দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও, অতনু কিন্তু সেদিনের সেই লোকটাকে আজও ভুলতে পারেনি। অল্প কিছু সময়ের পরিচয়, কিন্তু তারমধ্যেই তার সহানুভুতি অতনুকে অবাক করেছিল।
আঠারো বছর বয়সের অতনু, অপঘাতে মৃত কুড়ি বছরের এক নিকটাত্মীয়র মৃতদেহ নিয়ে সারাদিন মর্গ বা অন্যান্য ঝামেলা মিটিয়ে, অল্প কিছু সহযাত্রীর সাথে স্থানীয় এক শ্মশানঘাটে এসে হাজির হলো। শ্মশানের সাথে পরিচয় তার বছরখানেক-বছর দেড়েক, তবে সেগুলো তো নেহাতই সন্ধ্যা বেলা কলেজের ক্লাস কেটে, তিন-চারজন সহপাঠীর সাথে গঙ্গার ধারে, বা বৈদ্যুতিক চুল্লিবিহীন স্থানীয় শ্মশান ঘাটে আড্ডা মেরে। একবার অবশ্য কলকাতার এক মহাশ্মশানে মৃতদেহ সৎকার করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল। তবে সেখানে আরও অনেকের সাথে সঙ্গী হিসাবে যাওয়া, ও বৈদ্যুতিক চুল্লিতে মৃতদেহ দাহ করার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা লাভ করা।
প্রায়ই সে তার বন্ধুদের সাথে কলেজের কাছেই গঙ্গার ধারে যে শ্মশান ঘাটে আড্ডা দিতে যায়, আজকের এই শ্মশানটাও তারই মতো শুধুমাত্র কাঠের চুল্লিতেই শবদেহ দাহ করা হয়, তবে এটা গঙ্গার ধার থেকে বেশ কিছুটা দূরে ও অপরিস্কার। একটা চুল্লিতে শবদাহ প্রায় শেষের দিকে, আগুন প্রায় নিভে এসেছে। একজন, যাকে সকলে ডোম বলে, হাতে একটা বাঁশ নিয়ে আগুনের মাঝে নেড়েচেড়ে খুঁচিয়ে, দাহকার্য সুসম্পন্ন করতে ব্যস্ত। বেশ কিছু মানুষ সেই আগুনের পাশে অন্তিম কাজের জন্য অপেক্ষারত, তবে তাদের মধ্যে কয়েকজন যুবক কিভাবে খোঁচালে সুবিধা হবে, এরপরে কি করা উচিৎ, ইত্যাদি ডোমকে পরামর্শ দিচ্ছে। তাদের আচরণ ও কথাবার্তা শুনে মনে হতেই পারে, যে তারা কোন আনন্দানুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে। নেশার ঝোঁকে এদের অনেকেরই সুষ্ঠুভাবে দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। এদের কাজ শেষ হলে অতনুদের নিয়ে আসা মৃতদেহের চিতা সাজানো হবে। এখনও কাজ শুরু হতে দেরি আছে, তাই অতনুর সাথে আসা কাছেপিঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সঙ্গীরা কেউ ফিরে আসেনি। দীর্ঘক্ষণ মৃতদেহ আগলে, অতনু কাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় বসে আছে।
কিছুক্ষণ পরে সেই একই ব্যক্তি একটা একটা করে কাঠ সাজিয়ে চিতা সাজাতে শুরু করলে, একে একে প্রায় সকলেই ফিরে এসে মৃতদেহের কাছে দাঁড়ালো। চিতা সাজাবার সময় বেশ কয়েকবার একটা বোতল থেকে পানীয় গলায় ঢালায়, কাজটা ভালভাবে শেষ করতে পারবে কী না ভেবে অতনু চিন্তায় পড়লো। অতনু তাকে একবার ভালভাবে চিতা সাজাবার কথা অনুরোধ করায়, সে টলমলে পায়ে অতনুর কাছে এসে তার কাঁধে একটা হাত রেখে দাঁড়ালো। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল, মুখ দিয়ে পানীয়র উগ্র উৎকট গন্ধ। সে সামান্য জড়ানো গলায় অতনুকে বললো, “খোকাবাবু চিন্তা করো না, তোমার জন্মের আগের থেকে আমি এই কাজ করছি। ডেডবডি চিতায় তোলার আগে পুরুত মশাইকে ডেকে তাঁর কাজটা শেষ করে নাও”।
তাই করা হলো। মৃতদেহ চিতায় শোয়ানো হলো। এই পর্বের সবথেকে কঠিন কাজ, অতি আপনজনের মুখে জ্বলন্ত পাটকাঠির আগুন স্পর্শ করার কাজটাও কাঁপা হাতে সজল চোখে, অতনুকেই করতে হলো। চিতায় আগুন দেওয়ার পরে একসময় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করলে, সবাই পাশের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। চিতার একটু দূরে, অতনু একা বসে। ডোম তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে পানীয়র বোতল থেকে তরল পানীয় গলায় ঢালছে।
অনেকক্ষণ পরে সে এসে অতনুর ঠিক পাশে বসে জড়ানো গলায় বলে, “খোকাবাবু মন খারাপ করো না। আমরা সবাই একটা নির্দিষ্ট আয়ু নিয়ে এই পৃথিবীতে আসি। সেটা কারও ক্ষেত্রে খুব কম, কারও ক্ষেত্রে বেশি। জন্মাবার সময়েই বিধি মানুষের কপালে সেটা লিখে দেন। সেই ললাট লিখন কখনও মোছা যায় না, বদলানোও যায় না। আমরা কিছু বই পড়ে বিদ্যান হয়ে সেকথা ভুলে যাই, অস্বীকার করি। কিছুক্ষণ আগে ওই জোয়ান মরদগুলোকে দেখলে না? আমরা দুপাতা বই পড়ে উন্নতির পিছনে, সুখের পিছনে ছুটি। আকাঙ্ক্ষা শুধু একটাই, আরও টাকা, আরও সুখ স্বাচ্ছন্দ, আরও উন্নতি। কিন্তু তাই কি হয়? সবকিছুর একটা শেষ আছে, তারপর ধ্বংস হয়ে আবার নতুন করে শুরু হয়। আচ্ছা, এই যে তোমার দেহ, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পরে একটা পিঁপড়ে যদি তোমার পা বেয়ে উঠতে থাকে, তাহলে সে কোথায় যাবে”?
এর উত্তর অতনুর জানা নেই। ভাববার মতো মানসিক অবস্থা বা ইচ্ছা, এই মুহুর্তে কোনটাই তার নেই, তাই সে চুপ করে থাকলো। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার শুরু করলো, “পিঁপড়েটা কখনও ধীরে, কখনও দ্রুত, ওপরে উঠতে শুরু করবে এবং একসময় সে সর্বোচ্চ চূড়ায়, অর্থাৎ তোমার মাথায় এসে পৌঁছবে। তারপরে কিন্তু আর ওঠা সম্ভব নয়। তখন তাকে আবার মাটিতে নেমে আসতে হবে, আবার নতুন করে শরীর বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। আমরা এখন সেই উন্নতির চরম জায়গায় এসে পৌঁছেছি, এবার আমাদের পতনের পালা, এবার আবার নতুন করে শুরু করার পালা”।
সে উঠে গিয়ে বাঁশ হাতে নিয়ে আবার তার কাজ শুরু করলো। অতনু আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে বসে ভাবলো, এসব কথা কি এরই মস্তিষ্কপ্রসূত, না অন্য কারও কাছ থেকে শোনা? সে যাইহোক না কেন, এই অশক্ষিত বেহেড মাতালের মুখে সেটা কি সত্যিই বেমানান? অভিজ্ঞতাও যে একটা শিক্ষা, সেকথা বোধহয় অস্বীকার করা যায় না।
একসময় কাজ শেষ হলে তার পাওনা মিটিয়ে নাভিকুণ্ডলি নিয়ে, আর সকলের সাথে অতনু গঙ্গার ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।
সুবীর কুমার রায়
১৩-০১-২০২০