লক্ষ্মীবাঈ ও মহারাণা প্রতাপ {লেখাটি প্রতিলিপি বাংলা, ও গল্পগুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

36271711_998507660324983_1780579280690872320_n

বিয়ের অল্প কয়েক মাস পরে আমরা দুজন হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে গেলাম। আমার সাথে আমার এক সহকর্মী, বছর তিনেকের শিশুকন্যা সহ তার স্ত্রী, ও তার এক অবিবাহিতা শ্যালিকা সঙ্গী হলো। হিমাচল আমার আগে ঘোরা, তবে আমার স্ত্রীর দেখা না হওয়ায়, ও বন্ধু ও বন্ধু পত্নীর বিশেষ অনুরোধে তল্পিতল্পা নিয়ে রওনা হলাম।

বেশ কিছু জায়গা ঘুরে খাজিয়ার এসে পৌঁছলাম। খাজিয়ার আমার আগে দেখা হলেও, আগেরবার এই জায়গায় থাকার সুযোগ হয়নি। খাজিয়ারের অসাধারণ সৌন্দর্য আমায় যারপরনাই মুগ্ধ করায়, এবার ওখানে থাকার ব্যবস্থা পাকা করে গিয়েছি। এখন খাজিয়ারের যেসব ছবি দেখি বা লেখা পড়ি, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে সেখানে সৌন্দর্যায়নের জন্য অনেক কিছুই হয়েছে। ঢালু গামলার মতো সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল মাঠ ও ছোট্ট পুকুরের মতো তাল সংস্কার করে, আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। থাকা বা খাওয়ার সুবন্দোবস্তও যথেষ্টই হয়েছে। তবে আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে কিন্তু তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির ওপর কারও বিশেষ মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয়নি। হিমাচল ট্যুরিজমের গেস্ট্ হাউসটিই একমাত্র রাত্রিবাসের জায়গা ছিল। একপাশে পর্দা দেওয়া কাচের দেওয়াল দিয়ে তৈরি গেস্টহাউসটি সত্যিই সুন্দর ছিল। পর্দা সরিয়ে ঘরে বসেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের অনেকাংশই দেখা যেত। দুটো ঘরে মালপত্র গুছিয়ে রেখে স্থানীয় একটা ঝুপড়িতে চা জলখাবার খেয়ে, দুপুরে বাঙালিমতে ডাল, ভাত, আলুর ছক্কা, ও ডিমের অমলেট রান্নার রেসিপি ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে, আমরা সবাই মাঠের একধারে ছোট্ট তালটার কাছে এসে হাজির হলাম।

যাহোক্, অনেকক্ষণ মাঠে হেঁটে হইচই করে সময় কাটলো। মাঠের মধ্যে দিয়ে একটু জোরে হাঁটলে বা ছুটলে, সবুজ মখমলের মতো ঘাসের ভিতর থেকে দলবেঁধে সবুজ রঙের গঙ্গাফড়িং উড়ে যাওয়ার দৃশ্য একটা উপরি পাওনা বলে মনে হলো। রান্না শেষ হতে দেরি আছে, অনেকক্ষণ সময় এইভাবে কাটিয়ে আমরা মাঠের পাশেই গেস্টহাউসের কাছে এসে জড়ো হলাম।

নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব ঠাট্টা তামাশায় মশগুল, এমন সময় দুটো ছেলে “ঘোড়ায় চাপবেন নাকি বাবু” বলে দুটো ঘোড়া নিয়ে এসে হাজির। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউই কোন আগ্রহ প্রকাশ করলো না। কি আর করা যাবে, বিয়ের পর বেড়াতে এসে মুনি ঋষিরাই নতুন বউকে চটাতে চায় না, আমি তো কোন ছার। ইচ্ছা না থাকলেও, বাধ্য হয়ে রাজি হতেই হলো। উনি তো হাসিমুখে ছেলেটির দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে, ঘোড়ার পিঠে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো স্টাইলে উঠে বসলেন। ছেলেটি ঘোড়ার ফিতে ধরে হেঁটে হেঁটে মাঠ ভেঙে এগতে শুরু করলো। আমরা পাঁচজনই একমাত্র ট্যুরিস্ট, কাজেই খদ্দেরের অভাবে দ্বিতীয় ছেলেটি আমাদের এক নাগাড়ে ঘোড়ায় চাপার জন্য অনুরোধ শুরু করলো। একমাত্র আমার আনুকূল্যে তার সঙ্গীটি একজন খদ্দের পাওয়ায়, সে আমাকে বোধহয় দয়ার সাগর ভেবে বসে, আমায় তার ঘোড়াটায় চাপার জন্য অনুনয় বিনয় করতে শুরু করলো।

আমি কিছুতেই রাজি না হওয়ায় ছেলেটি যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন আমার বন্ধুটি বললো, “তোর শুধু বড় বড় কথা, তোর বউকে দেখে তোর শেখা উচিৎ। ঘোড়ার পিঠে চাপার তোর সাহস নেই স্বীকার করতে লজ্জা কিসের? টাকার অভাব হলে বল্, আমি ঘোড়া চাপার খরচ দিয়ে দিচ্ছি”। ব্যাস ঘোড়ার মালিক নতুন উদ্দমে আবার ঘোড়ায় চাপার অনুরোধ শুরু করে দিলো। তার অনুরোধের আগুনে সকলের সামনে বন্ধুর ব্যঙ্গ্যোক্তি ঘিয়ের কাজ করলো। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর সে আমাকে ভীরু কাপুরুষ ইত্যাদি চোখা চোখা বিশেষণে ভুষিত করায় ভীষণ রাগ হলো। ঘোড়ার মালিককে ঘোড়াটা নিয়ে আসতে বললাম।

হিন্দী ফিলমের নায়কের কায়দায় ঘোড়াটার পিঠে চেপে বসে লক্ষ্য করলাম আমার উনি মাঠের বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছেন। ঘোড়া ও ঘোড়ার মালিক ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে। এবার আমার ঘোড়ার মালিক মুখে নানারকম শব্দ করতে করতে প্রথমে ধীরে, তারপর ক্রমশঃ গতি বাড়িয়ে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিলো। ঘোড়াটা চেতকের প্রেতাত্মা কিনা জানি না, তবে সে বোধহয় আমাকে মেওয়ারের রাজা মহারাণা প্রতাপ ভেবে ও বিশাল মাঠটাকে হলদিঘাটের রণপ্রান্তর ভেবে এবার শুরু করলো দৌড়। মুহুর্তের মধ্যে আমি আগের ঘোড়াটাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলাম। আমি ঘোড়ার গলার ফিতে ধরে টেনে, কিছুক্ষণ আগে শোনা শব্দগুলো মুখ দিয়ে করেও তার তীব্র গতি রোধ করতে পারলাম না। হাঁটু দিয়ে তার পেটের কাছে আঘাত করেও কিছু সুবিধা তো হলোই না, বরং গতি কিছু বৃদ্ধি পেলো বলেই মনে হলো। ঘোড়ার মালিক আমায় ঘোড়ার গতি কমাবার, বা ঘোড়াকে দাঁড় করাবার মন্ত্র বা কায়দা শিখিয়ে দেয়নি। এবার সত্যিই ভয় পেলাম। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার বিপদের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। দুদিকে যে লোহার ক্লিপের মধ্যে পা ঢুকিয়ে বসেছিলাম, তার থেকে পা বার করে নিলাম, কারণ চিন্তা করে দেখলাম ওই ক্লিপের ভিতর পা আটকে থাকা অবস্থায় পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। যতক্ষণ না ঘোড়া দয়া করে দৌড় বন্ধ করবে, ততক্ষণ আমাকে মাঠের ওপর ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে যেতে হবে। পা বের করে নেওয়ার একমাত্র কারণ, প্রয়োজনে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে, নিজেকে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করে নেওয়ার চেষ্টা করা যাবে। পা বের করে নেওয়ার পর পাদুটো নিয়ে অসুবিধা হওয়ায়, ঘোড়ার পিঠে বসে আধশোয়া হয়ে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলাম। সবই আমার কপাল। লোকে নতুন স্ত্রীর কন্ঠলগ্ন হয়, আমি এক তাগড়াই হতভাগা ঘোড়ার।

অবশেষে মালিকের কাছে ফিরে আসার পর তিনি স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। কোনরকমে পিঠ থেকে নেমে বুঝলাম, আমার দুই পায়ের ঊরু থেকে প্রায় পাতা পর্যন্ত ছড়ে গিয়ে রক্ত বার হয়ে গেছে।

সুবীর কুমার রায়

০১-১০-২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s