বলি

দীর্ঘ প্রায় পনেরো বছর পর পূজোর ছুটিতে সপ্তাখানেকের জন্য নিজ রাজ্যে ফিরে, পঞ্চমীর দিন ভোরবেলায় খবরটা শুনেই অসীমবাবু সুবিমলবাবুর বাড়ি ছুটে গেলেন। এই একই পাড়ায় তাঁদের উভয়েরই দীর্ঘদিনের বাস। চাকরিসূত্রে বছর পনেরো আগে সপরিবারে ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার পর থেকে, অসীমবাবুর এখানে আর আসার সুযোগ হয়নি। সুবিমলবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখেন প্রচুর লোকের ভিড়, পুলিশের উপস্থিতিও তাঁর চোখ এড়ালো না। সুবিমলবাবুর একমাত্র সন্তান, সৈকতের স্ত্রী আজ ভীষণভাবে আগুনে পুড়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নানা কথা কানে এলো। কেউ বলছে মেয়ের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে শাড়িতে আগুন ধরে গেছে, কেউ বলছে অর্থপিশাচ সুবিমল বাবু মনোমতো পণ না পাওয়ায়, এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কারণ যাই হোক না কেন, অসীমবাবুর ভীষণ খারাপ লাগলো, কারণ অনেক বছর আগে এই পূজোর সময়, এই মেয়েটিকেই শিশু বয়সে এই বাড়িতে অন্য রূপে অন্যভাবে তিনি দেখেছিলেন। তাছাড়া এখন আর তার কতই বা বয়স হবে, বছর চারেক আগেই তো ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েও, সময় ও সুযোগের অভাবে তাঁর আসা হয়ে ওঠেনি। 

ভিড় কাটিয়ে তিনি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন। ভুসোকালি ও জলে থইথই ডানপাশের রান্নাঘরটার ওপর চোখ পড়ায়, তিনি আঁৎকে উঠলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি সুবিমলবাবুর ঘরে গিয়ে বসলেন। ঘরে আর কেউ নেই। শোকস্তব্ধ বাড়ির আর সকলে সম্ভবত ভিতরের অন্য কোন ঘরে আছেন। সুবিমলবাবু কান্না জড়ানো ধরা গলায় জানালেন, “ছেলে অফিসের কাজে বাইরে গেছে, এদিকে আজ ভোরের দিকে নাতনির জন্য গ্যাসে দুধ গরম করতে গিয়ে, বৌমার শাড়িতে আগুন ধরে যায়। ওর চিৎকারে ছুটে গিয়ে জল দিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও, বৌমা ভীষণভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যাওয়ায়, পাড়ার ছেলেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে”। ঘরের একপাশে দেখলাম, আগের মতোই অষ্টধাতুর তৈরি উজ্জ্বল দুর্গামূর্তিটা সিংহাসনের ওপর শোভা পাচ্ছে। আজ পঞ্চমী, পূর্বের ন্যায় এবারেও এই ঘরেই পূজার আয়োজন সম্পন্ন হলেও, পূজা বন্ধ রাখতে হয়েছে।

বাড়ির বাইরে উত্তেজিত জনতার প্রচণ্ড কোলাহল, তাই আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে সুবিমলবাবুকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি উঠতে যাবেন, এমন সময় একদল যুবক ঘরের ভিতরে ঢুকে, সুবিমলবাবুকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো।

উত্তেজিত এতগুলো ছেলের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার সাহস বা ক্ষমতা, কোনটাই অসীমবাবুর নেই, তবু সুবিমলবাবুকে মারধর না করার জন্য তিনি তাদের একবার অনুরোধ করলেন। তাঁর অনুরোধে কর্ণপাত না করে তারা জানালো, যে হাসপাতাল থেকে এইমাত্র খবর এসেছে, সুবিমলবাবুর পুত্রবধু মারা গেছে এবং মারা যাওয়ার আগে সে ডাক্তার ও পুলিশকে জানিয়েছে, যে তার বাবা তার বিয়েতে চাহিদা মতো পণ দিতে না পারায়, তার শ্বশুরমশাই প্রথম দিন থেকেই তার ওপর অত্যাচার করে আসছেন। আজ ভোরে রান্নাঘরে মেয়ের জন্য গ্যাসে দুধ গরম করতে গেলে, শ্বশুরমশাই পিছন থেকে তার শাড়িতে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। তার চিৎকার ও আর্তনাদেও তিনি রান্নাঘরের দরজা খোলেননি। বাড়ির কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। শেষে তার চিৎকারে পাড়ার ছেলেরা  এসে জল দিয়ে আগুন নেভায়। এরপর আর পাড়ার ছেলেদের হাত থেকে সুবিমলবাবুকে উদ্ধার করার প্রবৃত্তি বা সাহস, কোনটাই তাঁর হয় না।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুর্গামূর্তিটার ওপর তাঁর আবার চোখ পড়লো। প্রতি বছর দুর্গা পূজার সময় চার দিন ঘটা করে এই মূর্তি পূজিতা হন, এবারেও তার আয়োজন সম্পন্ন। অনেক বছর আগে এই বাড়িতেই একটি শিশু কন্যাকে ফুল মালা চন্দন দিয়ে সাজিয়ে কুমারী দুর্গা হিসাবে পূজা করে, সুবিমলবাবু এই দুর্গা মূর্তিকে খুশি করতে চেয়েছিলেন। আজ এতগুলো বছর পরে এই পঞ্চমীর দিনে সামান্য অর্থের লোভে, সেই একই বাড়িতে তিনি সেদিনের সেই শিশুটিকেই নিজহাতে বলি দিয়ে, এবং আর একটি শিশুকে মাতৃহারা করে, একই মূর্তির বোধন পর্ব সমাধা করলেন। শোনা যাই এই মূর্তিটি নাকি খুব জাগ্রত। পূর্বে বহুবার অসীমবাবু এই মূর্তিটি দেখে থাকলেও, আজ কিন্তু জাগ্রত মূর্তির মুখে কোন প্রতিক্রিয়া তাঁর চোখে পড়লো না। একটাও কথা না বলে, তিনি মনমরা হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, ও মেয়েটির বাড়ির লোকের অভিযোগে, পুলিশ সুবিমলবাবুকে থানায় তুলে নিয়ে গেলো।

কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পরে অসীমবাবু আর তাঁর খোঁজ রাখার কোনদিন প্রয়োজন বোধ করেননি।

সুবীর কুমার রায়

০২-১১-২০২১

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s