বড়দিনের শুভেচ্ছা {লেখাটি ভালোবাসা, ও গল্পগুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

71946068_1338812139627865_3484388348838019072_n

আজ পঁচিশে ডিসেম্বর, আজ বড় শুভদিন। একে বড়দিন, তার ওপর প্রভু যীশুর জন্মদিন। এই দিনটি নিয়ে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একটু লোক দেখানো মাতামাতি করার অভ্যাস আছে। বাড়িতে ডাঁটা চচ্চরি খেলেও, সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে গিয়ে কিছু খেয়ে ছবিসহ তাৎক্ষণিক প্রচার না করলে, সমাজে নাকি স্টেটাস রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ে, সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ও হয়তো থাকে। আজ এই শুভদিনে হঠাৎ একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, তিনি প্রভু যীশু নন, কোন বন্ধুবান্ধব বা পরমাত্মীয়ও নন। একটি অচেনা অজানা অপরিচিতা অল্পবয়সি মেয়ে, যার মুখটা আজ আর মনেও পড়ে না।

আজ থেকে ঠিক এগারো বছর আগে, অর্থাৎ পঁচিশে ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে আজকের সন্ধ্যায় আমাকে কলকাতার মুকুন্দপুরে একটি হাসপাতালের আই.সি.সি.ইউ. বেডে কাটাতে হয়েছিল। ঠিক দুদিন আগে আমার বাইপাস অপারেশন হয়েছে, প্রচণ্ড যন্ত্রনায় চিৎ হয়ে শোয়ার ক্ষমতা নেই। হেলান দিয়ে আধ বসা আধ শোয়া অবস্থায় বাড়ির লোকের আসার অপেক্ষায় আছি। দিনে ঠিক দুজনকে আমার সাথে দেখা করতে দেওয়া হবে, তাও আবার অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাড়ির লোকের দেখা নেই। এরপর ভিজিটিং আওয়ার্স পার হয়ে গেলে হয়তো দেখা করতেও দেবে না। যাইহোক, শেষপর্যন্ত আমার কন্যা ও জামাতা এসে উপস্থিত হলো। জানা গেল, যে সায়েন্স সিটিতে মান্না দে ও সন্ধ্যা মুখার্জীর সঙ্গীতানুষ্ঠান থাকায় রাস্তা বেশ জ্যাম ছিল, তাই এতো বিলম্ব।

এই হাসপাতালটিতে অনেক নার্স বা অন্যান্য কর্মচারী খৃস্টান ধর্মাবলম্বী, কেরালার অধিবাসী। আমার বেডের ঠিক পাশেই একটি টেবিলে একজন নার্সের পোষাক পরিহিতা একটু বয়স্কা ভদ্রমহিলা বসে আছেন, বাকি কয়েকজন অল্পবয়সি নার্স রোগীদের দেখভাল করছে। অন্যান্যদের কথায় বুঝতে পারছি যে, যে মেয়েটি মূলত আমায় দেখভাল করছে, সে খৃস্টান ধর্মাবলম্বী। সন্ধ্যার পর একে একে প্রায় সব নার্স চলে গেলেও, এই মেয়েটি চলে যেতে পারছে না। সম্ভবত এর রিলিভার না আসায়, বা অন্য কোন কারণে সে বাড়ি যেতে পারছে না। এই মেয়েটির আজ উৎসব, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। অন্যান্য নার্সরা মৌখিক সহানুভতি দেখালেও, তার সাহায্যে কাউকে কিন্তু এগিয়ে আসতে দেখিনি। সারাদিন তার কাজ, রোগীদের প্রতি তার সাহায্য ও সহানুভুতি, আমায় মুগ্ধ করেছিল। ধীরে ধীরে অনেক সময় কেটে গেল, এই মেয়েটি একাই সব সামলাচ্ছে। ওই অবস্থাতেও আমার মেয়েটির জন্য বড় মায়া হোল, কষ্ট হলো। আর সকলের তো বছরে অনেক উৎসবের দিন আছে, এই মেয়েটির কিন্তু সারাবছরে এই একটিই উৎসবের দিন, অন্তত প্রধান উৎসবের দিন। তাদের একজনও কি পারতো না, একটা দিন নিজে একটু বেশিক্ষণ থেকে এই মেয়েটিকে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দিতে? মেয়েটি ঠায় আমার বেডের পাশে একটা টুল নিয়ে বসে থাকলো। শেষে আমি তাকে বললাম, “তুমি চলে যেতে পারো, আমার কোন অসুবিধা হবে না। সে বললো, “আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি এটাই করতাম”। আরও অনেক পরে অন্য কয়েকটি নার্স এসে উপস্থিত হওয়ায়,  এই মেয়েটি মুক্তি পেলো ও আমার ভালো থাকার কামনা করে, শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল।

পরের দিন সকালে আমাকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত করা হলো, ফলে তার সাথে আর আমার দেখা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় ইচ্ছা ছিল তাকে কিছু টাকা     উপহার হিসাবে দেওয়া। কিন্তু ওই  

হাসপাতালের কর্মচারীদের রোগী বা রোগীর বাড়ির লোকের কাছ থেকে কোন টাকা নেওয়া শুধু খাতাকলমে বারণ ছিল না, বাস্তবে এটাই ঘটনা ছিল। তাছাড়া মেয়েটির নামও জানতাম না, তাই উপহার নাহোক সামান্য একটা শুকনো ধন্যবাদ জানাবার সুযোগও হয়নি। অনেকে হয়তো বলতেই পারেন, যে এই টাকা দেওয়াটা ঠিক নয়, এতে ওদের চাহিদা ও লোভ বেড়ে যায়। আমিও তাই মনে করি, কারণ বহুবার সরকারি হাসপাতাল বা নামীদামি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর কথা ভেবে বাধ্য হয়েছি উপহার নয়, ঘুষ হিসাবে টাকা দিতে। একবালপুরের এক নামী হাসপাতাল নামের নার্সিং হোম থেকে, মার মৃতদেহ নিয়ে আসার সময়েও এই চাহিদার হাত থেকে মুক্তি পাইনি।

মেয়েটির নাম জনি না, তার মুখ বা চেহারাটাও আজ এতগুলো বছর পরে আর মনে করতে পারি না। তবু আমার সেই অতি কষ্টের একটি দিনে, তার সেবা যত্ন সহানুভুতির কথা এই দীর্ঘ এগারো বছরেও ভুলতে পারলাম কই? আজ সেই একই উৎসবের দিনে তাকে আমার প্রাণভরা স্নেহ, ভালবাসা, শুভেচ্ছা, এমনকী শ্রদ্ধা জানালাম। সে ভালো থাকুক, সুখে থাকুক, আনন্দে থাকুক।

সুবীর কুমার রায়

২৫-১২-২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s