জ্যোৎস্না মাসি { লেখাটি প্রতিলিপি-বাংলা, ও Sahityashruti পত্রিকায় প্রকাশিত।}

14

এমন একটা সময় ছিল, যখন কর্মসূত্রে সপ্তাহের পাঁচটা দিন স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ছেড়ে অন্য এক জেলায় গিয়ে থাকতে হতো। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন যোগাযোগহীন, মোহনার নিকটবর্তী এই অঞ্চলটিতে জীবনের বেশ কয়েকটি বছর কাটাতে হয়েছিল। দিনের বেলাটা অফিসের কাজ, গ্রামে গ্রামে সাইকেল নিয়ে সরকারি অনুদানযুক্ত ঋণ আবেদনের তত্ত্বানুসন্ধান ও ঋণ পরিশোধের জন্য তাগাদায় যাওয়া, ইত্যাদি নিয়ে সময় কেটে গেলেও, সন্ধ্যার পর থেকে অন্ধকারে সময় আর কাটতে চাইতো না। বিকালের পর থেকে নিকটবর্তী শহরের সাথেও প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই জায়গায়, অফিস থেকে ফিরে আমাদের একমাত্র বিলাসিতা ছিল, মাদুর পেতে ছাদে শুয়ে থাকা, ও মাঝেমধ্যে তাস পেটানো। আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে মাঝেমাঝে তাস খেলার অছিলায় দোতলা থেকে একতলায় আসতো, যদিও আসার মূল কারণ ছিল, চা খাওয়া ও বিড়ি সিগারেট ফোঁকা। তাস খেলায় খেলোয়ারের অভাব হলে তাকে আমরা খেলতে নিতাম, এমনকী ওপর থেকে ডেকেও নিয়ে আসতাম। গরমের সময় প্রচণ্ড গরম, শীতে বেশ ঠান্ডা, ও বর্ষাকালে জলকাদা ও ভয়ংকর সাপের উপদ্রব নিয়ে দিন কেটে যেতো।

আমরা একই অফিসের পাঁচজন, একটা দোতলা বাড়ির একতলায় মেস করে থাকতাম। জ্যোৎস্না নামে একজন বয়স্কা রান্নার মাসি দুবেলা রান্না করে দিয়ে যেত। ওই অঞ্চলে পয়সা খরচ করে বাড়িতে রান্না করে দিয়ে যাবার জন্য রান্নার লোক রাখার মতো বসবাসকারী মানুষ বিশেষ ছিল না বললেই চলে। আমাদের মতো কর্মসূত্রে যারা বাইরে থেকে আসতো, তারা কাজের শেষে অধিকাংশই নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত, অথবা নিজের রান্না কোনমতে নিজেই করে নিতো। গরিব এলাকা, কাজেই খোঁজ করলে হয়তো অন্য রান্নার লোক পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারতো, কিন্তু আমাদের রান্নার মাসির মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও এহেন সুস্বাদু রান্নার হাতের একজন দ্বিতীয় মাসির সন্ধান পাওয়া শুধু শক্ত নয়, হয়তো অসম্ভবই ছিল। স্বাভাবিকভাবে মেসের এক একজন এক এক প্রকৃতির হলেও, পাত্রের অভাবে তেল ও জল একই পাত্রে সহাবস্থান করতে বাধ্য হতো। দীর্ঘদিন আগে মাসির স্বামী বসন্ত, স্থানীয় এলাকার আরও অনেকের মতোই মাসিকে ছেড়ে অন্য একটি মহিলার সাথে বসবাস করতে শুরু করে। এটা ওই অঞ্চলে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও নির্দোষ কর্ম বলেই প্রচলিত ও বিবেচিত ছিল। অনেকটা লাক্স ছেড়ে সিন্থল সাবান ব্যবহার করার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে মাসির কপালে বসন্তের দেওয়া উপহার স্বরূপ একটি কন্যা সন্তান, ও তাকে মানুষ করা ছাড়া, এই সুদীর্ঘ জীবনে আর কোন সুখের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। উপায় না থাকায় মাসি তার মেয়ে জামাইয়ের কাছে তাদের কাজের লোকের মতোই থাকতো। অনেক সময় মেয়ে ও জামাই তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে বলে শুনতাম। জামাই তাকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বললেও, আমার ভয়ে সে খুব একটা বাড়াবাড়ি করার সাহস দেখাতো না, কারণ অল্প টাকা হলেও, আমার ব্যাঙ্কে তার নামে একটা সরকারি লোন ছিল। কাজেই একমাত্র আপনার লোক হলেও, তার স্বামী, কন্যা, বা জামাতা, কেউই তার প্রকৃত আপনার লোক ছিল না। ত্রিভূবনে তার আপনার বলতে ছিল খানকয়েক ছাগল। অধিকাংশ দিনই সন্ধ্যায় মাসি আসতে বেশ দেরি করে দিতো। চায়ের আশায় অন্ধকারে আমরা পাঁচজন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে বসে থাকতাম। ঘরের ভিতর থেকেই আমরা মাসির আগমন বার্তা পেয়ে যেতাম। সমগ্র পৃথিবীর প্রতি বিড়বিড় করে বিষোদগার করতে করতে ঘরে ঢুকতো। রাগ ক্ষোভ দুঃখ, অভিমান, সবকিছু একটাই কারণে, আর সেটা তার ছাগল খুঁজে না পাওয়া। প্রায় রোজই যুক্তি করে কোন না কোন ছাগল আমাদের অসুবিধায় ফেলার জন্য আত্মগোপন করে কেন থাকতো জানার সুযোগ হয়নি।

আমাদের মেসের রান্নার জায়গায় দুটো কাঠের তাকে বিভিন্ন কৌটোয় ডাল তেল নুন মশলা ইত্যাদি রান্নার উপকরণ রাখা থাকতো, মাসিই গুছিয়ে রাখতো। মাসির ফরমাশ মতো আমরা শুধু কিনে এনে দিয়েই আমাদের দায়িত্বে ইতি টানতাম, কোন কৌটোয় কি আছে বা কতটা আছে খোঁজ রাখারও প্রয়োজন বোধ করতাম না। মেস জীবনের সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন, যে মেসের বিভিন্ন সদস্যের পছন্দ অপছন্দ, খাদ্যরুচি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ইত্যাদি ভিন্ন ধরণের হয়। আমাদের মেসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একফালি রান্নার জায়গাটার ঠিক পাশেই ছিল আরও ছোট একটা বাথরূম ও পায়খানা। বাথরূমটা ভাতের ফেন গালা ছাড়া, অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা হতো না। হতো না, কারণ জলের অভাব। মাসি প্রতিদিন কলসি করে খাবার ও রান্নার জল নিয়ে এসে রেখে দিতো। বাড়ির ঠিক পিছনে একটা ছোট্ট ডোবা ছিল, যদিও তাতে জলের চেয়ে পাঁকের পরিমাণই বেশি ছিল। বাথরূমে একটা ছোট চৌবাচ্চা ছিল। সেই ডোবা থেকেই স্নান করার সময় আমরা বালতি করে জল বয়ে এনে চৌবাচ্চা ভরে রাখতাম। মাসি ছিল অসম্ভব পরিষ্কার, কিন্তু শুচিবাইগ্রস্ত আদপেই নয়। ফলে মাসির কঠোর শাসনে হাওয়াই চটি পায়ে রান্নাঘর লাগোয়া বাথরূম পায়খানা ব্যবহার করা ছিল বড়ই পীড়াদায়ক। মেসের আর সকলের থেকে মাসি কিন্তু আমায় একটু বেশিই ভালবাসতো। আমার একটু বেশি জল খাওয়া অভ্যাস বলে মাসি আমাকে কখনও ফর্সা বাবু, কখনও বা জল বাবু বলে ডাকতো। সকালে ও সন্ধ্যায় সবার অলক্ষ্যে শুধুমাত্র আমার জন্য দ্বিতীয় দফার এক কাপ চা সরিয়ে রাখতো।

এরমধ্যে আমাদের অফিসেরই নতুন একজনকে মেসে জায়গা দেওয়া হলো। তিনি আবার এক অদ্ভুত মানসিকতার মানুষ। আমরা সকালে খেয়েদেয়ে অফিস চলে যেতাম। মাসি তার দিনগত কাজকর্ম সেরে, খেয়েদেয়ে অথবা নিজের খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যেত। এই নতুন সদস্যটির সন্দেহ হলো, যে মাসি তেল মশলা ইত্যাদি সরিয়ে রেখে, নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এটা যে বাস্তবে সত্য, এটা আমরা সকলে বুঝলেও চুপ করে মেনে নিতাম। এই নিয়ে ভাবার পিছনে সময় ও আলোর অভাব একমাত্র অন্তরায় ছিল। যাইহোক, এই নতুন সদস্যটি এক সোমবার বাড়ি থেকে ধুয়ে মুছে একটি কাচের শিশি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। জানা গেল, আমাদের রান্নার জন্য প্রতিদিন পঁচাত্তর গ্রাম সরষের তেলের বরাদ্দ হওয়া উচিৎ, তাই তিনি অনেক খুঁজে পেতে ঠিক পঁচাত্তর গ্রাম তেল ধরে, এমন একটি শিশি চুনচুনকে নিয়ে এসেছেন। পরের দিন থেকে তিনি ওই বিশেষ শিশিটিতে তেল ভর্তি করে রেখে, তেল রাখার মূল পাত্রটি মাসির নাগালের বাইরে রেখে যেতে শুরু করলেন। অন্যান্য সমস্ত রন্ধন সামগ্রী একই প্রক্রিয়ায় মাসিমুক্ত করা অসম্ভব ও পরিশ্রম সাধ্য, তাই আপাতত তারা স্ব স্ব স্থানেই অবস্থান করতে থাকলো। ভগবান মঙ্গলময়, তাঁর অশেষ কৃপা, তাই বোধহয় তিনি নতুন সদস্যটিকে নিজ চাকরিটি ছেড়ে মাসির তেলমশলা চুরি রোধে নিযুক্ত না করে, তার নিজ সংসার ও আমাদের কল্যানার্থে চাকরিটি বহাল রাখাই মনস্থ করলেন, যদিও তার ফল হলো ভয়ংকর। নিজের বাড়ির জন্য তেল মশলা যোগানের সহজ পথটি বন্ধ হওয়ায়, আমাদের মেসের রান্নার ওপরেও মাসির প্রভাব পড়তে বিলম্ব হলো না। রান্নায় মিষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পাওয়া গেল, “কি করবো? তেল কম, তাই বেশি করে মিষ্টি দিতে হচ্ছে”। চিনি যে সরষের তেলের বিকল্প, সেদিন প্রথম জানতে পারলাম।

সে যাইহোক, সন্ধ্যার সময় অতো দেরি করে আসা নিয়ে সকলের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বললেও, তার বহিঃপ্রকাশ খুব একটা ছিল না। কারণ ওই সময়টাতে অশান্তি করার থেকে এক কাপ চা হাতে পাওয়া অনেক জরুরী ছিল। আমার নিজেরও খুব রাগ হতো, কিন্তু অসহনীয় গরম বা অত্যন্ত শীতেও মাসিকে একটা ছোট কুপির স্বল্পালোকে মুখবুজে উনুন জ্বেলে চা করে রান্নার আয়োজন করতে দেখলে, রাগকে দূর করে মায়া সেই স্থান দখল করতো। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকা প্রয়োজন, উচিৎও বটে।

একদিন এক প্রচণ্ড শীতের সন্ধ্যায় অন্ধকারে মশার কামড় খেয়ে মাসির আগমনের অপেক্ষায় বসে আছি, মাসির দেখা নেই। ক্রমশঃ রাত বাড়ছে, আশেপাশে কোন দোকানও নেই যে চা খেয়ে আসবো। ভয় হচ্ছে শেষপর্যন্ত মাসি আসবে তো? ভরসা একটাই, মাসি খুব একটা দূরে থাকে না ও একদিনও কামাই করে না। অবশেষে বাইরে থেকে মাসির সেই বিড়বিড় করে ক্ষোভ প্রকাশের আওয়াজ পাওয়া গেল। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশি রাত করে এসেছে বলেই বোধহয়, আজ গলার আওয়াজও দুই পর্দা চড়ায় বাঁধা। ঠিক করলাম আর নয়, আজই এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। আমি জানতাম, যে সকলের মধ্যে মাসি আমাকে বেশি ভালবাসে, মাঝেমধ্যে সামান্য হলেও আমার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যও পেয়ে থাকে, কাজেই যা করার আমাকেই করতে হবে।

ঘরে ঢুকতেই আমি মাসির হাত ধরে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম, “মাসি, তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে ছাগল নিয়ে থাকো, তোমায় আর রান্না করতে হবে না”। মাসি একটু অবাক হয়ে গিয়ে আমায় কিছু বলতে চাইছিলো, কিন্তু আমি তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিলাম। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। মেসের সকলে খুব ভয় পেয়ে গিয়ে আমায় বললো, বাড়ি তো ফিরিয়ে দিলেন এবার কি হবে? আমি তাদের আশ্বস্ত করে বললাম, “ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমাদের যেমন মাসিকে ছাড়া চলবে না, মাসিরও তেমনি আমাদের ছাড়া চলবে না। আজ যদি কোন কারণে ও না আসতো, তাহলে কি হতো? একটা দিন আমরা নিজেরা চালিয়ে নিতে পারবো না? আজ রাতে ভাত ডাল আলুভাতে দিয়ে চালিয়ে নেবো। কাল দেখা যাবে”। চালিয়ে তো নেবো, কিন্তু চালিয়ে নেওয়ার মূল সমস্যাটা যে উনুন ধরানোয় কেন্দ্রিভুত, আগে বুঝিনি। অনিল জানালো, যে সে ভাত রান্না করতে জানে। মহা খুশি হয়ে বললাম, “তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই গেল। তুই ভাতটা করে ফেল, আমি ডাল আর মচমচে করে আলুভাজা করে ফেলছি। গরম গরম ফার্স্ট ক্লাস খাওয়া হবে। তবে সবার আগে উনুন ধরিয়ে চা করতে হবে”।

উনুন ধরানো যে যুদ্ধ বিমান চালানোর চেয়েও শক্ত কাজ, তখন কি আর জানতাম ছাই। উনুনে খানকতক ঘুঁটে দিয়ে তার ওপরে কয়লা দিয়ে নীচের গর্তে দুটো ঘুঁটে রেখে, তাতে বেশ করে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। মুহুর্তের মধ্যে গোটা বাড়ি ধোঁয়ার আবরণে ঢেকে গেলেও, উনুন কিন্তু জ্বললো না। নীচের গর্তে ঘনঘন হাওয়া করায় ধোঁয়ার উড়ে বেরানোয় কিছু সুবিধা হল বটে, কিন্তু উনুন জ্বালানোয় কোন উপকার হলো না। এবার ঘাবড়ে গেলাম, ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে জল বেরোনোর সাথে সাথে ওই শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করলাম। এমন সময় দোতলা থেকে বাড়িওয়ালার ছেলে এসে হাজির হলো। মাসি তাদের আত্মীয় হলেও, মাসিকে তারা বিশেষ পছন্দ করতো না। সে বোধহয় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গোটা নাটকটাই দেখেছে বা শুনেছে। সে শুধু বললো “মাসিকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তো, বেশ করেছেন”। আমি আর এই ব্যাপারে কথা বাড়তে না দিয়ে উনুন ধরানোয় মনোনিবেশ করলাম। সে আমাকে সরে যেতে বলে উনুন থেকে সমস্ত কিছু বার করে বাথরূমে ফেলে, নতুন করে ঘুঁটে কয়লা দিয়ে সাজিয়ে, উনুনে আগুন দিয়ে হ্যারিকেনগুলো জ্বালিয়ে দিলো। এবার কিন্তু উনুন ধরতে খুব বেশি সময় লাগলো না। চা তৈরি হলো, আজ তার কদরই অন্যরকম। আমাদের সাথে চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বললো, “আজ তো আর তাস খেলার কোন সুযোগ নেই। আপনারা রান্না করুন, কোন প্রয়োজন হলেই আমায় ডাকবেন”।

সে চলে যাবার পর অনিল ভাত বসিয়ে দিলো। আমি মচমচে আলুভাজার জন্য সরু সরু করে আলু কাটতে শুরু করে দিলাম। ভাত হলেই ডাল বসিয়ে দেবো। তারপরে আলু ভাজা হলেই গল্প শেষ। কতক্ষণের আর মামলা? কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর অনিল গিয়ে ভাতের কতদূর দেখে আসছে। সে গ্রীন সিগনাল দিলেই আমি ডাল রাঁধার প্রস্তুতি নেবো। ছেলেরা চুল বাঁধে না, চুল আঁচড়ায়। তা নাহলে গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে অনিল বাথরূমে ভাতের হাঁড়ি নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে হাঁড়ির দুদিকে কাপড় দিয়ে কাত করে ধরে, ফেন গালতে শুরু করলো। এবার আমার খেলা শুরু। জীবনের প্রথম ডাল রান্নার দিনেই যে এই শর্মা আলোড়ন ফেলে দিতে পারে, সে ধারণা বোধহয় এদের করোরই নেই। মুসুর ডাল কি করে রাঁধে সঠিক ধারণা নেই। মাকে দেখেছি শুকনো কড়ায় মুগ ডাল ভেজে রান্না করতে। ডাল ভাজাটাও ভারী সুন্দর খেতে লাগে। উনুনে কড়া বসিয়ে এ কৌটো ও কৌটো খুঁজেও মুগ ডালের সন্ধান পেলাম না। শেষে খুঁজে পেলাম বটে কিন্তু তার পরিমাণ খুবই অল্প। নিশ্চই অন্য কোন কৌটোয় আছে ভেবে খোঁজার আগে যতটুকু পেয়েছিলাম কাজ এগিয়ে রাখার জন্য উনুনের ওপর কড়ায় দিয়ে দিলাম। কড়াটা এত গরম হয়ে গেছে, যে ডালগুলো কড়ায় ঢালার সাথেসাথেই মোটামুটি ষাট শতাংশ ডাল গরম সহ্য করতে না পেরে,  লাফ দিয়ে কড়ার বাইরে চলে গেল। সোনা মুগের ডাল কেন বলে জানি না, সম্ভবত সোনার মতো রঙ ধারণ করে বলে। যারা কড়ার বাইরে লাফিয়ে চলে গেল, তাদের গাত্রবর্ণ আর দেখা সম্ভব হলো না, কিন্তু অবশিষ্ট চল্লিশ শতাংশ ডাল, যারা পালাবার সুযোগ না পেয়ে কড়ার ভিতর রয়ে গেল, তাদের একজনেরও গায়ের রঙের সাথে সোনার মিল খুঁজে পেলাম না। বরং তাদের সাথে আলকাতরা, কয়লা, বা অমাবস্যার রাতের কোথায় একটা যেন মিল খুঁজে পেলাম। কি করবো ভেবে না পেয়ে চটপট্ কড়ায় জল ঢেলে দিলাম। মাসির স্বভাব ছিল কোন কিছু শেষ হবার আগেই আমাদের জানানো, অতএব মুগের ডালের দ্বিতীয় কোন কৌটো অবশ্যই আছে। তাই আদা জল খেয়ে মুগের ডালের উৎস সন্ধানে লেগে পড়লাম। একে একে এ কৌটো ও কৌটো হাতড়েও মুগের ডালের সন্ধানে ব্যর্থ হলাম বটে, তবে মুসুর ডালের সন্ধান পেলাম। ঈশ্বর করুণাময়, মুসুর ডাল রন্ধনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শুকনো কড়ায় ভেজে নেওয়ার নির্দেশ দেননি। আন্দাজ মতো মুসুর ডাল, মুগের ডালের ফুটন্ত কড়াইয়ে দিয়ে দিলাম। এবার কি করা উচিৎ ভেবে না পেয়ে তাতে সামান্য হলুদ গুঁড়ো, নুন, ও চিনি দিয়ে দিলাম।

এদিকে অনিল তখনও ভাতের হাঁড়ির দুদিকে কাপড় দিয়ে ধরে ফেন গেলেই যাচ্ছে। আর কতক্ষণ ফেন গালতে লাগবে জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিলো, “ও সুবীরদা, ফেন তো বেড়িয়েই যাচ্ছে শেষ হচ্ছে না যে”!  মাসিকে আমি তাড়িয়েছি, তাই দায় আমার। আর সকলে চৌকিতে শুয়ে বসে গুলতানি করলেও, আমার উপায় নেই। হাঁড়ি সোজা করে স্বল্প আলোতেও যেটা নজরে পড়লো সেটা আঁৎকে ওঠার মতো। হাঁড়িতে বোধহয় শুধুই মাড়, ভাত বিশেষ চোখে পড়ছে না। ওই অবস্থায় অবশিষ্ট ভাতের রেস্ট্ ইন পিস কামনা করে তাকে একপাশে রেখে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম ডাল সিদ্ধ হয়ে গেছে। ডাল রান্নাটা অন্তত ভালোই হয়েছে বলে মনে হলো, কারণ কিছু কালো কালো স্পট্ থাকলেও, মোটের ওপর ডালের রঙ বেশ হলুদ হয়েছে। অবশ্য সেটা ডালের ধর্মে না হলুদ গুঁড়োর আধিক্যে, ঠিক বোঝা গেল না। ডাল একটা পাত্রে ঢেলে রেখে, কড়াইটা ভালো করে ধুয়ে সাধের মচমচে আলু ভাজার জন্য তাকে উনুনে বসালাম, এমন সময় বাড়িওয়ালার ছেলে সম্ভবত বিড়ির লোভে এসে হাজির হলো। কড়াইতে সবে তেল ঢেলেছি, আমার ইচ্ছা ছিল তেল বেশ গরম হলে নুন হলুদ মাখানো আলুগুলো অনেক বেশি যত্ন নিয়ে ধীরে ধীরে ভাজবো, কারণ আজ রাতে ওটাই আমার তুরুপের তাস। কাটা আলুর পাত্র হাতে আমায় দেখে সে বললো “কি করছেন, আলু ভাজছেন? দিন আমি ভেজে দিচ্ছি”। এরপর কিছু বোঝার আগেই সে আমার হাত থেকে আলুর পাত্রটা নিয়ে  কড়াইতে ঢেলে দিলো। আলুর সাথে বেশ কিছুটা হলদেটে জলও গরম কড়াইয়ের ঠান্ডা তেলে আশ্রয় পেয়ে ধন্য হলো। ঠান্ডা তেল না তার হাতের গুণে জানি না, আলুভাজাটা একটা মাঝারি আকারের বলের রূপ ধারণ করলো। ভয় পেলে সজারু যেমন নিজেকে গুটিয়ে ফেলে বলের আকৃতি ধারণ করে, অনেকটা সেরকম। রাতে প্রায় স্ট্র দিয়ে খাওয়ার মতো ভাত ও অসাধারণ সুস্বাদু ডাল, সাথে ওই আলুর বল ভেঙে খানিকটা করে তেলমাখা আলুভাজা খেয়ে ও খাইয়ে আমার কি অবস্থা হয়েছিল, সেকথা আর নাই বা বললাম।

পরদিন সাতসকালে মাসি এসে হাজির হয়ে উনুন ধরিয়ে চা করে সকলকে দিয়ে গেল। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো। বেশ কিছুদিন মাসির ছাগলগুলো আমাদের ভয়ে সুবোধ ছাগলের মতো সন্ধ্যার আগেই মাঠ থেকে ফিরে আসা শুরু করলো। মাসি কিন্তু আগের মতো দুবেলাই তার ফর্সা বাবুর জন্য এক কাপ করে অতিরিক্ত চা আলাদা করে সরিয়ে রাখতো। মাসিকে নিয়ে কত ঘটনা, লিখতে গেলে রামায়ণ হয়ে যাবে।

এর অনেক পরে আমি বদলি হয়ে আবার নিজের শহরে ফিরে আসি। চলে আসার আগে মাসির জন্য ভালো শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাকে শাড়ি ও কিছু টাকা দিতে সে আমার হাতদুটো চেপে ধরে শিশুর মতো কেঁদেছিল। কতো স্মৃতি! তখন কষ্ট হতো, বড় অসহায় ছিল প্রাত্যহিক জীবন। আজ কিন্তু সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো মন্দ লাগে না, একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছা করে। অনেকগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। জানি না মাসি কেমন আছে, বা আদৌ বেঁচে আছে কী না। প্রার্থনা করি মাসি যেখানেই থাকুক, শেষ বয়সে একটু সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক, আনন্দে কাটুক তার বাকি জীবন।

সুবীর কুমার রায়

১৪-০৬-২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s