যেটা মানুষের জীবনে আজ বড়ই অভাব, শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে। পাড়ার সকলে হারাধন বাবুকে ভালবাসেন, সম্মান করেন। স্বাস্থ্য সচেতন স্থানীয় লাফিং ক্লাবের বয়স্ক সদস্যরা নিজেরা তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ক্লাব সভাপতির পদে বসিয়ে সম্মানিত করতে দ্বিধা করেননি। তিনি রোজ ক্লাব প্রাঙ্গণে গিয়ে তাঁর বয়সি সদস্যদের সাথে গল্প করে ও স্বাস্থ্য সচেতন বেশ কিছু মানুষের কৃত্রিম হাসির মহড়া দেখে, অনেকটা সময় আনন্দে কাটান। তাঁর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথায় তাঁর সমবয়সি বৃদ্ধদের হাসির আওয়াজে, লাফিং ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের কৃত্রিম হাসির আওয়াজ প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায়।

এহেন হারাধন বাবু আজ হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে, ডাক্তার দেখাবার জন্য চড়া রোদে অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে বাসে উঠলেন। বাসে বেশ ভিড়, তিনি বরিষ্ঠ নাগরিকদের আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওই আসনে দুটি যুবক কানে মোবাইলের তার গুঁজে নিজেদের মধ্যে হাসি মশকরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। তারা হারাধন বাবুকে দেখেও একইভাবে বসে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি যুবক দুটির উদ্দেশ্যে মৃদু স্বরে বললেন, “আমাকে একটু বসতে দেবে বাবা, আমি বড় অসুস্থ”।

যুবক যুগল কোন উত্তর দিলো না।

হারাধনবাবু আবার বললেন, “আমি আর দাঁড়াতে পারছি না বাবা, আমি বড় অসুস্থ। দয়া করে আমাকে একটু বসতে দাও”।

“ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন নাতো, অসুস্থ তো ফুলবাবু সেজে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কেন”?

যুবকটির কথা শুনে হারাধন বাবুর কান লাল হয়ে গেলেও, বাসের অনেকেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো, কিন্তু কারও কোন প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেল না। হারাধন বাবু আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে, অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও বাসের মেঝেতেই বসে পড়লেন। বাসের লোক চলাচলের জায়গায় বসে পড়ায় বেশ অসুবিধা দেখা দেওয়ায় অনেকেই, এমনকী কন্ডাক্টার পর্যন্ত তাঁকে উঠে দাঁড়াতে বললেন। হারাধন বাবুর শরীর তখন ঘামে ভিজে গেছে। বাধ্য হয়ে তিনি কোনক্রমে আবার উঠে দাঁড়ালেন।

যুবক দুটির একজন একটা গা জ্বালানো হাসি হেসে বললো, “একেই বলে শক্তের ভক্ত”।

সামনে পিছন থেকে আবার একবার হাসির রোল ভেসে আসলো।

হারাধন বাবু পরের স্টপেজে নামবেন। নামার সময় জামার হাতায় কপালের ঘাম মুছে যুবক দুটিকে বললেন, “ভালো থেকো বাবারা”।

“দিব্যি তো চলে আসলেন, শুধু শুধু অসুস্থতার ভান করেন কেন? অনেক তো বয়স হলো, এবার সুযোগ নেওয়ার স্বভাবটা ছাড়ুন না। এইজন্যই দেশটার আজ এই অবস্থা”।

আবার একবার হাসির রোল।

হারাধন বাবু বাস থেকে নামার সময় শুধু একবার বললেন, “তাহলে আমার অনেক বয়স হয়েছে বলছো”?

বেশ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাস থেকে নেমে হারাধন বাবুর হঠাৎ মনে হলো, তাঁর যথেষ্ট কষ্টের মাঝেও তাঁর কথায় তো বেশ কিছু লোকের হাসির উদ্রেক হয়েছে। মানুষ আজ হাসতে ভুলে গেছে, এটাই তো একটা বড় পাওয়া। ধীরে ধীরে তিনি ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।

সুবীর কুমার রায়

০৬-০৫-২০২০

জ্যোৎস্না মাসি { লেখাটি প্রতিলিপি-বাংলা, ও Sahityashruti পত্রিকায় প্রকাশিত।}

14

এমন একটা সময় ছিল, যখন কর্মসূত্রে সপ্তাহের পাঁচটা দিন স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ছেড়ে অন্য এক জেলায় গিয়ে থাকতে হতো। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন যোগাযোগহীন, মোহনার নিকটবর্তী এই অঞ্চলটিতে জীবনের বেশ কয়েকটি বছর কাটাতে হয়েছিল। দিনের বেলাটা অফিসের কাজ, গ্রামে গ্রামে সাইকেল নিয়ে সরকারি অনুদানযুক্ত ঋণ আবেদনের তত্ত্বানুসন্ধান ও ঋণ পরিশোধের জন্য তাগাদায় যাওয়া, ইত্যাদি নিয়ে সময় কেটে গেলেও, সন্ধ্যার পর থেকে অন্ধকারে সময় আর কাটতে চাইতো না। বিকালের পর থেকে নিকটবর্তী শহরের সাথেও প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই জায়গায়, অফিস থেকে ফিরে আমাদের একমাত্র বিলাসিতা ছিল, মাদুর পেতে ছাদে শুয়ে থাকা, ও মাঝেমধ্যে তাস পেটানো। আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে মাঝেমাঝে তাস খেলার অছিলায় দোতলা থেকে একতলায় আসতো, যদিও আসার মূল কারণ ছিল, চা খাওয়া ও বিড়ি সিগারেট ফোঁকা। তাস খেলায় খেলোয়ারের অভাব হলে তাকে আমরা খেলতে নিতাম, এমনকী ওপর থেকে ডেকেও নিয়ে আসতাম। গরমের সময় প্রচণ্ড গরম, শীতে বেশ ঠান্ডা, ও বর্ষাকালে জলকাদা ও ভয়ংকর সাপের উপদ্রব নিয়ে দিন কেটে যেতো।

আমরা একই অফিসের পাঁচজন, একটা দোতলা বাড়ির একতলায় মেস করে থাকতাম। জ্যোৎস্না নামে একজন বয়স্কা রান্নার মাসি দুবেলা রান্না করে দিয়ে যেত। ওই অঞ্চলে পয়সা খরচ করে বাড়িতে রান্না করে দিয়ে যাবার জন্য রান্নার লোক রাখার মতো বসবাসকারী মানুষ বিশেষ ছিল না বললেই চলে। আমাদের মতো কর্মসূত্রে যারা বাইরে থেকে আসতো, তারা কাজের শেষে অধিকাংশই নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত, অথবা নিজের রান্না কোনমতে নিজেই করে নিতো। গরিব এলাকা, কাজেই খোঁজ করলে হয়তো অন্য রান্নার লোক পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারতো, কিন্তু আমাদের রান্নার মাসির মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও এহেন সুস্বাদু রান্নার হাতের একজন দ্বিতীয় মাসির সন্ধান পাওয়া শুধু শক্ত নয়, হয়তো অসম্ভবই ছিল। স্বাভাবিকভাবে মেসের এক একজন এক এক প্রকৃতির হলেও, পাত্রের অভাবে তেল ও জল একই পাত্রে সহাবস্থান করতে বাধ্য হতো। দীর্ঘদিন আগে মাসির স্বামী বসন্ত, স্থানীয় এলাকার আরও অনেকের মতোই মাসিকে ছেড়ে অন্য একটি মহিলার সাথে বসবাস করতে শুরু করে। এটা ওই অঞ্চলে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও নির্দোষ কর্ম বলেই প্রচলিত ও বিবেচিত ছিল। অনেকটা লাক্স ছেড়ে সিন্থল সাবান ব্যবহার করার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে মাসির কপালে বসন্তের দেওয়া উপহার স্বরূপ একটি কন্যা সন্তান, ও তাকে মানুষ করা ছাড়া, এই সুদীর্ঘ জীবনে আর কোন সুখের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। উপায় না থাকায় মাসি তার মেয়ে জামাইয়ের কাছে তাদের কাজের লোকের মতোই থাকতো। অনেক সময় মেয়ে ও জামাই তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে বলে শুনতাম। জামাই তাকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বললেও, আমার ভয়ে সে খুব একটা বাড়াবাড়ি করার সাহস দেখাতো না, কারণ অল্প টাকা হলেও, আমার ব্যাঙ্কে তার নামে একটা সরকারি লোন ছিল। কাজেই একমাত্র আপনার লোক হলেও, তার স্বামী, কন্যা, বা জামাতা, কেউই তার প্রকৃত আপনার লোক ছিল না। ত্রিভূবনে তার আপনার বলতে ছিল খানকয়েক ছাগল। অধিকাংশ দিনই সন্ধ্যায় মাসি আসতে বেশ দেরি করে দিতো। চায়ের আশায় অন্ধকারে আমরা পাঁচজন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে বসে থাকতাম। ঘরের ভিতর থেকেই আমরা মাসির আগমন বার্তা পেয়ে যেতাম। সমগ্র পৃথিবীর প্রতি বিড়বিড় করে বিষোদগার করতে করতে ঘরে ঢুকতো। রাগ ক্ষোভ দুঃখ, অভিমান, সবকিছু একটাই কারণে, আর সেটা তার ছাগল খুঁজে না পাওয়া। প্রায় রোজই যুক্তি করে কোন না কোন ছাগল আমাদের অসুবিধায় ফেলার জন্য আত্মগোপন করে কেন থাকতো জানার সুযোগ হয়নি।

আমাদের মেসের রান্নার জায়গায় দুটো কাঠের তাকে বিভিন্ন কৌটোয় ডাল তেল নুন মশলা ইত্যাদি রান্নার উপকরণ রাখা থাকতো, মাসিই গুছিয়ে রাখতো। মাসির ফরমাশ মতো আমরা শুধু কিনে এনে দিয়েই আমাদের দায়িত্বে ইতি টানতাম, কোন কৌটোয় কি আছে বা কতটা আছে খোঁজ রাখারও প্রয়োজন বোধ করতাম না। মেস জীবনের সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন, যে মেসের বিভিন্ন সদস্যের পছন্দ অপছন্দ, খাদ্যরুচি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ইত্যাদি ভিন্ন ধরণের হয়। আমাদের মেসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একফালি রান্নার জায়গাটার ঠিক পাশেই ছিল আরও ছোট একটা বাথরূম ও পায়খানা। বাথরূমটা ভাতের ফেন গালা ছাড়া, অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা হতো না। হতো না, কারণ জলের অভাব। মাসি প্রতিদিন কলসি করে খাবার ও রান্নার জল নিয়ে এসে রেখে দিতো। বাড়ির ঠিক পিছনে একটা ছোট্ট ডোবা ছিল, যদিও তাতে জলের চেয়ে পাঁকের পরিমাণই বেশি ছিল। বাথরূমে একটা ছোট চৌবাচ্চা ছিল। সেই ডোবা থেকেই স্নান করার সময় আমরা বালতি করে জল বয়ে এনে চৌবাচ্চা ভরে রাখতাম। মাসি ছিল অসম্ভব পরিষ্কার, কিন্তু শুচিবাইগ্রস্ত আদপেই নয়। ফলে মাসির কঠোর শাসনে হাওয়াই চটি পায়ে রান্নাঘর লাগোয়া বাথরূম পায়খানা ব্যবহার করা ছিল বড়ই পীড়াদায়ক। মেসের আর সকলের থেকে মাসি কিন্তু আমায় একটু বেশিই ভালবাসতো। আমার একটু বেশি জল খাওয়া অভ্যাস বলে মাসি আমাকে কখনও ফর্সা বাবু, কখনও বা জল বাবু বলে ডাকতো। সকালে ও সন্ধ্যায় সবার অলক্ষ্যে শুধুমাত্র আমার জন্য দ্বিতীয় দফার এক কাপ চা সরিয়ে রাখতো।

এরমধ্যে আমাদের অফিসেরই নতুন একজনকে মেসে জায়গা দেওয়া হলো। তিনি আবার এক অদ্ভুত মানসিকতার মানুষ। আমরা সকালে খেয়েদেয়ে অফিস চলে যেতাম। মাসি তার দিনগত কাজকর্ম সেরে, খেয়েদেয়ে অথবা নিজের খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যেত। এই নতুন সদস্যটির সন্দেহ হলো, যে মাসি তেল মশলা ইত্যাদি সরিয়ে রেখে, নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এটা যে বাস্তবে সত্য, এটা আমরা সকলে বুঝলেও চুপ করে মেনে নিতাম। এই নিয়ে ভাবার পিছনে সময় ও আলোর অভাব একমাত্র অন্তরায় ছিল। যাইহোক, এই নতুন সদস্যটি এক সোমবার বাড়ি থেকে ধুয়ে মুছে একটি কাচের শিশি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। জানা গেল, আমাদের রান্নার জন্য প্রতিদিন পঁচাত্তর গ্রাম সরষের তেলের বরাদ্দ হওয়া উচিৎ, তাই তিনি অনেক খুঁজে পেতে ঠিক পঁচাত্তর গ্রাম তেল ধরে, এমন একটি শিশি চুনচুনকে নিয়ে এসেছেন। পরের দিন থেকে তিনি ওই বিশেষ শিশিটিতে তেল ভর্তি করে রেখে, তেল রাখার মূল পাত্রটি মাসির নাগালের বাইরে রেখে যেতে শুরু করলেন। অন্যান্য সমস্ত রন্ধন সামগ্রী একই প্রক্রিয়ায় মাসিমুক্ত করা অসম্ভব ও পরিশ্রম সাধ্য, তাই আপাতত তারা স্ব স্ব স্থানেই অবস্থান করতে থাকলো। ভগবান মঙ্গলময়, তাঁর অশেষ কৃপা, তাই বোধহয় তিনি নতুন সদস্যটিকে নিজ চাকরিটি ছেড়ে মাসির তেলমশলা চুরি রোধে নিযুক্ত না করে, তার নিজ সংসার ও আমাদের কল্যানার্থে চাকরিটি বহাল রাখাই মনস্থ করলেন, যদিও তার ফল হলো ভয়ংকর। নিজের বাড়ির জন্য তেল মশলা যোগানের সহজ পথটি বন্ধ হওয়ায়, আমাদের মেসের রান্নার ওপরেও মাসির প্রভাব পড়তে বিলম্ব হলো না। রান্নায় মিষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পাওয়া গেল, “কি করবো? তেল কম, তাই বেশি করে মিষ্টি দিতে হচ্ছে”। চিনি যে সরষের তেলের বিকল্প, সেদিন প্রথম জানতে পারলাম।

সে যাইহোক, সন্ধ্যার সময় অতো দেরি করে আসা নিয়ে সকলের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বললেও, তার বহিঃপ্রকাশ খুব একটা ছিল না। কারণ ওই সময়টাতে অশান্তি করার থেকে এক কাপ চা হাতে পাওয়া অনেক জরুরী ছিল। আমার নিজেরও খুব রাগ হতো, কিন্তু অসহনীয় গরম বা অত্যন্ত শীতেও মাসিকে একটা ছোট কুপির স্বল্পালোকে মুখবুজে উনুন জ্বেলে চা করে রান্নার আয়োজন করতে দেখলে, রাগকে দূর করে মায়া সেই স্থান দখল করতো। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকা প্রয়োজন, উচিৎও বটে।

একদিন এক প্রচণ্ড শীতের সন্ধ্যায় অন্ধকারে মশার কামড় খেয়ে মাসির আগমনের অপেক্ষায় বসে আছি, মাসির দেখা নেই। ক্রমশঃ রাত বাড়ছে, আশেপাশে কোন দোকানও নেই যে চা খেয়ে আসবো। ভয় হচ্ছে শেষপর্যন্ত মাসি আসবে তো? ভরসা একটাই, মাসি খুব একটা দূরে থাকে না ও একদিনও কামাই করে না। অবশেষে বাইরে থেকে মাসির সেই বিড়বিড় করে ক্ষোভ প্রকাশের আওয়াজ পাওয়া গেল। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশি রাত করে এসেছে বলেই বোধহয়, আজ গলার আওয়াজও দুই পর্দা চড়ায় বাঁধা। ঠিক করলাম আর নয়, আজই এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। আমি জানতাম, যে সকলের মধ্যে মাসি আমাকে বেশি ভালবাসে, মাঝেমধ্যে সামান্য হলেও আমার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যও পেয়ে থাকে, কাজেই যা করার আমাকেই করতে হবে।

ঘরে ঢুকতেই আমি মাসির হাত ধরে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম, “মাসি, তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে ছাগল নিয়ে থাকো, তোমায় আর রান্না করতে হবে না”। মাসি একটু অবাক হয়ে গিয়ে আমায় কিছু বলতে চাইছিলো, কিন্তু আমি তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিলাম। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। মেসের সকলে খুব ভয় পেয়ে গিয়ে আমায় বললো, বাড়ি তো ফিরিয়ে দিলেন এবার কি হবে? আমি তাদের আশ্বস্ত করে বললাম, “ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমাদের যেমন মাসিকে ছাড়া চলবে না, মাসিরও তেমনি আমাদের ছাড়া চলবে না। আজ যদি কোন কারণে ও না আসতো, তাহলে কি হতো? একটা দিন আমরা নিজেরা চালিয়ে নিতে পারবো না? আজ রাতে ভাত ডাল আলুভাতে দিয়ে চালিয়ে নেবো। কাল দেখা যাবে”। চালিয়ে তো নেবো, কিন্তু চালিয়ে নেওয়ার মূল সমস্যাটা যে উনুন ধরানোয় কেন্দ্রিভুত, আগে বুঝিনি। অনিল জানালো, যে সে ভাত রান্না করতে জানে। মহা খুশি হয়ে বললাম, “তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই গেল। তুই ভাতটা করে ফেল, আমি ডাল আর মচমচে করে আলুভাজা করে ফেলছি। গরম গরম ফার্স্ট ক্লাস খাওয়া হবে। তবে সবার আগে উনুন ধরিয়ে চা করতে হবে”।

উনুন ধরানো যে যুদ্ধ বিমান চালানোর চেয়েও শক্ত কাজ, তখন কি আর জানতাম ছাই। উনুনে খানকতক ঘুঁটে দিয়ে তার ওপরে কয়লা দিয়ে নীচের গর্তে দুটো ঘুঁটে রেখে, তাতে বেশ করে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। মুহুর্তের মধ্যে গোটা বাড়ি ধোঁয়ার আবরণে ঢেকে গেলেও, উনুন কিন্তু জ্বললো না। নীচের গর্তে ঘনঘন হাওয়া করায় ধোঁয়ার উড়ে বেরানোয় কিছু সুবিধা হল বটে, কিন্তু উনুন জ্বালানোয় কোন উপকার হলো না। এবার ঘাবড়ে গেলাম, ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে জল বেরোনোর সাথে সাথে ওই শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করলাম। এমন সময় দোতলা থেকে বাড়িওয়ালার ছেলে এসে হাজির হলো। মাসি তাদের আত্মীয় হলেও, মাসিকে তারা বিশেষ পছন্দ করতো না। সে বোধহয় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গোটা নাটকটাই দেখেছে বা শুনেছে। সে শুধু বললো “মাসিকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তো, বেশ করেছেন”। আমি আর এই ব্যাপারে কথা বাড়তে না দিয়ে উনুন ধরানোয় মনোনিবেশ করলাম। সে আমাকে সরে যেতে বলে উনুন থেকে সমস্ত কিছু বার করে বাথরূমে ফেলে, নতুন করে ঘুঁটে কয়লা দিয়ে সাজিয়ে, উনুনে আগুন দিয়ে হ্যারিকেনগুলো জ্বালিয়ে দিলো। এবার কিন্তু উনুন ধরতে খুব বেশি সময় লাগলো না। চা তৈরি হলো, আজ তার কদরই অন্যরকম। আমাদের সাথে চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বললো, “আজ তো আর তাস খেলার কোন সুযোগ নেই। আপনারা রান্না করুন, কোন প্রয়োজন হলেই আমায় ডাকবেন”।

সে চলে যাবার পর অনিল ভাত বসিয়ে দিলো। আমি মচমচে আলুভাজার জন্য সরু সরু করে আলু কাটতে শুরু করে দিলাম। ভাত হলেই ডাল বসিয়ে দেবো। তারপরে আলু ভাজা হলেই গল্প শেষ। কতক্ষণের আর মামলা? কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর অনিল গিয়ে ভাতের কতদূর দেখে আসছে। সে গ্রীন সিগনাল দিলেই আমি ডাল রাঁধার প্রস্তুতি নেবো। ছেলেরা চুল বাঁধে না, চুল আঁচড়ায়। তা নাহলে গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে অনিল বাথরূমে ভাতের হাঁড়ি নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে হাঁড়ির দুদিকে কাপড় দিয়ে কাত করে ধরে, ফেন গালতে শুরু করলো। এবার আমার খেলা শুরু। জীবনের প্রথম ডাল রান্নার দিনেই যে এই শর্মা আলোড়ন ফেলে দিতে পারে, সে ধারণা বোধহয় এদের করোরই নেই। মুসুর ডাল কি করে রাঁধে সঠিক ধারণা নেই। মাকে দেখেছি শুকনো কড়ায় মুগ ডাল ভেজে রান্না করতে। ডাল ভাজাটাও ভারী সুন্দর খেতে লাগে। উনুনে কড়া বসিয়ে এ কৌটো ও কৌটো খুঁজেও মুগ ডালের সন্ধান পেলাম না। শেষে খুঁজে পেলাম বটে কিন্তু তার পরিমাণ খুবই অল্প। নিশ্চই অন্য কোন কৌটোয় আছে ভেবে খোঁজার আগে যতটুকু পেয়েছিলাম কাজ এগিয়ে রাখার জন্য উনুনের ওপর কড়ায় দিয়ে দিলাম। কড়াটা এত গরম হয়ে গেছে, যে ডালগুলো কড়ায় ঢালার সাথেসাথেই মোটামুটি ষাট শতাংশ ডাল গরম সহ্য করতে না পেরে,  লাফ দিয়ে কড়ার বাইরে চলে গেল। সোনা মুগের ডাল কেন বলে জানি না, সম্ভবত সোনার মতো রঙ ধারণ করে বলে। যারা কড়ার বাইরে লাফিয়ে চলে গেল, তাদের গাত্রবর্ণ আর দেখা সম্ভব হলো না, কিন্তু অবশিষ্ট চল্লিশ শতাংশ ডাল, যারা পালাবার সুযোগ না পেয়ে কড়ার ভিতর রয়ে গেল, তাদের একজনেরও গায়ের রঙের সাথে সোনার মিল খুঁজে পেলাম না। বরং তাদের সাথে আলকাতরা, কয়লা, বা অমাবস্যার রাতের কোথায় একটা যেন মিল খুঁজে পেলাম। কি করবো ভেবে না পেয়ে চটপট্ কড়ায় জল ঢেলে দিলাম। মাসির স্বভাব ছিল কোন কিছু শেষ হবার আগেই আমাদের জানানো, অতএব মুগের ডালের দ্বিতীয় কোন কৌটো অবশ্যই আছে। তাই আদা জল খেয়ে মুগের ডালের উৎস সন্ধানে লেগে পড়লাম। একে একে এ কৌটো ও কৌটো হাতড়েও মুগের ডালের সন্ধানে ব্যর্থ হলাম বটে, তবে মুসুর ডালের সন্ধান পেলাম। ঈশ্বর করুণাময়, মুসুর ডাল রন্ধনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শুকনো কড়ায় ভেজে নেওয়ার নির্দেশ দেননি। আন্দাজ মতো মুসুর ডাল, মুগের ডালের ফুটন্ত কড়াইয়ে দিয়ে দিলাম। এবার কি করা উচিৎ ভেবে না পেয়ে তাতে সামান্য হলুদ গুঁড়ো, নুন, ও চিনি দিয়ে দিলাম।

এদিকে অনিল তখনও ভাতের হাঁড়ির দুদিকে কাপড় দিয়ে ধরে ফেন গেলেই যাচ্ছে। আর কতক্ষণ ফেন গালতে লাগবে জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিলো, “ও সুবীরদা, ফেন তো বেড়িয়েই যাচ্ছে শেষ হচ্ছে না যে”!  মাসিকে আমি তাড়িয়েছি, তাই দায় আমার। আর সকলে চৌকিতে শুয়ে বসে গুলতানি করলেও, আমার উপায় নেই। হাঁড়ি সোজা করে স্বল্প আলোতেও যেটা নজরে পড়লো সেটা আঁৎকে ওঠার মতো। হাঁড়িতে বোধহয় শুধুই মাড়, ভাত বিশেষ চোখে পড়ছে না। ওই অবস্থায় অবশিষ্ট ভাতের রেস্ট্ ইন পিস কামনা করে তাকে একপাশে রেখে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম ডাল সিদ্ধ হয়ে গেছে। ডাল রান্নাটা অন্তত ভালোই হয়েছে বলে মনে হলো, কারণ কিছু কালো কালো স্পট্ থাকলেও, মোটের ওপর ডালের রঙ বেশ হলুদ হয়েছে। অবশ্য সেটা ডালের ধর্মে না হলুদ গুঁড়োর আধিক্যে, ঠিক বোঝা গেল না। ডাল একটা পাত্রে ঢেলে রেখে, কড়াইটা ভালো করে ধুয়ে সাধের মচমচে আলু ভাজার জন্য তাকে উনুনে বসালাম, এমন সময় বাড়িওয়ালার ছেলে সম্ভবত বিড়ির লোভে এসে হাজির হলো। কড়াইতে সবে তেল ঢেলেছি, আমার ইচ্ছা ছিল তেল বেশ গরম হলে নুন হলুদ মাখানো আলুগুলো অনেক বেশি যত্ন নিয়ে ধীরে ধীরে ভাজবো, কারণ আজ রাতে ওটাই আমার তুরুপের তাস। কাটা আলুর পাত্র হাতে আমায় দেখে সে বললো “কি করছেন, আলু ভাজছেন? দিন আমি ভেজে দিচ্ছি”। এরপর কিছু বোঝার আগেই সে আমার হাত থেকে আলুর পাত্রটা নিয়ে  কড়াইতে ঢেলে দিলো। আলুর সাথে বেশ কিছুটা হলদেটে জলও গরম কড়াইয়ের ঠান্ডা তেলে আশ্রয় পেয়ে ধন্য হলো। ঠান্ডা তেল না তার হাতের গুণে জানি না, আলুভাজাটা একটা মাঝারি আকারের বলের রূপ ধারণ করলো। ভয় পেলে সজারু যেমন নিজেকে গুটিয়ে ফেলে বলের আকৃতি ধারণ করে, অনেকটা সেরকম। রাতে প্রায় স্ট্র দিয়ে খাওয়ার মতো ভাত ও অসাধারণ সুস্বাদু ডাল, সাথে ওই আলুর বল ভেঙে খানিকটা করে তেলমাখা আলুভাজা খেয়ে ও খাইয়ে আমার কি অবস্থা হয়েছিল, সেকথা আর নাই বা বললাম।

পরদিন সাতসকালে মাসি এসে হাজির হয়ে উনুন ধরিয়ে চা করে সকলকে দিয়ে গেল। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো। বেশ কিছুদিন মাসির ছাগলগুলো আমাদের ভয়ে সুবোধ ছাগলের মতো সন্ধ্যার আগেই মাঠ থেকে ফিরে আসা শুরু করলো। মাসি কিন্তু আগের মতো দুবেলাই তার ফর্সা বাবুর জন্য এক কাপ করে অতিরিক্ত চা আলাদা করে সরিয়ে রাখতো। মাসিকে নিয়ে কত ঘটনা, লিখতে গেলে রামায়ণ হয়ে যাবে।

এর অনেক পরে আমি বদলি হয়ে আবার নিজের শহরে ফিরে আসি। চলে আসার আগে মাসির জন্য ভালো শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাকে শাড়ি ও কিছু টাকা দিতে সে আমার হাতদুটো চেপে ধরে শিশুর মতো কেঁদেছিল। কতো স্মৃতি! তখন কষ্ট হতো, বড় অসহায় ছিল প্রাত্যহিক জীবন। আজ কিন্তু সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো মন্দ লাগে না, একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছা করে। অনেকগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। জানি না মাসি কেমন আছে, বা আদৌ বেঁচে আছে কী না। প্রার্থনা করি মাসি যেখানেই থাকুক, শেষ বয়সে একটু সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক, আনন্দে কাটুক তার বাকি জীবন।

সুবীর কুমার রায়

১৪-০৬-২০২০