হাসি {লেখাটি প্রতিলিপি-বাংলা, ও গল্পগুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

72478165_1338803969628682_6661569837455638528_n

হারাধন বাবুর পঁয়ত্রিশ বছরের উপর শিক্ষকতার জীবনে বহুবার তাঁর স্কুলটির গঠন পালটেছে, প্রতিবছর পাস করে চলে যাওয়া, ও নতুন নতুন ছাত্রের আগমনে ছাত্র সংখ্যা ও ছাত্রদের চরিত্র পালটেছে, পালটেছে স্কুল পরিচালনার নিয়ম কানুন। কিন্তু যেটা কখনোই পালটায়নি, সেটা তাঁর হাসিখুশি স্বভাব ও ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তাঁর রসিকতা বোধ ও কথা বলার ধরণ, সকলকে হাসতে বাধ্য করতো। তাঁর মতে প্রাণখুলে হাসতে পারলে, যেটা মানুষের জীবনে আজ বড়ই অভাব, শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে। পাড়ার সকলে হারাধন বাবুকে ভালবাসেন, সম্মান করেন। স্বাস্থ্য সচেতন স্থানীয় লাফিং ক্লাবের বয়স্ক সদস্যরা নিজেরা তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ক্লাব সভাপতির পদে বসিয়ে সম্মানিত করতে দ্বিধা করেননি। তিনি রোজ ক্লাব প্রাঙ্গণে গিয়ে তাঁর বয়সি সদস্যদের সাথে গল্প করে ও স্বাস্থ্য সচেতন বেশ কিছু মানুষের কৃত্রিম হাসির মহড়া দেখে, অনেকটা সময় আনন্দে কাটান। তাঁর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথায় তাঁর সমবয়সি বৃদ্ধদের হাসির আওয়াজে, লাফিং ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের কৃত্রিম হাসির আওয়াজ প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায়।

এহেন হারাধন বাবু আজ হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে, ডাক্তার দেখাবার জন্য চড়া রোদে অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে বাসে উঠলেন। বাসে বেশ ভিড়, তিনি বরিষ্ঠ নাগরিকদের আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওই আসনে দুটি যুবক কানে মোবাইলের তার গুঁজে নিজেদের মধ্যে হাসি মশকরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। তারা হারাধন বাবুকে দেখেও একইভাবে বসে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি যুবক দুটির উদ্দেশ্যে মৃদু স্বরে বললেন, “আমাকে একটু বসতে দেবে বাবা, আমি বড় অসুস্থ”।

যুবক যুগল কোন উত্তর দিলো না।

হারাধনবাবু আবার বললেন, “আমি আর দাঁড়াতে পারছি না বাবা, আমি বড় অসুস্থ। দয়া করে আমাকে একটু বসতে দাও”।

“ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন নাতো, অসুস্থ তো ফুলবাবু সেজে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কেন”?

যুবকটির কথা শুনে হারাধন বাবুর কান লাল হয়ে গেলেও, বাসের অনেকেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো, কিন্তু কারও কোন প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেল না। হারাধন বাবু আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে, অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও বাসের মেঝেতেই বসে পড়লেন। বাসের লোক চলাচলের জায়গায় বসে পড়ায় বেশ অসুবিধা দেখা দেওয়ায় অনেকেই, এমনকী কন্ডাক্টার পর্যন্ত তাঁকে উঠে দাঁড়াতে বললেন। হারাধন বাবুর শরীর তখন ঘামে ভিজে গেছে। বাধ্য হয়ে তিনি কোনক্রমে আবার উঠে দাঁড়ালেন।

যুবক দুটির একজন একটা গা জ্বালানো হাসি হেসে বললো, “একেই বলে শক্তের ভক্ত”।

সামনে পিছন থেকে আবার একবার হাসির রোল ভেসে আসলো।

হারাধন বাবু পরের স্টপেজে নামবেন। নামার সময় জামার হাতায় কপালের ঘাম মুছে যুবক দুটিকে বললেন, “ভালো থেকো বাবারা”।

“দিব্যি তো চলে আসলেন, শুধু শুধু অসুস্থতার ভান করেন কেন? অনেক তো বয়স হলো, এবার সুযোগ নেওয়ার স্বভাবটা ছাড়ুন না। এইজন্যই দেশটার আজ এই অবস্থা”।

আবার একবার হাসির রোল।

হারাধন বাবু বাস থেকে নামার সময় শুধু একবার বললেন, “তাহলে আমার অনেক বয়স হয়েছে বলছো”?

বেশ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাস থেকে নেমে হারাধন বাবুর হঠাৎ মনে হলো, তাঁর যথেষ্ট কষ্টের মাঝেও তাঁর কথায় তো বেশ কিছু লোকের হাসির উদ্রেক হয়েছে। মানুষ আজ হাসতে ভুলে গেছে, এটাই তো একটা বড় পাওয়া। ধীরে ধীরে তিনি ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।

সুবীর কুমার রায়

০৬-০৫-২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s