বাড়িওয়ালা বেশ কিছুদিন থেকেই খুব খারাপ ব্যবহার করছিলেন। তাঁর একটা হাড় জিরজিরে গরু ছিল। শুকনো কিছু খড় ও ঘাস খেতে দিয়ে, তিনি গরুটার কাছে অনেক দুধের প্রত্যাশা করতেন। তাঁর দোষ নয়। তাঁদের ও আমাদের গরু একই গোয়ালে পাশাপাশি থাকতো। আমাদের গরুটা ছিল বাবার অত্যন্ত প্রিয়। শীতকালে আমাদের গরম জামা বার করার আগেই, বাবা তার জন্য বস্তা কেটে গরম জামা তৈরি করে দিতেন। পিঠের ওপর মোটা বস্তার অংশটা রেখে, দড়ি দিয়ে পেটের তলা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হতো। আমাদের সংসারে সাত-আটজনের জন্য মাসে যা খরচ হতো, তার থেকে বোধহয় কিছু বেশিই, বাবা শুধু এই একটা গরুর জন্য খরচ করতেন। খোলচুনি, সরষের তেল, আঁখের গুড়, ছাতু, ইত্যাদি দিয়ে খড় মেখে, তাকে খেতে দেওয়া হতো। এছাড়া ভাতের ফ্যান, টাটকা শাকপাতা, কচি ঘাস ইত্যাদি তো ছিলই। কিন্তু আমাদের মেমসাহেব গরু, প্রতিদিনই বেশ কিছুটা করে খাবার নষ্ট করতেন। বাড়িওয়ালার রোগা পটকা গরুটা সেই খাবার চোখবুজে পরম তৃপ্তি সহকারে খেত। জানিনা দু’জনের মধ্যে কোন গট্-আপ কেস ছিল কী না। কিন্তু তাঁর গরু দিনে এক-দেড় সের দুধ দেয়, অথচ আমাদের দেশি গরু কেন রোজ সাত সের দুধ দেয়, এটাই ছিল তাঁর প্রধান দুঃখের ও রাগের কারণ।
শেষ পর্যন্ত এই গরু রাখা নিয়ে অশান্তি শুরু হলো। অন্যান্য অনেক কিছু উপদ্রবও সঙ্গে এসে হাজির হলো। গরুটা ছিল বাবার প্রাণাধিক প্রিয়। গরুটাও কী সুন্দর বাবার কথা বুঝতো ও শুনতো। অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার আগে, একবার গোয়ালঘর ঘুরে আসা ছিল বাবার অভ্যাস। কতদিন দেখেছি গরুটা তার গলায় বাঁধা দড়ি, খুঁটিতে ও পায়ে জড়িয়ে ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা গোয়ালঘরে ঢুকে দড়িটা ঠিক করে দিতেন। গরুটার পায়ে দড়ি জড়িয়ে গেলে, বাবা শুধু বলতেন, পা তোল্। অদ্ভুত ব্যাপার, গরুটা সঙ্গে সঙ্গে পা উচু করতো। বাবা দড়িটা ঠিক করে দিতেন। জানিনা এত বুদ্ধিমতী গরু নিজেই কেন তার পা তুলে অসুবিধা দুর করতো না।
জন্মের পর থেকেই আমাদের বাড়িতে গরু দেখে এসেছি। এই প্রথম আমাদের বাড়ি থেকে গরু বিদায় নিল। অনেকেরই এই গরুটার প্রতি লোভ ছিল। অনেক দাম দিতেও চেয়েছিল। কিন্তু বাবা টাকার লোভ সম্বরণ করে এক প্রফেসারকে প্রায় বিনামূল্যে গরুটা দিলেন, শুধু মাত্র গরুটার যত্ন হবে বলে। এই গরু নিয়ে কত স্মৃতি।
মনে পড়ে, বাবা কোনদিন জ্বাল দেওয়া পাতলা দুধ খেতেন না। দুধও প্রচুর হতো। প্রতিদিন বাবার জন্য খানিকটা দুধ, মা খুব ঘন করে জ্বাল দিয়ে ক্ষীর করে দিতেন। আমার, আমার ঠিক ওপরের দাদা তপা, ছোটবোন বুলা, ও ছোটভাই মাকার, ক্ষীর নয়, ঐ দুধ জ্বাল দেওয়া পাত্রটার প্রতি খুব লোভ ছিল। চামচ দিয়ে চেঁচে তুলে ওই ক্ষীরের অংশ, মা আমাদের চারজনকে ভাগ করে দিতেন। পাত্র থেকে চামচ দিয় চেঁচে তোলা ঘন দুধের অংশকে আমরা চাঁচি বলতাম। কিন্তু ঐ উপাদেয় পদার্থটি চারজনের তুলনায়, খুবই অপ্রতুল ছিল। তার ওপর কে একটু বেশি পেল, কে ভালো অংশটা পেল, এইসব নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় সমস্যা দেখা দিত। ফলে মা নতুন রুল জারি করলেন— এক এক দিন, এক একজন পাত্রটা চামচ দিয়ে চেঁচে খাবে। সোমবার হয়তো মাকা খেল, মঙ্গলবার বুলা, বুধবার আমি, বৃহস্পতিবার তপা। একদিন খেয়ে আবার তিন-চার দিন অপেক্ষা করা, খুবই কষ্টকর ছিল। কিন্তু আরও কষ্টকর ছিল, অন্য কেউ একা একা খাওয়ার সময়, সেটার প্রতি লোভ না করা।
টুলুদা নামে একজন, সন্ধ্যার সময় আমাদের পড়াতে আসতো। টুলুদার কাছে পড়া চলাকালীন, দুধ ঘন করে একটা বাটিতে ঢেলে, পাত্রটা চেঁচে খাবার জন্য, মা এক একদিন এক একজনকে রুটিন মাফিক ডাকতেন। এই অতি আকাঙ্খিত ডাক শুনে, পড়া ছেড়ে এক একদিন এক একজন উঠে চলে যেতাম। টুলুদা এই ডাক শুনে উঠে যাওয়ার রহস্যটা জানতো না বটে, কিন্তু সেও নিশ্চয় অবাক হয়ে, আমাদের এই এক একদিন এক একজনের পালা করে উঠে যাওয়া, এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসা রহস্যের কারণ খুঁজতো।
সুবীর কুমার রায়।
২০-০৩-২০১৬