কার্তিক পূজার দিন সন্তানহীন দম্পতির বাড়ির দরজার সামনে বন্ধুবান্ধবদের কার্তিক মূর্তি বসিয়ে রেখে যাওয়া, যাকে সবাই কার্তিক ফেলে গেছে বলে উল্লেখ করে, সম্ভবত কারও অজানা নয়। এই ঘটনা আগেও ছিলো, এখনও আছে। নির্ভেজাল আনন্দ ও পেট পূজার সুযোগ ছাড়া, এইসব বন্ধুবান্ধবদের কপালে নাকি কিছু অর্থাগমের সুযোগ ঘটে বলেও শোনা যায়। বিবাহের দীর্ঘদিন পরেও যাদের কপালে সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ হয়নি, তাদের অনেকেই মনে মনে তার বাড়িতে কার্তিক মূর্তি ফেলা হোক আশা করে, ও মূর্তি ফেলে গেলে খুশি হয়ে সন্তান কামনায় ধুমধাম করে পূজাও করে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তাদের, যাদের ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস বা আস্থা নেই, এবং বিবাহের পরে যাদের এখনও সন্তান লাভের সময়ই আসেনি। বর্তমানে ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যে বৈশাখ মাসে বিবাহিত দম্পতির দরজার সামনে মাত্র ছ’মাস পরে কার্তিক পূজোর আগের রাতে কার্তিক মূর্তি রেখে যেতে, এমনকী এক জোড়া কার্তিক রেখে যেতেও, এইসব বন্ধুবান্ধবরা একবার চিন্তা করারও প্রয়োজনবোধ করে না। বাস্তবে দেখা যায়, মূর্তি আবাহনের থেকে মূর্তি বিদায়, লাশ পাচারের মতো অনেক বেশি সমস্যা ও ঝামেলা সাপেক্ষ। ফলে কার্তিক পূজার আগের রাতে নব বিবাহিত দম্পতিদের বেশ চিন্তায় ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়েই বিনিদ্র নিশি যাপন করতে হয়। বহু বছর আগে বাড়িতে এরকমই এক মূর্তির আগমনে, আমাকেও বেশ আতঙ্কগ্রস্ত ও ঝামেলায় পড়তে হয়েছিলো, তবে সেই আতঙ্কের চরিত্র ছিল, একেবারেই ভিন্নধর্মী।
বিবাহের বছর দেড়েক পরে এক সকালে আমার বছর চারেকের ভাইঝি তার আধোআধো বুলিতে আমায় ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে সুসংবাদ দেয়, “রাঙা কাকা আমাদের বাড়িতে কে দুটো ঠাকুর রেখে গেছে”। গত জন্মে সম্ভবত পেচক ছিলাম, তাই এই জন্মে চিরটাকাল আমার গভীর রাতে শোয়া ও অনেক বেলায় ওঠা অভ্যাস। সকালের দিকের ঘুমটাই আমার বড় প্রিয়, তাই আধো ঘুমে আধো জাগরণে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “ঠিক আছে”। সে কিন্তু এতবড় সুসংবাদটা আমায় না শুনিয়ে ছাড়বে না, তাই আমায় ধাক্কা দিয়ে আবার বললো, “ও রাঙাকাকা, আমাদের বাড়িতে কে যেন দুটো ঠাকুর রেখে গেছে”। খবরটা শুনে এবার ধড়মড় করে উঠে, একপ্রকার ছুটেই বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য এগলাম। কেউ নিশ্চই কার্তিক ফেলে গেছে ভেবে ভয় পেলাম। একবারও মনে হলো না, যে আমার বাড়িতে কার্তিক মূর্তি ফেলার মতো আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই, কারণ ফেললেও সেই মূর্তিকে যে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হবে, সেটা সবাই জানে, সর্বোপরি এটা কার্তিক মাস তো নয়ই, আশ্বিন কিংবা অগ্রহায়ণ মাসও নয়।
আমাদের বাড়ি ও ঠিক পাশের নির্মলদার বাড়ির সীমানা বোঝার জন্য, একটা এক-দেড় ফুট উঁচু পাঁচিল ছিলো। পাঁচিলের শেষপ্রান্তে নির্মলদাদের অংশে, নালার নোংরা জল ফেলার জন্য বেশ খানিকটা মাটি খুঁড়ে, সোকপিটের মতো একটা কাঁচা কুয়োর মতো করা ছিল। তাদের বাড়ির আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থও তাতে ফেলা হতো। আর তার ঠিক পাশে দেড় ফুট পাঁচিলের এপাশে আমাদের অংশে, বেশ কিছু অব্যবহৃত ইট সাজিয়ে রাখা ছিলো। এক ছুটে বাইরে গিয়ে মূর্তি দেখে একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। বড় তো নয়ই, রীতিমতো ছোট দুটি মূর্তি, এবং সেটা কার্তিক চন্দ্রের নয়। দোকানে যেমন লক্ষ্মী ও গণেশের ছোট ছোট মূর্তি রেখে, নিত্য ফুলের মালা দেওয়া হয় ও পূজা করা হয়, ঠিক সেরকম একটা একবারে ছোট লক্ষ্মী ও গণেশের মূর্তি। ছোট হলেও অবশ্য ভারী সুন্দর ও চকচকে মূর্তি।
এবার রীতিমতো চিন্তায় পড়লাম, এবং সেই চিন্তা কার্তিক মূর্তি ফেলার শতগুণ বেশি। সেই সময় বাচ্চাদের খেলনা, বল, পুতুল, পরিত্যক্ত ব্যাগ, বা ওই জাতীয় যেকোন জিনিস রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে, হাত না দেওয়ার জন্য রেডিও টিভি বা খবরের কাগজে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিলো। ওইসব সামগ্রীতে হাত দেওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটে বেশ কিছু মানুষ, বিশেষ করে শিশুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, এমন ঘটনা যত্রতত্র আকছার ঘটছে। আমাদের বাড়িতে আবার একজন বছর দশেকের এবং একজন বছর চারেকের শিশু আছে। এই অবস্থায় এই মূর্তিদুটোকে রেখে দেওয়া উচিত হবে না। তখনও টেলিফোন ব্যবস্থা সেইভাবে চালু হয়নি, কাজেই অনেক দূরের থানায় গিয়ে জানানোও সম্ভব নয়। আর জানালেও তারা যে এই ঘটনার কতটা গুরুত্ব দেবে, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একটু পরেই তো অফিসে বেরিয়ে যেতে হবে, কাজেই তারপরে কি হবে ভেবে পেলাম না। কোন বদ উদ্দেশ্য না থাকলে, এই সাতসকালে মূর্তিদুটো কেউ রেখেই বা যাবে কেন? হাতে করে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করা উচিত নয়, ফেলতেও সাহস হচ্ছে না।
শেষে সাহস করে তখনকার যুবকদের এক হিরোর ভূমিকা নেওয়া ছাড়া, দ্বিতীয় কোন সমাধানের পথ খুঁজে পেলাম না। এন্টার দি ড্রগনের ব্রুস লি’র কথা মনে পড়লো। সিনেমাটা দেখে অবাক হয়েছিলাম। পত্রপত্রিকায় পড়েছিলাম, তিনি নাকি লাইটের সুইচ অফ করার পরে লাইট নেভার আগেই নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে পারতেন। আমাকেও মূর্তি বিদায়ের কাজটা সেই দক্ষতায় ও ক্ষিপ্রতায় খুব দ্রুত সারতে হবে। বাচ্চাদুটোকে বাড়ির ভিতর পাঠিয়ে দিয়ে মনে মনে রেডি স্টেডি গো আওড়ে, একছুটে গিয়ে পেলে বা গ্যারিঞ্চার স্টাইলে অতি দ্রুত এক কিকে মূর্তিদুটোকে পাশের সোকপিটে চালান করে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটার আগেই ব্রুস লি’র মতো দ্রুত ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করলাম। না, কোনরকম বিস্ফোরণ তো দূরের কথা, বিনা প্রতিবাদে দেবতাযুগল টুঁ শব্দটি না করে, পাশের সোকপিটে নিমজ্জিত হলেন।
অযথা সময় নষ্ট না করে আমি নিজের বিছানায় ফিরে এসে আবার যোগনিদ্রায় মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করলাম। সবে একটু তন্দ্রা মতো এসেছে, লক্ষ্মীদির গলা পেলাম। লক্ষ্মীদির বাড়ি উলুবেড়িয়ায়, সে আমাদের বাড়ি ঠিকে কাজ করে। লক্ষ্মীদি মা’র কাছে জানতে চাইছে, যে অন্য এক বাড়িতে নতুন লক্ষ্মী ও গণেশের মূর্তি কেনায়, তাকে আগের একটা লক্ষ্মী ও একটা গণেশের মূর্তি উলুবেড়িয়ার গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার জন্য দিয়েছিলো। সকালে যখন এই বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলো, তখন বাইরে ইটের পাঁজার ওপর মূর্তিদুটো রেখে গেছিলো। এখন নিতে গিয়ে দেখছে সেখানে নেই। মূর্তিদুটো কেউ সরিয়ে রেখেছে কিনা। আমি আর কি করি, গোটা গল্পটা তো আর তাকে বলা যায় না। বাধ্য হয়ে বললাম, তুমি চিন্তা করো না, মূর্তিদুটোকে আমি ঠিক জায়গায় বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। আর শুয়ে থাকা গেলো না, বাধ্য হয়ে উঠে পড়ে মুখ ধুয়ে বিপম্মুক্ত আমি, চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম।
সুবীর কুমার রায়
১৮-১১-২০২১
