মল্লিক বাজারের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা, ভদ্র নম্র ঠান্ডা চরিত্রের শীতল বাবুকে পাড়ার সকলেই চেনে, শ্রদ্ধা করে। তিন বছর হলো ভারতীয় রেলের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে, তিনি বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। তবে এযাবৎ তাঁর নিজের সভ্য ভদ্র সুন্দর ব্যবহারের জন্য তিনি পাড়ার সকলের পরিচিত হলেও, ইদানিং গোটা পাড়ায় তাঁর পরিচিতি, ভোম্বলের পিতা হিসাবে।
পুত্র সন্দীপ, যে ভোম্বল নামেই অধিক পরিচিত, কিন্তু বাবার চরিত্র আদপেই পায়নি। ছোটখাটো একটা অফিসে অতি সাধারণ একটা কাজ করলেও এবং বাড়িতে সংসার খরচের জন্য কোন টাকা দিতে না হলেও, হোটেল, সিনেমা, দামি মোবাইল, মোটর বাইকের পিছনে গার্লফ্রেন্ডকে বসিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ব্যয় তার আয়কে ছাপিয়ে যায়। ফলে অধিক আয়ের জন্য তাকে অন্য ধান্দা করতেই হয়। বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় বিশেষ না থাকায়, তাকে আয়ের সবচেয়ে সহজ রাস্তা, মাস্তানি ও লোক ঠকানোর মসৃণ পথেই বিচরণ করতে হয়। নানা কায়দায়, নানা অজুহাতে, সে পাড়ার লোকেদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।
একদিন সে খবর পেলো, যে নবাবগঞ্জের ত্রিকালদর্শী বিপদভঞ্জন বাবা নাকি সকল বাধা বিপদ কাটিয়ে, অতি সহজেই অনেকের ভাগ্য আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছেন। তিনি নাকি তারাপীঠ না কোথাকার শ্মশানে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে কঠিন তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে, দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের সেবায়, নবাবগঞ্জে এক চেম্বার খুলে বসেছেন। এরপরে আর ঘরে বসে থাকা চলে না, যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে থাকে। ফলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ও পাড়ার লোক ঠকানো ব্যবসা সাময়িক মুলতুবি রেখে, সে ছুটলো নবাবগঞ্জে বিপদভঞ্জন বাবার ডেরায়।
বাবার আশ্রমটির সামনে বহু মানুষের ভিড়। সকলের মুখেই এক কথা, বাবা নাকি ত্রিকালদর্শী, কঠিন সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে তিনি সর্বশক্তিমান। যেকোন সমস্যার আশু সমাধান বাবার নাকি বাঁহাতের খেল। বাবার ত্রিকাল দর্শন ও সর্বশক্তিমান হওয়া নিয়ে ভোম্বলের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা বা আগ্রহ, কোনটাই নেই। তার আগ্রহ শুধু ইহকালে প্রচুর অর্থাগমের সুযোগ, এবং সেই ব্যবস্থা করে দিলেই সে খুশি।
যাহোক, দীর্ঘক্ষণের অপেক্ষার পর সে বাবার সাক্ষাৎ পাওয়ার সুযোগ পেলো। বাবাকে প্রণাম করে বসার সাথে সাথেই বাবা তার হাতের তালুটা নিজের চোখের সামনে টেনে নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, “কি নাম, কোথায় থাকা হয়”? এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ভোম্বল জানালো, “আঁজ্ঞে আমার নাম সন্দীপ চন্দ্র মিত্র, অবশ্য আমাকে সবাই ভোম্বল নামেই চেনে। বাবা রেলের চাকরি করার সময়েই মল্লিক বাজারে বাড়ি করেন। বাবার নাম শ্রী শীতল চন্দ্র…”। তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বাবা বললেন, “ওরে ছোঁড়া এবার থাম, এতকথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করেছে? সবই যদি তুই বলবি, তাহলে আমি বলবো কী? হাতের রেখায় তো দেখছি, বুলটি নামে তোর তো একটা বিবাহিতা বোনও আছে। তোর বাবা অবসর নেওয়ার আগেই তার বিয়েও দিয়ে দেয়”। একটু থেমে আবার বললেন, “আচ্ছা, তোর ভগ্নিপতি কি পোস্ট অফিসে কাজ করে”?
ভোম্বল তো অবাক, শুধুমাত্র হাতের রেখা দেখে এতকিছু বলে দেওয়ার ক্ষমতা তো স্বয়ং ঈশ্বরও রাখেন বলে মনে হয় না। গদগদ হয়ে ভোম্বল বললো, “হ্যাঁ স্যার, মানে প্রভু। আমার ভগ্নিপতি চন্ডীপুর পোস্ট অফিসে কাজ করেন। ওদের বেশ সচ্ছল অবস্থা, শুধু আমারই কিছু হলো না। আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন প্রভু, কথা দিচ্ছি, আমার একটা ভালো চাকরি হলে, আমি আপনার এই চেম্বার মার্বেলে মুড়ে ঝাঁচকচকে করে দেবো”।
“মূর্খ। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে আমি এই কাজ করি। মায়ের নির্দেশে নিজের সামান্য চার্জ ছাড়া, একটা পয়সাও অধিক নেওয়ার অধিকার আমার নেই, আর তুই এসেছিস আমায় লোভ দেখাতে? এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করে বেরিয়ে যা। তোর উপকার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তুই বরং অন্য কারও কাছে গিয়ে সাহায্য ভিক্ষা কর”।
বাবার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা টমা চাওয়ায়, বাবা তাঁকে বলেন, “আমার নির্দেশ যদি অক্ষরে অক্ষরে ত্রুটিমুক্ত ভাবে পালন করিস, তাহলে তোর সব সমস্যা মিটে যাবে। তবে কয়েকটা মাস সময় লাগবে। এবার জানবি তোর সমস্যার সমাধান তোর হাতে। বল্ আমার নির্দেশ ঠিকমতো মেনে চলতে পারবি তো”?
চোখের সামনে ভোম্বল তার সুদিন আসার ও মনোবাঞ্ছা পূরণের ছবিটা দেখতে পেলো। কতদিনের সখ একটা দামি আই ফোন কেনার। নিজের ওই লজঝড়ে মোটর বাইকে নিজের চলে গেলেও, সুইট হার্ট অনামিকাকে পিছনে বসিয়ে নিয়ে যেতে লজ্জা করে। একটা দামি মোটর বাইক না কিনলেই নয়। অনামিকাকে ভালো একটা গয়না কিনে দেওয়ার ইচ্ছা তার বহুদিনের। বেচারা মুখ ফুটে চাওয়ার পরেও, পয়সার অভাবে কিনে দিতে পারেনি। নাঃ, সে আর ভাবতে পারছে না। অতি বিনয়ের সাথে সে বললো, “নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমি সব করতে প্রস্তুত প্রভু, আপনি আমায় শুধু আদেশ করুন, পথ বাতলান”।
বাবা এবার একটা তাবিজ ও ভাঁজ করা কাগজ তার হাতে দিয়ে বললেন, তোকে একটা সংকটমোচন তাবিজ দিচ্ছি। তুই মাথা মুড়িয়ে, ভালো করে গঙ্গা স্নান করে, নতুন ধুতি ও গেঞ্জি পরিধান করে, লাল রঙের কার দিয়ে ডান বাহুতে কোন সৎ ব্রাহ্মণকে দিয়ে বেঁধে নিবি। পারলে এই পোশাকে একটা মাস অন্তত কাটাবি। পূর্ব দিকে মুখ করে বসে, দুবেলা নিরামিষ আহার করবি। আর কাগজে লেখা মন্ত্রটা সকাল সন্ধ্যায় পাঠ করবি। যাঃ, আমার প্রণামীর পাঁচ হাজার টাকা ওই প্রণামির বাক্সে রেখে দিয়ে বিদায় হ, আর বিরক্ত করিস না। পাঁচমাস পরে নতুন জীবন নিয়ে দেখা করে যাস।
টাকার অঙ্ক শুনে ভোম্বল ভিরমি খেলো। পাঁচ হাজার টাকা মানে তো তার এক মাসের মাইনে, তাছাড়া এত টাকা সে সঙ্গে করে নিয়েও আসেনি। অথচ এই সুযোগ হাতছাড়াও করা যায় না। শেষে তার অসুবিধার কথা বাবাকে খুলে বলে, মায়ের স্বপ্নাদেশের পাঁচ হাজার টাকার সাড়ে চার হাজার টাকা আপাতত দিয়ে, পাঁচমাস পরে বাকি পাঁচশ’ টাকা দিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলো।
বাবা-মা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও নেড়া হওয়ার ব্যাপারে সকলের ঘোর আপত্তি অগ্রাহ্য করে, একদিন সে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে মাথা মুড়িয়ে, নতুন বস্ত্র পরিধান করে বাড়ি ফিরে এলো। পাড়ার এক পুরোহিত ব্রাহ্মণকে দিয়ে ডান বাহুতে তাবিজ বাঁধার পর্বও সম্পন্ন হলো, অবশ্য তার জন্য আবার কিছু খরচাও করতে হলো। প্রকৃত ঘটনা শীতল বাবুর জানা নেই, তবে উচ্ছন্নে যাওয়া পুত্রের এহেন সন্ন্যাসীসুলভ আচরণে, তিনি হয়তো মনে মনে একটু খুশিই হলেন।
নিয়মিত পূর্ব দিকে মুখ করে ধুতি পরে বসে, দুবেলা নিরামিষ আহার ও মন্ত্র পাঠ করে দিন কাটতে লাগলো। নেড়া মাথায় এই পোশাকে অফিস যাওয়া ও গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে মোটর বাইকে ঘোরাও মাসখানেক বন্ধ রইলো। ফলে চাকরিটি গেলো। টাকার অভাবে মোটর বাইকটাও বেচে দিতে হলো। সবই হলো, শুধু টাকার আগমন হলো না। এইভাবে পাঁচ-পাঁচটা মাস কেটে গেলো।
শেষে একদিন তার বন্ধু সুবিমল তার বাড়িতে এসে শীর্ণ কঙ্কালসার ভোম্বলকে দেখে তো অবাক। সুবিমলের বাবা শীতল বাবুর সাথে একই অফিসে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করতেন। ভোম্বলের মুখে সব ঘটনা শুনে, সে পরের দিনই তাকে নিয়ে নবাবগঞ্জে বিপদভঞ্জন বাবার চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখা গেলো বাবার চেম্বার বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, বিপদভঞ্জন তাঁর আসল নাম নয়। তাঁর প্রকৃত নাম শান্তিরঞ্জন চাকলাদার, রানাঘাটের কাছে কোথায় যেন তাঁর বাড়ি। তিনি রেলে কাজ করতেন, এবং যে অফিসে কাজ করতেন, সেখানেই সুবিমল ও ভোম্বলের বাবা কাজ করতেন। দিনের পর দিন লোক ঠকানোর ব্যবসায় অতিষ্ঠ হয়ে, একদিন বেশ কিছু প্রতারিত মানুষ তাঁর চেম্বার ভাঙচুর করে তাঁকে মারধোর করে এখান থেকে তাড়িয়ে দেয়।
ভোম্বল তাঁকে চিনতে না পারলেও, সুবিমল তাঁকে ঠিক চিনতে পেরেছে। সুবিমল ভোম্বলকে বললো, “তুই লোকটাকে চিনতে পারলি না? তোর বোন, বুলটির বিয়েতে তো সে তোদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতেও এসেছিলো। তোর ঠিকানা ও বাবার নাম তাকে বলায়, সে তোকে চিনতে পেরে তোর পারিবারিক ইতিহাস শুনিয়ে তোকে সম্মোহন করেছে।
চাকরি নেই, গার্ল ফ্রেন্ড নেই, মোটর বাইক নেই, আগের মতো মাস্তানি করে লোক ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনের শারীরিক বা মানসিক শক্তিও নেই। ভোম্বল এখন পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ে সবজি বিক্রি করে।
সুবীর কুমার রায়
০৫-১০-২০২১
