ভৌতিক সাহিত্যচর্চা {লেখাটি গল্পগুচ্ছ, প্রতিলিপি বাংলা, ও Sahitya Shruti পত্রিকায় প্রকাশিত}

72395822_1338804236295322_8003158745590792192_n গত ডিসেম্বরে কাঞ্চনগড় থেকে অসুস্থ হয়ে ফিরে বহু চিকিৎসার পর সুস্থ হলেও, অতনুবাবু আজ দীর্ঘ দুমাস হলো পূর্ব স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে বাড়িতে বসে আছেন। ডাক্তারদের অভিমত, তিনি এখন শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ, রোগটা তাঁর মনের। সেইমতো বেশ কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েও, বিশেষ কোন ফল পাওয়া যায়নি। শেষপর্যন্ত ডাক্তার মন্দার বাসুর চিকিৎসায় এখন তিনি তাঁর নাম মনে করতে পারলে বা বাড়ির সবাইকে চিনতে পারলেও, তাঁর ঠিক কি হয়েছিল বা আদৌ কিছু হয়েছিল কী না, এখনও মনে করতে পারেন না। এই অবস্থায় আরও বেশ কিছুদিন কাটার পর, বিছানার পাশের টেবিলে রাখা একটা মাসিক ম্যাগাজিনের বিশেষ একটি পাতায় চোখ পড়ায়, ধীরে ধীরে তাঁর কাঞ্চনগড়ের সব ঘটনা মনে পড়ে যায়, ও নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলা যাক। ডাকসাইটে সরকারি অফিসার, অতনু চৌধুরীর দাপটে অফিসের সবাই সর্বদা তটস্হ। বলা যায় তাঁর দাপটে বাঘে গরুতে এখনও একঘাটে জল খায়। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, সুন্দর স্বাস্থ্য, অত্যন্ত সাহসী, অনর্গল বাংলা ইংরেজি ও হিন্দীতে কথা বলতে পারা এহেন মানুষটি, সারাদিন অফিসের কাজে ডুবে থাকতে ভালবাসেন। অবসর সময় বই পড়ে ও গল্প উপন্যাস লিখে সময় কাটান। দু’-চারটে বই প্রকাশ ছাড়া, অনেক পত্রিকাতেও তাঁর লেখা বেশ সমাদৃত হয়েছে। মাস তিনেক আগে অফিসের কাজে তাঁকে বাংলার শেষপ্রান্তে যেতেই হলো। দিন পাঁচেক সেখানে থেকে কাজ মিটিয়ে ফিরে আসার কথা। এই জাতীয় অফিস ট্যুর তাঁকে মাঝেমাঝে করতেই হয়। তিনি নিজে গেলে কাজটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, তাই সাধারণত তাঁকেই পাঠানো হয়।

তৃতীয় দিন হাতে বিশেষ কোন কাজ না থাকায়, ওখানকার অফিসের একজন পদস্থ অফিসার, সুবিমল সমাদ্দার তাঁকে অফিসের গাড়ি নিয়ে ‘মিঠেপাতা’ গ্রামে ঘুরে আসতে বলেন। জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর। অতনুবাবু সকালের দিকে তৈরি হয়ে, অফিসের একটি গাড়ি নিজেই চালিয়ে মিঠেপাতা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। কথা ছিল পনেরো কিলোমিটার দূরের গ্রামটা ঘুরেফিরে দেখে, দুপুরে সুবিমলবাবুর সাথেই লাঞ্চ সারবেন। কিন্তু দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে, এমনকী রাতেও না ফেরায়, সকলেই চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। তাঁর মোবাইলে বারবার যোগাযোগ করা হলেও, সেটা বেজে বেজে একসময় থেমে যাচ্ছে।

পরদিন সকালেই পুলিশে খবর দেওয়া হয়। মোবাইল টাওয়ার থেকে জানা যায়, যে মিঠেপাতা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে, কাঞ্চনগড় এলাকায় তাঁর মোবাইলটি বাজছে। কাঞ্চনগড় একটি অতি প্রাচীন গ্রাম, তিনি হঠাৎ সেখানে কেন গেলেন বোঝা গেল না। যাইহোক, পুলিশের গাড়ির সাথে সুবিমলবাবু দুজন অফিসকর্মী নিয়ে অপর একটি গাড়ি নিয়ে কাঞ্চনগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।

কাঞ্চনগড়ে এসে জানা গেল, গতকাল দুপুরের দিকে এক ভদ্রলোক একটি সাদা গাড়ি নিয়ে এখানে আসেন এবং কাল থেকে আজ এখন পর্যন্ত গাড়িটি পরিত্যক্ত রাজবাড়ির সামনে দাঁড় করানো আছে। প্রায় আড়াইশ’ বছরের পুরাতন রাজবাড়িটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ন’মাসে ছ’মাসে বড়রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে, কেউ কেউ রাজবাড়িটির কাছে গাড়ি থামিয়ে ঘুরেফিরে দেখেন, ছবি তোলেন বটে, কিন্তু এই জঙ্গলে ভরা দোতলা বাড়িটিতে বাদুড় চামচিকে, ও সাপখোপ বাস করলেও, কোন মানুষকে কখনও রাত্রিবাস করতে দেখা যায়নি।

অতনুবাবুর সন্ধানে এখানে আসা পুলিশ ও অফিস কর্মীরা স্থানীয় কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করেন। বেশ কিছু জায়গায় মেঝেতে ফাটল ধরে গাছ গজিয়ে গেছে। ঘরগুলোর কড়িকাঠ থেকে কিছু বাদুড়কে ঝুলতেও দেখা গেল বটে, কিন্তু যাঁর সন্ধানে ভিতরে প্রবেশ, সেই অতনু চৌধুরীর দেখা মিললো না। ভাঙাচোরা সিঁড়ি ভেঙে ভ্যাপসা গন্ধযুক্ত দোতলার প্রথম ঘরটিতে প্রবেশ করেই, অচৈতন্য অতনুবাবুর দেখা পাওয়া গেল। এক ইঞ্চি পুরু ধুলোমাখা একটা ভাঙা, উইপোকায় খাওয়া তক্তপোশে তিনি চিৎ হয়ে কড়িকাঠের দিকে বিস্ফারিত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে শুয়ে আছেন। ব্রিফকেসটা পাশে খোলা পড়ে আছে। তার পাশে একটা দামি ক্যামেরা, রাইটিং প্যাড ও একটা কলম। প্যাডের বেশ কিছু লেখা ও সাদা ছেঁড়া পাতা সারা ঘরে  ছড়ানো। পরীক্ষা করে দেখা গেল, সেগুলো অফিসের কাজকর্ম ও হিসাব সংক্রান্ত কিছু লেখা।

স্থানীয় একজন ডাক্তারকে ডেকে আনার পর দেখা যায়, যে তাঁর রক্তচাপ অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অনেক চেষ্টার পরে জ্ঞান ফিরলে, অযথা আর সময় নষ্ট না করে, তাঁকে কলকাতার একটা বড় হাসপাতালে নিয়ে এসে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেও, অতনুবাবু কিন্তু অতীতের কোন ঘটনাই মনে করতে পারলেন না। সেই থেকে তিনি মন্দার বাসু নামে একজন নামজাদা মানসিক চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন।

আজ এই ম্যাগাজিনটির পাতা ওলটাতে ওলটাতে তিনি হঠাৎ ধীরে ধীরে পূর্বস্মৃতি ফিরে পেয়ে, নতুন করে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে চিকিৎসক ডাক্তার মন্দার বাসু, সব কাজ ফেলে নিজে তাঁর বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। ম্যাগাজিনটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মন্দারবাবু তাঁকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। এইভাবে দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ার পর, অতনুবাবু সেদিনের ঘটনা খুলে বলতে সক্ষম হন।

পরিতক্ত রাজ বাড়িটির সন্ধান পেয়ে তিনি মিঠেপাতা গ্রামে অল্প সময় কাটিয়ে কাঞ্চনগড়ে এসে হাজির হন। রাজ বাড়িটি ঘুরেফিরে দেখা, ও কিছু ছবি তোলার জন্য তিনি একাই বাড়িটির ভিতরে প্রবেশ করেন। একতলার সমস্ত ঘরগুলো বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে ঘুরেফিরে দেখে, ছবি তুলে, ও ফিরে এসে নতুন লেখার রসদের প্রয়োজনে, তাঁর রাইটিং প্যাডে বাড়িটির বেশ কিছু নকশা ও প্রয়োজনীয় তথ্য নোট করেন। এরপর তিনি সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে গিয়ে একইভাবে ঘরগুলো দেখে, ছবি তুলে, ও প্রয়োজনীয় নকশা এঁকে প্রথম ঘরটিতে প্রবেশ করেন।

ডিসেম্বর মাস, বেলা বেশ ছোট হয়ে যাওয়ায় এরমধ্যেই বেশ আলো কমে এসেছে। তিনি ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই বেশ কয়েকটা বাদুড় ডানা ঝাপটিয়ে কড়িকাঠ থেকে উড়ে প্রায় তাঁর মুখের ওপর দিয়েই খোলা দরজা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চলে যায়। বাদুড়গুলো উড়ে যাওয়ার ঠিক পরেই বাইরে কোন ঝোড়ো বাতাস না বইলেও, দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরটা আরও অন্ধকার হয়ে যাওয়ায়, ফটো তোলার স্বার্থে তিনি দরজার পাল্লাদুটো টেনে খুলে দেন, আর ঠিক তখনই জনাপাঁচেক সাদা কাপড় পরিহিত মানুষ, তাঁকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের দিকে চোখ ফেরাতেই তিনি লক্ষ্য করেন, যে তাদের মুখ ও হাতে কোন মাংসের চিহ্ন নেই। তার পরিবর্তে জায়গাগুলো ঘোলাটে সাদা রঙের হাড় দিয়ে তৈরি, আর চোখের জায়গায় চোখের পরিবর্তে বিশাল দুটো গর্ত। ওই ঠান্ডাতেও ভয়ে তাঁর গোটা শরীর ঘামে ভিজে প্রায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়।

অশরীরীদের একজন তাঁকে বলে, যে তারা তাঁর কোন ক্ষতি করবে না। একজন ক্যামেরাটা নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে দেয়। অপর একজন প্যাডটা তার চোখের গর্তদুটোর কাছে মেলে ধরে কিছুক্ষণ দেখে বলে, “লেঁখালেখিঁর সখ আছে মনে হঁচ্ছে, সাঁহিত্যিক নাকি? তাঁ শুধু ঘঁরের বিবরণ লিঁখে কি হবে, বঁলি এই বাঁড়ির ইঁতিহাস কিছু জানা আঁছে? ইঁতিহাস না জানা থাকলে লিখবেটা কি? আমার কঁতদিনের সখ, এই বাড়ির ইঁতিহাস নিয়ে একটা কিছু লিখি। কিন্তু আঁমার সেই ক্ষমতা না থাকায় এতগুলো বঁছরেও তা সম্ভব হয়নি। আমি বঁলে যাঁচ্ছি, তুমি নিজের মতো করে লিঁখে যাও”। অতনুবাবু মিনতি করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখন আমাকে ছেড়ে দিন”। উত্তরে অশরীরীটি শুধু বললো, “এটাইতো লেঁখালেখিঁর আঁদর্শ সময়, কেন তুঁমি কি চোঁখে ভালো দেখো না? ওরে ও গোপলা এঁর চোঁখদুটো একটু দেঁখে দেতো বাঁবা”। চোখ হারাবার ভয়ে, ওই অবস্থাতেও তিনি লিখতে রাজি হলেন। সে এই বাড়ির অদ্ভুত ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলে যেতে লাগলো, আর ইচ্ছা না থাকলেও অতনুবাবু তাঁর প্যাডের পাতায় লিখে যেতে বাধ্য হলেন। তাঁর ঘাড়ের ওপর দিয়ে অপর তিনজন ঝুঁকে পড়ে করোটি বাড়িয়ে, তিনি কি লিখছেন, ঠিক লিখছেন কী না, বানান ও ব্যাকরণ মেনে লেখা হচ্ছে কী না, লক্ষ্য করতে লাগলো। ঘাড়ের ওপর তাদের বরফের মতো ঠান্ডা নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো।

এইভাবে লেখা শেষ হলে, বাড়ির ইতিহাস যে শোনাচ্ছিল, সে তার চোখের গর্তদুটোর কাছে প্যাডটা তুলে  অনেকক্ষণ মেলে ধরে খোনা গলায় উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠে, “আমার অনেক দিনের একটা সখ মিটলো” বলে, প্যাডের পাতাগুলো ছিঁড়ে নিয়ে অতনুবাবুকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে হুকুম করলো। সুযোগ পেয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে পালাতে গিয়ে তিনি ভাঙা চৌকিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তারপর তাঁর আর কিছু মনে নেই।

অতনুবাবু এবার ডাক্তার মন্দার বাসুকে বললেন, “আজ এখন দেখছি, এই ম্যাগাজিনে আমার লেখাটা ভূতনাথ সিকদার নামে একজন নিজের নামে প্রকাশ করেছে। আমার তোলা ওই বাড়ির কিছু ছবিও লেখার সাথে দিয়েছে। লেখার শেষে একটা মোবাইল নাম্বার দেওয়া আছে। অনেকবার ফোন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কলার টিউন হিসাবে সেই খোনা গলায় হাড় হিম করা ভয়ংকর হাসিটা বেজে বেজে, একসময় ফোনটা কেটে যাচ্ছে, কেউ ধরছে না”।

গোটা ঘটনা শুনে চিকিৎসক মন্দার বাসু তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে, ফিজ নিয়ে, “গয়ায় গিয়ে একটা পিণ্ড দিয়ে আসুন” উপদেশ দিয়ে, বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। অতনুবাবু একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তাদের একজনের নামও তো আমার জানা নেই, পিণ্ডটা দেবো কার নামে”? সেকথার কোন জবাব না দিয়ে, মন্দারবাবু দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করে উর্ধ্বশ্বাসে বিদায় নিলেন। এরপর থেকে তাঁকে আর কোনদিন এই বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়নি।

সুবীর কুমার রায়

০২-১১-২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s