স্কুলে দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য নামে একজন ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। অজাতশত্রু কথাটা বইতে পড়া যায়, বা অভিধানে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে কেউ অজাতশত্রু হতে পারে না। কারণ একজন ব্যক্তি কখনই সকলের প্রিয় হতে পারে না। শত্রু মাত্রই তো আর খুনোখুনি, রক্তারক্তি কাণ্ড করে না। একজন যদি অপর একজনকে পছন্দ না করে, তবে দুজনে দুজনের মিত্র, একথা নিশ্চই বলা যায় না। কিন্তু সৌম্যদর্শন শিবতুল্য এই মানুষটি ছিলেন স্কুলের সবার প্রিয়, সবার মিত্র, সবার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি ছিলেন সত্যিকারের শিশুসুলভ নিষ্পাপ, নিষ্কাম এক আদর্শ পুরুষ।
দ্বিজেন বাবুরা ছিলেন বারো ভাইবোন। বেনারসে বাড়ি। তাঁর কাছ থেকে তাঁর বাড়ির কথা শুনতাম। তাঁর বড় ভাইবোনেরা ছিলেন কেউ ঈশান স্কলার, কেউ ডক্টরেট্, প্রথম বিভাগে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। দ্বিজেন বাবু ছিলেন, এদের মধ্যে অতি সাধারণ, ইংরেজিতে এম.এ.। ছাত্রদের তিনি আদর করে ছাওয়াল বলতেন। ইংরেজি ভাষায় এতো পাণ্ডিত্য সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর একটাই দোষ ছিল, তিনি থামতে জানতেন না। আমাদের সময় যতদূর মনে পড়ে, সম্ভবত দুশ’ নম্বরই আনসিন্ ছিল। কোন টেক্সট্ বই ছিল কী না সঠিক মনে করতে পারছি না।
একটা স্টোরি লিখতে হতো একশত কুড়ি শব্দের মধ্যে। একটা কুকুর মুখে করে মাংস খণ্ড নিয়ে নদীর ওপর ব্রিজ দিয়ে পার হবার সময়, নদীর জলে তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে কী করলো, এই গল্পটা তিনি আমাদের লিখে দিলেন। তাঁকে কোন কিছু লিখে দিতে বললেই, তিনি ডিক্টেট্ করতেন, আমরা লিখতাম। পরে অন্য কোনদিন, সেই লেখাটাই নিজে লিখেছি বলে তাঁকে দেখালে, তিনি অনেক শব্দই পরিবর্তন করে দিয়ে বলতেন, এই জায়গায় এই শব্দটা ঠিক ভালো লাগছে না, বরং এই শব্দটা লিখলে অনেক বেশি ভালো শোনাচ্ছে।
যাহোক্ কুকুরের মাংস নিয়ে নদী পর্যন্ত আসতেই, বোধহয় দুশ’ শব্দ লেখা হয়ে গেল। এর মধ্যে পঁচিশ শতাংশ শব্দ, জীবনে কোনদিন শুনিনি। ফলে পরবর্তীকালে আমরা নিজে লিখে তাঁকে দিয়ে শুদ্ধ করাতাম। তাঁর একটা বড় গুণ ছিল, তিনি কখনও ছাত্রদের গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, বকাবকি পর্যন্ত করতেন না। দরকারও হতো না। লেখায় কোন রকম ভুলভ্রান্তি হলে, বড়জোর গাধা বলতেন। অন্য যে কোন শিক্ষক, এমনকী আমার বাবাকেও দেখেছি, ইংরেজি লেখায় কোন ভুল পেলে রাগারাগি করতেন এবং ক্রমে ক্রমে নাউন, প্রোনাউন কয় প্রকার, ভার্ব, অ্যাডভার্ব, টেন্স্, জেন্ডার, সব একে একে টেনে এনে তালগোল পাকিয়ে, জানা জিনিসকে অজানা করে ছাড়তেন। দ্বিজেন বাবু ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। আমি ভালো ছেলে, এটা যদি ইংরেজিতে কেউ আই ইজ এ গুড বয় লেখে, তাহলেও তিনি বিরক্ত না হয়ে বাক্যটা ঠিক করে দিয়ে বলতেন, আই এর পরে ইজ হয় গাধা? ফলে তাঁর কাছে নিজে লেখার সাহস এবং লেখার ক্ষমতা, উভয়ই জন্মাতো। তিনি সব সময় একটা উপদেশ দিতেন— simple sentence এ বাক্য লেখ, বেশি জটিলতায় যেও না। কিন্তু মুশকিল হলো, তাঁকে খাতা দেখাতে গেলে, তিনি প্রায় অধিকাংশ শব্দই পরিবর্তন করে দিয়ে বলতেন, এটা লিখলে শুনতে ভালো লাগবে। তাঁর স্টক্ অফ্ ওয়ার্ডসের ভাণ্ডারও ছিল সমুদ্রের মতো বিশাল। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় কেউ কোনদিন তাঁর হাতে ভালো নম্বর পায়নি। তার প্রধান কারণ ছিল, সমস্ত শিক্ষকরা যখন পরীক্ষার খাতা দেখে স্কুলে জমা দিয়ে দিতেন, তখনও তাঁর খাতা দেখা শুরুই হতো না। শেষে স্কুল থেকে তাড়া খেয়ে, লাল পেন্সিল নিয়ে খাতা দেখতে বসতেন। তাঁর স্বভাব ছিল প্রতিটি খাতার প্রতিটি লাইন লাল দাগ দিয়ে খুঁটিয়ে পড়া, এবং বেশির ভাগ শব্দে লাল গোল পাকিয়ে তার মাথায় অন্য কোন সমার্থক ভালো শব্দ লাল পেন্সিলে লেখা। এরপর গোটা খাতা লাল দাগে ও লাল রঙের শব্দে ভরে গেলে, নোংরা করসে, ভালো লেখে নাই, ভালো শব্দ প্রয়োগ করে নাই, ইত্যাদি মন্তব্য করে, কম করে নম্বর দিতেন। তাঁর দেখা ইংরেজি খাতায় প্রত্যেক ছাত্রকে গ্রেসমার্ক দিতে হয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
এখনকার মতো প্রথম বিভাগে বেশির ভাগ ছাত্রের পাস করা, বা অধিকাংশ বিষয়ে লেটার পাওয়া বা স্টার পাওয়ার কথা, সেই সময় ভাবাই যেত না। কোন স্কুলে আট-দশটা ছাত্রছাত্রী প্রথম বিভাগে পাস করলে, স্কুলে হইচই পড়ে যেত। এখনকার ছেলে-মেয়েদের এতটুকু ছোট না করে বলতে পারি, সেই সময়ের ছেলে-মেয়েরাও কিন্তু কম ভালো ছিল না। বেশ মনে পড়ে, সাতের দশকের শেষে সম্ভবত মলবিকা চক্রবর্তী নামে একটি মেয়ে, হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায়, কলা বিভাগে প্রথম হয়। তার প্রাপ্ত মোট নম্বর, বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ছেলেটির প্রাপ্ত মোট নম্বরের থেকেও বেশি ছিল। মেয়েটি বাংলা ও ইংরেজি, উভয় বিষয়েই লেটার মার্কস্ পেয়েছিল। এটাও একটা অসাধারণ ও বিরল ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। তার মেধা নিয়ে খবরের কাগজে খুব লেখালিখিও হয়েছিল।
যাহোক্, দ্বিজেন বাবু বলতেন, “আমার হাতে কেউ ত্রিশ পেলে, ফাইনাল পরীক্ষায় সে পঞ্চাশ পাবে”। কিন্তু তাঁর দেওয়া নম্বর দেখে বাবার হাত থেকে বাঁচলে, তবে তো ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। তিনি ছিলেন ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ। যদিও তিনি একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন, কিন্তু সে বাসায় তিনি প্রায় থাকতেনই না। তিনি অবিবাহিত ছিলেন, ফলে একাই থাকতেন। তাই বোধহয় তাঁর নিজের বাসার প্রতি কোন টান বা আকর্ষণও ছিল না। তার বাসায় ঢুকতে গেলে মাকড়সার জাল সরিয়ে, ধুলো মেখে ঢুকতে হতো। তাঁকে লেখা তাঁর বাবার কোন কোন চিঠি তিনি পড়ে শোনাতেন। তাঁর বাবা ঠিক কি করতেন, এতদিন পরে মনে করতে পারি না। সম্ভবত বেনারস হিন্দু ইউনিভর্সিটির প্রফেসার ছিলেন। তাঁর বাবা অদ্ভুত কবিতার ছন্দে, ছেলেকে চিঠি লিখতেন। একটা চিঠি একদিন তিনি পড়ে শুনিয়েছিলেন। তাতে অদ্ভুত কবিতার ছন্দে তাঁকে তাঁর বাবা যা লিখেছিলেন, তার সারমর্ম— তিনি একটা পাকা আমের মতো বৃন্তে ঝুলছেন। যে কোন মুহুর্তে বৃন্ত থেকে খসে পড়তে পারেন। কাজেই তিনি তাঁর ছেলেকে হাত পুড়িয়ে খাবার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য, বিবাহ করার উপদেশ দিয়েছিলেন, এবং সেটা তিনি দেখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা বোধহয় জানতেন না, যে তাঁর পুত্রের হাত পুড়বার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ তাঁর পুত্র রান্নাঘরের ধারেকাছেও যেতেন না। আর যাবেনই বা কেন? সেখানে তো রান্নার কোন ব্যবস্থাও ছিল না। তাঁর ওই বাসায় কখনও-সখনও পড়তে গিয়ে দেখেছি, ধুলোয় ভরা ঘরটা তিনি কিভাবে নিজে না থেকে, শত শত মাকড়সাদের অবাধে থাকার সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তাঁর বাবার কবিতার ছন্দে লেখা চিঠির প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, তাঁর খুব অল্প বয়সে একবার কঠিন অসুখ করেছিল। তাঁর বাবা তাঁকে নিজ হাতে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খাওয়াতেন। কোন একটা ওষুধে বোধহয় অ্যালকোহলের মিশ্রণ ছিল। সেই ওষুধটা তাঁকে খাওয়াবার সময়, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন— “নিজ হাতে খাওয়ায় দারু, এমন পিতা দেখেছ কারু”? ইংরেজিতে অনুবাদ করতে।
তাঁকে কতবার দেখেছি স্কুলে এসে ধুতি পরেই টিউবওয়েলের জলে স্নান করে নিতে, অথবা দুপুরের খাবার হিসাবে মুড়ি, আর ঠান্ডা আলুর চপ্ খেয়ে নিতে। তাঁর ভবঘুরে জীবনের আর একটা নমুনা দিয়ে এবং তাঁর নীচের দুই ভাইয়ের কথা বলে, তাঁর প্রসঙ্গ শেষ করবো। তিনি কখন যে কোথায় থাকতেন, কী খেতেন, কেউ জানতো না। একদিন বেশ রাতে কোথা থেকে ঘুরে ফিরে পণ্ডিত স্যারের বাড়িতে এসে উপস্থিত। এরকম আমার বড়িতেও অনেক রাতে পড়াতে চলে আসতেন। ইচ্ছা না থাকলেও অত রাতে তাঁর কাছে ইংরেজি নিয়ে বসতে হতো। অত রাতে আমাকে পড়িয়ে, তিনি যে কোথায় থাকতেন কে জানে। আমার ও তাঁর বাড়ির মধ্যে দূরত্ব, প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার তো বটেই। যাহোক্, তাঁর ডাকে পণ্ডিত স্যারের ছেলে দরজা খুলে দিতে, তিনি শোবার ঘরে গিয়ে বললেন, “অনেক রাত হয়ে গেছে, একটু সরে সরে শোও দেখি, এখানেই শুয়ে পড়ি”।
দ্বিজেন বাবুর ছোট এক ভাই একবার আমাদের স্কুলে তার দাদার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে শিবপুর বি.ই. কলেজে পড়তো। ওই সময়ে অত আধুনিক পোষাকে তাকে দেখে আমরা অবাক হয়ে গেছিলাম। হাতে বালা, বিরাট জুলপি, পকেটে চিরুনি বা ছুড়ি জাতীয় কিছু একটা হবে। অবাক হয়েছিলাম, কারণ সে দ্বিজেন বাবুর ভাই। তার নাম সম্ভবত বুধেন্দ্র নারায়ণ ছিল। পরবর্তীকালে সে খুব ব্রিলিয়্যান্ট্ রেজাল্ট করে ইঞ্জিনিয়ার হয়।
দ্বিজেন বাবুর একবারে ছোট ভাইয়ের নাম ছিল ধ্রুব, সম্ভবত ধ্রুবেন্দ্র নারায়ণ। সে ছিল বংশের কুলাঙ্গার। কি কারণে বলতে পারবো না, ধ্রুবকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। একবার, সম্ভবত সপ্তম শ্রেণীতে সে সমস্ত বিষয় মিলে মোট সতেরো নম্বর পেয়ে রেকর্ড করেছিল। বিশ্ব রেকর্ডও হতে পারে। হাফ ঈয়ার্লি পরীক্ষা, গ্রীষ্মকাল সম্বন্ধে রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছিল। ধ্রুব লিখেছিল—গ্রীষ্মকালে ভীষণ গরম পড়ে, মাঠ ঘাট গরমে ফেটে যায়, পুকুরের জল শুকিয়ে যায়। এরপরই আসে বর্ষাকাল। বৃষ্টির জলে মাঠ, ঘাট, পুকুর জলে ভর্তি হয়ে যয়। চারিদিক জল কাদায় ভরে যায়। যে দিন সারাদিন ধরে খুব বৃষ্টি হয়, ছাতা নিয়েও স্কুলে যাওয়া যায় না, সেদিন আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার মশাই রেনি ডে দিয়ে দেন। তিনি খুব ভালো ও দয়ালু লোক। এরপর এক পাতা হেড মাস্টার মশাই এর গুণকীর্তন।
এ হেন ধ্রুব হঠাৎ একদিন কোথা থেকে একটি মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে, তার দাদাকে শুধু ছ’টি শব্দ ব্যয় করে, জীবনের একটা বড় অধ্যায়কে কত সহজে ব্যাখ্যা করে দিল— “বিস্কুট কিনতে গিয়ে বিয়ে হয়ে গেল”। কথায় বলে লাখ কথার কমে বিয়ে হয় না। কিন্তু কোন কথা না বলে, শুধু দোকান থেকে বিস্কুট কিনতে গিয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়ার নমুনা বোধহয়, ভূভারতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এর কয়েক মাস পরে ধ্রুবকে লাল কাপড় ও লাল চাদর গায়ে, সাধু হয়ে যেতে দেখেছিলাম। তার জীবনে হঠাৎ আসা স্ত্রী, তাকে হঠাৎই ছেড়ে চলে যায়। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ, দ্বিজেন বাবুদের আত্মীয় ছিলেন বলে শুনেছিলাম। এক পরিবারে দু’-দুজন সন্ন্যাসী, ভাবা যায়? স্কুল ছেড়ে আসার বেশ কয়েক বছর পরে শুনেছিলাম নিতান্ত অসহায়, নিঃসঙ্গ জীবন শেষ করে, দ্বিজেন বাবু ইহলোক ত্যাগ করেছেন। পোস্ট্ অফিস ও ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা সঞ্চিত থাকলেও, তাঁর চিকিৎসা সেভাবে করা হয়নি। আজ এতদিন পরে তাঁকে আবার স্মরণ করে, আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম। সারাজীবন কষ্টে থাকা মানুষটি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন।
সুবীর কুমার রায়
২০-১০-২০১৯