ইলিশ উৎসব{লেখাটি প্রতিলিপি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত}

36271711_998507660324983_1780579280690872320_n ইদানীং দেখছি বাঙালির সব উৎসবকে ছাপিয়ে একটা উৎসব মাথাচাড়া দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে স্থান করে নিয়েছে। সেটা আর কিছু নয়, ইলিশ উৎসব। বাজারে ইলিশ মাছের জোগান থাকুক বা না থাকুক, বাড়িতে সপ্তাহে দু’-তিন দিন ইলিশের পদ রান্না হোক বা না হোক, ইলিশ উৎসবে যোগ দিয়ে ইলিশের স্বাদ আস্বাদন করে সবাইকে সেই সুসংবাদটা ঘটা করে না জানালে, সমাজে স্টেটাস্ বজায় রাখা দায় হয়ে পড়ে।

বিভিন্ন কারণে আমি আজ পর্যন্ত সেই উৎসবে যোগদান করতে না পারায়, একপ্রকার একঘরে হয়ে আছি। অথচ এই ইলিশ আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি মাছ। বাজারে তার মূল্য যাই হোক না কেন, তাকে আদর করে রান্নাঘরে নিয়ে আসতে কখনই দ্বিধা বা কার্পণ্য করি না। তবে একবার অদ্ভুতভাবে ছলচাতুরির মাধ্যমে আমার এই ইলিশ ভক্ষণের সুযোগ হয়েছিল, বলা যায় বিনা পয়সায় একটা ঘরোয়া ইলিশ উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ এসেছিল। আজ হঠাৎ সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল, তাই সেই গল্পই আজ বলবো।

আজ থেকে প্রায় একত্রিশ বছর আগে, তখন আমি দক্ষিন বঙ্গের একটি জেলার একটি সদর শহরে একটা লজে থেকে, প্রায় সতেরো-আঠারো কিলোমিটার দূরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরিসূত্রে যাতায়াত করি। অফিস থেকে কয়েক কিলোমিটার পথ ভ্যান রিক্সায় গিয়ে, একটা নদীর প্রায় মোহনার কাছ থেকে নৌকা পার হয়ে, ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার পথ লজঝড়ে বাসে করে আমার লজে যেতে হতো। আমার সাথে আমার অফিসেরই একজন সহকর্মী, দেবাশীষ একসাথে যাতায়াত করতো। অবিবাহিত দেবাশীষ আমার লজের পিছনদিকে সামান্য দূরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো, এবং আমারই মতো চন্দনের ঝুপড়িতে রাতে খেতে যেত।

সেবছর নদীতে হঠাৎ প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। গঙ্গা বা রূপনারায়ণ না হলেও, ওই এলাকার ইলিশ এখনও সব বাজারেই প্রচুর দেখা যায়। সবথেকে বড় কথা, যেমনই হোক সেটা ইলিশ, এবং বেশ তাগড়াই সাইজের ইলিশ। ইলিশ আমার অত্যন্ত প্রিয়, এবং দিনের পর দিন মাসের পর মাস চন্দনের ঝুপড়িতে খেয়ে খেয়ে, জিভে চড়া পড়ে গেছে। বিকেলের শেষভাগে, প্রায় সন্ধ্যার মুখে আমি আর দেবাশীষ ভ্যান রিক্সা থেকে নদীর পারে নেমে দেখি রাস্তার ধারে স্তুপীকৃত, প্রায় পাহাড় প্রমাণ ইলিশ জড়ো করা আছে। প্রায় গোটা ব্লকেই তখনও বিদ্যুৎ বা টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়নি, কাজেই মাঝেমধ্যে কাঠি আইসক্রীম ছাড়া, বরফের দেখা পাওয়া ভার। পরিবহণ ব্যবস্থার হালও তথৈবচ। তিনটে-সাড়ে তিনটের পর, হাওড়া-কলকাতা যাওয়ার বাসের জন্য, বড় রাস্তায় যাওয়ার বাস যোগাযোগও প্রায় অনিশ্চিত ছিল। কতদিন বাড়ি ফেরার জন্য, ওই ছাব্বিশ-সাতাশ কিলোমিটার পথ বাসের অভাবে ভ্যান রিক্সায় যেতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কাজেই বরফ দিয়ে মাছকে তাজা রাখা, বা হঠাৎ ব্যবস্থা করে দূরের কোন শহরে মাছ পাঠানোর ব্যবস্থা করা, প্রায় অসম্ভবই ছিল।

সে যাহোক যেকথা হচ্ছিল। আমাকে দেখেই ইলিশের পাহাড়ের মালিক এসে পাকড়াও করলো, “বাবু টাটকা ইলিশ, দুটো নিয়ে যান, আমি বেছে দিচ্ছি”। সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু লোক এগিয়ে এসে আমায় দুটো ইলিশ নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলো। করবে নাই বা কেন, আমি যে গোটা ব্লকের দু’-দুটো অঞ্চলের প্রায় আশিটা গ্রামের প্রভুত অর্থনৈতিক উন্নতি করাবার পবিত্র দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একমাত্র ঠেকা  নিয়ে গেছি, আমি যে একমাত্র রূরাল ডেভেলপমেন্ট্ অফিসার, বা ফিল্ড অফিসার। ওদের ভাষায় ফিলটার বাবু।

পাকা তেঁতুল দেখলে বা নাম শুনলে যেমন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রসনা সিক্ত হয়, অত ইলিশের উপস্থিতি ও দু’-দুটো রাক্ষুসে সাইজের ইলিশ নিয়ে যাওয়ার অনুরোধও, চন্দনের ঝুপড়ির ছাইপাঁশ খাওয়া আমার শুকনো জিভে জল এনে দিলো। কিন্তু উপায় নেই, কারণ আমি একটা লজে থাকি, আর অবিবাহিত দেবাশীষও একা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, এবং উভয়েই রাতে চন্দনের ঝুপড়িতে পেট ভরাতে যাই। সন্ধ্যার পর থেকে চন্দনের ঝুপড়িতে আমাদের মতো হতভাগ্যদের ভিড় শুরু হয়ে যায়। এতো খদ্দেরের জন্য ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস, ইত্যাদি একা হাতে রান্না করতে চন্দন হিমশিম খেয়ে যায়। তার ফুলবাবু পুত্র ও একজন কর্মচারী তাকে নামমাত্রই সাহায্য করে। কাজেই তাকে দিয়ে মাছ কাটিয়ে রান্না করে দেবার প্রস্তাব মোটেই কার্যকরি হবে না বুঝে লোভ সংবরণ করে বললাম, “না গো আমার অসুবিধা আছে”।

ইলিশ বিক্রেতা আমায় চেনে, হয়তো আমাদের দেওয়া লোনের টাকাতেই তার নৌকা বা ট্রলার কেনা। সে বোধহয় আমার কাছে যথেষ্ট টাকা নেই ভেবে বললো, “দুটো মাছ নিয়ে যান বাবু, সস্তায় দিয়ে দেবো”। আমার নেওয়ার উপায় নেই, তাই নেবো না বলায় সে বললো, “আজ নিয়ে যান, সুবিধা মতো পরে দাম দিয়ে দেবেন”। এই প্রস্তাবেও রাজি না হওয়ায়, সে দুটো মাছ নিয়ে আমায় বললো, “আপনাকে কোন দাম  দিতে হবে না ফিলটার বাবু, এতো মাছ উঠেছে আর আপনি খাবেন না তাই কখনও হয়? আপনি এই দুটো নিয়ে যান”। আমার রাজি হওয়ার কোন উপায় নেই, তাই অন্য একদিন হবে বলে নৌকার দিকে এগিয়ে গেলাম।

দেবাশীষ একবার চন্দনকে কিছু টাকা দিয়ে রান্না করিয়ে নিলে কেমন হয় জিজ্ঞাসা করলে, তাকে আমার অতীতের এক এই জাতীয় তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালাম। উনিশশ’ আশি সালে একবার বেড়াতে গিয়ে চন্ডীগড়ের এক লজে উঠেছিলাম। ওখানে ডিম খুব সস্তা দেখে, ওই সেক্টরের সুপার মার্কেট থেকে একগাদা ডিম কিনে নিয়ে এসেছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল না, কারণ লজটায় রান্না করার কোন সুযোগ ছিল না, এবং কেয়ারটেকার হয়তো ডিমগুলো সিদ্ধ করে দিতে নাও রাজি হতে পারে। কিন্তু আমার বন্ধুর বুদ্ধিতে অতগুলো ডিম কিনে লজে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। ওর যুক্তি ছিল, চাঁদির জুতো মারলে সবাই সব কাজ করে দেয়। কিন্তু হাজার অনুরোধ, পয়সার লোভ দেখিয়েও বাস্তবে কোন লাভ না হওয়ায়, আবার সেই দোকানে গিয়ে ফেরৎ দেবার চেষ্টা করা হলো। ফেরৎ দেওয়াও সম্ভব না হওয়ায়, পাশের এক দোকান থেকে সিদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু যাতায়াতের পথে যেভাবেই হোক বেশ কয়েকটা ডিম ফেটে যাওয়ায়, ও বাকি ডিমগুলো সিদ্ধ করে দেওয়ার পারিশ্রমিক দিয়ে প্রতিটা ডিমসিদ্ধের যা দাম দাঁড়ালো, একটা পাঁচতারা  হোটেলেও বোধহয় ডিমসিদ্ধের মূল্য তার থেকে কম।

সে যাহোক আমরা দুজনে হাতের ইলিশ পায়ে ঠেলে ভগ্ন হৃদয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকা যখন দড়িদড়া খুলে প্রায় ছেড়ে দেবে, হঠাৎ দেবাশীষ নৌকা থেকে নেমে এক প্রকাণ্ড ইলিশ কিনে আনলো। ওর আর আমার, উভয়েরই একই সমস্যা, তাই জিজ্ঞাসা করলাম এটা নিয়ে গিয়ে সে কি করবে। উত্তরে সে জানালো, যে সে এটা তার বাড়িওয়ালিকে প্রেজেন্ট করবে। বাড়িওয়ালার ছোট সংসার, কাজেই সে অবশ্যই ইলিশের ভাগ পাবে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, “তোর তবু বাড়িওয়ালি আছে, আমার যে কেউ নেই’।  দেবাশীষ আমায় বললো, “আজ রাতে চন্দনের ঝুপড়িতে খেতে না গিয়ে, রাত সাড়ে ন’টা-দশটা নাগাদ আপনি আমার বাড়ি চলে আসুন, বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দিন”। সেই ব্যবস্থাই পাকা করে একসময় আমরা যে যার ডেরায় চলে গেলাম।

কথামতো রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ তৈরি হয়ে, ফুরফুরে মেজাজে, গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে দেবাশীষের বাসায় হাজির হয়ে চিৎকার করে ডাকলাম, “দেবাশীষ বাড়িতে আছিস নাকি”? বোধহয় সাবধানতা রক্ষার্থেই, সে আমার তৃতীয়বার চিৎকারের পরে ভিতর থেকে উত্তর দিলো, “কে-এ-এ-এ-এ-এ”? এইবার দরজা খুলে আমায় দেখে যেন ভীষণ অবাক হয়ে গলার পর্দা পাঁচ ডেসিবেল চড়িয়ে বললো, “আরে সুবীরদা আপনি হঠাৎ, ভিতরে আসুন ভিতরে আসুন”। এবার সে তার বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, “আমার অফিসার, খুব ভালো লোক, এই সামনেই একটা লজে থাকেন”। এরপর সে নিজেই বললো, “ঘরে এসে বসুন, ভালো দিনে এসেছেন। এসেছেনই যখন, তখন গরিবের বাসায় দুটো ভাত খেয়ে যাবেন কিন্তু”।

আমিও প্রচণ্ড অনিচ্ছা ও যারপরনাই অবাক হবার ভান করে বললাম, “তুই হঠাৎ চন্দনের ঝুপড়ি ছেড়ে রান্নাবান্না শুরু করলি কবে যে খাওয়াবি? জানা ছিল নাতো”। এবার ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা, উভয়েই  আমাকে তাদের বাসায় আজ দেবাশীষের সাথে রাতে খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। এটা তো মানতেই হবে, যে এই অনুরোধ রক্ষা না করলে, তাঁদের চরম অপমান করা হবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিমরাজি হয়ে দেবাশীষের ঘরে গিয়ে বসলাম।

যথা সময়ে বেশ বড় বড় দুটুকরো ইলিশ দিয়ে ভাত খেয়ে লজের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। দেবাশীষ আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমার সাথে চললো। আমি বললাম, “তোর বাড়িওয়ালি বড় ভালো রান্না করে রে।  আজ তো অর্ধেক মাছ আমরা দুজনেই সাঁটিয়ে দিলাম, ওদের বোধহয় কম পড়বে। আগামীকাল আমি তোর বাড়িওয়ালিকে দুটো মাছ প্রেজেন্ট করবো”। দেবাশীষ বললো, সেটা ঠিক হবে না, ওরা তাহলে বুঝতে পারবে যে আজকের ঘটনাটা সাজানো। কাজেই সেই সুযোগ আর পাওয়া গেল না। পরের দিন থেকে রাতে আবার সেই চন্দনের দোকানের ছাইপাঁশ ভক্ষণ শুরু হলো।

সুবীর কুমার রায়

১৭- ০৭- ২০১৯

মধু চন্দ্রিমা (স্মৃতির পাতা থেকে) {লেখাটি Sahityasmriti online, গল্পগুচ্ছ, প্রতিলিপি বাংলা পত্রিকা সাহিত্য-উৎসব, ও সফর(Safar) পত্রিকায় প্রকাশিত।}

16বিয়ের পরে, সে যত বছর পরেই হোক না কেন, স্বামী স্ত্রীর একসাথে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহলের সীমা নেই। এখন ব্যাপারটা নিয়ে যতটা হইচই লাফালাফি করা হয়, আগে কিন্তু তা ছিল না। ঘটনাটা যদিও চিরকালই ছিল, আজও আছে। তবে এখনকার মতো বিয়ে ঠিক হওয়ার সাথে সাথে, কোথায় অনুষ্ঠান হবে, মেনু কি হবে, পিওর সিল্ক না কাঞ্জিভরম, ইত্যাদি ঠিক হওয়ার আগেই, উভয়ে মিলে জায়গা পছন্দ, হোটেল বুকিং, টিকিট কাটা সম্পন্ন হতো না। এমনকী আগে এই নিয়ে ব্যস্ততা বা মাতামাতিও বিশেষ লক্ষ্য করা যেত না।

আজ আমি আটের দশকের গোড়ায়, এক নবদম্পতির সেই অর্থে মধুচন্দ্রিমা না হলেও, বিয়ের পর দু’জনের একসাথে প্রথম বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ঘটনা শোনাবো। হ্যাঁ, ঘটনাটি আমার নিজের জীবনের এক তিক্ত অভিজ্ঞতাও বটে। বিয়ের দিন কুড়ি-পঁচিশ পরে জানুয়ারী মাসের এক শনিবারের সকালে হঠাৎ ঠিক করলাম,  যে আজ অফিস থেকে ফিরে দিন তিন-চারেকের জন্য সস্ত্রীক দীঘা ঘুরতে যাবো। পূর্বে বহুবার দীঘা ঘুরতে যাওয়ার সুবাদে, ছোট্ট দীঘা শহরটি আমার হাতের তালুর মতোই পরিচিত ছিল। স্ত্রীকে সেইমতো সবকিছু গুছিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়ে, অফিস চলে গেলাম। তখন ইন্টার নেট, মোবাইল, গুগল, অনলাইনের গল্প এদেশে চালু হয়নি। হাতেগোনা কিছু মানুষের বাড়িতে দশফুটোর কালো বেঢপ টেলিফোন দেখা যেত মাত্র। কাজেই আগে থেকে হোটেল বুকিং করার সময় ও সুযোগ, কোনটাই আমার হাতে ছিল না। ছোট্ট দীঘা শহর বললাম, কারণ নিউ দীঘা তখন পরিকল্পনার মধ্যে থাকলেও, সেই অর্থে তৈরিই হয়নি। পূর্বে হাওড়া বা  কলকাতা থেকে দীঘা যেতে হলে, খড়গপুর থেকে বাস ধরে যেতে হতো। কিন্তু হলদি নদীর ওপর মাতঙ্গিনী সেতু, যা নরঘাট ব্রিজ নামেও পরিচিত, তৈরি হওয়ায় এখন আর খড়গপুর পর্যন্ত না গিয়ে, মেচেদা থেকে বাসে সরাসরি যাওয়া যায়।

অন্যান্য শনিবারের তুলনায় অনেক আগে অফিস থেকে ফিরে, এতটুকু সময় নষ্ট না করে, দু’জনে দীঘার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। মেচেদায় নেমে জানা গেল, নরঘাট ব্রিজের কাছে নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে গোলমাল  হওয়ায়, এদিকের বাস ব্রিজ পর্যন্ত যাচ্ছে। ব্রিজের ওদিকে সম্ভবত বাস চলাচল বন্ধ আছে। স্থানীয় একজন উপদেশ দিলেন, এখান থেকে মাতঙ্গিনী সেতু পর্যন্ত বাসে গিয়ে, নৌকায় ওপারে গিয়ে যাহোক কিছু একটা ম্যানেজ করে স্বচ্ছন্দে দীঘা চলে যেতে পারবেন। এইভাবে আন্দাজে ব্রিজ পর্যন্ত বাসে গিয়ে, যাহোক কিছু একটা ম্যানেজ করে দীঘা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া শুধু মুর্খামি নয়, গোঁয়ার্তুমি ও হঠকারীতার নামান্তরও বটে। সকাল থেকেই গন্ডগোলের জেরে বাস বন্ধ, তাই আর বৃথা সময় নষ্ট না করে, খড়গপুর হয়ে দীঘা যাওয়া স্থির করে ফেললাম। মেচেদার কাছেই হাওড়া জেলার একটি রেলওয়ে স্টেশনে, আমার এক নিকট আত্মীয় থাকেন, অসুবিধা হলে তাঁর বাড়িতে রাতে ফিরে এসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে খড়গপুরের ট্রেন ধরলাম।

খড়গপুর এসে দেখি, দীঘা যাওয়ার জন্য সামান্য কিছু যাত্রী নিয়ে একটি বাস প্রস্তুত। কখন ছাড়বে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেবে, তবে বাসে উঠতে গেলে আগে টিকিট কেটে তবে বাসে উঠতে দেওয়া হবে। এই জাতীয় নিয়মের সাথে আগে পরিচিত না হলেও, পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে দীঘার দু’টো টিকিট কেটে বাসে উঠে আসন গ্রহণ করলাম। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলেও, নানা অজুহাতে বাস আর ছাড়ে না। আগেই টিকিট কাটতে হয়েছে, তাই নেমে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। শেষে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হতে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাস ছাড়লো। আমাদের ঠিক সামনে এক অল্পবয়সি দম্পতি বসেছেন। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর থামতে থামতে বাসটা যেভাবে যাচ্ছে, তাতে বেশ বুঝতে পারছি, যে দীঘা পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যাবে।

যাহোক্, বাস ক্রমশ ফাঁকা হতে হতে শেষপর্যন্ত রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ দীঘা এসে পৌঁছলে, প্রায় সমস্ত যাত্রীই নেমে পড়লেন। একটি পুলিশ জীপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ওই জীপের ড্রাইভার জীপ থেকে নেমে, খুব খাতির করে আমাদের সামনের সিটে বসে আসা সেই অল্পবয়সি দম্পতির মালপত্র নিজে বয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের জীপে বসালেন। জীপ ছেড়ে দিল, সম্ভবত তারা দীঘা থানার বড়বাবু বা অন্য কারও অতিথি।  তখন দীঘার সমুদ্রে, এই ঘাটটির কাছেই সবথেকে বেশি ভিড় হতো। বাঁদিকে সৈকতাবাস, সামনেই দীঘা সমুদ্র সৈকতের প্রধান ঘাট, এখান থেকেই ডানদিকে কিছুটা দূরে গিয়ে বাস স্ট্যান্ড। আমাদের বাসের যাত্রীরা সকলেই সম্ভবত স্থানীয় অধিবাসী। যে যার মালপত্র নিয়ে চলে যেতেই, জায়গাটা একবারে ফাঁকা হয়ে গেল। অনেক রাত, জানুয়ারী মাসের ঠান্ডা, তাই বোধহয় ঘাটেও কোন ট্যুরিস্ট নেই। এখানেই একটি হোটেল, এতদিন পরে ঠিক স্মরণ করতে পারছি না, তবে সম্ভবত সি ভিউ নামে হোটেলটিতে গিয়ে একটি ঘরের কথা বলতে জানা গেল, যে হোটেলটিতে একটি ঘরও ফাঁকা নেই। ভদ্রলোক জানালেন, যে গতকাল থেকে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের তিন দিনব্যাপী কনফারেন্স দীঘায় শুরু হওয়ায়, কোথাও কোন হোটেল ফাঁকা নেই। আপনাদের একটু খোঁজ নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। আমাদের এই খবর জানা ছিল না। যে কোন ভাড়ায় যে কোন একটা ঘর অন্তত আজকের রাতটার জন্য দিয়ে আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার অনুরোধে তিনি জানালেন, যে আজ এবং আগামীকাল কোন ঘর তাঁর পক্ষে দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবে পরশু দিন তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য একটি ভালো ঘর রেখে দেবেন।

রাত বাড়ছে, এখানে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই বুঝে রাস্তায় নামলাম। নির্জন ফাঁকা রাস্তায় শীতের রাতে এক এক করে অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বুঝতে পারছি, আজ এই রাতে কোন একটা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার আশা, লটারির পুরস্কার পাওয়ার থেকেও ক্ষীণ। ইতিমধ্যে একটি রোগা মতো যুবক কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে আমাদের ঘর লাগবে কী না জিজ্ঞাসা করলো। তার চেহারা ও ট্যারা চোখ দেখে, আশার থেকে ভয় হয় বেশি। বুঝতে পারছি, যে যুবকটি ঘরের দালালি করে।

এখন দেখি দীঘায় গেলে সঙ্গে নারী না থাকলে, ঘর পাওয়া খুবই ঝামেলা সাপেক্ষ। তখন কিন্তু সঙ্গে নারী থাকলে, অন্যরকম বিপদের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। তখন ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, বার্থ সার্টিফিকেট, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট, আধার কার্ড, বা এখনকার মতো হাজার একটা পরিচিতিপত্রের প্রয়োজন হতো না। বিপদটা আসতো প্রশাসনের রক্ষাকর্তাদের কাছ থেকে। পুলিশ যে তাদের মাস মাহিনার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে  না পেরে, বিভিন্নভাবে উপরি আয়ের ফন্দিফিকির খুঁজে বেড়ায়, এই ঘটনা তখনও দেখেছি আজও দেখি। হয়তো পুরাতন প্রস্তর যুগেও, এদেশের মানুষ তা দেখেছে। সম্ভবত এই জাতীয় দালাল অনুচরদের কাছ থেকেই স্থানীয় থানা খোঁজখবর জোগাড় করে, একঘরে নারী-পুরুষ আছে এমন ঘরে, বিশেষ করে অনামী কমদামি হোটেলে রাতদুপুরে গিয়ে ঝামেলা করে থানায় তুলে আনতো, এমনকী লক-আপে ঢুকিয়ে দিত। লোকলজ্জার ভয়ে অধিকাংশ নরনারীই প্রশাসনিক ভগবানকে মূল্য ধরে দিয়ে মুক্তি পেত। পরবর্তীকালে একটি বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্রে দেখেছিলাম, যে এক দম্পতিকে গভীর রাতে জোর করে থানায় তুলে এনে তাঁরা যে স্বামী-  স্ত্রী প্রমাণ চাওয়া হয়। এ বড় কঠিন সমস্যা, পরিচয়পত্র ছাড়া, তখন যেটা বাধ্যতামূলক ছিল না, এটা প্রমাণ করা স্বয়ং ভগবানের পক্ষেও সম্ভব নয়। ডি.এন.এ. পরীক্ষা করে হয়তো পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র, ভ্রাতা-ভগ্নি প্রমাণ করা সম্ভব, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কোন্ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, আমার সঠিক জানা নেই। যাহোক, তাঁদের সাথে কোন পরিচিতিপত্র না থাকায়, মুখের কথা ছাড়া প্রমাণ করার কোন দ্বিতীয় উপায় ছিল না। এই নিয়ে তর্কাতর্কির শেষে তাঁদের লক-আপে স্থান হয়। লোকলজ্জার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা  করতে, তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন পুলিশকে উপযুক্ত নজরানা দিয়ে মুক্তি পেতে। ফিরে এসে ওই প্রথম শ্রেণীর সংবাদ পত্রে তিনি গোটা ঘটনাটা চিঠি দিয়ে জানান। তিনি ছিলেন কোন এক নামী ডাক্তার। তাঁর পত্র সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর তাই নিয়ে খুব হইচই হয়, অনেকেই তাঁদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন। শুনেছিলাম ওই অফিসারটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু ওই অফিসারটিই তো রাজ্যের একমাত্র অসৎ ও লোভী ছিলেন না।

সে যাইহোক, শেষে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বিশাল ট্যুরিস্ট লজে গিয়ে হাজির হলাম। পিছন পিছন কিন্তু যুবকটি একটাই কথা বলতে বলতে হেঁটে চলেছে, “আজ আপনারা কোথাও জায়গা পাবেন না। আমার সাথে চলুন, ঘরটা পছন্দ হবেই, এরপর ওই ঘরটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে”। এই ট্যুরিস্ট লজে থাকার খরচ অনেক জেনেও, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেতেই হলো। এখানেই কয়েক বছর আগে একটা শুটিং-এর সময় এসে, মহানায়ককে থাকতে দেখেছিলাম। এখানেও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী অবস্থা। আমি জানালাম যে, যেকোন মূল্যের ঘর নিতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু অনেক অনুরোধ করেও কোন ফল না হওয়ায়, তাঁদের সমস্ত ঘটনার কথা খুলে বলে আমাদের বিপদের কথা বললাম। তাতেও কোন ফল না হওয়ায়, ট্যুরিস্ট্ লজের বারান্দায় আজকের রাতটা নিরাপদে কাটাতে দিতে অনুরোধ করায়, তাঁরা পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে এই অনুমতি তাঁরা দিতে অক্ষম।

এতক্ষণে বুঝলাম যে যথেষ্ট ঝুঁকি সম্পন্ন হলেও, আজ রাতে ওই দালাল যুবকটির নির্দেশিত ঘরটি ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাইরে এসে দেখি যুবকটি আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটি কোথায় ও কতো ভাড়া  জিজ্ঞাসা করায়, সে জানালো সামনেই ঘর এবং আমাদের পছন্দ হবেই। আমরা ঘর দেখে যা সঠিক বলে বিবেচনা করবো, সেই ভাড়া দিলেই হবে। এখন অনেক রাত, হাতে কোন বিকল্প ব্যবস্থাও নেই, তাই তাকে অনুসরণ করে এগতে শুরু করলাম। বলা ভালো, অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম।

রাস্তার পাশেই ‘ভবার হরবোলা মন্দির’ লেখা একটা সিমেন্টের তৈরি বেশ বড়ো সাইনবোর্ড। এর আগেও অনেকবার দীঘায় এসে সেটা লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই, ভবা বা তার হরবোলা মন্দিরটি কোথায়, দেখা বা জানার সুযোগ হয়নি। রাস্তার অপর পারে দু’পাশে আগাছার জঙ্গলে ভরা মোরাম ঢালা একটা সরু রাস্তা নেমে গেছে। যুবকটির পিছন পিছন সামান্য পথ হেঁটে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কত দূরে”?  সে জানালো, সামনেই গভর্নমেন্ট্ কোয়ার্টার্সের কাছে। এপথে আগে কখনও আসিনি, তাই চিনিও না। কাজেই বিশ্বাস না করেও উপায় নেই, তাই তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম। আরও কিছুটা পথ যাওয়ার পর, আমার স্ত্রী অত্যন্ত ভয় পেয়ে আমাকে আর এগতে বারণ করলো। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক, অথচ না এগিয়েও উপায় নেই। তাই দাঁড়িয়ে পড়ে এবার বেশ চড়া গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ঠিক করে বলোতো ঘরটা কোথায়”? সে জানালো, আমরা এসে গেছি সামনেই ঘর।

হ্যাঁ, এবার আমরা সত্যিই এসে গেছি। সরু রাস্তাটার ডানপাশে সামান্য একটু মাঠের মতো ঘাসে ঢাকা খালি জমি। জমির শেষ প্রান্তে, অন্ধকারে ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি চোখে পড়লো। বাড়ির ঠিক সামনে একটা টিউবওয়েল। চারিদিক নিস্তব্ধ। আমরা মোরাম ঢালা রাস্তা থেকে নেমে, তার সাথে ছোট জমিটার ওপর দিয়ে বাড়িটার কাছে এসে, দুটো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আমাদের ঘরের দরজার কাছে হাজির হলাম। যুবকটি পকেট হাতড়ে ঘরের চাবি বার করে, ছোট্ট একটা তালা খুলে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল।

এবার বাড়িটার একটা বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন। দু’টো সিঁড়ি ভেঙে উঠেই, একটা ছোট বারান্দার মতো বাঁধানো জায়গা। সামনেই একটা দরজা, এটা দিয়েই আমাদের ঘরে ঢুকতে হলো। বারান্দার ডানপাশে শেষ   প্রান্তে, ভিতর থেকে বন্ধ আর একটা দরজা। জানা গেল যে ওটা অপর ঘরে ঢুকবার দরজা। এই বাড়িটায় দু’টোই ঘর। আমাদের ঘরে ঢুকে দেখা গেল একটাই বাল্ব, সেটা নাইট ল্যাম্প হিসাবে ভুল হলেও, আসলে ওটাই একমাত্র আলোর ব্যবস্থা। স্যাঁতসেঁতে ঘরটার বাঁদিকে প্রায় দেওয়ালের সাথে ঠেকানো একটা খাট। খাটের বিছানা দেখলে শোয়া তো দূরের কথা, বসতেও প্রবৃত্তি হবে না। খাটের ওপরে দু’টো ততোধিক নোংরা বালিশ, ও একটা ভাঁজকরা মশারি রাখা আছে। খাটের বাঁপাশে ও মাথার কাছে, সরু সরু শিক লাগানো দু’টো ছোট ছোট জানালা। স্বল্প আলোয় যেটুকু দেখা গেল, তাতে বুঝলাম যে বামদিকের জানালার বাইরে কোমর পর্যন্ত উচ্চতার জঙ্গলে ভরা একটা ফাঁকা জমি। মাথার দিকের জানালার বাইরে সম্ভবত একটা ডোবা। দু’টো জানলার কোনটাই কিন্তু বন্ধ করে ছিটকিনি লাগানো যায় না। খাটের মাথার দিকে ডানপাশে আর  একটা দরজা, শুনলাম ওই দরজা দিয়ে বাথরূমে যেতে হয়। খাট ও এই দরজাটির মাঝখানে একটা কাঠের ছোট টেবিল ও একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা অর্ধেক জলপূর্ণ নোংরা প্লাস্টিকের খাবার জলের জগ্, ও অ্যালুমিনিয়মের তৈরি বাঁকাচোরা একটা অ্যাশট্রে। ব্যস্, এই ঘরের জন্য এইটুকুই ব্যবহার্য মূল্যবান সম্পদ। যুবকটির সাথে ডানপাশের দরজা খুলে বাথরূমের সৌন্দর্য সন্দর্শনে গেলাম। ছোট্ট একটু জায়গা। তার ডানপাশে একটা দরজা ও বামপাশে ঘরের সাথে মানানসই একটা ছোট্ট বাথরূম-পায়খানা, ও ভিতরে একটা ছোটো চৌবাচ্চা। না, আবাসিকদের ব্যবহারের সুবিধার্থে একটা প্লাস্টিকের মগও চৌবাচ্চার ওপর রাখা রয়েছে। খুব পরিস্কার সবকিছু দেখা সম্ভব হলো না, কারণ শোয়ার ঘরের তুলনায় বাথরূমে আলোর প্রয়োজন স্বাভাবিক ভাবে অনেক কম হওয়ায়, অনেক হিসাব করে বাথরূমে সত্যিই একটা নাইট ল্যাম্প লাগানো হয়েছে। জানা গেল, ডানপাশের দরজাটি দিয়ে অপর ঘর থেকে বাথরূমে আসতে হয়। এও জানা গেল যে, দু’টো ঘরের ব্যবহারের জন্য এই একটিই বাথরূম।

যাইহোক, দর কষাকষির কোন সুযোগ নেই জেনেও, এবার ভাড়ার কথায় আসা গেল। যথারীতি অনেক বেশি, প্রায় একটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মাঝারি মানের হোটেলের ভাড়া চাওয়া হলো, সাথে একটি অদ্ভুত আবদার— ঘরটি তিনদিনের জন্য ভাড়া নিতে হবে। এই অদ্ভুত আবদারের কারণ জানতে চাইলে জানা গেল,  যে ঘরটি একজন তিনদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি না আসায় আমাদের ঘরটি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাই এই ব্যবস্থা। আমি বললাম, “তাহলে তো ভাড়া নেওয়াই উচিৎ নয়, বা নিলেও অনেক কম নেওয়া উচিৎ। তাছাড়া সেই ভদ্রলোক যদি এক মাসের জন্য ভাড়া নিতেন, তাহলে কি আমাদেরও এক মাসের ভাড়া দিতে হতো”? যুবকটি সংক্ষেপে উত্তর দিলো, “ভেবে দেখুন কি করবেন”। দাবিদাওয়ার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঘর ভাড়া ছাড়া একটা ভালো পরিমান কশন্ মানি চাওয়া হলো, যেটা ঘর ছাড়ার সময় ফেরৎ পাওয়া যাবে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘরের আসবাবপত্রের মূল্যের থেকেও বেশি কশন্ মানি প্রদানের প্রস্তাবও মেনে নিতে হলো। সময় নষ্ট না করে টাকা মিটিয়ে যুবকটিকে বিদায় করে, দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম কোন খিল নেই। একটিই ছিটকিনি, যার আকার একটা ছোট মিটসেফে ব্যবহৃত ছিটকিনির থেকেও ছোট। আর সময় নষ্ট না করে, পরের কাজগুলো খুব দ্রুত সেরে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলো।

খাবার জলের জগটা নিয়ে বাইরের টিউবওয়েলের কাছে এসে দেখি, হাতের কড়ে আঙুল দিয়েও সহজেই হ্যান্ডেলটি ওপর নীচে করা যাচ্ছে। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যে কলের মুখ চেপে ধরে ওপরের ফুটো দিয়ে কিছুটা জল ঢেলে পাম্প করলে, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টিউবওয়েল থেকে জল পড়া শুরু হয়ে যায়। জগের জলটা কলের ভিতর ঢেলে দিয়ে, কলের মুখ চেপে ধরে পাম্প করা শুরু করলাম। কপাল ভালো, অল্প সময়ের মধ্যেই কলের হাতল ক্রমশ শক্ত হয়ে জল পড়তে শুরু করলো। ভালো করে জগটা ধুয়ে অনেকটা জল খেয়ে জগটা ভরে নিলাম, যদিও জানি না এই জল আদৌ খাওয়া উচিৎ কী না। এবার চটপট দ্বিতীয় কাজটা সেরে ফেলতে হবে। সঙ্গে সামান্য কিছু ফল ছাড়া কোন খাবার নেই। শীতকালের এতবড় রাতটা কিছু না খেয়ে থাকা ঠিক হবে না, তাই খাবারের সন্ধানে যেতে হবে। যদিও জানি না এতো রাতে কোন দোকান খোলা পাবো কী না, তবু চেষ্টা তো একবার করে দেখতেই হবে।

স্ত্রীর চোখমুখ দেখে নিজেরই খারাপ লাগছে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই, কারণ পরিবেশ আমার হাতের বাইরে। স্ত্রীকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করতে বলে সাবধান করে দিলাম, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন অবস্থাতেই দরজা না খুলতে। ছিটকিনির আকার দেখে খুব ভয় পেয়ে, সে আমায় বাইরে যেতে বারণ করলো। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই তাই আমাকে বেরতেই হলো।

খুব দ্রুত পা চালিয়ে সমুদ্রের ধারে এসে হাজির হলাম। তখনকার দীঘার চেহারা যাঁদের মনে আছে, তাঁরা জানেন যে তখন এই অঞ্চলটাতেই বেশি দোকানপাট ছিল। সমুদ্রের ধারের ঘাটে একটাও পর্যটক নেই, খাবার দোকানগুলো বন্ধ করার আয়োজন করছে। অথচ এর আগে এর থেকেও অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধুবান্ধবের সাথে এই ঘাটের সিঁড়িতে বসে কাটিয়েছি। আমাকে দেখে দোকানের একজন আমার কি চাই জিজ্ঞাসা করায়, জানতে চাইলাম কি খাবার পাওয়া যাবে। দোকানদার একে একে দোকানে অবিক্রীত যা যা পড়ে আছে, তার বিবরণ শোনাতে শুরু করলো। তাকে থামিয়ে রুটি ও একটা সবজি প্যাক করে দিতে বললাম।

খাবার নিয়ে ফিরে আসছি, সম্ভবত হোম গার্ডের পোষাক পরিহিত একটি যুবক কোথা থেকে এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, “কোথা থেকে আসছেন”? তাকে দেখতে প্রায় একটু আগে দেখা দালাল যুবকটির মতো, এমনকী এরও একটা চোখ ট্যারা। বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম, “আমি কোথা থেকে আসছি সেটা আপনার কি প্রয়োজন”? সে উত্তর দিলো আমি জিজ্ঞাসা করছি, তাই বলুন আপনি কোথা থেকে আসছেন? “আমি কোথা থেকে আসছি আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই” বলে আমি পা চালালাম।

বাসায় ফিরে এসে জগের জলে হাত ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। এবার তৃতীয় ও শেষ কাজ, বিছানা করে মশারি টাঙানো। সঙ্গে দুটো বিছানার চাদর নিয়ে এসেছিলাম। বিছানায় পাতা চাদরটা তুলে ফেলে বাড়ি থেকে আনা একটা চাদর পাতা হলো। নোংরা লেপটা গায়ে দিতে ঘেন্না করলেও বেশ ঠান্ডা, কাজেই গায়ে না দিয়েও উপায় নেই। অবশেষে আর একটা চাদর পেতে তার ওপরে লেপটা পাতা হলো। দুই চাদরের মাঝে আমাদের অনেকটা স্যান্ডউইচের মতো শুতে হবে। লেপের আকার দেখলাম দরজার ছিটকিনির মতোই ছোট। তোষকটা যদি পাঁচ ফুট চওড়া হয়, তাহলে লেপটা হয়তো চার ফুট হবে। মেনে নিতে হবে, মেনেও নিলাম। কিন্তু মশারি টাঙাতে গিয়ে দেখি সেটা সম্ভবত একটা সিঙ্গল্ বেডের মশারি, কোনভাবেই সেটাকে খাটের ছত্রিতে লাগানো সম্ভব নয়। অবশেষে সুটকেস খুলে পায়জামা বার করে, তার দড়ি দিয়ে কোনমতে কাজটা সম্পন্ন হলো। এবার কিন্তু লেপটাকে আর ছোট মনে হচ্ছে না। তোষকের নীচে মশারি গোঁজার কোন সুযোগ নেই, তাই একদিকে তোষকের নীচে গুঁজে অপরদিকে নিজের জামা প্যান্ট ইত্যাদি চাপা দিয়ে কাজটা কোনমতে সম্পন্ন করে শুয়ে পড়লাম। মনে একটাই চিন্তা, ওই ট্যারা হোম গার্ডটা বা পুলিশ রাতে ঝামেলা করবে নাতো? সারাদিনের পথশ্রমে বেশ ক্লান্ত থাকায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে মুখ ধুয়ে বাথরূম সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম নতুন কোন আস্থানার খোঁজে। দিনের আলোয় তন্নতন্ন করে খুঁজেও, একটা থাকার জায়গার সন্ধান পেলাম না। সকলেরই এক বক্তব্য, কালকের আগে কোন ঘর দেওয়া সম্ভব নয়। অবশেষে আবার কাল রাত্রের প্রথম হোটেলটায় গিয়ে অনুরোধ করলাম। ভদ্রলোকটি খুব ভালো। তিনি বললেন, দেওয়ার উপায় থাকলে গতকাল রাতেই আপনাদের ঘর দিয়ে দিতাম। অতদূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, কাজেই ফিরে না গিয়ে আজকের দিনটা কোনমতে কষ্ট করে কাটিয়ে দিন। আগামীকাল অবশ্যই আপনাদের একটা ভালো ঘর দেবো। কি আর করবো, চা জলখাবার খেয়ে সমুদ্রের ধারে ঘুরেফিরে দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে, নরকে ফিরে গেলাম। নোংরা বাথরূমে কোনমতে স্নান সেরে আবার সমুদ্রের ধারে যাবো বলে বেরিয়ে ডানদিকে নজর পড়লো। সেখানে আগাছার জঙ্গলের ধারে স্তুপীকৃত কন্ডোম পড়ে আছে। অনেকের মুখেই শুনি মেদিনীপুরের এইসব অঞ্চল নাকি তিনটি ‘ব’, অর্থাৎ বাদাম বালি ও বালিকার  জন্য বিখ্যাত। হয়তো এই বাড়িটিও তৃতীয় ‘ব’-এর জন্য ব্যবহৃত হয়।

সমুদ্রের পাশে এসে মানসিক দুঃখ কষ্ট অনেকটাই লাঘব হলো। সত্যি, সমুদ্র প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর কাছে এলে সমস্ত দুঃখ কষ্ট ক্লান্তির সাময়িক অবসান হয়। চা জলখাবার খেয়ে দুপুর পর্যন্ত সমুদ্রের ধারে ঘুরেফিরে আমাদের একমাত্র আশার আলো, হোটেলটায় মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য এসে উপস্থিত হলাম। একতলায় বেশ বড় ও পরিস্কার ডাইনিং হল। এখানে আসার আরও একটা কারণ, আর একবার আগামীকালের কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমাদের দেখে ভদ্রলোক নিজে থেকেই জানালেন, যে আগামীকাল ঘর রাখা থাকবে। এখানে খাবারের মানও দেখলাম বেশ ভালো। মনে দুঃখ থাকলেও পেট ও জিভের সুখ মন্দ হলো না। খাওয়া দাওয়া সেরে অনেকক্ষণ বসে, শেষে আবার অগতির গতি, সেই সমুদ্রের কাছেই ফিরে গেলাম।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। রাত একটু বাড়তে, আবার সেই একই হোটেলে নৈশভোজ সেরে মর্তের নরকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যেতে ইচ্ছা করছে না, পা চলছে না, তবু যেতে হলো। বাড়িটাতে পৌঁছে ঘরের দরজা খোলার সময় অপর ঘরটা থেকে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ জানিয়ে দিল, পাশের ঘরে লোক এসেছে। আজ কাজ অনেক কম। নতুন করে বিছানা করা ও মশারি টাঙানোর ঝামেলা কমাতে, সকালে বিছানা যেমন ছিল সেই অবস্থাতেই রেখে গেছি। জল খেয়ে গতকালের প্রক্রিয়ায় জগে জল ভরে নিয়ে এসে, ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। মনে একটাই আনন্দ, রাত পোহালেই এই নরক যন্ত্রণার অবসান।

বাথরূম সেরে আলো নিভিয়ে রাজশয্যায় শরীর এলিয়ে দিলাম। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, পাশের ঘর থেকে মহিলা কন্ঠের তীব্র আর্তনাদে ঘুমটা ভেঙে গেল। দীর্ঘক্ষণ এই আর্তনাদ চললো। সবকিছুর একটা শেষ আছে, আর্তনাদেরও শেষ আছে। একসময় সব চুপচাপ হয়ে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, যথারীতি ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। উঠে পড়ে মুখ ধুয়ে বাথরূম সেরে মশারি খুলে বিছানায় পাতা দুটো চাদর ভাঁজ করে মালপত্র গোছাতে বসবো, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ভেবেছিলাম পাশের ঘরের লোকটি বোধহয় মহিলাটির মৃত্যু সংবাদ জানাতে এসেছে। দরজা খুলে দেখি সেই দালাল যুবকটি এসেছে। সে এই সকালে কেন এসেছে জানি না। সে কি একটা বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিল, তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে ভিতরে ডেকে এনে মশারিটা টাঙিয়ে গুঁজে দিতে বললাম। সে বোধহয় এই জাতীয় প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমতা আমতা করে মিনমিনে গলায় একবার বললো, “কেন কোন অসুবিধা হয়েছে নাকি”? সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে বেশ জোর গলায় হুকুমের সুরে তাকে মশারিটা টাঙিয়ে দিতে বললাম। বিছানার সাথে মশারির বেমানান সম্পর্কের ইতিহাস, তার বোধহয় জানা ছিল না। তা নাহলে সে কিছুতেই অহেতুক সেই চেষ্টা করে নিজের বিপদ ডেকে আনতো না। তিন ফুটের মশারির দড়ি পাঁচ ফুটের খাটের ছত্রির একদিকে লাগিয়ে অপরদিকে লাগাতে গিয়ে অসমর্থ হয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কথা না বাড়িয়ে কশন্ মানি ফেরৎ চাইলাম। সে বললো, “আপনারা তো আগামীকাল যাবেন, কাল সকালে দিয়ে যাবো”। পরশু রাতে আমার বিপদ ছিল, আজ কিন্তু নেই। তাই চিৎকার করে ধমক দিয়ে টাকা ফেরৎ দিতে বললাম। এবার সে সুরসুর করে পকেট থেকে টাকা বার করে আমার হাতে দিয়ে দিলো। আমি তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে, মালপত্র সুটকেসে ভরে বেরিয়ে এসে তার হাতে ঘরের চাবি দিয়ে, নতুন হোটেলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।

এত সকালে মালপত্র নিয়ে আমাদের আসতে দেখে, হোটেলের ভদ্রলোক তো অবাক। তিনি বললেন, “এতো সকালে কখনও ঘর খালি হয়? আগের বোর্ডার চলে গেলে ঘর পরিস্কার করে, তবে নতুন বোর্ডারকে ঘর দেওয়া হয়”। এ তথ্য আমারও অজানা নয়, তাই বললাম “সেতো আমি জানি। ওখানে আর এক মুহুর্ত  থাকার ইচ্ছা নেই, তাই মালপত্র নিয়ে চলে এলাম। মালগুলো একপাশে রেখে দিন, আমরা ঠিক সময় চলে  আসবো”। তিনি রাজি হলেন। মালপত্র একপাশে রেখে আমরা রাস্তায় নামলাম।

একটা দোকানে চা জলখাবারের অর্ডার দিয়ে স্ত্রীকে দোকানে বসিয়ে, একটা বড় স্টেশনারি দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। ওই জাতীয় হোটেলের বিছানা থেকে নোংরা চর্মরোগ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার একটা ভয় মনের মধ্যে প্রথম দিন থেকে ছিলই। তখন সালফার সাবান ও নিকো সাবান নামে দু’রকমের গায়ে মাখার সাবান পাওয়া যেত। শুনতাম ওই সাবান দু’টো চর্মরোগ থেকে রক্ষা করে। সত্যি মিথ্যা জানি না,  তবে একটা নিকো সাবান কিনে চায়ের দোকানে ফিরে এলাম। চা জলখাবার খেয়ে সকালের মিঠে রোদে সমুদ্রের ধারে অনেকটা সময় কাটিয়ে, হোটেলটায় এসে হাজির হলাম।

ভদ্রলোক দোতলার একটা অ্যাটাচ্ড্-বাথ্ ঘর আমাদের দিয়ে জানালেন, এই ঘরটার পাশেই তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। তাই এই ঘরটা বয়স্ক ফ্যামিলি বা নব দম্পতি ছাড়া কাউকে দেন না। ঘর দেখে খুব ভালো লাগলো। একটু আগে শুনেছিলাম ওনারা স্বামী স্ত্রী এখানে থাকেন। দু’জনের একজন বাঙালি ও একজন  নেপালি না ভুটানি। ঘরের পিছন দিকে ব্যালকনি। ভদ্রলোক চলে গেলে, দু’বার করে আগাপাস্তলা নিকো সাবান মেখে স্নান সারলাম। মনে হল নিকো সাবানের সাথে একটা সিরিশ কাগজ কিনে এনে স্নানটা সারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। আমার হয়ে গেলে আমার স্ত্রী, গত দু’দিনের ব্যবহৃত বিছানার চাদর ও জামাকাপড় নিয়ে বাথরূমে ঢুকলেন। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে সমস্ত কিছু কেচে, স্নান সেরে তিনি বাইরে এলেন। ব্যালকনিতে দড়ি টাঙিয়ে সব কিছু শুকতে দিয়ে, আমরা তৈরি হয়ে নীচের ডাইনিং হলে গেলাম। আজকের মধ্যাহ্ন ভোজের আনন্দ ও খাবারের স্বাদই আলাদা বলে মনে হলো।

দু’টো দিন এখানে ছিলাম। অন্য কারও একটা গলার আওয়াজ পর্যন্ত শুনিনি। বুঝলাম এই জন্যই তিনি সবাইকে এই ঘরটা দেন না। দু’টো দিন খুব ভালো কাটলো। এর আগে বহুবার দীঘায় এসে সমুদ্রে নৌকা চাপার চেষ্টা করেও অসফল হয়েছি। এবার একজন নৌকা নিয়ে নিজে থেকেই “নৌকা চাপবেন নাকি বাবু” বলায়, আমরা ও অপর একটা ফ্যামিলি সমুদ্রে নৌকা চেপে অনেকটা দূর পর্যন্ত ঘুরে আসার সুযোগও পেলাম। যাইহোক, এবার ঘরে ফেরার পালা। হোটেল মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরার বাস ধরলাম। এবার কিন্তু নরঘাট ব্রিজের ওপর দিয়ে মেচেদায় এসে ট্রেন ধরলাম।

সুবীর কুমার রায়

০৭—০৬-২০১৯

 

অতি সাবধানতার ফসল{ লেখাটি প্রতিলিপি বাংলা, ও পাহাড়িয়া….এক সাথে পত্রিকায় প্রকাশিত।}

11933477_499335700242184_8226523325230916592_nসালটা ১৯৮০, আমরা সাতজন হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সাথে বাবা, মা, দুই বন্ধু, ও এক নিঃসন্তান প্রতিবেশী দাদা-বৌদি। মাঝপথে চাম্বাতে বয়স্ক চারজনকে হোটেলে রেখে, দুই বন্ধুকে নিয়ে মণিমহেশ ট্রেক করার পরিকল্পনা।

যেকোন ভ্রমণেই ছোট বড় কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতেই হয়, এটাকে চিরকালই ভ্রমণের অঙ্গ হিসাবেই মেনে এসেছি। পরিকল্পনা মতো সমস্ত জায়গা ঘুরে মানালি থেকে চন্ডিগড় যাওয়ার পথে, ঘটলো সেই অযাচিত ভয়ানক বিপদটি।

মানালি থেকে বাসে চন্ডিগড় গিয়ে, চন্ডিগড় শহরে দুটো দিন থেকে শহরটা ঘুরে দেখে, কালকা হয়ে ফিরে আসার কথা। সেইমতো দু’দিন আগেই একটা লাকসারি বাসে দু’টো দু’জনের বসার, ও একটা তিনজন বসার  সিট্ পুরো টাকা দিয়ে রিজার্ভ করে রেখেছি। সে যাইহোক, বেশ সকালেই আমাদের বাস ছাড়ার কথা, সেইমতো অনেক আগেই আমরা মালপত্র নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হাজির হলাম। সুন্দর আবহাওয়ায় ঘন নীল আকাশের নীচে, মানালি শহরটি ভোরের আলোয় এক অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে যেন আমাদের বিদায় জানাবার অপেক্ষায় রয়েছে।

এখনকার মতো সেইসব দিনে পরিবহনের এতো সুযোগ সুবিধা ছিল না। মোটর গাড়ি ভাড়া করে এক জায়গা থেকে অপর জায়গা যাওয়ার সুযোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা, দু’টোরই আমার বেশ অভাব ছিল। নির্দিষ্ট  সময়ের বেশ আগেই ঝাঁচকচকে বিশাল বাসটা এসে দাঁড়ালো। আমার স্বভাব ছিল বাসের ভিতর মালপত্র রাখা সম্ভব না হলে, বাসের ছাদে মালপত্র নিজে তুলে সাজিয়ে রেখে, একটা পলিথিন শীট দিয়ে ভালো করে মুড়ে রাখা, যাতে বৃষ্টি আসলেও পথে মালপত্র না ভেজে। এবারেও তার অন্যথা হলো না। বন্ধুদের সাহায্যে একে একে সমস্ত মালপত্র বাসের ছাদে তুলে সাজিয়ে রাখলাম। একবারে সামনে বাসের একটা প্রকান্ড চাকা, সম্ভবত স্টেপনি রাখা থাকায়, ঠিক তার পাশে মালপত্র রাখতে হলো। চাকাটার তলায় ভাঁজকরা খাকি রঙের ভীষণ মোটা ত্রিপল রাখা থাকায় সুবিধাই হলো। পলিথিন শীট দিয়ে মালপত্র না ঢেকে, ওই ত্রিপল দিয়েই ঢেকে রাখা অনেক নিরাপদ বিবেচনা করে, চাকার তলা থেকে ত্রিপলের একটা কোণ ধরে টেনে নিয়ে মালপত্র ঢেকে রাখার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। কিন্তু চাকাটা যে অত ভারী, ও ত্রিপলটা যে অত বড়, মোটা ও ভারী, এ ধারণা আমার ছিল না। ত্রিপলটার কিছুটা অংশ টেনে বার করে চাপা দেওয়া সম্ভব হলেও, সমস্ত মালপত্র চাপা দেওয়া সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়ে চাকার সাথে টাগ্ অফ্ ওয়ারের মতো যখন ত্রিপল নিয়ে শক্তি পরীক্ষার লড়াই চলছে, এবং এলোপাথাড়ি ভাবে যখন অনেকটা ত্রিপল চাকামুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়েও এসেছে, তখন বাসের পাশে রাস্তায় দাঁড়ানো একটি বছর ত্রিশের ছেলে, বেশ বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, “এ কেয়া হো রাহা হ্যায়, বাদল্ হুয়া হ্যায় বারিস আ রাহা হায় কেয়া”? কিছু বলার নেই, মেঘমুক্ত নির্মল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ, তাই বাধ্য হয়ে ত্রিপল টানা বন্ধ করে, যতটুকু অংশ চাকার বাইরে টেনে আনা সম্ভব হয়েছে, তাই দিয়েই মালপত্রের কিছুটা অংশ ঢেকে, নীচে নেমে আসলাম। ত্রিপলের অনেকটা অংশই চাকার তলা থেকে বেরিয়ে আসলেও এমনভাবে বেরিয়েছে, যে সেটা দিয়ে মালপত্র ঢাকা বাস্তবে সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ছেলেটি চালকের আসনে বসে ইঞ্জিন চালু করে বেশ দীপ্ত কন্ঠে আদেশের সুরে বাসের ভিতর ধূমপান করতে বারণ করে দিল। জানা গেল হরিয়ানার এই ছেলেটি নিজেও ধূমপান করে না, অন্য কেউ বাসের ভিতর ধূমপান করুক, এটা সে বরদাস্ত করে না। আমি দু’জন বসার একটা সিটের জানালার ধারে বসেছি, আমার ডানপাশে আমার সেই প্রতিবেশী দাদার মতো ভদ্রলোক। এই ভদ্রলোকটি আবার চেন্ স্মোকার, একটার পর একটা সিগারেট খান। কিছুক্ষণ উসখুস উসখুস করে নেশার তাড়নায় থাকতে না পেরে, ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরানো মাত্রই, ছেলেটি ঠিক গন্ধ পেয়ে বাস দাঁড় করিয়ে দিলো। দেখা গেল বাসে অনেকেই ধূমপায়ী আছেন। সকলের যৌথ অনুরোধে ছেলেটি শেষপর্যন্ত একটু নরম হয়ে কম সিগারেট খাওয়ার ও জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে বাস ছেড়ে দিলো।

সুন্দর আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে বাস বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন রোদের তেজও বেশ চড়া। জানালার ধারে বসে আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, জানালার ঠিক ওপরে কি যেন একটা উড়ছে। মাথা বাড়িয়ে দেখেও কিছু নজরে পড়লো না। কিছুক্ষণ পরে দেখি সেই ত্রিপলের কিছুটা ভাঁজকরা অংশ, ছাদ থেকে ঝুলে পড়ে হাওয়ায় কাঁপছে। সেরেছে, কি করা উচিৎ ভাবতে ভাবতেই ত্রিপলটার অনেকটা অংশ নীচের দিকে ঝুলে পড়লো। ঘটনাটা যখন আমারই কারণে ঘটছে, এবং স্বয়ং চালকই যখন এই ঘটনার প্রধান সাক্ষী, তখন তার মতো বদমেজাজি একজন মানুষকে ব্যাপারটা নিজমুখে জানিয়ে, শহিদ হওয়ার সাহস আমার কোথায়? বাধ্য হয়ে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ত্রিপলটা ওপর দিকে চাগিয়ে ধরে বসে রইলাম। বাসের প্রায় সব যাত্রীই তন্দ্রাচ্ছন্ন, বা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে মাধ্যাকর্ষণ, প্রবল হাওয়ার গতি, ও ত্রিপলের বিশাল ভার, আমাকে বেশিক্ষণ ওইভাবে ত্রিপল ধরে রাখতে দেবে না। তবু ত্রিপল টেনেছেন যিনি, ধরে থাকবেন তিনি পথ অবলম্বন করে, আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় ওপর দিকে ঠেলে ধরে থাকলাম। আরও কিছুটা সময় পরে বুঝলাম আমি অ্যাটলাস নই, এই ভার আমার একার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। যন্ত্রণাগ্রস্ত হাতটা বাসের ভিতরে সরিয়ে নিলাম।

মুহুর্তের মধ্যে দেখলাম, ত্রিপলটা ‘হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে, যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে’ বলে ঠিক পাখির মতোই সম্পূর্ণ ডানা মেলে নীচের দিগন্তের উদ্দেশ্যে উড়ে চলে যাচ্ছে। বামপাশে ইতস্তত পাথর পড়া সবুজ তৃণভূমি অনেকটা নীচু পর্যন্ত নেমে গেছে। হেঁটে অথবা দৌড়েও সেখানে সহজেই নেমে যাওয়া যায়। ভাবলাম বাঁচা গেল, চন্ডিগড়ে চুপচাপ মালপত্র নিয়ে কেটে পড়লেই হলো। কিন্তু আমি কি আর সেই কপাল নিয়ে জন্মেছি? পিছনের সিট থেকে একজন ‘সামান গির গ্যায়া সামান গির গ্যায়া’ করে চিৎকার শুরু করলো। হা ভগবান, তুমি কেন আর সকলের মতো এই লোকটাকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখলে না!

বাসটা তখন বেশ কিছু মিটার পথ এগিয়ে গেছে। পিছনের চিৎকারে মুহুর্তের মধ্যে বাসটা প্রবল বেগে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। এবার বাসটাকে হেল্পার ও কন্ডাকটারের নির্দেশে, পিছিয়ে নিয়ে আসা শুরু হলো। আমার আয়ু এই ধরাধামে আর মাত্র কয়েক মিনিট জেনেও, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন না করে, চোখ বুঝে ঘুমের ভান করে, মনে মনে ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ গাইবার চেষ্টা করেও নিস্ফল প্রার্থনা বুঝে, মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান গাইতে শুরু করলাম।

ধীরে ধীরে বাসটা একসময় অকুস্থলের কাছাকাছি পিছিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল। অনেকেই এই সুযোগে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গেলেও, মৃত্যুপথ যাত্রী আমি চোখ পিটপিট করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে, ত্রিপল উদ্ধার পর্ব ও চালকের প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। কন্ডাকটার ও হেল্পার দু’জনে মিলে বাস চালকের নির্দেশে, বহু নীচে ত্রিপল উদ্ধারে প্রায় ছুটে নামতে শুরু করলো। বাস চালক চিৎকার করে হম্বিতম্বি করলেও, ঘুমন্ত ও অর্ধমৃত মানুষের সাথে ডুয়েল লড়াইয়ের পথে না গিয়ে, কিছু খিস্তি খেউড়ের পথকেই সঠিক বিবেচনা করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন, ত্রিপল উদ্ধার পর্ব সমাপ্ত করে, ভাঁজ করে বাসের ছাদে তুলে রাখতে গেল। আমি আধবোজা চোখে লক্ষ্য রাখতে লাগলাম যে, চালকের রোষে আমাদের মালপত্র না আবার ত্রিপল উদ্ধারে নীচের জমিতে গিয়ে হাজির হয়। বাসের ত্রিপল বাসে ফিরে আসায় পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো, চালকও নিজের আসনে গিয়ে বসলো। না, চন্ডিগড়ে গিয়ে মালপত্র বাসের ছাদ থেকে নামাবার সময় দেখলাম, মালপত্র ঠিক আগের জায়গায় আগের মতোই আছে। তাদের ওপর কোন অত্যাচার করা হয়নি।

সুবীর কুমার রায়

০২-০৫-২০১৯

মহাদেব বাবু {লেখাটি প্রতিলিপি, উইপোকার কলম, বইপোকার কলম, গল্পগুচ্ছ, ও Sahitya Shruti পত্রিকায় প্রকাশিত।}

SONKUPI BANJARA CAMP (31)

ঠিক সন্ধ্যার মুখে অন্যান্য দিনের অভ্যাস মতোই, স্ত্রীর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিতে গিয়ে মহাদেব বাবু একটু অবাক হলেন। স্ত্রীর এক হাতে চায়ের কাপ, অপর হাতে একটা বেশ বড় কাচের প্লেট। ঘাড় উঁচিয়ে প্লেটটার দিকে তাকিয়েই জিভে জল এসে গেল। কাচের প্লেটে টম্যাটো সস্, রাই, পেঁয়াজ ও শসা কুচি দিয়ে সাজানো তাঁর সবথেকে প্রিয় খাদ্য, একটা বেশ বড়সড় ফিশ ফ্রাই রাখা।

মহাদেব বাবু একজন অত্যন্ত শান্তশিষ্ট নিরীহ গোছের মানুষ। কারও সাথে কোনদিন তাঁর বিবাদ হয়েছে, একথা তাঁর কোন অপছন্দের মানুষও মনে করতে পারবেন না। দোষের মধ্যে তিনি একটু ভালোমন্দ খেতে ভালবাসেন। যদিও রক্তচাপ, সুগার, কোলেস্টেরল, গৃহকর্ত্রীর শাসন, ইত্যাদি নানাবিধ অন্তরায়, তাঁকে সেই আনন্দ থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত করে রেখেছে।

হাসিমুখে স্ত্রীর হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে, আগুন গরম ফিশ ফ্রাইটায় বেশ খানিকটা সস্ মাখিয়ে মুখের কাছে এনে একটা বড়সড় কামড় বসাতে যাবেন, স্রীর ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেল। না, এখন তো সন্ধ্যা নয়, সকালবেলা। এক কাপ চা আর একটা সুগার ফ্রী বিস্কুট হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্ত্রী বললেন, “যত বয়স বাড়ছে তত যেন তোমার ঘুম বাড়ছে। মুখ ধুয়ে চা খেয়ে বাজার নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, আজ কিন্তু রেশন তোলার দিন, রেশন তুলে গমটা একবারে ভাঙিয়ে নিয়ে আসবে, নাহলে রাতে রুটি হবে না। জলখাবারের মুড়ি আর ছোলা ভেজানো কি এখন খাবে, না ঘুরে এসে খাবে”?

মহাদেব বাবু মুখ ধুয়ে চা বিস্কুট খেয়ে বাজারের থলি ও রেশন কার্ড নিয়ে যাওয়ার সময় মিনমিনে গলায় বললেন, আজ আমার খিদে নেই, কিছু খাবো না। রাস্তায় বেরিয়ে মহাদেব বাবুর মনে হলো, খনার বচন নিয়ে আমরা যতই মাতামাতি করি না কেন, সাহেবরা আমাদের থেকে অনেক সুসভ্য ও শিক্ষিত জাত। কাজেই তাদের বচনের কাছে খনার বচন? কিস্যু না, স্রেফ নস্যি নস্যি। আমরা ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় বলে যতই লাফালাফি করি না কেন, সাহেবরা অনেক বুদ্ধিমান জাত। ‘মর্নিং শোজ দি ডে’ তো সেই সাহেবদেরই কথা, সেকথা মিথ্যা হবার নয়।

ধীরে ধীরে বেজার মুখে তিনি বাজারের পথ ধরলেন।

সুবীর কুমার রায়

১৮-০৪-২০১৯

ভুটানে কয়েকটা দিন {লেখাটি Weekend tours from Kolkata, ও Tour Planner পত্রিকায় প্রকাশিত।}

13

গত বছর জুন মাসে পূর্ব ও উত্তর সিকিম সফর সেরে রামধুরার খালিং হোমস্টের রেলিং ঘেরা ঝুলন্ত বারান্দার মনোরম পরিবেশের আড্ডাতেই ঠিক হয়ে গেল— এবার ভুটানটা একবার ঘুরে না দেখলেই নয়। শুধুমাত্র ওইটুকু আলোচনার ওপর ভিত্তি করে, প্রতিবারের ভ্রমণসঙ্গী ভ্রাতৃপ্রতিম তরুণ, আমার সাথে কোনরকম আলোচনা না করেই, গত তেরোই অক্টোবর ২০১৮ তারিখে, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে হাসিমারা যাওয়ার ও হাসিমারা থেকে একই ট্রেনে ফেরার বাতানুকুল কনফার্ম টিকিট কেটে, আমায় সুসংবাদটি জানাবার প্রয়োজন বোধ করলো। যাওয়ার ট্রেন নয়ই জানুয়ারী, শিয়ালদহ থেকে রাত সাড়ে আটটায় ছাড়বে, আর ফেরার ট্রেন বিশে জানুয়ারী হাসিমারা থেকে বিকাল চারটে আটচল্লিশে ছাড়ার কথা। কাজেই ভুটান গিয়ে থাকা, খাওয়া, সর্বোপরি ঘোরা সম্বন্ধে একটু খোঁজ খবর না নিলেই নয়।

ভুটানের চারটি জায়গায় হোটেলে থেকে, আমাদের ঘুরে দেখার কথা— থিম্পু, পুনাখা, হা, ও পারো। অনেকের কাছেই শুনলাম, পুনাখা অত্যন্ত খরচা সাপেক্ষ জায়গা, হা তে থাকার খরচও বেশ ভালো। কিছুদিন আগেই দেখেছিলাম, এবছর পয়লা জানুয়ারী থেকে ভুটান যেতে গেলে, ভোটার আই. ডি. কার্ড বা পাসপোর্ট ছাড়া অন্য যেকোন পরিচিতি পত্র, গ্রহণ যোগ্যতা হারাচ্ছে। যদিও গরিব মানষী, নিজের দেশটাকেই ভালভাবে দেখার সুযোগ হলো না, বিদেশ যাওয়ার বিলাসিতা আমায় মানায় না, তবু বাংলা দেশটাকে একবার দেখে আসার বড় সাধ। ওই দেশের বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবি তাদের দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে, কবজি ডুবিয়ে ইলিশ খাওয়াবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কাজেই ভোটার আই.ডি. কার্ড থাকলেও, বৃথা সময় নষ্ট না করে, গত বছরর শেষে সাড়ে ছেষট্টি বছর বয়সে, পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলাম। খরচার কথা ভেবে এখন আর লাভ নেই, তাই ল্যাপটপ নিয়ে হোটেল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংবাদের খোঁজখবর নিতে গিয়ে, এক নতুন ও অদ্ভুত তথ্য জানতে পারলাম। ভুটানে থাকার হোটেল বুকিং করে না গেলে, ভুটানে ঢোকার পারমিট দেওয়া হয় না। আমার এক ফেসবুক বন্ধু রাতুল, পূজোর আগে ভুটান সফরে গিয়েছিল, সেও ব্যাপারটার সত্যতা স্বীকার করে থিম্পু, পুনাখা, ও পারো শহরের তিনটি হোটেলের রসিদের ছবি পাঠালো।

যাব যখন তখন থাকতে তো হবেই, আবার থাকতে যখন হবে, তখন নির্দিষ্ট শহরে হোটেলও অবশ্যই বুক করতে হবে। অবশ্য আইন যেমন আছে, আইনের ফাঁকও তো তেমনি থাকবেই। জানা গেল, বিভিন্ন হোটেলে মাত্র এক টাকা দিয়ে বুকিং করারও সুব্যবস্থা আছে। অবশ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বুকিং বাতিল না করলে, আইনগত ঝামেলার ব্যবস্থাও নাকি আছে। অসুবিধা একটাই, এত আগে এখান থেকে হোটেল বুক করে জানুয়ারী মাসের ঠান্ডায় যদি ঘর পছন্দ না হয়, বা গায়ে দেওয়ার লেপ কম্বল যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে অসুবিধা বা কষ্ট শুধু নয়, সাংসারিক অশান্তির সম্ভবনার কথাই বা অস্বীকার করি কিভাবে?

আধুনিক বিজ্ঞান ও পর্যটন শিল্পের উন্নতির গুণে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলির, অর্থাৎ থিম্পু, পুনাখা, ও পারোর বিভিন্ন হোটেলের বাড়ির ছবি, ঘরের ছবি, বিছানা বা বাথরূম, এমনকী কমোডের ছবি দেখে, কয়েকটা হোটেল পছন্দ করে, মেল ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলো। অনেকটা বিয়ের আগে বিভিন্ন পাত্রীর ছবি দেখে প্রাথমিক পছন্দের পর, বিশদ বিবরণ ও দেনা পাওনার খোঁজ নেওয়ার কায়দা আর কি! তাদের কেউ উত্তর দিলো, কেউ বা দিলো না। তবে প্রতিটা হোটেলের রেট চার্টেই কিন্ত একটা বিষয় মিল আছে। অফ্ সীজন্ হওয়ার দৌলতে, প্রায় প্রতিদিনই রেট কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শেষে থিম্পুর নরলিং হোটেল, ও পারোর সীজন্স্ হোটেলকে অনুরোধ করা হলো যে, ভুটান প্রবেশের পারমিট করার প্রয়োজনে তারা যেন আমাদের বুকিং-এর কনফার্মেশন পাঠিয়ে দেয়, যদিও তাদের কোন টাকা পাঠানো হলো না। তারা রাজিও হলো। কিন্তু পুনাখার দামচেন রিসর্ট থেকে এক মহিলা জানালেন যে তিনি বাইরে আছেন, ছয় তারিখে ফিরে এসে যোগাযোগ করবেন। থ্রী স্টার রিসর্টটির অফ্ সীজন রেট, অবস্থান, ও বিভিন্ন ছবি দেখে অন্য কোথাও খোঁজ না করে, অপেক্ষা করাই শ্রেয় বলে মনে করা হলো। সিকিম ভ্রমণের সময় যেমন সারাটা পথের জন্যই গাড়ি আমাদের সাথে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম, এবার খরচের ভার কিছুটা কমাতে, তরুণের পরামর্শ মতো আর সে বিলাসিতা করা হলো না। তাছাড়া সদ্য বিদেশ ফেরৎ ছোট ভাইয়ের মতো রাতুল জানালো যে, পূজোর মুখে পরিবার নিয়ে সফর করার আশঙ্কা ও সম্ভাব্য অসুবিধার কথা ভেবে, সে গোটা ট্যুরটাতেই তাদের সাথে গাড়ি রেখেছিল। যদিও ওপথে প্রাইভেট গাড়ি, ট্যাক্সি, ও সুন্দর আরামপ্রদ ছোট ছোট বাসের অভাব সে মোটেই লক্ষ্য করেনি। সুতরাং একজায়গা থেকে অপর জায়গায় পৌঁছে, গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তেই শিলমোহর মারা হলো। এবার শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা।

কয়েকদিনের মধ্যেই থিম্পু ও পারোর হোটেল, আমাদের জন্য একটি দু’জনের শয়নকক্ষ, ও একটি তিনজনের শয়নকক্ষের বুকিং পাকা করে, রসিদ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে গোছগাছ শুরু হলো, পুনাখার দামচেন রিসর্টও কথামতো তাদের দু’টি ঘরের বুকিং কনফার্মেশন যথাসময় পাঠিয়ে দিলো। এবার শুধু নয় তারিখ রাত সাড়ে আটটায় শিয়ালদহ স্টেশন যাওয়ার অপেক্ষা।

আজ ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসের নয় তারিখ, পরপর দু’দিনের ভারত বন্ধের দ্বিতীয় দিন। সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করে, বন্ধ্ করা ও বন্ধ্ করতে না দেওয়ার যুদ্ধের রীতি এদেশে চিরদিনের। গতকালও কিছু ঝামেলা ও রেল অবরোধের ঘটনা ঘটেছে, তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছনোর জন্য অনেক আগেই তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরোলাম। একই ট্রেনে হাওড়া হয়ে, সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে, আমাদের সাথে তরুণরা তিনজনও যাবে। একই কিউবিক্যালের ছটি বার্থের মধ্যে, একটি আপার বার্থ ছাড়া বাকি পাঁচটাই আমাদের দখলে। একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকের কাছেই শুনেছিলাম, যে ভুটানে নাকি ভারতীয় দু’হাজার টাকার নোট গ্রহণ করা হয় না, পাঁচশ’ টাকার নোট যদিও চলে, তবু ওই নোট যতটা পারা যায় কম নিয়ে যাওয়াই ভালো। সুতরাং অগত্যার গতি অধিকাংশ একশ’ টাকার নোট নিয়ে সঙ্গে অনেক টাকা। এত বড়ো ট্যুরের জন্য শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবেই, আর শরীরটাকে চাঙ্গা রাখার জন্য রাতে ট্রেনে বসে খাবার জন্য আলুর পরোটা, কষা আলুর দম, কড়া পাকের সন্দেশ, ও শনপাপড়ি সঙ্গে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে কি?

বন্ধ্ সাধারণ মানুষের শুধু অপকার করে না, বিপদে ফেলে না, উপকারও করে। রাস্তাঘাট অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকায় ও জ্যামজট্ কম থাকায়, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আমরা শিয়ালদহ স্টেশনে এসে হাজির হলাম। একসময় গাড়িও এলো, এবং বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বগি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে গুছিয়ে বসা গেল। প্রায় নির্দিষ্ট সময়েই গাড়ি ছাড়লে গল্পগুজব করে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে একসময় যে যার বার্থে গা এলিয়ে দিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের দশ তারিখ। বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। হাসিমারা স্টেশনে সকাল এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে ঢোকার কথা হলেও, ঐতিহ্য বজায় রেখে কিছু সময় বিলম্বে ট্রেন ছুটে চলেছে। একসময় আমরা হাসিমুখে হাসিমারা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলাম। স্টেশন প্ল্যাটফর্মে মেয়েদের বসিয়ে রেখে তরুণকে নিয়ে গাড়ির খোঁজে স্টেশনের বাইরে গিয়ে দেখি ছোট গাড়ি অনেক থাকলেও, আমাদের অতো মালপত্র সমেত পাঁচজনকে নিয়ে জয়গাঁও যাওয়ার মতো গাড়ি প্রায় নেই। তাছাড়া ভাড়ার ব্যাপারেও সব শিয়ালের এক রা। শেষে বাধ্য হয়ে সময় নষ্ট না করে অনেক বেশি ভাড়া চাওয়া হচ্ছে বুঝেও, একটা বড় গাড়ি আটশ’ টাকায় ঠিক করতে বাধ্য হলাম।

একসময় আমরা হাসিমারা থেকে সম্ভবত আঠারো কিলোমিটার দূরত্বের জয়গাঁও এসে, ভুটান গেটের প্রায় কাছাকাছি গাড়ি ছেড়ে দিলাম। সামনেই বড় রাস্তার ওপরে ‘হোটেল সত্যম্ লজ্ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ এর তিনতলায় দু’হাজার চার শত টাকা ভাড়ায় দু’টো ঘর নিয়ে, মেয়েদের ফ্রেশ হয়ে নিতে বলে কাগজপত্র নিয়ে ভুটান গেট পার হয়ে চললাম পারমিটের ব্যবস্থা করতে। তরুণ অবশ্য গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি সবাইকে নিয়ে পারমিট অফিসে যাওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু অত মালপত্র নিয়ে ওখানে যাওয়ার অসুবিধার কথা ভেবে, মহিলাদের হোটেলে রেখে ঝাড়া হাতপায় আমাদের দু’জনের সেখানে যাওয়াই স্থির করা হলো। কাজ সেরে আমাদের হোটেলে ফিরে আসতে আসতেই মহিলারা স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিতে পারবে। প্রথমে ভেবেছিলাম পারমিট করিয়ে সেদিনই থিম্পু চলে গেলে কেমন হয়, একটা গোটা দিন অতিরিক্ত হাতে এসে যায়। পরে সে চিন্তা ত্যাগ করে, পরের দিন সকাল সকাল থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করাটাই সমীচীন হবে বলে স্থির করা হলো।

ভুটান গেট পেরিয়েই ভুটানের ফুন্টশলিং-এ, ১৯৮০ সালে একবার ঘুরতে এসেছিলাম। খোঁজ করে পেট্রল পাম্পের পাশে ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছে দেখলাম বেশ কিছু লোকের ভিড়। সকলের হাতেই একটি করে ফর্ম। এখন সম্ভবত টিফিন বা লাঞ্চ ব্রেক চলছে। সিকিম ঘোরার সময়ও পারমিট করাতে হয়েছিল, তবে সে কাজটা আমাদের গাড়িচালক, মিংমাই সুসম্পন্ন করেছিল, আমি শুধু একটি ফর্ম সাক্ষর করে তাকে কৃতার্থ করেছিলাম মাত্র। এখানে একটি টেবিলে ভুটানের জাতীয় পোষাক পরে একজনকে বসে থাকতে দেখে তাঁর কাছে ওই নির্দিষ্ট ফর্মটি চাওয়ায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে আমরা সংখ্যায় কতজন আছি। আমরা পাঁচজন আছি শুনে, তিনি আমাদের পাঁচটি ফর্ম দিলেন। প্রতিটি ফর্মের নীচে আবেদনকারীর সাক্ষর করার জায়গা, অর্থাৎ মহিলাদের সাক্ষর করিয়ে আনার জন্য একজনকে আবার বিদেশ থেকে স্বদেশ যাওয়ার প্রয়োজন। আমার কাছে দুটো ফর্ম রেখে, তরুণ বাকি তিনটি ফর্ম নিয়ে হোটেলে ছুটলো মহিলাদের দিয়ে সাক্ষর করাতে। উপস্থিত প্রায় সকলেই ফর্ম পুরণ করতে ব্যস্ত। দু’জন মহিলা ও দু’-তিনজন পুরুষ সকলকে ফর্ম পুরণে সাহায্য করছে, তবে তারই ফাঁকে ফাঁকে ভুটান ঘুরতে গাড়ি লাগবে কী না, জিজ্ঞাসা করতে ভুলছে না। আমি আমার ও তরুণের ফর্মটা পুরণ করতে শুরু করে দিলাম। হ্যাঁ, কোথায় থাকবো তার ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়েছে বটে। ভোটার কার্ড অথবা পাসপোর্টের নম্বর ও ডেট অফ ইসুও চাওয়া হয়েছে। আমি যখন ফর্ম পুরণ করছি, তখন ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক যুবক এগিয়ে এসে আমায় সাহায্য করতে শুরু করলো। এরমধ্যে তরুণ বাকি তিনটে ফর্ম সাক্ষর করিয়ে নিয়ে এসে হাজির হলো। আমি খুব দ্রুত ফর্মগুলো পুরণ করতে শুরু করে দিলাম। আমার ও তরুণের ফর্মটায় আমি ভোটার কার্ডের নম্বর ও ডেট অফ্ ইসু উল্লেখ করেছিলাম। যুবকটি আমায় জিজ্ঞাসা করলো, যে আমাদের পাসপোর্ট আছে কী না। আমাদের সকলেরই পাসপোর্ট আছে শুনে সে আমায় পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করতে বলে জানালো, তাহলে স্ট্যাম্প মেরে ছেড়ে দেবে। ভোটার কার্ড প্রমাণপত্র হিসাবে দিলে, অনেক বেশি সময় লেগে যাবে। আমরা আগামীকাল থিম্পু যাবো শুনে সে জানালো, যে আজই থিম্পু চলে যাওয়া ভালো। যেতে পারলে হয়তো ভালোই হতো, কিন্তু বাস্তবে সেটা আর সম্ভব নয়, কারণ আমরা অনেকগুলো টাকা দিয়ে হোটেল বুক করে এসেছি। যাইহোক্, যুবকটিই একটি স্টেপলার দিয়ে ফর্মের সাথে জেরক্স কপি, ও আঠা দিয়ে ছবি সেঁটে দিয়ে ঝামেলামুক্ত করলো। এবার কাউন্টারে ফর্ম জমা দিতে গিয়ে, নতুন ঝামেলায় জড়ালাম। জানা গেল প্রত্যেকের হাতের আঙুলের ছবি, চোখের ছবি নেওয়া হবে, তাই প্রত্যেকের উপস্থিতি প্রয়োজন। তরুণ ভুটান সীমান্ত পেরিয়ে আবার ভারতবর্ষে ছুটলো বাকি তিনজনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। আমাদের দেশের বিকাল সাড়ে তিনটে, অর্থাৎ ভুটানের বিকাল চারটে পর্যন্ত পারমিট সংক্রান্ত কাজকর্ম করা হয়। ক্রমে গোটা অফিস ফাঁকা হয়ে গেল। কাউন্টারের দু’-তিনজন কর্মচারী ও সেই সাহায্যকারী যুবক ছাড়া, আর কাউকে চোখে পড়ছে না। কাউন্টারে আমার অসুবিধার কথা জানিয়ে, আমার জন্য একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ করলাম। তাঁরা আমায় যা করার শীঘ্র করতে পরামর্শ দিলেন। ক্রমে ভুটানের ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটে পার হয়ে গেল। যুবকটি কিন্তু এখনও আমার সঙ্গ ছাড়েনি। সে জানালো এখানে গাড়ির ভাড়া একটু বেশি, তবে তার একটি ছয়জন বসার নতুন গাড়ি আছে। আমরা ইচ্ছা করলে তার সাথে ভুটান ঘুরে দেখতে পারি। আর কিছুক্ষণ পরেই সে জানালো যে চারটের পরে আর পারমিট দেওয়া হয় না, কাজেই আগামীকাল পারমিট করাতে হবে। মহা বিপদে পড়লাম, আগামীকাল পারমিট করে, তারপর গাড়ি ঠিক করে হোটেল ছেড়ে মালপত্র নিয়ে থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া মানে অনেকটা সময় নষ্ট। যুবকটি যে কে তাই এখনও জানা হয়নি, তবে তার ওই আলখাল্লা গোছের জাতীয় পোষাক, ও সাহায্যের হাত বাড়ানো দেখে মনে হয়েছে, যে সে এই অফিসেরই কোন কর্মচারী। ডুববার সময় শুনেছি খড়কুটো ধরেও মানুষ বাঁচবার চেষ্টা করে থাকে। আমিও তাই হাতজোড় করে আমার দামি হিন্দীতে তাকে বললাম, “ভাইসাব, কুছতো মদত করো। আজ পারমিট মিলনা বহুত জরুরী হায়। আজ পারমিট নাহি মিলেগা তো হামলোগ কাল যা নাহি পায়েগা। হাম বহুত তখলিফ মে পড়েগা। প্লীজ হামকো কুছ মদত করো”। ও শুধু “বললো বহুত দের হো চুকা হায়, উনলোগোকো আভি আনা চাহিয়ে”। এরমধ্যে হাঁটুর সমস্যাজনিত দু’জন মহিলা, ও কন্যাকে নিয়ে তরুণ এসে উপস্থিত হলো।

একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে জনমানব শুন্য অফিসের নির্দিষ্ট কাউন্টারে সকলকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম। ভেবেছিলাম হয়তো বা খেঁকিয়ে উঠে ফিরে যেতে বলবে, যেমনটা আমরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকি আর কি! না, তা তাঁরা করলেন না, পরিবর্তে চটপট দোতলায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। যুবকটি সঙ্গে করে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেল। আমাদের এখানকার পাসপোর্ট অফিসের মতোই, পরপর চার-পাঁচজন মহিলা কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন। আমাদের পাসপোর্টগুলো নিয়ে প্রতিটা কম্পিউটারের সামনে এক একজনকে বসতে বলে ছবি তুলে বেশ দ্রুত তাঁরা কাজ শেষ করলেও, হাতের আঙুল নিয়ে কিছু সময় নষ্ট হলো। মাত্র কয়েকদিন আগে পাসপোর্ট করিয়ে থাকলেও, যতবার নির্দিষ্ট জায়গায় আঙুল রাখতে বলেন, ততবার মিস্ ম্যাচড্ দেখাচ্ছে। শেষে ভোলানাথ না বুদ্ধ, কার কৃপায় জানি না, আঙুলগুলো যে এই অধমেরই প্রমাণ করতে সক্ষম হলাম। সাত দিনের জন্য পারমিট দেওয়া হয়েছে, এবং সেটাই নাকি নিয়ম। এর থেকে বেশিদিন থাকতে হলে পারমিট এক্সটেন্ড করাতে হয়। যেহেতু আজ দশ তারিখ, তাই দশ থেকে ষোল তারিখ পর্যন্ত থিম্পু ও পারোতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পুনাখা যাওয়ার জন্য ফুন্টশলিং থেকে পারমিট দেওয়া হয় না, ওটা থিম্পু থেকে করিয়ে নিতে হবে। মহিলাদের হোটেলে ফিরে যেতে বলে, যুবকটির পরামর্শে ওখান থেকেই এক একটা একশ’ দশ টাকা দিয়ে ভুটানের দুটো সিম নিয়ে, আমরা নীচে বাইরে যাবার গেটের কাছে এলাম। যুবকটি এবার আবার নতুন করে গাড়ির প্রসঙ্গে কথা শুরু করলো। আমরা বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই অফিস বন্ধ করে সবাই বাইরে গেটের কাছে চলে এসে যুবকটিকে গেটের বাইরে গিয়ে কথা বলতে বললেন। যুবকটি এখানকার কোন কর্মচারী, না দালাল, অথবা গাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করে, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা যদিও এবার প্রতিটি জায়গাতেই আলাদা করে ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করার কথা ও হোটেল থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে স্থানীয় দ্রষ্টব্য স্থান পরিদর্শনের কথা ভেবে এসেছিলাম, কিন্তু তাতে অর্থের কিছু সাশ্রয় হলেও, সময়ের অপচয় না করে ঝামেলা মুক্তি ও নিশ্চিন্ত ভ্রমণের সার্থে, আমি ফুন্টশলিং থেকে সব জায়গা ঘুরে ফুন্টশলিং ফিরে আসাই যুক্তিযুক্ত মনে করলাম। তরুণকে আমার মত জানাতে ও সাথেসাথেই সম্মতি জানালো। আজ পর্যন্ত ওর সাথে কোনদিন মতের অমিল হয়নি, আর সেইজন্যই সে বা তার পরিবার আমার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণসঙ্গী।

যুবকটি জানালো যে তার একটি ছয়জন বসার নতুন টয়োটা এরটিগা গাড়ি আছে। অন্য গাড়িও আছে, কিন্তু তাতে অকারণে অনেক বেশি খরচ পড়ে যাবে। সে জানালো, এই গাড়িটার জন্য প্রতিদিন চার হাজার টাকা করে গাড়ি ভাড়া লাগবে। আমরা রাজি না হয়ে ফিরে আসবো আসবো করছি, এমন সময় সে নিজে থেকেই তিন হাজার পাঁচশ’ টাকা করে প্রতিদিন দেওয়ার প্রস্তাব দিলো। আমরা তাতেও রাজি না হওয়ায়, সে সাত রাত্রি আট দিনের জন্য প্রতিদিন তেত্রিশশ’ টাকা করে ছাব্বিশ হাজার চার শত টাকা শেষ দাম হিসাবে জানালো। আমরা ছাব্বিশ হাজার টাকায় রফা করে, গাড়িটা দেখতে চাইলাম। কার পার্কিং এলাকায় ধবধবে সাদা রঙের একটা ঝাঁচকচকে গাড়ির দরজা খুলে সে আমাদের দেখিয়ে, সন্দেহ হলে গাড়ির একটা ছবি নিয়ে নিতে বললো। গাড়িটা দেখে খুব পছন্দ হলেও গাড়িটা যে কার, তার না ভুটানের কোন ভি.আই.পি.’র বোঝার উপায় নেই। একটা ছবি নিয়ে হোটেলে ফেরার মুখে সে কিছু অগ্রিম চাইলো। একটু ঝুঁকিতো নিতেই হবে, তাকে হাজারটা টাকা অগ্রিম দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

স্নান সেরে সবাই মিলে হোটেল থেকে রাস্তায় নামলাম। আমাদের হোটেলটার সব ভালো, তবে দোতলায় এর রেস্টুরেন্টে শুধুমাত্র নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। অনেক বেলাও হয়ে গেছে, তাই এতো বেলায় আর ভাত রুটির চক্করে না গিয়ে, একটু এগিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ভেজ চাউ, অনিয়ন পকোড়া, ও চা খেয়ে জয়গাঁওয়ের রাস্তায় সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে, হোটেলে ফিরে এসে আড্ডা জমালাম। যতক্ষণ পর্যন্ত না কাল সকালে গাড়ি এসে হাজির হচ্ছে, ততক্ষণ একটা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে, তবে এইটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হয়। আগেও অন্যত্র এই জাতীয় ঝুঁকি নিয়েছি। যুবকটি আমাদের আজ সত্যিই অনেক উপকার করেছে। গাড়িটা সত্যিই যদি তার নিজের হয়, তাহলে মাত্র এক হাজার টাকার জন্য সে এত বড় ব্যবসার সুযোগ কিছুতেই নষ্ট করবে না। সঙ্গে গাড়ি থাকার খবরে সবাই খুব খুশি ও নিশ্চিন্ত, নিশ্চিন্ত আমি নিজেও।

সন্ধ্যার পর আমি আর তরুণ বেরোলাম কম পয়সায় পুষ্টিকর খাদ্যের দোকান সন্ধানে। জানা গেল, থানার পাশে খাবার হোটেল আছে। বড় রাস্তার পাশে একবারে সরু একটা গলির মধ্যে ‘হোটেল ডুয়ার্স’ নামে বোর্ডটা দেখে ইচ্ছা বা ভক্তি, কোনটাই না হলেও ভিতরে গেলাম। খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে এসে, আমাদের রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ সকলে খেতে গেলাম। রুটি, তড়কা, পনিরের তরকারি খাওয়া হলো। তড়কাটা সেরকম উল্লেখযোগ্য না হলেও, পনিরের তরকারি সকলকে মুগ্ধ করলো। কাউন্টারের ভদ্রলোকটিও খুব ভদ্র। তিনি আমাদের আগামীকাল থিম্পু যাওয়ার কথা শুনে থিম্পুর সিনেমা হলের বিপরীতে হোটেল এ.ভি. তে খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। দুই ভাই মিলে হোটেলটি চালান, এবং সেখানে নাকি ন্যায্য মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়। যাইহোক আমরা বিদায় নিয়ে সামান্য দূরেই, আমাদের সত্যম হোটেলে ফিরে এলাম। রাতেই হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে আগামীকালের কাজ কিছুটা কমিয়ে রাখা হলো। সকলেই আজ বেশ ক্লান্ত, তাই মালপত্র গোছগাছ করে কিছুক্ষণ পরেই যে যার বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের এগারো তারিখ। ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। তরুণ একটা ইলেকট্রিক কেতলি নিয়ে এসেছে। টি ব্যাগ, গুঁড়ো দুধ, কফি, ও চিনিও সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে। তরুণের স্ত্রীর তৈরি চা খেয়ে, বাথরূম সেরে স্নান করে সবাই প্রস্তুত হয়ে নীচে জলখাবার খেতে গেলাম। তরুণ জানালো সোনম চম্ফেল নামক যুবকটি ফোন করেছিল। সে সবাইকে তৈরি হয়ে ফুন্টশলিং কার পার্কিং-এ চলে আসতে বলেছে। দূরত্ব বেশি না হলেও, অতো মালপত্র নিয়ে সেখানে যাওয়া বেশ অসুবিধাজনক তো বটেই। তাকে ফোন করে আমাদের হোটেলের নীচে গাড়ি নিয়ে আসতে বললে, সে জানালো গাড়ি নিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকলে তাকে অনেক টাকা জরিমানা দিতে হবে, আমরা যেন একটু কষ্ট করে তার গাড়ির কাছে চলে আসি। শেষপর্যন্ত সময় নষ্ট না করে ও প্রথম থেকেই অশান্তি করে সম্পর্ক খারাপ না করে, মালপত্র নিয়ে তার গাড়ির কাছে গিয়ে দেখলাম, যে সে পলিথিন শীট ও দড়ি নিয়ে প্রস্তুত। আমাদের কাছ থেকে মালপত্র নিয়ে সে খুব দ্রুত নিজের পছন্দ মতো গাড়ির ছাদে পলিথিন শীট দিয়ে মুড়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রায় সমস্ত মালপত্র রেখে দিলো। গাড়ির পিছনে দুটো বসার সিটের একটায় একটা বড় ব্যাগ ও হঠাৎ প্রয়োজন হতে পারে বা খাবার দাবারের ব্যাগও সে নিজেই গুছিয়ে রাখলো। আমরা বুদ্ধ বুদ্ধ বলে থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

সোনম নিজের থেকে তার গাড়ির যত্ন অনেক বেশি করে দেখছি। ওর আর একটা বড় গুণ, ফাঁকা ও মাখনের মতো মসৃণ রাস্তা হওয়া সত্ত্বেও ও খুব ধীরে গাড়ি চালায়। পাহাড়ি পথে এটাই কাম্য। বিপদের সম্ভাবনা অনেক কমে যাওয়া ছাড়াও, পথের ও আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাওয়া যায়। সোনমের সব ভালো, লেখাপড়াও আছে, শুধু ওর কথা বুঝতে না পারলেই, ও আঃ বলে বিরক্তি প্রকাশ করে। একসময় সে জানালো, যে এই ভুটানে চাষবাস বা শিল্পের অভাব দেখে মনে হতেই পারে যে ভুটানের লোকেরা কিভাবে রোজগার করে। এখানে গ্রাউন্ড আপেল নামে একটা ফল পাওয়া যায়, যা নাকি আঁখের থেকেও মিষ্টি, এবং সব রোগ থেকে মুক্তি দেয়। উদাহরণ স্বরূপ সে যা শোনালো, শুনে তো আবার প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হবো কী না ভাবছি। যার ওজন বেশি তার যেমন ওজন কমিয়ে দেয়, যার ওজন কম, তার ক্ষেত্রে ফল ঠিক উলটো। শুধু ওজন নয়, সুগার, কোলোস্টোরাল, প্রেসার, ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই অবস্থা বুঝে দু’রকম কাজ করে। এই গ্রাউন্ড আপেল রপ্তানি করেই নাকি এই অঞ্চলের মানুষ কোটি কোটি টাকা রোজগার করে। এহেন গ্রাউন্ড আপেল খাওয়া বা চোখে দেখা দূরে থাক, আমরা তার নামও শুনিনি শুনে সে ‘আঃ’ বলে মোবাইল থেকে ফলটার ছবি দেখালো। দেখে তো মনে হলো শাঁকালু বা রাঙা আলু জাতীয় কিছু হবে। আমাদের কথা শুনে সে জানালো, যে ওটা সবজি নয়, ফল হিসাবে খাওয়া হয়। এখানে নাকি একটাই জায়গায় সেই বিখ্যাত গ্রাউন্ড আপেল পাওয়া যায়। তরুণের একটু ভুঁড়ি আছে সত্য, সে বারবার তরুণকে এই ফল খেয়ে জগিং করার পরামর্শ দিলো। ক্রমে ‘সরচেন’ ও ‘কামজি’র ওপর  দিয়ে একসময় আমরা ‘গেদু’ এসে পৌঁছলাম। সোনম আগেই জানিয়েছিল, যে গেদুতে আমাদের নাস্তা করাবার জন্য কিছুক্ষণ গাড়ি দাঁড় করাবে। একটা বেশ বড় ঝকঝকে দোকানে এসে সে গাড়ি দাঁড় করালো। দোকানটায় পাওয়া যায় না, এমন জিনিস নেই। ভাত, রুটি, চাউ, ওয়াই ওয়াই, মোমো, থুপ্পা, অমলেট, টোস্ট, চা বা কফি তো আছেই, তার সাথে বিস্কুট লজেন্স, কেক্, আইসক্রীম, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, কাঁচা আনাজ, চাল, ডাল সব পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ, বস্তা ভর্তি গ্রাউন্ড আপেলতো আছেই। জানি না এরই টানে সে আমাদের এই দোকানে নিয়ে এসে হাজির করলো কী না। আমরা চাউ আর অত্যন্ত জঘন্য একটা চা খেলাম। মহিলারা টুকটাক খাদ্যদ্রব্য কিনলেও, তরুণ সোনমকে খুশি করার জন্য, না স্লিম্ হওয়ার বাসনায় জানি না, তবে মাত্র একশ’ টাকা দিয়ে এক কিলোগ্রাম গ্রাউন্ড আপেল কিনে ফেললো। আগে সব জায়গাতে দেখেছি ড্রাইভাররা সহজে কিছু খেতে চায় না, তবে সোনম আবার একটা লজেন্সও আমাদের থেকে নেয় না।

যাইহোক, আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো। সোনম বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলো, যে আমাদের হোটেলে পেমেন্ট করা আছে কী না। সবক’টা জায়গাতেই নাকি ওর বন্ধুর খুব ভালো হোটেল আছে। আমরা জানালাম যে তিন জায়গাতেই আমাদের হোটেল ঠিক করা ও পেমেন্ট করা আছে। ও জানালো থিম্পুতে আমাদের বুক করা নরলিং হোটেল, ও পুনাখার দামচেন রিসর্টটা খুব ভালো হলেও, পারোর সীজনস্ হোটেলটা তেমন সুবিধার নয়। বেশ কিছুটা পথ এসে সে আমাদের কাছ থেকে পাসপোর্টগুলো নিয়ে ছবি তুলে কাকে যেন পাঠালো। আরও কিছুক্ষণ পরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে, আমাদের জানালো যে পুনাখার পারমিট হয়ে গেছে। অসাধারণ সুন্দর ও মসৃণ রাস্তা দিয়ে ওয়াংখা, চুখা, দামচু হয়ে গাড়ি এগিয়ে চললো। এই চুখাতে বিখ্যাত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি আছে। চুখা ড্যাম দামচু থেকে ছাব্বিশ কিলোমিটার আগে অবস্থিত। ক্রমে বুনাগু, চুজম্, খাসদাপচু, নামসেলিং হয়ে সন্ধ্যর মুখে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে আমরা থিম্পুর ক্লক্ টাওয়ারের কাছেই নরলিং হোটেলের সামনে এসে পৌঁছলাম।

এখানে আমাদের আজ ও আগামীকাল, এই দুটোদিন থাকার কথা। রিসেপশনে গিয়ে কথা বলতে ও তাঁদের পাঠানো মেল দেখাতেই তাঁরা তিনতলায় মুখোমুখি দুটো ঘর খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। হোটেলের কিছু মহিলা কর্মচারী আমাদের অধিকাংশ মালপত্র ঘরের সামনে এনে রেখে দিলেন। বেশ সুন্দর ঘর, পরিস্কার বাথরূম, সুন্দর বিছানা। সাদা চাদরে ঢাকা একটি পরিস্কার লেপ ও একটি কম্বল রাতে যথেষ্ট হবে কী না ভাবছি, দেখলাম একজন মহিলা কর্মচারী এসে একটা রূমহিটার লাগিয়ে দিয়ে গেলেন। এবার নিশ্চিন্ত। অফ্ সীজন্ হওয়ার কারণেই হয়তো হোটেলটা প্রায় ফাঁকা। তা নাহলে এরকম একটা দ্বিশয্যার ঘর পনেরোশ’ টাকায়, ও তিনশয্যার বড় ঘরটি আঠারোশ’ টাকায় আশা করাই অন্যায়। মহিলাদের হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হওয়ার সুযোগ দিয়ে, আমি ও তরুণ একটা চক্কর দিয়ে জায়গাটা ঘুরে দেখা ও সেই এ.ভি. হোটেল খুঁজে বার করার জন্য রাস্তায় নামলাম। যাওয়ার আগে শুনলাম তরুণদের কলে জল নেই, ভরা বালতির জলও শেষ। সন্ধ্যা সাতটায় জল আসবে। বাইরে এসে কোথাও একটু নোংরা বা জঞ্জাল চোখে পড়লো না, ঝাঁচকচকে রাস্তাঘাট। বাড়িঘর দোকানপাট সুন্দর আলোক মালায় সজ্জিত। ফুটপাথে প্রচুর লোকের যাতায়াত। প্রচুর গাড়ি, তবে অপরিস্কার, পুরাতন, বা ভাঙাচোরা গাড়ি কিন্তু একটাও চোখে পড়লো না। ট্রাফিক পুলিশ কিছু নজরে পড়লেও, আমাদের এখানকার তুলনায় তা অতি নগন্য। যেটা চোখে পড়ার মতো মনে হলো, তা হলো ওদের নিয়মানুবর্তিতা। জেব্রা ক্রসিং ছাড়া কেউ রাস্তা পারাপার করে না। কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই, রাস্তা পার হবার জন্য আমরা জেব্রা ক্রসিং-এ পা রাখতেই, গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে গেল। এটাই নিয়ম, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে মানুষের রাস্তা পারাপারকে অগ্রাধিকার দিয়ে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ বড় বড় রাস্তা দিয়ে এক ঝলকে রাতের রাজধানী শহরকে হেঁটে হেটে ঘুরেফিরে দেখে, এ.ভি. হোটেলের সন্ধানে এগলাম। সিনেমা হলের কথা ভুলেই গেছিলাম বা চোখেও পড়লো না বটে, তবে আমাদের হোটেলের প্রায় কাছেই অবস্থিত, এ.ভি. হোটেলকে খুঁজে পেতে বিশষ অসুবিধা হলো না। নিজেদের হোটেলে ফিরে এসে দেখলাম জল এসে গেছে, গরম বা ঠান্ডা জলের অভাব নেই। হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেতে গেলাম। হোটেলটা সত্যিই ভালো, গরম গরম রুটি, চিলি চিকেন, ও পেঁয়াজ সহযোগে জমিয়ে খেয়ে, হোটেলে ফিরে এলাম। এ.ভি. হোটেলেও দেখলাম বড় বড় ড্রামে জল ধরা আছে। এখানে নাকি জলের বেশ অভাব, সকাল ও সন্ধ্যায় জল আসে। আগামীকাল সকালে আমাদের থিম্পুর দ্রষ্টব্য স্থানগুলো সোনমের সাথে ঘুরে দেখার কথা। সকলেই ক্লান্ত, আজ কোন মালপত্র গোছগাছের ঝামেলাও নেই, তাই কিছুক্ষণ গুলতানি করে, সীমার বানানো কফি খেয়ে, একসময় যে যার বিছানা নিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের বারো তারিখ। ভোরবেলা সেই অগতির গতি সীমার বানানো চা খেয়ে, তৈরি হয়ে নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোনম ফোন করে জানালো, যে সে হোটেলের নীচে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। নীচে গিয়ে দেখি রাস্তার দু’পাশে বরফ জমে আছে। সোনম গাড়ির ছাদ ও কাচ থেকে বরফ ঝাড়ছে। আজ সাথে শুকনো কিছু খাবার ও জলের বোতলের ব্যাগ, এবং ক্যামেরার ব্যাগ ছাড়া সঙ্গে কোন মালপত্র নেই। সোনম কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টের কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের জলখাবার খেয়ে নিতে বলে, গতকাল ফোনে ব্যবস্থা করে রাখা পুনাখা যাওয়ার পারমিটটা, সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার, এরজন্য আমাদের কিন্তু কোন লিখিত আবেদন করতে, এমনকী কোথাও সাক্ষর পর্যন্ত করতে হলো না।

কিছুক্ষণ পরে সোনম ফিরে এলো, আমরা রাস্তা বা দু’পাশের কিছু বাড়ির ছবি তুলে, মচমচে বাটার টোস্ট, ডিমের অমলেট, ও কফি খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এখানকার প্রায় সব বাড়ির রঙের মধ্যেই ভুটানের ঐতিহ্য ও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যাহোক্ অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বিখ্যাত ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোরতেনের গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। এখানে প্রবেশ করতে গেলে মাথাপিছু তিন শত টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। আমাদের বোধহয় এখনও ঠিক বিদেশি হিসাবে ধরা হয় না, কারন নোটিশ বোর্ডে দেখলাম বিদেশিদের এন্ট্রি ফি ডলারে ধার্য করা আছে। ভুটানবাসীর বোধহয় ভিতরে প্রবেশ করতে কোন পয়সা লাগে না, কারণ তাদের টিকিট ছাড়া বিনাবাধায় প্রবেশ করতে দেখলাম।

বিশাল অঞ্চল নিয়ে তৈরি এই মেমোরিয়াল চোরতেনটি যেমন সুন্দর, তেমনি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। গেট দিয়ে ঢুকে দু’পাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা সুন্দর মাঠের মাঝখান দিয়ে পাথর বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে মূল মন্যাস্টারি পর্যন্ত। গেট দিয়ে বাঁদিকে গেলে একটি ঘেরা সুন্দর রঙিন জায়গায় পরপর বেশ কয়েকটা সোনালি বা লাল রঙের বড় বড় প্রেয়ার হুইল। এর ঠিক বাইরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো রাস্তার মতো জায়গাটিতে পরপর অনেক নরনারী বসে প্রার্থনা করছেন। ঘেরা জায়গাটির ভিতরেও অনেকে বসে প্রার্থনা করছেন। অনেকে ক্লক ওয়াইজ প্রেয়ার হুইলগুলি প্রদক্ষিণ করার সময় ঘুরিয়ে দিয়ে ভক্তি নিবেদন করছেন। চোরতেনের বাঁদিকে পরপর বেশ কয়েকটা পায়াহীন কাঠের চৌকির মতো পাতা, তার ওপরে পরপর বেশ কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা, অনেকটা নামাজ পড়ার বা দণ্ডিকাটার ভঙ্গিমায় প্রার্থনা করছেন। চোরতেনের প্রবেশ দ্বারটিতে বিভিন্ন রঙের সুক্ষ কাজ দেখলে, মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। একটা পূজা বা ভক্তি নিবেদনের জায়গাকে আয়ের বা জুলুমবাজির আখরা না করে যে কিভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখতে হয়, ওদের কাছে গিয়ে শিখে আসতে হয়।

এখানে বেশ কিছুটা সময় ছবি তুলে কাটিয়ে, আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সোনম জানালো, এবার আমরা বুদ্ধ পয়েন্টে যাবো। কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে আমরা বুদ্ধ পয়েন্টের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। সোজা অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে যেতে হবে। সোনম জানালো, যে সে ওপরে যাওয়ার পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে গিয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে নীচে এখানে এসে অপেক্ষা করবে। দেখা হয়ে গেলে আমরা যেন এই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গাড়ির কাছে চলে আসি। অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামার কষ্ট থাকলেও, অত সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা সকলেই খুশি। কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি বলেই হয়তো, এতখানি জায়গা জুরে এত বড় একটা প্রকল্পের, এখনও কোন টিকিটের ব্যবস্থা নেই। পাথর বাঁধানো বিশাল অঞ্চল নিয়ে এই বুদ্ধ পয়েন্ট দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হবে। অনেক উঁচুত সম্ভবত পদ্মফুলের ওপর, জায়গার বিশালত্বের মানানসই বিশাল অথচ নিখুঁত সুন্দর নিরাবরণ নিরাভরণ বুদ্ধদেব, ডান হাঁটুর ওপর ডান হাত ও ডান পায়ের পাতার ওপর বামহাত রেখে একটি কলস ধরে বসে আছেন। স্নিগ্ধ চোখদুটির দিকে তাকালে মন শান্ত হয়, বেঁচে থাকার আনন্দ ফিরে পাওয়া যায়। চারিদিকে সোনালি রঙের মুর্তিগুলি অসাধারণ সুন্দর। এছাড়া অন্যান্য ছবি ও মুর্তিগুলির নিখুঁত কাজ ও রঙের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। এই এত বেলাতেও একপাশে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বরফ জমে আছে। চারিদিক ঘুরে দেখে ছবি তুলে অনেটা সময় ব্যয় করলাম, এবার ফেরার পালা। ধীরে ধীরে প্রচুর সিঁড়ি ভেঙে একসময় নীচে নেমে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম।

একসময় আমরা চানগাংখা মন্যাস্টারির সামনে এসে পৌঁছলাম। শুনলাম এটিই নাকি থিম্পু শহরের প্রাচীনতম মন্যাস্টারি। কিছুটা ওপরে উঠে এই মন্যাস্টারির একপাশে পরপর অনেকগুলো ছোট ছোট প্রেয়ার হুইল, যেগুলো প্রায় সকলেই সবক’টা ঘুরিয়ে তবে এগচ্ছেন। বামপাশে কিছু গাছপালাযুক্ত অঞ্চলে দেখলাম কিছু মুর্তি আছে, যেখানে অনেকেই সম্ভবত মানত করে লক্ষ্মীর ঝাঁপির মতো দেখতে একরকম ছোট ছোট মাটির তৈরি জিনিস রেখে যাচ্ছেন। মূল মন্যাস্টারিটি আর একটু ওপরে সিঁড়ি ভেঙে উঠে তবে দেখতে হয়, তবে মুর্তি যে ঘরে আছে, তার সামনের কোলাপসিবল্ গেটটি দেখলাম বন্ধ করা। এই মন্যাস্টারিটি প্রাচীন সন্দেহ নেই, তবে প্রাচীনতম কী না, বলা মুশকিল। তবে একটা ব্যাপার চোখে পড়লো, যে ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোরতেনে যেমন অধিকাংশ মানুষই দেখতে আসেন, এখানে কিন্তু তেল, মোমবাতি, বা অন্যন্য জিনিস নিয়ে পূজো দিতে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশি। আরও বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে, নীচে নেমে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

এবার আমাদের গন্তব্য স্থল, করোনেশন পার্ক। বড় রাস্তাটার ঠিক পাশে অবস্থিত পার্কে ঢুকেই সোনালি রঙের একটি বেশ বড় বুদ্ধ মুর্তি লক্ষ্য করলাম। ডান হাতটা সোজা নীচের দিকে ঝুলিয়ে বাম হাতটি অভয় দেওয়ার ভঙ্গিমায় রেখে, ও বাম কাঁধে একটা পরিপাটি করে ভাঁজ করা চাদর জাতীয় কিছু ঝুলিয়ে, পদ্ম ফুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। মোটামুটি পার্কটি আকারেও বেশ বড়, এবং ভিতরে বাচ্চাদের আনন্দ পাওয়ার মতো উপকরণও আছে, কিন্তু যেটা নেই সেটা হলো উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ। বুদ্ধ মুর্তিটির পায়ের কাছে পদ্ম ফুলের পাপড়ি প্রায় খুলে পড়েছে, পার্কটিও যথেষ্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নয়। অবাক হতাম না যদি এই মুর্তিটি আমাদের দেশে, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের কোথাও দেখতাম। কিন্তু দেশটি ভুটান, ও স্থানটি সেই দেশের রাজধানী, যেখানে রাস্তাঘাটে পানের পিক্ বা গুটকা মিশ্রিত থুথু তো দূরের কথা, একটা কাগজের টুকরোও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যাইহোক্ কিছুক্ষণ সময় ঘুরেফিরে এখানে কাটিয়ে, বড় রাস্তার অপর পারে আর্চারি স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলাম। এই আর্চারি বা তীরন্দাজী ভুটানের জাতীয় খেলা, কাজেই এই খেলার গুরুত্ব এদেশে যথেষ্ট। রাস্তায় কথা প্রসঙ্গে সোনম একবার জানিয়েছিল, যে তীরন্দাজরা নাকি দেড়শ’ মিটার দূরের বুলস্ আই-তে লক্ষভেদ করেন। ছোটবেলায় ব্যাখারির ধনুক বানিয়ে পাটকাঠির তীর কিছু ছুঁড়লেও, তীরন্দাজদের তীর ছোঁড়া দেখার সুযোগ কখনও হয়নি। তবে ওই ধনুক ও তীর নাকি অত্যন্ত মূল্যবান শুনেছি। আমাদের কপাল সত্যিই খুব অনুকুল বলতে হবে, স্টেডিয়ামে ঢুকেই দেখলাম তীর ছোঁড়ার অনুশীলন চলছে। না, দেড়শ’ মিটার নয়, তবে দেড়শ’ ফুটের কিছু বেশি হবে। বুঝলাম সোনম ফুট ও মিটারের গোলমাল করে ফেলেছে। বিশাল মাঠে আমাদের কাছাকাছি বুলস্ আইয়ের কাছ থেকে কিছু তীরন্দাজ মাঠের অপর প্রান্তের বুলস্ আই লক্ষ্য করে লক্ষ্যভেদ করার চেষ্টা করছেন। অপর প্রান্তের বুলস্ আইয়ের পাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে থাকলেও, তীর সেই বুলস্ আই তে গিয়ে লাগছে কী না, পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে অনেক দূর পর্যন্ত তীরটাকে উড়ে যেতে বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে আসতে যাব, এমন সময় শুরু হলো ওপ্রান্তের তীরন্দাজদের তীর ছোঁড়া। তিনটি মাত্র তীরকে বুলস্ আইয়ের ঠিক নীচে এসে মাটিতে গিঁথে যেতে দেখলেও, বাকি সবক’টা তীরই বুলস্ আই-এ লক্ষ্যভেদ করলো। আমার কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার বলে যেটা মনে হলো, বুলস্ আইয়ের দু’পাশে যেসব তীরন্দাজ ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে তীর ছোঁড়ার সময়, যে তীর বুলস্ আই বা ঠিক তার নীচে মাটিতে এসে গেঁথে যাচ্ছে, দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন না। অর্থাৎ তাঁরা নিশ্চিত যে তীর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, বা ঠিক তার নীচে বা পাশে এসেই পড়বে। আরও কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটিয়ে, আমরা থিম্পু টেক্সটাইল মিউজিয়ামে গিয়ে উপস্থিত হলাম। পকেটে একটা পাতলা ফিনফিনে মানিব্যাগ নিয়ে আমার এই অনেকটা জায়গা জুড়ে অবস্থিত, ঝাঁচকচকে বিশাল বাড়িটার ভিতর ঢুকতে কিরকম ভয় ভয় করলো। যাহোক ভিতরে ঢুকে দেখলাম, ডানদিকে বেশ কিছু সম্পদ কয়েকটা শোকেসে সাজিয়ে রেখে, এক সুবেশা যুবতী বসে আছেন। কাগজে লেখা দাম দেখে জিভের তলায় সরবিট্রেট রাখবো কী না ভাবতে ভাবতে অপর দিকে গেলাম। যার কেউ নেই, তার ভগবান বুদ্ধ আছেন। আমার মতো হতদরিদ্র মানুষদের লোভ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে সংযমী হওয়ার শিক্ষা দিতে, মূল মিউজিয়ামের বন্ধ দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশের জন্য বেশ মূল্যবান টিকিট বিক্রয়ের জন্য আর একজন মহিলা কর্মীকে সেখানে বসিয়ে রেখেছেন। আমরা একটু ঘুরেফিরে চারপাশটা দেখে, থিম্পু রয়্যাল টাকিন প্রিসার্ভ, বা এককথায় থিম্পুর চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

এখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ভুটানের জাতীয় পশু, ‘টাকিন’ দেখা। হাঁসজারু, বকচ্ছপ, বা হাতিমি জাতীয় অদ্ভুত দর্শন বিলুপ্তপ্রায় এই পশুটি দেখার সুযোগ হয়তো আর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে না। মাথাপিছু এক শত টাকা করে টিকিট কেটে, গাছপালা ঘেরা বিস্তীর্ণ অঞ্চলটির ভিতরে প্রবেশ করা গেল। অনেকটা করে অঞ্চল লোহার শক্ত জাল দিয়ে ঘিরে কোথাও টাকিন, কোথাও হরিণ, কোথাও বা পাখি রাখা হয়েছে। এখানে শুনলাম দুটো মোনাল রাখা আছে। আমার আগ্রহ অন্য কোন পশু বা পাখিকে নিয়ে নয়, আমার আগ্রহ টাকিন ও মোনালের সাথে এই নিরিবিলি নির্জন এলাকায় পরিচিত হওয়ার। অনেকগুলো টাকিন বেশ কাছে এসে দর্শন দিয়ে পোজ দিয়ে তাদের ছবি তোলার সুযোগ দিলেও, মোনাল আমাদের হতাশ করলো। আমাদের সামনের জাল থেকে বেশ কিছুটা দূরে, একটা সবুজ রঙের ঝোলানো কাপড়ের নীচে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা সত্বেও, তিনি সেই জায়গা ছেড়ে আমাদের সাথে আলাপ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। বার দু’-তিন মুখটা বাড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করায়, তাঁকে কোনমতে দেখার সুযোগ পাওয়া গেলেও, ছবি তোলার সুযোগ পাওয়া গেল না। স্ত্রী মোনাল, অর্থাৎ মোনালীটি একবার খুব কাছাকাছি এসে তাঁদের কুশল জানালেও, তাঁর প্রতি আমাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। আর সময় নষ্ট না করে আমরা থিম্পু ভিউ পয়েন্ট থেকে থিম্পু শহর, জোং, ও রাজার বাসস্থান দেখার জন্য গাড়িতে এসে বসলাম।

থিম্পু ভিউ পয়েন্ট থেকে থিম্পু শহরের ভিউ বেশ সুন্দর হলেও, বেশ ঘিঞ্জি বলে মনে হয়। বহু নীচে থিম্পচু বা ওয়াঙচু নদী বয়ে গেলেও, নদীটিকে সেরকম আকর্ষণীয় বলে মনে হলো না। ওপর থেকেই থিম্পু জোং, রাজ বাড়ি, ইত্যাদি সোনম আমাদের দেখালো। রাস্তার কোন কাজ হচ্ছে বলে, ওখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়ায় কিছু অসুবিধা আছে বলে শুনলাম। সোনম আমাদের গাইডের কাজ করছে, কাজেই ওর কথা বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। শুনলাম আজকাল নাকি রাজবাড়ির কাছে যাওয়ায় কিছু বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অথচ রাজার প্রতি ওদের আস্থা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ও সম্মান দেখলে অবাক হতে হয়। এই জাতীয় শ্রদ্ধা ও সম্মান সিকিমে দেখেছিলাম তাদের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি। সোনম জানালো, রাজাকে অনেক সময় সাইকেল চেপে বা ঘোড়ার পিঠেও রাস্তায় যেতে দেখা যায়। যাইহোক আর সময় ব্যয় না করে, আমরা গাড়ি নিয়ে সোজা ক্লক্ টাওয়ারের কাছে এসে নেমে পড়ে, নীচে ক্লক্ টাওয়ারের কাছে চলে এলাম।

ক্লক্ টাওয়ারের কাছে দেখলাম রীতিমতো মেলা বসেছে। একদিকে স্টেজ করে নাচ ও গানবাজনার অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনেকেই বসে বা দাঁড়িয়ে সেই অনুষ্ঠান দেখছেন। বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব হলেও যেটা খারাপ লাগলো, একদিকে পরপর অনেকগুলো দোকানের মতো তৈরি করে, তাতে প্রকাশ্যে নানারকম জুয়া খেলা হচ্ছে। মেলার ভিড়টা এই এলাকায় সবথেকে বেশি। কাল রাত থেকে আজ এখন পর্যন্ত ঘুরে এখানকার সকল মানুষদের বেশ টেনশনহীন আনন্দে দিন কাটে বলে মনে হলো। সবসময় তাদের সকলকেই বেশ ফেস্টিভ মুডে থাকতে দেখলাম। তাদের সকলের রুজি রোজগার কি বা কত জানি না, তবে তাদের মধ্যে কোন অভাব বা দুঃখ আছে বলে তো আপাতদৃষ্টিতে ধরা পড়লো না। সারাদিন পেটে বিশেষ কিছু পড়েনি, একটা দোকানে অখাদ্য চাউ খেয়ে বাইরে অন্য দোকান থেকে বেশ ভালো কফি খেয়ে, হোটেলে ফেরার উদ্দেশ্যে ওপরের বড় রাস্তায় উঠে এলাম। সোনম চলে গেছে, চা বা কোন খাবার তো দূরের কথা, আমাদের সাথে সোনমকে একটা চকোলেট পর্যন্ত খেতে এখন পর্যন্ত রাজি হতে দেখিনি।

সারাদিনের পথশ্রমে মহিলাদের বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়তে লক্ষ্য করেছিলাম। বড় রাস্তায় উঠে তাদের সেই ক্লান্তি আর চোখে পড়লো না। কারণ সেই একটাই, এখানে পরপর সব বড় বড় দোকান। প্রায় প্রতিটা দোকানে ঢুকে জিনিসপত্রের দাম করে করে, শেষে খালি হাতেই হোটেলে ফিরলাম। জানা গেল এখানে সবকিছুর দাম আকাশ ছোঁয়া। চরম সত্যটা যে এত সহজে উপলব্ধি করেছে, তার জন্য বুদ্ধদেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে, একসময় হোটেলে ফিরে এলাম। হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে রাত প্রায় নটা পর্যন্ত যে যার বিছানায় শবাসন করে, কালকের সেই হোটেল এ.ভি. তে রাতের খাবার খেতে গেলাম। এখানকার খাবারটা সত্যিই বেশ ভালো। খাওয়া শেষে হোটেলে ফিরে এসে, হোটেলের বিল মেটাতে গেলাম। যাওয়ার আগে মেল বা হোয়াটসঅ্যাপে দু’জনের থাকার এক একটা ঘর পনেরোশ’ টাকা করে, ও একটা অতিরিক্ত কটের জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত তিনশ’ টাকা দেওয়ার কথা হবার পর, আমরা দু’দিনের ওই অতিরিক্ত ছয় শত টাকা না নেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। কাউন্টারের মেয়েটি নিজে থেকেই দেখলাম ছয় শত টাকা বাদ দিয়ে ছয় হাজার টাকা নিয়ে রসিদ দিলো। ঘরে ফিরে এসে কিছুক্ষণ গুলতানি করে, সবাই বিছানা নিলো। কাল সকালে আমরা থিম্পু ছেড়ে পুনাখায় চলে যাবো।

আজ জানুয়ারী মাসের তেরো তারিখ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সীমার তৈরি চা খেয়ে, একে একে সকলেই তৈরি হয়ে নিলাম। সোনম ফোন করে জানালো, যে সে নীচে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। নীচে নেমে দেখি সোনম তার গাড়ির ছাদ ও সামনের কাচ থেকে বরফ ঝেড়ে পরিস্কার করছে। রাস্তার পাশে পাশেও বেশ কিছু বরফ জমে আছে। সোনম তার গাড়িতে সমস্ত মালপত্র সাজিয়ে রাখার পর, আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি এগিয়ে চললো। কিছুক্ষণ পর ও আমাদের জলখাবার খাওয়ার জন্য গতকালের সেই রেস্টুরেন্টের কাছে নামিয়ে দিলো। মন মেজাজ বেশ দখিনা বাতাসের মতো ফুরফুরে, সোনমের মতো একজনকে সাথে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার অবশ্য চিরকালই গাড়ির ড্রাইভার ভাগ্য বেশ ভালো, সে লেহ্-লাদাখেই হোক, গুজরাটেই হোক, সিকিম, বেতলা, পুরুলিয়া, টাকি, বা অন্যত্রই হোক। আমার মনে হয়, বেড়াতে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভার না ভেবে নিজেদের ভ্রমণ সঙ্গী ভাবলে, খুব একটা সমস্যা হয় না।

যাহোক, জলখাবার খেয়ে তৈরি হতে হতেই, সোনম এসে আমাদের গাড়িতে উঠে পড়তে বললো। আমরা আর সময় নষ্ট না করে, গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সুন্দর রাস্তা দিয়ে ধীরে সুস্থে এগিয়ে যেতে যেতে একসময় সিমটোখা, যোসেপাঙ, হয়ে হং-সো তে এসে পৌঁছলাম। এখানে আমাদের পুনাখা যাবার পারমিট পরীক্ষা করা হলো। একসময় আমরা প্রায় দশ হাজার দুই শত ফুটের ওপর অবস্থিত দোচুলা পাস-এ এসে পৌঁছলাম। এবারের ট্যুরে এই প্রথম আমরা বরফের রাজ্যে এসে পৌঁছলাম। সোনম গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের ঘুরে দেখে আসতে বললো। এখন পর্যন্ত সোনমের একটা বড় গুণ লক্ষ্য করেছি, ও হোটেল থেকে তাড়াতাড়ি বেরতে বললেও, কখনও কোন দ্রষ্টব্য জায়গা দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসতে বলে না, এবং প্রতিটা দ্রষ্টব্য স্থান সম্বন্ধে ওর শোনা, জানা, ও জ্ঞান থেকে একটা মোটামুটি ইতিহাস বর্ণনা করে। সেটা সত্য, অর্ধসত্য, বা ভুলও হতে পারে, কিন্তু তবু তারপরে দেখার একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ বা আনন্দ যে তৈরি হয়, সেকথা অস্বীকার করি কিভাবে?

বামপাশে একটা উঁচু ঘেরা জায়গায় একটা বড় চোরতেন, তার সামনে ছোট ছোট অনেকগুলো চোরতেন। পিছনে বহুদূরে তুষারাবৃত পর্বতমালা, জায়গাটার সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করেছে। আমরা চারিপাশে অনেকক্ষণ ঘুরেফিরে, পাথর বাঁধানো রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে ওপরে ওঠা শুরু করলাম। এই অঞ্চলটা পুরো বরফে ঢাকা। অনেকেই রাস্তা ছেড়ে আনন্দ ও উত্তেজনায় বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে, সেলফি তুলতে, ও বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি করতে গিয়ে, বরফের ওপর আছাড় খাচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে আসা মহিলারা সম্ভবত আছাড় খাওয়ার ভয়েই, বরফ ছেড়ে পাথরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে কিছুটা ওপরে উঠে একটা জায়গায় বসে থাকলো। আমি ও তরুণ বরফের ওপর দিয়ে বেশ কিছুটা ওপরে ঘুরেফিরে দেখে, ফিরে এসে তাদের হাত ধরে বরফের ওপর দিয়ে অনেকটা ওপরে তুলে নিয়ে এলাম। এখানেও পাথর বাঁধানো হাঁটার রাস্তা আছে। ওরা এখানে বরফহীন পাথরের ওপর বসে গল্প করে, ছবি তুলে, সময় কাটাতে লাগলো, আমি আর তরুণ বরফ ভেঙে ওপরে বরফের রাজ্যে গিয়ে হাজির হলাম। এখানে ভিড় অনেক কম, একমাত্র অল্প বয়সি কিছু ছেলে মেয়ে এখানে এসে হইহুল্লোড় করছে, ছবি তুলছে। এখানে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় একই আকৃতির অনেকগুলো গুহার মতো ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে। ঘরগুলোর পিছনের দেওয়ালে রঙিন তৈলচিত্র, তৈলচিত্রের ঠিক নীচে পাথর বাঁধানো উঁচু বেদি, ও দু’পাশে বেঞ্চ মতো তৈরি করা। স্বাভাবিক ভাবেই এই ছোট ছোট মন্দিরসম ঘরগুলি বরফের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বরফের ওপর গাছপালার ফাঁক দিয়ে আরও অনেকক্ষণ ঘুরেফিরে, আমি ও তরুণ নীচে সঙ্গিনীদের কাছে ফিরে এলাম। আরও কিছুক্ষণ বসে সময় কাটিয়ে, একসময় ধীরে ধীরে নীচে নেমে গাড়ির কাছে চলে এলাম।

গাড়ি ছেড়ে দিল। সোনম জানিয়েছিল, যে থিম্পু থেকে পুনাখার দূরত্ব প্রায় বাহাত্তর কিলোমিটার। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পরে, ধীরে ধীরে বরফ আর চোখে পড়লো না। প্রায় বারোশ’ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পুনাখা শহর অনেকটাই গরম জায়গা। পূর্বে এই পুনাখা শহরই ভুটানের রাজধানী ছিল। যাইহোক আমাদের গাড়ি একসময় লাম্পেরি, টোকটোকা, তেনিয়াগাং, চেষাগাং, ওয়াংডু, মেটসিনা হয়ে লোবেসায় এসে, বামদিকে মোড় নিলো। সোনম বললো এখান থেকে চা নাস্তা করে নাও। এখান থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর দেখতে পাবে। লোবেসা নামে জায়গাটা একটা জংশন মতো। সোজা গেলে পুনাখা যাওয়ার রাস্তা বলে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা আছে দেখলাম। অনেকটা পথ পার হয়ে এগিয়ে গেলেও, সেরকম আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য বা কোন হোটেল রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো না। আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ‘রিনচেনলিং ক্যাফেটারিয়া’ নামে একটা রেস্টুরেন্টের কাছে গাড়ি দাঁড় করালো। জায়গাটার নাম দেখলাম ‘সোবসোখা’। পুনাখা না গিয়ে নিজে থেকে এতটা অতিরিক্ত পথ তেল পুড়িয়ে এখানে আসার কারণ এখনও আমার কাছে অজানাই রয়ে গেল। ক্যাফেটারিয়ার গঠন ও টেবিল চেয়ার বা আনুষাঙ্গিক আসবাব দেখে একটা ব্যাপার বেশ বুঝতে পারলাম— সোনম নিজের পকেট থেকে অতিরিক্ত একশ’ টাকার তেল পুড়িয়ে এখানে নিয়ে আসার ফলে, আমাদের পকেট থেকে অতিরিক্ত বেশ কিছু টাকা খরচ হওয়ার রাস্তা পরিস্কার। চারি দিকে বড় কাচের জানালা দিয়ে দূরে বেশ নীচে আমাদের এখানকার বিজতোলা লাগানো ধান চাষের সবুজ জমির মতো চাষের জমির দেখা পেলাম। এই ক’দিন প্রচুর সবুজের সংস্পর্শে এসেছি এটা সত্য, কিন্তু শীতকাল বলেই হোক বা বৃষ্টির অভাবের জন্যই হোক, সবুজের উজ্জ্বল্য কিন্তু সেরকম কোথও চোখে পড়েনি। অতবড় একটা ক্যাফেটারিয়ার একপাশে একজন বিদেশিনী মহিলাকে তাঁর একজন মহিলা গাইডকে নিয়ে খাবার খেতে খেতে গল্প করতে দেখলাম। জানি না তাঁরা কোথায় যাবেন, বা কোথা থেকে আসছেন। খাবারের দাম দেখে বাইরে কোথাও ছোলা মুড়ি পাওয়া যায় কী না ভাবছি। শেষে অনেক খুঁজে অনেক ভেবে, দু’প্লেট আলুভাজা, যদিও আদর করে যাকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বলা হয়, ও চার কাপ কফি, চারশ’ ছাপান্ন টাকা দিয়ে খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। গাড়ির কাছে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়লো। দু’পাশের প্রতিটি বাড়িতেই একটা বা একাধিক পুরুষাঙ্গের ছবি আঁকা রয়েছে। এমনকী ‘গা টিয়েন হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট’ নামে দোকানটির বিক্রেতা যদিও একজন নারী, তবু সেই দোকানের শোকেসেও সম্ভবত কাঠের তৈরি পুরুষাঙ্গ সাজানো আছে। এই বাড়িগুলোর বাচ্চারা কিন্তু এইসব ছবিগুলোর আশপাশে দিব্য খেলে বেড়াচ্ছে, মায়েরা দোকানের কাছে বা বাড়ির কাছে বসে আছেন, কিন্তু এই ব্যাপারে কারও কোন হেলদোল, লজ্জা, বা অস্বস্তি লক্ষ্য করলাম না। এর কোন বিশেষ কারণ আছে কী না খুব জানার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু জানতে গেলে সেই মহিলাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, তাই আর জানার সুযোগ হলো না। আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। একসময় চিমেলহেকং, খুরুথাং হয়ে পুনাখা এসে পৌঁছলাম। পুনাখা আসার পথে পাহাড়ের ওপর কিছু বাড়ি দেখিয়ে সোনম জানালো, যে জায়গাটার নাম ‘তোলো’। এই বাড়ির চার বোনের সাথে নাকি রাজবাড়ির চতুর্থ রাজার বিবাহ হয়, অর্থাৎ চতুর্থ রাজার চার রানী, এবং তাঁরা চার বোন ও এই একই বাড়ির সন্তান।

মেল ও হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের ‘দামচেন রিসর্ট’ বুক করা ছিল, কাজেই হোটেল খোঁজার ঝামেলা না থাকায়, আমাদের গাড়ি সরাসরি রিসর্টটির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাইরে থেকেই তিন তারকা রিসর্টটিকে দেখে মহিলারা খুব খুশি, খুশি আমরাও। রিসেপশনে মোবাইল মেসেজ দেখালে আমাদের দোতলার ওপর পাশাপাশি একটা দ্বিশয্যা ও একটা তিনশয্যার ঘর দেওয়া হলো। ঘর, আসবাব, বিছানা, বাথরূম ইত্যাদি, এমনকী দুই ঘরে দুই ফ্রিজ ও ট্রের ওপর ইলেকট্রিক কেটলি, চা, কফি, গুঁড়ো দুধ, চিনির স্যাশে, ইত্যাদি দেখেই মালুম হয়ে গেল, যে পুনাখার মতো একটা খরচা সাপেক্ষ শহরে, এই জাতীয় রিসর্টের এরকম দুটো ঘরের ভাড়া কত হতে পারে। এরকম একটা সময়ে এখানে আসার জন্য নিজেদের ভাগ্যবান মনে হলো। মেল ও হোয়াটসঅ্যাপে এই হোটেল বুকিং-এর ব্যাপারে সেই ভদ্রমহিলার সাথে আমাদের শেষ যে কথা হয়েছিল, তাতে ছোট ঘরটা পনেরোশ’ টাকা ও বড় ঘরটার জন্য আঠারোশ’ টাকা চাওয়া হয়েছিল। আমরা কোন অতিরিক্ত টাকা, ট্যাক্স হিসাবে না নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে, তাঁকে সম্মতি জানিয়ে আমাদের বুকিং কনফার্মাশন পাঠিয়ে দিতে বলেছিলাম। যাইহোক এখনও অনেক বেলা আছে। সোনম আজই আমাদের পুনাখা জোং দেখিয়ে আনবে বলে জানিয়ে, ঘরে মালপত্র রেখে নীচে নেমে আসতে বলেছিল। গাড়ি নিয়ে সে নীচে অপেক্ষা করছে, তাই আর সময় নষ্ট না করে, নীচে নেমে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

আমাদের রিসর্টটার একবারে পাশ দিয়ে পুনাখার অসাধারণ সুন্দর নদীটা বয়ে চলেছে। নাম জিজ্ঞাসা করাতে সোনম জানালো যে নদীটার নাম পুনাসাংচু। আগেই শুনেছি যে চু কথার অর্থ নদী। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুরে আমাদের রিসর্টটির ঠিক সামনে বেশ বড় মাঠের মতো আকারের বিশাল বাঁধানো ফাঁকা জায়গা। নদীর ওপারে বেশ বড় বড় বাড়ি, সম্ভবত ওটাই পুনাখা শহর। আমরা রিসর্ট ও নদীটির বেশ কিছু ছবি তুলে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আমাদের গাড়ি একসময় ঠিক সেই জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো, যেখান থেকে নদীর ওপারে বিশাল পুনাখা জোংটা ছবির মতো মনে হয়। নদীটা বাঁদিক থেকে বয়ে এসে ডানদিক, অর্থাৎ যেদিক থেকে এখন এলাম, চলে গেছে। একটু বাঁদিকেই ফ আর ম অর্থাৎ ফচু আর মচু নামে দুটি নদী এসে মিলিত হয়েছে। ফচু নদ ও মচু নদী। নামদুটি ভারি মিষ্টি। আমরা ব্রিজ পেরিয়ে ১৬৩৭ সাল থেকে নির্মান কার্য শুরু করে ১৬৩৮ সালে সম্পূর্ণ হওয়া পুনাখা জোং দেখতে এগিয়ে গেলাম। থিম্পুতে ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোরতেন ও বুদ্ধ পয়েন্ট, বা চানগাংখা মন্যাস্টারি দেখলেও, থিম্পুর জোং আমরা দূর থেকে দেখেছি। কাজেই এই প্রথম জোংপ্রবেশ। বারোশ’ ফুট উচ্চতায় পাঁচশ’ নব্বই ফুট লম্বা ও দু’শ’ ছত্রিশ ফুট চওড়া এই জোং বারবার এই দুই নদীর বন্যায়, বিশেষ করে ফচু নদের বন্যার জলচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঢুকবার মুখেই টিকিট কাউন্টার থেকে মাথাপিছু তিনশ’ টাকা করে পনেরোশ’ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হলো। গাইড যদিও ফ্রী, কিন্তু সেই মুহুর্তে কাউন্টারের কাছে কোন গাইড না থাকায়, একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে আমরা নিজেরাই এগিয়ে গেলাম। ব্রিজের নীচ দিয়ে পরিস্কার জল বেশ স্রোতে বয়ে যাচ্ছে, এবং তাতে হাজার মাছ মনের আনন্দে দলবেঁধে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে গেট দিয়ে প্রবেশ করে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, যেখানে অনেক গাছ ও উঁচু একটা লোহার দণ্ডে বিশাল একটা সাদা কাপড়ের পতাকা মতো লাগানো আছে। এখানেই একটা গাছে ছোট ছোট বেশ কিছু কমলালেবু হয়ে আছে। সাদা রঙের কিছু পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পরে, পাশাপাশি চারটি কাঠের হাতল লাগানো যে তিনটি সিঁড়ি আছে, তার যেকোন একটার তেরোটা ধাপ ভেঙে জোং-এ প্রবেশ করতে হবে দেখে দুশ্চিন্তা শুরু হলো। দুশ্চিন্তার কারণ দু’টো, প্রথমত, হাঁটুর সমস্যায় জর্জরিত সঙ্গের দুই মহিলার ওপরে উঠতে খুব কষ্ট হবে। আর দ্বিতীয়টা, কোনভাবে পড়ে গেলে বোধহয়, মৃত্যুর বিকল্প কিছু থাকবে না। যাইহোক, সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে সিকিউরিটির হাতে টিকিট জমা দিয়ে একজন গাইড পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করায়, তিনি জানালেন যে গাইডের জন্য মূল গেটে টিকিট কাউন্টারে যেতে হবে। শেষে একজন পুলিশের লোক আমাদের সঙ্গে করে জোং-এর মূল প্রবেশ দ্বারের কাছে ছেড়ে দিলেন। এই পর্যন্ত আসার পথে দু’পাশের তৈলচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অবাক করা রঙের কাজ। এখানে দেখলাম একজন গাইড তিন-চারজন ভ্রমণার্থীকে এই ছবিগুলো সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলছেন। টিকিট না কাটলে সম্ভবত ব্রিজ পার হয়ে জোং-এর ঠিক বাইরে বিশাল খোলা জায়গাটা পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়, কিন্তু ওই বিপজ্জনক সিঁড়ি ভেঙে জোং-এর ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। টিকিট কাটলে, সঙ্গে বিনা দক্ষিণায় একজন গাইড দেওয়া হয়। অথচ আমরা পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি তাঁর বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে আমাদের ওই স্থান ত্যাগ করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। মূল মন্দিরটির সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, এবং তার চারপাশের স্থাপত্যের বিশালতা, ও রঙের কাজ দেখে বিষ্মিত হতে হয়। চোখ ছাড়া, কথা বা লেখায় এর বিশালত্ব বর্ণনা করা অসম্ভব, অন্তত আমার সে ক্ষমতা নেই। জুতো খুলে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। এখানে তিনজনের মুর্তি আছে। একজন তো স্বাভাবিক ভাবেই বুদ্ধদেব। অপর দু’জনের পরিচয় কাউকে জিজ্ঞাসা করেও, সঠিক জানা গেল না। ভিতরে মুর্তির কাছে বসে একজন ধ্যান করছিলেন, শেষে তরুণ আবার ভিতরে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করায়, তিনি অপর একটি মুর্তি বধিগুরুর বলে জানালেন। তৃতীয় জনের পরিচয় আর জানার সুযোগ হলো না। আজ আর কোথাও যাওয়ার নেই, আগামীকাল সারাদিন পুনাখায় ঘুরে দেখার কথা থাকলেও, নতুন করে সময় ও অর্থ ব্যয় করে পুনাখার এই বিখ্যাত জোং-এ আর আসা সম্ভব হবে না। তাই আরও অনেক সময় ব্যয় করে ঘুরে ঘুরে দেখে, ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে কাঠের ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মাছের ছবি তুলে একসময় আমরা গাড়িতে ফিরে এলাম।

অসময়ে দামচেন রিসর্টের দুটি ঘর সস্তায় দখল করে ডেরা বাঁধলেও, এই রিসর্টের ক্যান্টিনে খাদ্য তালিকা ও মূল্য দেখে বুঝলাম, কিরকম একটা শীত শীত করছে। সোনম এখনও তার গাড়ি নিয়ে চলে না যাওয়ায়, আমি ও তরুণ তাকে কাছেপিঠে কোন রেস্টুরেন্ট আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমাদের গাড়িতে উঠে বসতে বললো। আমাদের রিসর্ট থেকে বেশ কিছুটা দূরে ‘হোটেল লিংগার’ নামে একটা বেশ বড় ও কায়দা কানুন করা হোটেলে আমাদের নিয়ে এসে হাজির করলো। ওপরে থাকার ব্যবস্থা ও একতলায় এই খাবার জায়গা। আমাদের অবস্থাটা অনেকটা ‘টকের ভয়ে পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস’ এর মতো হলো। এখানে আমাদের বাড়ির মতো এক একটা হাতেগড়া রুটি পঁচিশ টাকা করে দাম। তরুণ জানালো যে ভুটানে আসার আগে এই হোটেলেও থাকার ব্যাপারে মেল করেছিল, কিন্তু এরা কোন যোগাযোগ করেনি। তরুণ বললো যে পরে সবাই মিলে এখানে এসে খেয়ে যাবে। বাইরে বেশ ঠান্ডা, তাছাড়া সারাদিন এতো জার্নি করে এতোটা পথ ওদের নিয়ে আসা মুশকিল, কারণ তখন আর সোনম আমাদের সাথে থাকবে না। তাই পরে আমরা দু’জন একবার এসে খাবার নিয়ে যাবো ঠিক করে, সোনমের সাথে দামচেন রিসর্টে ফিরে এলাম। সোনম হাত মিলিয়ে ফিরে যাবার সময় কোন অসুবিধা হলে তাকে ফোন করতে বলে, গাড়ি নিয়ে চলে গেল। শুনলাম রাতে সে তার এক বন্ধুর হোটেলে থাকবে।

বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, রাত আটটা নাগাদ আমরা হাঁটতে হাঁটতে হোটেল লিংগারে এসে হাজির হলাম। রুটি ও চিকেন তৈরি করে প্যাক করে দিতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নিলো। বাইরে অসম্ভব ঠান্ডা, আধো অন্ধকার রাস্তায় কিছু গাড়ি চলাচল করলেও, একটা লোকেরও দেখা পেলাম না। একটা পেট্রল পাম্পের পাশ দিয়ে আমাদের রিসর্টে যাওয়ার রাস্তা। খাবার আনতে যাওয়ার সময়ও ওই পথে এসে, বামদিকে দোকানে যাওয়ার মসৃণ রাস্তা ধরেছিলাম। এখন সেই একইভাবে এসেও আমাদের রিসর্টের দর্শন পেলাম না। আবার বড় রাস্তায় ফিরে গিয়েও প্রকৃত রাস্তার হদিশ খুঁজে বার করতে পারলাম না। রাস্তায় একটা লোক নেই যে তাকে জিজ্ঞাসা করবো। শেষে দেখলাম, আমরা ঠিক পথে এসেও অহেতুক সন্দেহে ঘুরে মরছিলাম। যাইহোক, নিজেদের ডেরায় ফিরে আর দেরি না করে, হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে, খাবার খাওয়ার জন্য তরুণের ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। বাইরের ওই ঠান্ডায় রুটিগুলো আমাদের সাথে অতক্ষণ পথ পরিক্রমা করায়, তারা তাদের বৈশিষ্টের কিছু পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখন তাদের আর রুটি বলে মনে হচ্ছে না, পরিবর্তে পাঁপড় ভাজার সাথে কোথায় একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অত্যন্ত মূল্যবান রুটি, তাই সেগুলো কোনমতে গলাধঃকরণ করা হলো। আজ বেশ সকাল থেকে আমাদের সেই অর্থে বিশ্রাম নেবার সুযোগ হয়নি। আগামীকাল সকালে আবার পুনাখা শহরের দ্রষ্টব্য ঘুরে দেখার কথা, তাই কিছুক্ষণ পরে যে যার বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের চোদ্দ তারিখ। বেশ সকালে তরুণের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। সীমার তৈরি চা নিয়ে এসে সে আমাদের ডেকে দিয়ে গেল। আমরা তৈরি হতে শুরু করলাম এবং যথারীতি সোনম আমাদের ফোনে তাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বললো। যত শীঘ্র সম্ভব আমরা তৈরি হয়ে নীচে নেমে গাড়ির কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সোনম আমাদের সুপ্রভাত জানিয়ে গাড়ি নিয়ে গতকালের সেই হোটেল লিংগারে গিয়ে হাজির করলো। গতকাল রাতে হোটেলের ক্যান্টিন বা রেস্টুরেন্টটা বেশ বড়, সাজানো গোছানো, ও সুন্দর দেখলেও, ঘুরে দেখার সুযোগ ছিল না। আজ দেখলাম ক্যান্টিন সংলগ্ন লম্বা ব্যালকনির প্রায় ঠিক নীচ দিয়ে নদীটি বয়ে গেছে। নদী, ও নদীর অপর পাড়ের শহরের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। খাবার তৈরি হতে হতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তোলা হলো। অবশেষে আমার অতিপ্রিয় বেশ কড়া করে স্যাঁকা ব্রেড, সাথে বাটার, জ্যাম, অমলেট, ও চা দিয়ে তোফা প্রতরাশ সেরে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

একসময় আমরা আবার প্রায় গতকালের সেই পুনাখা জোং-এর অপর পাড়ে ফচু ও মচুর সংগমস্থলে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে নীচে নেমে নদীর ধারে গেলাম। আজ দেখলাম প্রচুর পাখি নদীর অপর পাড়ে উড়ে এসে বসছে। সোনম জানালো পাখি শিকার করলে, বা পাখির কোন ক্ষতি করলে, এমন কী জোং-এ ঢোকার সময় মাছ ধরলেও, অনেক টাকা জরিমানা ও জেল পর্যন্ত হয়, এবং তা গরীব আমির সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। একপাল গাধা দেখলাম নদীর পাড়ে এসে হাজির হলো। এখান থেকে ফচু ও মচু, দু’জনের আগমন পথ পরিস্কার করে দেখা যায় না। আমি ও তরুণ, জুতো না খুলে গাছপালা সরিয়ে পাথরের ওপর দিয়ে কোনক্রমে সেই জায়গাটায় গিয়ে হাজির হলাম, যেখান থেকে দু’জনকেই দু’দিক থেকে এসে, মিলিত হওয়ার দৃশ্য পরিস্কারভাবে দেখা যায়। নদীদু’টি তাদের নামের মতোই মিষ্টি ও সুন্দর। আরও বেশ কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটিয়ে, আমরা ওপরে রাস্তায় উঠে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি একটা ঘেরা জায়গায় এসে দাঁড়ালো। জানা গেল যে এটা একটা শ্মশান। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হলেও, ভিতরে গিয়ে দেখার সুযোগ হলো না, কারণ তার ভিতরে প্রবেশ করার দরজাটি বন্ধ, ও তালা দেওয়া। জানি না, হয়তো মৃতদেহ না আসলে, দরজা খোলা হয় না। আমরা সোনমের নির্দেশ মতো বাঁদিকের রাস্তা ধরে এগতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা এগিয়েই, ডানদিকে ফচু নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজটা চোখে পড়লো। নদীর ওপর একশ’ ষাট মিটার লম্বা এই সাসপেনশন ব্রিজটার কথা গতকাল থেকে সোনমের মুখে শুনে আসছিলাম। এই ব্রিজটা নাকি ভুটানের দীর্ঘতম ব্রিজ। একসময় আমরা ফচু নদের অনেক ওপর দিয়ে দুপাশের ওপর নীচে মোটা তারের জাল দিয়ে ঘেরা, এই ঝুলন্ত ব্রিজটার সামনে এসে পৌঁছলাম। কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে বিভিন্ন রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগে ঘেরা ব্রিজটা, প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট সময় ধরে হেঁটে পার হয়ে, নদীর অপর পারে যেতে হবে। ব্রিজটার প্রবল দুলুনির জন্য সময় অনেক বেশি লাগে। নদীর ওপারে গ্রামগুলো অবস্থিত। এই অঞ্চলেই নাকি সবথেকে বেশি ধান উৎপাদিত হয়। পুনাখা জোং এর লামাদের ওপাশের গ্রামে যাতায়াত করার জন্যই নাকি একসময় এই ব্রিজ তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে নদীর ওপারের গ্রামগুলির সাথে পুনাখা শহরের যোগাযোগ রক্ষার্থে ও গ্রামবাসীদের পুনাখা জোং-এ যাতায়াতের জন্য ব্রিজটির প্রয়োজনীতা অসীম। আমরা দুলতে দুলতে ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে হাজির হলাম। জানি না, পারাপারের সময় মাঝপথে ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে কি অবস্থা দাঁড়ায়। ব্রিজের ওপারে গিয়ে তিনটি বাচ্চাকে আইসক্রীম হাতে খেলা করতে দেখলাম। তাদের মা পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। বছর আট-দশের ভাইটি বড়, বোন দুটি ছোট। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, আমি ব্রিজের ছবি তোলার সময়, ভাইটি আমায় হাত নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। তার চালচলন ও দৃষ্টিতে কিছু অস্বাভাবিকতাও লক্ষ্য করলাম। বাচ্চাগুলোর মা আমাকে ইংরেজিতে বললেন, যে তাঁর ছেলেটি কথা বলতে পারে না এবং কানেও শুনতে পায় না। সে আমাকে তার একটা ফটো তুলে তাকে দেখাতে বলছে। কথাগুলো বলবার সময় তিনি কেঁদে ফেললেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত কোন ভুটানবাসীর চোখে মুখে কোন দুঃখ বা টেনশনের ছাপ দেখিনি, বরং সবসময় তাদের ফেস্টিভ মুডে থাকতে দেখে এসেছি। ব্রিজের ছবি তোলা স্থগিত রেখে, বাচ্চাটার কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম। সেও খুব খুশি হয়ে তার পছন্দ মতো পোজে ছবি তুললো। তাকে তার ছবিগুলো দেখাতে সে খুব খুশি হলো। তার খুশিতে তার মা’কেও খুব খুশি হতে দেখে ভালো লাগলো। বোনদুটোরও ছবি তুলে দিলাম, যদিও ছোট বোনটা কিছুতেই ছবি তুলতে চায় না। ব্রিজ ও আশপাশের কিছু ছবি তুলে, পাশেই একটা দোকানের সামনে আমরা বসলাম। এখানে নানারকম জিনিস পাওয়া যায়। এখানে আইসক্রীম খেয়ে, চিপস্, ম্যাগি, ওয়াই ওয়াই না কি যেন বলে, ও আরও কিছু ওই জাতীয় দ্রব্য কেনা হলো। মুড়ির প্যাকেট আছে দেখে উত্তেজনায় বেশ মূল্যবান মুড়িও কিছু সংগ্রহ করা হলো। এবার ফেরার পালা, সোনম আমাদের বাজো টাউন দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছে। আমরা আবার সেই ঝুলন্ত ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় ওপাড়ে গিয়ে হাজির হলাম। ব্রিজের পাড়ে বসে বেশ কিছুক্ষণ গুলতানি হলো। সোনম আমাদের মোবাইলে আমার ও তরুণের কিছু ছবি তুলে দিলো। আমরা ধীরে ধীরে গাড়ির কাছে এসে হাজির হলাম। শ্মশানটার বাইরের লোহার শিকের গেট দেখলাম এখনও বন্ধ। আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

ধীরে ধীরে আবার একসময়, আমরা প্রায় আমাদের সেই দামচেন রিসর্টের কাছ দিয়েই, খুরুতে অবস্থিত  খুরুখুয়েনফেন জ্যাম (KHURUKHUENPHEN ZAM) ব্রিজ পার হয়ে গিয়ে, সামথাং হয়ে বাজো বা ওয়াংডু শহরে এসে উপস্থিত হলাম। এপথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবশ্যই সুন্দর, তবে চোখে পড়ার মতো নতুন কোন বিশেষ বৈচিত্র লক্ষ্য করলাম না। বাজো বা ওয়াংডু শহরটা বেশ ছোট, এবং সম্ভবত খুব বেশিদিন গড়ে ওঠেনি। কারণ সোনম জানালো, পুরাতন ওয়াংডু ফোডরাং শহরটি, যেটা আগে জোং-এর নিকটবর্তী অঞ্চলে ছিল, এখন সেটা বাজো বা নতুন ওয়াংডু শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে। সোনম আরও জানালো, যে এই নতুন শহরটির কাছে প্রচুর চাষবাস হয়। পুরাতন ওয়াংডু জোংটি আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ সম্ভবত ২০১১ সালে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ভষ্মিভুত হওয়ার পরে, বাজো শহরে স্থানান্তরিত হয়। প্রতি রবিবার এখানে হাট বসে এবং ওয়াংডু ও পুনাখার জনগন এখানে ব্যবসায়িক কারণে ভিড় করেন। স্থানীয় মানুষ ওই বিশেষ  দিনটিতে তাঁদের উৎপাদিত সামগ্রী নিয়ে হাটে উপস্থিত হন। আজ সোমবার, তাই আমরা সেই দৃশ্য দর্শনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।

শহরটি ছোট হলেও, পরিকল্পনা মাফিক চওড়া রাস্তার দু’পাশে, পরপর বেশ বড় বড় সুন্দর বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। পুরাতন ওয়াংডু শহর কিরকম ছিল জানি না, তবে পুনাখা একসময় ভুটানের রাজধানী শহর হলেও,  এই বাজো শহরটি আদপেই বর্তমানের পুনাখা শহরের মতো ফাঁকা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পন্ন নয়। আর পাঁচটা বড় শহরের মতো রাস্তার দু’পাশে বড় বড় সুন্দর বাড়ি, ও ঝাঁচকচকে দোকানপাট দিয়ে সাজানো  একটি ইঁট কাঠ পাথরের শহর মাত্র। সোনম আমাদের গাড়ি থেকে নেমে শহরটাকে ঘুরে দেখতে বললো। আমরাও গাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে শহর প্রদক্ষিণের প্রস্তুতি নিলাম। শেয়ালকে আঁখের খেত দেখানোর মতো, সোনম আমাদের এমন একটা জায়গায় বড় বড় দোকানের সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো, যে সেখানে পাওয়া যায় না, এমন জিনিসের বড় অভাব। চায়নার তৈরি স্কচ্ ব্রাইট, যা কিনা কলকাতা তো দূরের কথা, চায়নাতেও নাকি পাওয়া যায় না, তাও এখানে সুদৃশ্য মোড়কে অঢেল পাওয়া যায়। ফলে দোকানে দোকানে ঘুরে কি কি পাওয়া যায়, বা কি কি কেনা যায়, দেখতে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটলো। হাতে কোন কাজ নেই বা আর কোথাও যাওয়ারও তাড়া নেই, তাই এ রাস্তা সে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সুন্দর সুন্দর বাড়ি, দোকানপাট, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখে কাটালাম। একটা পার্কে বাচ্চাদের হইহুল্লোর, ও পাশে বাস্কেট বল খেলার অনুশীলন দেখেও অনেকটা সময় বেশ কেটে গেল। জয়গাঁও ছাড়ার পর থেকে আজ প্রায় চার দিন, রাস্তাঘাটে আবর্জনা, পলিথিন প্যাকেট, রাস্তার পাশে আবর্জনা উপচে পড়া পূতি গন্ধে ভরা উপচে পড়া ভ্যাট, গুড়াখু খৈনি বা গুটখা মিশ্রিত থুথু না দেখে দেখে হাঁপিয়ে উঠছিলাম, মনটা নিজের শহরের জন্য কেমন হুহু করে উঠছিল। এখানে রাস্তার পাশে কোন কোন জায়গা এখনও বেশ অপরিস্কার ও আবর্জনা পড়ে নোংরা হয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হতেই হলো, কারণ এখন পর্যন্ত এ দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য জানি না, আমাদের হয়নি। আসলে গোটা শহরটা সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরির কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।

এমন সময় সোনম ফোন করে আমরা এখানে লাঞ্চ করবো কী না জিজ্ঞাসা করলো। আমরা তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। সোনম আমাদের সঙ্গে করে একটা সুন্দর হোটেলে নিয়ে গেল। দোতলার ওপর হোটেলটার ভিতরে ঢুকেই যেটা বুঝতে পারলাম, আজ আমাদের অনেকগুলো টাকা আমাদের মানিব্যাগের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে, এই হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারের ড্রয়ারে বেশ কিছু Ngultrum, বা সংক্ষেপে NU এর সাথে আশ্রয় নেবে। সে যাহোক্, আমাদের কপাল ভালো না মন্দ বলতে পারবো না, তবে হোটেলটির খাবার এখনও প্রস্তুত না হওয়ায়, আমরা খুব সহজেই ওখান থেকে রাস্তায় নেমে আসার সুযোগ পেলাম। সোনম আমাদের একটু দূরেই ‘রিগসাম’ হোটেলে নিয়ে গেল। এই হোটেলটাও বেশ ভালো ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। হোটেলটার খাবার টেবিল দু’দিকের দুটো অংশে সাজানো। আমরা ভিতরের অংশে আসন গ্রহণ করলাম। ভুটানে আসা অবদি ভাত না খাওয়ায়, মহিলারা ভাত বা ফ্রায়াড রাইস জাতীয় কিছু খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, এই হোটেলে ফ্রায়াড রাইস ও চিকেন নেওয়া হলো। এই প্রথম সোনম আমাদের সাথে খেতে রাজি হলো। খাবারের মান খুব একটা উল্লেখযোগ্য না হলেও, ফ্রায়াড রাইসটা আমাদের এখানকার চিড়ের পোলাও জাতীয় মনে হলো। একফাঁকে সোনম এসে জানিয়ে গেল, যে সে কাউন্টারের দিকের টেবিলে বসেছে। তাকে খাবার দেওয়া হয়েছে, তবে তার খাবারের দাম যেন না দেওয়া হয়। আমরা সোনমকে ধরে ছ’জনের মতোই খাবারের অর্ডার করেছিলাম, কাজেই নতুন করে আলাদা দাম দেওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। খাবারের পরিমানটা একটু বেশি হয়ে যাওয়ায়, খাবারের মূল্যর কথা চিন্তা করে, ও খাবার নষ্ট না করার বাসনায়, জোর করেই খেয়ে নিতে হলো। খাওয়া শেষে গাড়িতে গিয়ে বসলাম, এবার আবার পুনাখা ফেরার পালা। বিদায় বাজো শহর, বিদায়, জানি না এ জীবনে আর দেখা হবে কী না।

আমরা পুনাখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে সোনম জানালো, যে সে অন্য রাস্তা দিয়ে আমাদের পুনাখায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, যাতে আমরা আরও বিস্তির্ণ অঞ্চলের সাথে পরিচিত হতে পারি। একসময় আমরা ওয়াংডু ব্রিজ পার হয়ে অপর পাড়ে গেলাম। ওয়াংডু ফোডরাং এলাকার বিস্তির্ণ অঞ্চল দেখিয়ে সোনম জানালো, সম্ভবত ২০১১ সালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ওয়াংডু জোং সমেত বিস্তির্ণ অঞ্চল পুড়ে যায়। কিভাবে আগুন লেগেছিল জানতে চাওয়ায় সে যা বললো, তাতে মনে হলো দাবানলই ওই বিপজ্জনক অগ্নিকান্ডের কারণ। ফিরবার পথে রাস্তার পাশেই ফুটপাথের ওপর দোকান করে একটা বাজারের মতো জায়গার সামনে, সোনম আমাদের গাড়িকে আমাদের ইচ্ছায় দাঁড় করালো। কতরকমের টাটকা ফল ও সবজি যে দোকানগুলোয় বিক্রি হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারবো না। একজায়গায় দেখলাম আঁখ বিক্রি হচ্ছে। আঁখগুলোর স্বাস্থ্য দেখলে অবাক হতে হয়। এছাড়া প্যাকেটে করে ফল ছাড়াও, ডাল, মুড়ি, চানাচুর, চিজ্, বেশ বড় বড় ফুচকার মতো কি একটা জিনিস, ও আরও কত কি যে বিক্রি হচ্ছে, ভাবা যায় না। ফল ও সবজিগুলো এতো টাটকা, যে দেখলেই কিনতে ইচ্ছা করবে। আমরা বেশ কিছু কমলা লেবু, ও আপেল কিনে গাড়িতে ফিরে এলাম। আরও অনেক পথ ঘুরে আমরা একসময় নিরাপদে আমাদের রিসর্টের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে পৌঁছলাম। সোনম তার গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

আজই পুনাখায় আমাদের শেষ দিন। কাল সকালেই আমরা পারোর উদ্দেশ্যে রওনা হবো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমি ও তরুণ নীচে গিয়ে হোটেলের বিল মেটাতে গেলাম। কাউন্টারের ভদ্রমহিলাটি অঙ্কে সম্ভবত একটু বেশিই কাঁচা। একটি ঘর প্রতিদিন পনেরোশ’ টাকা ও একটি ঘর প্রতিদিন আঠারোশ’ টাকা ভাড়ায়, দু’দিনের ভাড়া কত হবে হিসাব করতে তিনি হিমশিম খেয়ে, শেষে তেরো হাজার দুশ’ টাকা লাগবে বলে জানালেন। শেষে অনেক রকম প্রক্রিয়ায় হিসাব করে দেখিয়ে তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হলাম, যে আমাদের কাছে তাঁর মোট ছয় হাজার ছয় শত টাকা পাওনা। এর পরেও নির্ভুল হিসাবের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে তিনি ফোন করে অন্য কারো সাহায্য নিয়ে, আমাদের হিসাব নির্ভুল বলে স্বীকার করে, টাকা নিয়ে রসিদ প্রদান করে আমাদের মুক্তি দিলেন।

ঘরে ফিরে এসে মালপত্র গোছগাছ করে নিয়ে তরুণদের ঘরে আড্ডা দিতে বসলাম। দুপুরের ফ্রায়াড রাইসের কল্যানে কারো সেরকম খিদে না থাকায় ঘরের কেতলিতে চাউ ও ওয়াই ওয়াই তৈরি করে, ও ফল দিয়ে নৈশভোজ সারা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। খাবার তৈরির ভার তরুণের কন্যা পুপুর ওপর, ও ফল কাটার দায়িত্ব তরুণের ওপর ন্যস্ত হলো। সঙ্গে এখনও একটা বিশাল আকারের সেই মহৌষধি গ্রাউন্ড আপেল ছিল। আপেল, গ্রাউন্ড আপেল, ও কমলা লেবু দিয়ে আমরা দিব্য ডিনার সেরে নিলাম। পুপু সম্ভবত একা তার অতিপ্রিয় ওয়াই ওয়াই খেয়েছিল। আরও বেশ কিছুক্ষণ গুলতানি করে, যে যার ঘরে নিজ নিজ বিছানা নিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের পনেরো তারিখ। বেশ ভোরেই সীমার তৈরি চা খেয়ে তৈরি হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। আজ আমাদের গন্তব্য স্থল পারো, তবে সোনম গতকালই জানিয়েছিল যে যাওয়ার পথে একবার থিম্পু হয়ে যেতে হবে, কারণ আমাদের ভুটানে থাকার পারমিটটা উনিশ তারিখ পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে হবে। আমরা ভুটান ছেড়ে জয়গাঁও ঢুকবো উনিশ তারিখে। কিন্তু উনিশ ও কুড়ি তারিখ যথাক্রমে শনি ও রবিবার। ওই দু’দিনই ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ থাকে। সোনমকে কোন কিছু মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন এখন পর্যন্ত হয়নি। যাইহোক, আমরা তৈরি হয়ে নিয়ে আর বৃথা সময় নষ্ট না করে, গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সোনম গাড়িতে মালপত্র গুছিয়ে রেখে গাড়ি ছেড়ে দিল।

আজ আমরা কোন প্রতরাশ না সেরেই এগিয়ে চলেছি। রাস্তায় সুযোগ সুবিধা মতো ব্যাপারটা সেরে নিলেই হবে, তাছাড়া সঙ্গে কেক, বিস্কুট, বাদাম, ইত্যাদি শুকনো খাবার যথেষ্টই আছে। নতুন রাস্তায় নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দই আলাদা, তবু মনের কোণে ইষৎ একটা দুঃখ দেখা দিচ্ছে। আমাদের ট্যুর ক্রমে অন্তিম পর্বের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। রাস্তার সৌন্দর্য প্রায় একই রকম। আগেও বলেছি যে সোনমের একটা বড় গুণ, সে কখনও খুব জোরে গাড়ি চালায় না, খুব প্রয়োজন না হলে সামনের গাড়িকে অহেতুক ওভারটেক করে না, বাঁকের মুখে সবসময় হর্ণ না বাজালেও, ডান দিক দিয়ে কখনও বাঁকের মুখে গাড়ি ঘোরায় না। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকের মুখে অবশ্য সাধারণত কেউ কোথাও রাস্তার ডানদিক দিয়ে গাড়ি ঘোরায় না। আমাদের গাড়ি দিব্যি এগিয়ে চলেছে। আমি গাড়ির সামনে সোনমের পাশে বসে। পিছনে সকলের চোখে মুখে ও গলায় আনন্দের বহিপ্রকাশ। একটু পরেই সামনে একটা জায়গায়, রাস্তার পাশে সোনম হঠাৎ গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, যে আমরা মিনারেল ওয়াটার খাই কী না। বললাম সবসময় না হলেও, মাঝেমধ্যে তো খেতেই হয়। সে আবার জিজ্ঞাসা করলো, যে আমরা আমাদের দেশের ও ভুটানের, উভয় জায়গার মিনারেল ওয়াটার কিনে খেয়েছি কী না। এবারও আমার উত্তর হ্যাঁ হওয়ায়, সে আমাদের কাছ থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে জলটা ফেলে দিয়ে, রাস্তার পাশ থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা একটা জলের ধারা থেকে বোতলটা ভরে নিজে খেয়ে আবার ভর্তি করে আমাদের এনে দিয়ে বললো, এই জলটা খেয়ে দেখো কোন পার্থক্য বুঝতে পারো কী না। গাড়ি ছেড়ে দিলো, আমরা ভাগ করে সবাই কিছুটা করে জল খেলাম। যেখান থেকে জলটা পড়ছিল, সেই জায়গাটার নাম দেখলাম ‘মেঞ্চুটাক’। লোহার রড দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে, এবং একটা নোটিশ বোর্ড মতো লাগানো আছে যাতে লেখা ছিল, এই পানীয় হোলি ওয়াটারে কাপড় কাচলে, বা জায়গাটা নোংরা করলে জরিমানা দিতে হবে। সোনম জানালো, এটা পবিত্র জল। এরকম আরও কিছু জায়গায় এই পবিত্র জলধারা সাধারণ মানুষের জন্য নেমে এসেছে। এই জল পান করলে, যেকোন পেটের রোগ সেরে যায়। সে আরও জানালো, যে এই জায়গা কোনভাবে নোংরা করলে বা কাপড় কাচলে, অনেক টাকা জরিমানা দিতে হয়। প্রথম দিন থেকে দেখে আসছি যে সোনমের দেশের প্রতি, রাজার প্রতি, ও প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। এই ভালবাসা, আস্থা, বা বিশ্বাস কিন্তু এমনি এমনি হয় না। সোনম জানালো মেঞ্চু কথার অর্থ মেডিকেটেড ওয়াটার, আর টাক কথার অর্থ রক্ বা পাহাড়।

যাইহোক্, ও কথা বলতে বলতে, গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমাদের সামনে দেখলাম একটা গাড়ি বেশ ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। আমাদের গাড়ি ওই গাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, পিছনের সিটে দুটো বাচ্চা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বসে আছে। তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে শুরু করায়, আমরাও হেসে বাচ্চাদুটোকে হাত নাড়লাম। সামনেই রাস্তাটা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। সোনম কিন্তু ওই গাড়িটাকে ওভারটেক করে অতিক্রম করেও, রাস্তার বাঁপাশে চলে না গিয়ে, রাস্তার ডানপাশ দিয়েই নিজের গাড়িটাকে ডানদিকের বাঁকটাতে ঘোরাতে গেল, আর ঠিক তখনই বাঁকের মুখ থেকে একটা গাড়ি এসে হাজির হলো। পিছনের গাড়িটাকে ওভারটেক করার জন্য এই মুহুর্তে সোনমের গাড়ির গতি অস্বাভাবিক না হলেও, ওর স্বভাবসিদ্ধ গতির থেকে কিছু বেশিই বলবো। অপর দিকের গাড়িটি হর্ণ না বাজিয়ে সঠিক দিক দিয়ে রাস্তাটার বাঁক ঘুরলেও, সোনমের গাড়ির গতির তুলনায় তার গাড়ির গতি অনেকটাই বেশি। অতর্কিত দুটো গাড়ি মুখোমুখি এসে পড়ায়, সোনম একটা চিৎকার করে মাত্র দু’-এক হাত দূরত্ব থেকে দ্রুত বামদিকে গাড়িটা  ঘুরিয়ে নিলো। অপর প্রান্তের গাড়িটির মুখ কিন্তু বাম দিকে এতটুকু ঘুরিয়ে নেবার সুযোগ ছিল না, কারণ তার বামদিকে রাস্তার পাশেই খাদ। সে অতর্কিতে ব্রেক কষে তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। কোনক্রমে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। পিছন থেকে ওই গাড়ির চালকের বিরক্তিপূর্ণ চিৎকার শুনতে পেলাম। সোনম কোন কথা না বলে, গাড়ি দাঁড় না করিয়ে এগিয়ে চললো। মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে কেউ হতাহত না হলেও, গাড়িটার যে বেশ ভালো রকম ক্ষতি হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর ওই নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির কোন ক্ষতি হলে আমাদের ভুটান সফর যে সেখানেই ইতি হতো, এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

যাইহোক্, একসময় আমরা ঘুরে ফিরে থিম্পুর সেই আগের রেস্টুরেন্টটার কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। এই রেস্টুরেন্টটা আমাদের বেশ পছন্দের। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শুধু নয়, ব্যবহার বেশ ভালো, ও বেশ মনোমতো জলযোগ করা যায়। আমাদের আজ কপাল খারাপ, ভিতরে কিসব পরিস্কার টরিস্কারের কাজ চলছে, তাই এখন কোন খাবার পাওয়ার সুযোগ নেই। সোনম আমাদের একটা সমগোত্রীয় রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করলো। আমরা ভিতরে ঢুকলাম, সোনম গেল পারমিটের দিনটা এক্সটেন্ড করতে। কোথায় পারমিট দেওয়া হয়, তার জন্য কি কি করণীয়, কিছুই জানা নেই। ‘বোরলীন আছে তাই ভরসা’-র মতো সোনম আছে তাই  ভরসা ভেবে, খাবারের অর্ডার দিলাম। খাওয়া হয়ে গেলে, খাবার জল দিতে বলে কফির অর্ডার দিলাম। সব জায়গায় লক্ষ্য করে আসছি, যে এদেশের পুরুষরা দিব্য আছেন। আলখাল্লার মতো জাতীয় পোষাক পরে তারা দিব্য পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর যত দোকান সব মহিলারা চালাচ্ছেন। এই রেস্টুরেন্টেও সেই নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটেনি। ঠান্ডার জায়গা বলে এখন পর্যন্ত সর্বত্র দেখেছি, না চাইতেই খাবার জল গরম দেওয়া হয়। এখানেও গ্লাসে করে খাবার জল দিয়ে যাওয়া হলো। তবে এখানে আবার ভালবেসে ফুটন্ত জল কাচের গ্লাসে করে দেওয়া হলো। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে কফি দিয়ে যাওয়া হলেও, এখন পর্যন্ত জলের গ্লাসে একটা চুমুকও দেওয়ার সুযোগ হয়নি। কফি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার ভয়ে, শেষপর্যন্ত খাবার জল ছেড়ে, কফি খাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। জলখাবার পর্ব শেষ হলে বাইরে এসে দেখলাম, যে সোনম পারমিটের কাজ সেরে তখনও ফিরে আসেনি। বাইরে সুন্দর রোদে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আরও বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাবার পরে, সোনম ফিরে এলো। এই এক ছেলে, কোন কাজটা কবে কোথায় কখন করতে হবে, আমাদের জানা না থাকলেও, সে নিজে থেকেই মনে করে সবকিছু গুছিয়ে করে ফেলে। শুধু তাই নয়, এখনও পর্যন্ত সেই প্রথম দিনের এক হাজার টাকা অগ্রিম নেওয়া ছাড়া, যেটা অবশ্য না দিলেও চলতো, একটা পয়সাও নেয়নি।

আমরা আবার পারোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সুন্দর রাস্তা দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ছবি তুলতে তুলতে মনের আনন্দে এগিয়ে চলেছি। পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। তোবসা, সেমতোখা হয়ে একসময় চুজম এসে পৌঁছলাম। এই চুজম একটা বেশ বড় জায়গা। এখানে থিম্পুর থিম্পচু বা ওয়াংচু নদী ও পারোর পারোচু নদীদুটি এসে মিশেছে। এখান থেকে পারোর দূরত্ব মাত্র চব্বিশ কিলোমিটার। জায়গাটা একটা জংশন মতো। এখানে একটা বেশ চওড়া ব্রিজ পার হয়ে আমাদের যেতে হবে। ব্রিজের একটু আগে সোনম আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে, জায়গাটা ঘুরে দেখতে বললো। রাস্তার ওপর থেকে নীচে দুটি নদীর সঙ্গম স্থলটা বেশ সুন্দর ও পরিস্কার দেখা যায়। থিম্পুতে ওয়াংচু নদীটাকে খুব একটা সুন্দর বলে মনে না হলেও, এখানে তার রূপ একবারে ভিন্ন। মহিলারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নদীর সঙ্গম স্থলটা দেখতে ও ছবি তুলতে শুরু করলো। আমি ও তরুণ একটা পায়ে হাঁটা সরু পথ দিয়ে অনেকটা নীচে নদীদুটোর কাছাকাছি গিয়ে হাজির হলাম। এখানে একবারে কাছ থেকে সঙ্গমস্থলটা বেশ পরিস্কার দেখা যায়। বোঝা গেল অনেকেই এখানে নেমে নদীদুটোর সঙ্গমস্থলটা দেখতে আসেন, কারণ এখানে দেখলাম পুরুষ ও মহিলা, উভয়ের ব্যবহারের জন্যই রেস্টরূম লেখা একটা বেশ চকচকে পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট আছে। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে দেখে ও ফটো তুলে, আমরা ওপরে রাস্তায় ফিরে এলাম। সামনের দিকে একটু এগিয়েই চার মাথা মোড়ের ডানদিকে ব্রিজ, ওই পথে আমাদের যেতে হবে। সোনম গাড়ি নিয়ে ব্রিজের ওপারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা ধীর পায়ে মোড়টায় গিয়ে হাজির হলাম। ভুটানে বিভিন্ন জোং, পার্ক, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বা বড় রাস্তায়, রাজা ও রানীর ছবি টাঙানো আছে দেখে এসেছি। এখানেও দেখলাম বেশ বড় একটা মজবুত ছবি, যত্ন করে রাস্তার পাশে লাগানো আছে। বামদিকের রাস্তার ওপর ফুন্টশলিং ও জয়গাঁওয়ের মাঝে অবস্থিত বিশাল ভুটান গেটের মতো দেখতে একটা গেট। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকের বেশ কিছু ছবি তুললাম। এরপর ধীরেসুস্থে চওড়া ব্রিজটার ওপর দিয়ে দু’পাশে দেখতে দেখতে ব্রিজের অপর পাড়ে গেলাম। পথ নির্দেশ দেওয়া সবুজ রঙের একটা বিশাল বড় বোর্ড এখানে লাগানো আছে। এখান থেকে বাম দিকে ‘হা’ ও ‘নাগু’ যাওয়ার পথ, এবং ডানদিকে পারো, তাক্তসাং, ও দ্রুগিয়েল জোং যাবার রাস্তা। এখন আমাদের গন্তব্য পারো, অর্থাৎ আমরা ডানদিকে যাব। ডানদিকে ঘোরার মুখে বাঁধানো একটা বোর্ডে দেখলাম, ওয়াংচু নদীর সঙ্গম স্থলের ওপর এই ব্রিজটি ইন্দ-ভুটান ফ্রেন্ডশীপ প্রজেক্ট হিসাবে পুনের একটি কোম্পানি, ১৯৮৯ সালের মে মাসে শুরু করে, ১৯৯০ সালের জুলাই মাসে কাজ শেষ করে। যাইহোক্ আমরা পারোর উদ্দেশ্যে যাবার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম।

বেশ কিছু পথ এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়ার পর, একসময় একটা ফাঁকা জায়গায় এসে সোনম হঠাৎ তার গাড়ি দাঁড় করালো। অনেকটা নীচ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। সোনম জানালো, যে এখানে কয়েকশ’ বছর আগে এক বিখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মগুরু এসে, নদীর ওপারে একটি জোং তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। সেইসময় নদীর ওপারে যাওয়ার প্রয়োজনে, একটা তারের ঝুলন্ত ব্রিজ তৈরি করা হয়। ব্রিজটি নষ্ট হয়ে বিপজ্জনক হয়ে যাওয়ায় পাশ দিয়ে অপর একটি ব্রিজ তৈরি করা হলেও, পরিতক্ত ব্রিজটির স্মৃতি রক্ষার্থে ভেঙে ফেলা হয়নি। বড় রাস্তা থেকে কিছুটা পথ নেমে আমরা একটা অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা ধরে হেঁটে ব্রিজটার কাছে গেলাম। নদীর দুই পাড়ে দুটি ঘরের মতো দেখতে জায়গার ভিতর থেকে তৈরি তারের মরচে ধরা বহু প্রাচীন ব্রিজটি, এখনও অতীতের সাক্ষ বহণ করে চলেছে। কাপড়ের তৈরি নানা রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ ঝোলানো তারের তৈরি নতুন ব্রিজটার কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে, আমরা নদীর অপর পাড়ে এসে উপস্থিত হলাম। এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তা ধরে সামান্য কিছুটা এগতেই, বহু পুরাতন একটি ছোট্ট, ও অন্যান্য আর পাঁচটা জোং-এর ধাঁচেই রঙ করা, জোং জাতীয় দোতলা বাড়ি দেখা গেল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে গেলাম। গোটা জোংটায় কারও দেখা পেলাম না। ঝাঁচকচকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গোটা বাড়িটায় অল্প কিছু তৈলচিত্র ছাড়া, বিশেষ কিছু দেখার নেই। অন্যান্য জোং-এর মতো, এখানেও দেখলাম ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। তবে এটা পরিতক্ত নয়, এবং সম্ভবত প্রতিদিন পূজাআর্চা হয় বলেই মনে হলো। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় দেখলাম পুরাতন ঝুলন্ত ব্রিজটা যাতে ভেঙে না পড়ে যায়, তার জন্য কি অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় মোটা লোহার চেন দিয়ে এই বাড়িটার সাথে বাঁধা হয়েছে। মূল জোংটি কিন্তু অনেকটা ওপরে। মহিলারা ওপরে উঠতে রাজি না হওয়ায়, আমি ও তরুণ সোনমের সাথে জোংসন্দর্শনে ওপরে চললাম। সোনম আমাদের জোং-এর কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। বহু পুরাতন জোংটির মূল দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে একটা কমলা লেবু গাছে দেখলাম অজস্র কমলা লেবু হয়ে আছে। দরজার বাইরে জুতো ও টুপি খুলে, ভিতরে প্রবেশ করলাম। দরজার ঠিক কাছেই একজন আমাদের দেখে, তাঁর ছেলেকে ডেকে দিলেন। অল্প বয়সি যুবকটি সামনের একটা দরজা দিয়ে এসে, বাঁপাশের দরজা খুলে আমাদের নিয়ে জোং-এর ভিতর প্রবেশ করলো। এখানেও বুদ্ধমুর্তি ছাড়া বেশ কিছু তৈলচিত্র আছে। আর আছে ভুটানের রাজার ছোট্ট শিশু পুত্র সমেত তিন প্রজন্মের ছবি। এখন পর্যন্ত সমস্ত জায়গার জোংগুলোর অদ্ভুত সব তৈলচিত্র, এবং তার রঙের ব্যবহার দেখে অবাক হতে হয়েছে। সামনেই একটা দানপাত্র রাখা আছে, তাতে কিছু টাকা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। এতো নিস্তব্ধ ও শান্ত পরিবেশ ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু উপায় তো নেই। আমরা জোং থেকে বেরিয়ে আসলে, ছেলেটি জোং-এর দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে সামনের অংশের ভিতরে চলে গেল। সম্ভবত এরা এখানেই বসবাস করে ও জোংটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পূজোআর্চা করে থাকে। জুতো পরে বাইরে এসে কিছু ছবি তুলে নীচে প্রায় গাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলাম, মাথার টুপিটা পকেট থেকে কোথায় পড়ে গেছে। টুপি পড়ে জোং-এ ঢোকা নিষেধ, তাই পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। টুপি হারানোর ঘটনা শুনে সোনম আবার ওপরে গিয়ে টুপি উদ্ধার করে ফিরে এলো। নীচে এসে ব্রিজ পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে গাড়ির কাছে এলাম। জোং থেকে নদীর অপর পাড়ের এই রাস্তার দূরত্ব অনেকটা। এতক্ষণ গাড়ির ছাদে সমস্ত মালপত্র সমেত গাড়িটা নির্জন একটা জায়গায় রাখা ছিল। জানি না, এটা আমাদের দেশে, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে, কবে সম্ভব হবে।

আমরা আবার এগিয়ে চললাম। রাস্তায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ফল কিনে নিলাম। দোকানের বৃদ্ধা বিক্রেতার দেখলাম ফল বিক্রির থেকে নিজের ছবি তোলায় বেশি আগ্রহ। তাঁর ইচ্ছা মতো কিছু ছবি তুলে তাঁকে দেখাতে, ফলের দাম এক পয়সাও কমালেন না বটে, তবে বেশ খুশি হলেন। আমাদের গাড়ি সম্ভবত পারো শহরের কাছাকাছি চলে এসেছে। পারোতে আমাদের ‘হোটেল সীজনস্’ নামে একটা হোটেল বুক করা আছে। যদিও ‘হোটেল অল্ সীজনস্’ লেখা যে রূম কনফার্মেশন ভাউচারটা মেল ও হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠানো হয়েছে, তাতে মাঝের ‘অল’ কথাটা পেন দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে। যাবার পথে সোনম একবার তার গাড়ি থামিয়ে, আমাদের নেমে সামান্য দূরে নদীর ধারে যেতে বললো। এখানে নদীটি প্রায় রাস্তার পাশেই বলা যায় এবং রাস্তা থেকে সামান্যই নীচে। সোনম জানালো নদীর জলে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ থাকলে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়, পায়ের ব্যথা কমে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কি কি যেন উপকার পাওয়া যায়। বালি ও পাথরের ওপর দিয়ে নদীর তীরে গিয়ে হাজির হওয়া গেলেও, জুতো মোজা খুলে জলে নামা বেশ অসুবিধাজনক। কিন্তু জলে নামার ব্যাপারে তরুণের আগ্রহ দেখলাম সবথেকে বেশি। হয়তো সোনমের নির্দেশে এক কিলোগ্রাম গ্রাউন্ড আপেল কিনে ও তার সিংহভাগ নিজে উদরস্থ করে সে উপকৃত। যেটুকু ঘাটতি আছে, তা বোধহয় এই নদীর জলে পা ডুবিয়ে পূরণ করে নিতে চায়। তাই সীমাকে জুতো খুলিয়ে নিজে জুতো খুলে, ‘আশিতে আসিও না’ সিনেমার ভানু ব্যানার্জীর মতো সীমার হাত ধরে বালি ও পাথরের ওপর দিয়ে, নদীর জলে গিয়ে হাঁটু জলে নেমে পড়লো। ওর উৎসাহ দেখে একে একে সবাই নদীর জলে নেমে পা ডোবালাম। একদিকে গাছপালা ঢাকা অপর দিকে প্রায় নেড়া পাহাড়ে ঘেরা অসাধারণ সুন্দর জায়গাটার মাঝখান দিয়ে অপরূপ সুন্দরী নদীটি তিরতির করে বয়ে চলেছে। জলের গভীরতা সামান্য হলেও, আকাশ ও গাছপালার রঙে রঙ মিলিয়ে সে কোথাও নীল, কোথাও বা আবার সবুজ। আমরা যেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছি, সে দিকটায় নেড়া পাহাড় কেটে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। নদীর অপর পাড়টা সবুজ, ওইদিকে কোন গ্রাম বা লোকালয় আছে। আমরা আসার সাথে সাথে, গাড়ি নিয়ে পনেরো-বিশ জনের একটা বড় দল এসে হাজির হলেন। গাড়ি থেকে নেমেই তাঁরা হইচই করতে করতে নদীর পাড়ে চলে এলেন। মহারাস্ট্র থেকে এনারা সটান ভুটান দর্শনে চলে এসেছেন। আমরা নদীর পাড়ে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, রাস্তায় এসে একটু ঘোরাফেরা করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সোনম গাড়ি ছাড়ার আগে নদীর দিকে আঙুল দেখিয়ে হঠাৎ বললো, ওই লেড়কি আজ কতো টাকা রোজগার করে নিলো দেখেছো? তাকিয়ে দেখি একটা বছর কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে, একটা রোপওয়ের মতো জিনিসের সাহায্যে মহারাস্ট্র থেকে আসা যাত্রীদের নদীর এপার থেকে ওপারে নিয়ে গিয়ে, আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত একটা মোটা তার টাঙানো আছে। ওই তারে একটা কাঠের তক্তা দু’টো আঙটা দিয়ে ঝোলানো। এই তক্তায় একজনকে বসিয়ে নিজে পিছনে বসে, কপিকলের মতো চাকার সাহায্যে অপর পারে নিয়ে গিয়ে আবার ফিরিয়ে আনছে। একটু আগে এটা লক্ষ্য করিনি। সোনম জানলো যে মেয়েটা নদীর ওপারে থাকে, একসাথে এতগুলো মানুষের হঠাৎ আগমন হওয়ায়, সে ওপার থেকে এসে রোপওয়েটা চালু করে দিয়েছে। মোটা তার থেকে লোহার আঙটা দিয়ে ঝোলানো কাঠের তক্তাটা সম্ভবত নদীর ওপারে রাখা ছিল।

নদীর ওপারটা একবার দেখার বড় লোভ হলো। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ কবিও বলেছেন যে “ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস”। আমি, তরুণ, ও পুপু গাড়ি থেকে নেমে আবার নদীর পারে গিয়ে হাজির হলাম। মহারাস্ট্র থেকে আসা দলটি দেখলাম প্রথম দিকে নাহি চাপেঙ্গে নাহি চাপেঙ্গে করে, একে একে সকলেই তক্তায় চেপে নদী পারাপার করতে শুরু করলো। অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য শালপাতার বাটি হাতে না পেয়ে, যারা  ফুচকা বিক্রেতার পাশে তীর্থের কাকের মতো লোভাতুর দৃষ্টিতে সুযোগের আশায় অপেক্ষা করে, আমরাও ঠিক সেইভাবে সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। যাইহোক, অবশেষে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে নদী পারাপার পর্বও একসময় শেষ হলো। এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা গাড়িতে এসে বসলে, গাড়ি ছেড়ে দিলো। অবশেষে তামজুলাখাং, শাবা, বন্ডে হয়ে, একসময় আমরা পারো শহরে এসে পৌঁছলাম। নির্দিষ্ট হোটেলে ঢোকার আগেই সোনম তার গাড়ি পারো হ্যান্ডিক্র্যাফট্ এম্পোরিয়ামের সামনে দাঁড় করালো। সারাদিন পর এখন আর আমাদের এই হাতের কাজ বা শিল্পকর্ম দেখার খুব একটা উৎসাহ না থাকলেও, ভিতরে ঢুকলাম। প্রথম ঘরে দেখলাম জাতীয় পোষাক পরে ছবি তোলার জন্য সেই আলখাল্লা জাতীয় পোষাক ভাড়া দেওয়া হয়, তবে তার ভাড়া মাত্র দু’শ’ টাকা। আমরা ভিতরের দ্বিতীয় ঘরটায় প্রবেশ করলাম। বিশেষ উল্লেখযোগ্য সামগ্রী সেরকম কিছু না থাকলেও, জিনিসগুলোর মূল্য অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তবে এখানেও দেখলাম পুনাখার সোবসোখার মতো ছবি ও কাঠের তৈরি পুরুষলিঙ্গ সাজিয়ে রাখা আছে, এবং অল্প বয়সি মহিলা বিক্রেতার সাথে পুরুষদের দরদাম নিয়ে দিব্য আলোচনা চলছে। এখানেও লজ্জার মাথা খেয়ে সর্বত্র এগুলো বিক্রির কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। যাইহোক্ এখান থেকে বেড়িয়ে পারো শহরের বুকে হোটেল সীজনস্ এর তিন তলায় পাশাপাশি দুটি ঘরে, কথামতো ঘরপিছু পনেরোশ’ টাকা ভাড়ায় গিয়ে মালপত্র নিয়ে ওঠা গেল। ঘরদুটো প্রয়োজনীয় আসবাব দিয় বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে সাজানো, বাথরূম বা বিছানাও বেশ পরিস্কার। অফ সীজন, তাই অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও ঘর অনুযায়ী ভাড়া যে অনেকটাই কম, অস্বীকার করার উপায় নেই। এই হোটেলটাতে একটাই অসুবিধা, শুধুমাত্র নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। সারাদিন বিশেষ কিছু পেটে পড়েনি, তাই দোতলার ডাইনিং হলে গিয়ে কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে আসলাম। কিছুক্ষণ পরে ঘরে খাবার দিয়ে গেল। খাওয়া হয়ে গেলে সীমার বানানো কফি খেয়ে, আমি আর তরুণ চললাম জায়গাটা একটু ঘুরেফিরে রাতের খাবরের একটা ভালো হোটেলের সন্ধানে। এখানে পৌঁছে সোনম জানিয়েছিল যে সামনেই হোটেল ড্রাগন, সেখানে ভালো খাবার ন্যায্য মূল্যে পাওয়া যায়।

বাইরে বেশ ঠান্ডা। আমি আর তরুণ এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে ঘুরে, রাতের পারো শহরটাকে একটু দেখলাম। আমাদের হোটেল থেকে খানিকটা এগিয়ে ডানদিকে অনেকটা ওপরে রাতের আলোয় সুসজ্জিত পারো জোংকে দেখে মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। শেষে হোটেলে ফেরার পথে সোনমের কথা মতো, হোটেল ড্রাগনের সন্ধানও খুঁজে বার করলাম। হোটেলটি আমাদের হোটেলের খুব কাছেই অবস্থিত। হোটেলটির মাঝ বয়সি মালিকটি বাঙালি, এগারো বছর বয়সে নাকি মাদারি হাটের বাড়ি থেকে ভুটানে পালিয়ে এসে এখানেই বসবাস শুরু করে। ভদ্রলোক বেশ মিশুকে। আমাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার ফাঁকে জানালেন, যে তিনি ভুটানের এক মহিলাকে বিবাহ করে এখানেই রয়ে গেছেন। পারো বিমান বন্দরের কাছে কোথায় নাকি আর একটা বড় সুসজ্জিত হোটেল নতুন খুলেছেন। যাইহোক্, রাতের খাবারের ব্যাপারে বিশদ খোঁজখবর নিয়ে, আমরা নিজেদের হোটেলে ফিরে এলাম। পারো আসার পথে সোনমকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে আগামীকাল সকালে আমরা পারোর এই হোটেল ছেড়ে দিয়ে চেলালা পাস হয়ে ‘হা’ তে চলে যাব। ওখানেই আগামীকাল রাতটা কাটিয়ে, পরশু আবার আমরা এই সীজনস্ হোটেলেই ফিরে আসবো। ফুন্টশলিং-এ গাড়ি বুক করার আগেই কথা প্রসঙ্গে সোনম জানিয়েছিল, যে চেলালা পাস যাওয়ার রাস্তায় অত্যাধিক বরফ জমে থাকার জন্য চেলালা পাস যাওয়া যাচ্ছে না। চেলালা পাস থেকে হা শহরের দূরত্ব আরও ছাব্বিশ কিলোমিটার। হা তে থাকার জন্য অবশ্য কোন হোটেলের সাথে এখনও পর্যন্ত কথা হয়নি। আগামীকাল সকালে তাই হা শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে থাকলেও, বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে কী না সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। দোতলার রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে আমরা জানালাম যে আগামীকাল সকালে আমরা এই হোটেল ছেড়ে দিয়ে হা চলে যাবো। পরশু সকালে হা থেকে সরাসরি আবার এই হোটেলেই ফিরে আসবো। কাজেই পরশু যেন আমাদের জন্য এই দুটো ঘর একই শর্তে রেখে দেওয়া হয়। হা শহরে যাওয়া যাচ্ছে কী না, এরা সঠিক বলতে পারলো না। আমরা হোটেলের বিল মিটিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। হোটেল ড্রাগন একটু রাত পর্যন্ত খোলা থাকে, তাছাড়া এখানে এসে এই হোটেলেও কিছু খাওয়ার জন্য, একটু রাত করেই ড্রাগন অভিমুখে যাত্রা করলাম। ভদ্রলোক আমাদের বেশ আপ্যায়ন করেই খাওয়ালেন। শুধু তাই নয়, শেষ পাতে বিনি পয়সায় বেশ গরম গরম গুলাব জামুনও দিয়ে গেলেন। বাইরে বেশ ঠান্ডা, আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আগামীকাল সকাল সকাল বেরতে হবে, তাই কিছুক্ষণ গুলতানি করে মালপত্র গোছগাছ করে, যে যার বিছানায় লেপের তলায় ঢুকলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের ষোল তারিখ। অন্যান্য দিনের মতোই ঘুম ভাঙলো তরুণের ডাকে, তবে আজ কিন্তু গরম কফি হাতে নয়। ওদের ঘরের বাথরূমে জল নেই, আমাদের বাথরূমে জল থাকায়, ও আমাদের বাথরূম ব্যবহার করতে এসেছে। সোনম ফোন করে নীচে নেমে আসার জন্য জানিয়ে দিয়েছে। যাহোক্, ইতিমধ্যে তরুণদের ঘরেও জল এসে যাওয়ায়, একে একে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। মালপত্র নিয়ে নীচে গাড়ির কাছে এসে হাজির হয়ে দেখলাম, সোনম গাড়ি থেকে বরফ ঝেড়ে পরিস্কার করছে। আমরা সোনমকে আমাদের সাথে জলখাবার খেতে যাওয়ার কথা বলতে, সে যথারীতি আমাদের সঙ্গে না গিয়ে জানালো, যে সে ব্রেকফাস্ট করে এসেছে। সময় নষ্ট না করে আমরা যেন ব্রেকফাস্ট করতে চলে যাই, সে গাড়িতে মালপত্র গুছিয়ে তুলে হোটেল ড্রাগনের কাছে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে গেলাম। গরম গরম লুচি, আলুর চচ্চরি, ও গুলাব জামুন দিয়ে জমিয়ে প্রাতরাশ সেরে বাইরে এসে দেখি, সোনম গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত।

চেলেলা পাস হয়ে হা শহরের উদ্দেশ্যে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আমরা এগিয়ে যাওয়ার পথে সোনম জানালো, চেলেলা পাস যাওয়া যাচ্ছে কী না, ও এখনও সঠিক খবর পায়নি। এই চেলেলা পাস যাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে ওর সেই ফুন্টশলিং থেকে সন্দেহ লক্ষ্য করে আসছি। ও অবশ্য সেদিনও জানিয়েছিল, এখন এই মুহুর্তেও জানালো যে রাস্তায় সেরকম বরফ জমে থাকলে সে যতদূর গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নিয়ে যাবে। যাওয়ার পথে কথাবার্তার মধ্যে ওর কাছ থেকে সকালে আমাদের হোটেলে জল না থাকার ব্যাপারে ও জানালো, যে রাতের ঠান্ডায় জলের পাইপগুলোর ভিতরে জল জমে বরফ হয়ে থাকে। তাই বরফ না গলা পর্যন্ত পাম্প চালানো হয় না। ওই অবস্থায় পাম্প চালালে পাইপগুলো ফেটে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাই প্রতিটা হোটেলেই একটু বেলায় পাম্প চালানো হয়ে থাকে।

একসময় আমরা পারো বিমান বন্দরের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। অনেকটা ওপরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই বিমান বন্দরটা দেখতে হয়। তা হোক্, তবু এতেই আমি খুশি, কারণ বেশ কিছুদিন আগে গুগল থেকে দেখেছিলাম, যে পৃথিবীর প্রথম আটটা বিপজ্জনক বিমান বন্দরের মধ্যে ভুটানের পারো বিমান বন্দর একটি। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট অঞ্চল নিয়ে এই বিমান বন্দর। আমাদের কপাল সত্যিই খুব ভালো, নীচে বিমান বন্দরে গাড়ি পার্কিং এলাকায় হাজার মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও, রানওয়ের পাশে একটা ছোট্ট বিমান দাঁড়িয়ে আছে। সোনম জানালো একটু পরেই বিমানটা উড়ে যাবে। ক্যামেরার লেন্সে বিমানে লোক ওঠানামার দৃশ্যও বেশ পরিস্কার দেখতে পেলাম। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, বিমানটাকে রানওয়ের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে আবার যেদিক থেকে এসেছে সেদিকেই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড় করানো হলো। অন্যান্য বিমান বন্দরে যেমন রানওয়ের ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা রাস্তা ছুটে গিয়ে বিমানের গতি বাড়িয়ে হঠাৎ শুন্যে উড়ে যায়, এখানে কিন্তু সে সুযোগ নেই। খুবই ছোট এলাকা নিয়ে এই বিমান বন্দরটি হওয়ায়, রানওয়েও একবার ছোট্ট। ফলে প্রায় প্রথম থেকেই তীব্র গতিতে বিমানটি এগিয়ে এসে রানওয়ের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুন্যে উড়ে গেল। রানওয়ের প্রায় শেষপ্রান্ত থেকেই পাহাড়, আর তার চুড়ার ওপর দিয়েই তাকে যেতে হবে। আতঙ্কে জিভের নীচে একটা সরবিট্রেট রাখবো কিনা ভাবছি, দেখলাম ওই পাহাড়টার উচ্চতম জায়গাটা দিয়ে বিমানটা পাখির মতো কি সুন্দর নিরাপদে উড়ে চলে গেল। এখানে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। পাশেই এগ্রিকালচারাল মেসিনারি ট্রেনিং সেন্টারের বিশাল গেট। বিমান বন্দরের কাছে অনেকটা নীচে অনেকটা জায়গা নিয়ে ধাপে ধাপে চাষের জমি ও ছোট ছোট অনেকগুলো সুন্দর রঙ করা ঘরবাড়ি। সোনম জানালো ওখানে ফ্রুট প্রশেসিং করা হয়। বিদেশ থেকে আনা অত্যাধুনিক ও মূল্যবান যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিদেশিদের পরিচালিত ওই কারখানায় একমাত্র পাশের এগ্রিকালচারাল মেসিনারি ট্রেনিং সেন্টার থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। যাইহোক, এবার আমাদের চেলেলা পাস হয়ে হা শহরের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাবার পালা।

ধীরে ধীরে বেশ কিছুটা পথ পার হওয়ার পর থেকেই রাস্তার দুপাশে বরফ জমে আছে দেখা গেল। এই জমে থাকা বরফের পরিমান ক্রমে বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। সোনম জানালো, যে জায়গায় গাছের পরিমান যত বেশি, সেই জায়গায় বরফ গলতে তত বেশি সময় লাগে। গাছের জন্য বরফের ওপর সূর্যালোক না পড়ায়,  ওই জায়গাগুলো বরফে ঢাকা থেকেই যায়। রাস্তার দুপাশে গাছের পরিমানও যথেষ্ট। এইভাবে বরফে ঢাকা রাস্তা দিয়ে আরও দীর্ঘ পথ পার হয়ে আসার পর সোনম জানালো, যে এরপর এই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি যথেষ্ট। সে জানতে চাইলো যে আমরা কি করবো। লেহ্-লাদাখ ট্যুরে খারদুংলা হয়ে যাওয়ার পথে, এর থেকে অনেক পুরু ও কঠিন বরফের ওপর দিয়ে আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার্স গাড়ি জিগমে নামে একটা বাইশ বছরের ছেলে চালিয়ে নিয়ে গেছিল। সামনে মিলিটারির কিছু ব্যাক্তি বরফ কেটে রাস্তা পরিস্কার করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রচুর গাড়ি, এমনকী মিলিটারি গাড়িগুলো পর্যন্ত খুব ধীরে সেই রাস্তার ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ কেউ আবার পিচ্ছিল রাস্তার জন্য চাকায় লোহার চেন পর্যন্ত বেঁধে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। মোটকথা সেখানে বিপদে পড়লে সাহায্য করার বা রাস্তা পরিস্কার করার লোক কিছু ছিলো, কিন্তু এখানে তো সে সব ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। রাস্তায় গাড়ি চলাচলের পরিমানও প্রায় নেই বললেই চলে। সবথেকে বড় কথা, আজ চেলেলা পাস হয়ে হা শহরে যাওয়ার পর যদি রাতে আরও বেশি বরফ জমে, তাহলে আগামীকাল পারো ফিরে আসা মুশকিল হতে পারে। অর্থাৎ আমাদের আগামী পরশুর টাইগার নেস্ট যাওয়ার পরিকল্পনা সেখানেই ইতি। বাধ্য হয়ে সোনমকে বললাম, যে গাড়ি সে চালিয়ে নিয়ে যাবে, কাজেই সে যা ভালো বুঝবে, আমরা সেটাই মেনে নেবো। সোনম খুব ধীরে ও সাবধানে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললো। রাস্তার ধারে বেশ বড় বড় পাইন জাতীয় গাছগুলোকে বরফের ভিতর পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, চেলেলা ও হা দেখার আশার আলো ক্রমশই মলিন হতে শুরু করলো। এইভাবে চেলেলা পাস যখন আর মাত্র তেরো কিলোমিটার দূরে, আমাদের গাড়ির চাকা হঠাৎ পিছলে গেলে সোনম শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে বিপদ কাটিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো। সে এবার পরিস্কার জানালো, যে আর বেশি গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। সীমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে বুঝতে পারছি, কিন্তু যার হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, সে যদি নিজে ভয় পায়, তাহলে তাকে জোর করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পরে বলে আমি মনে করি না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। একটু পড়ে দু-তিনটে গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। আমরা সোনমকে বললাম, যে ওরা তো গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল। উত্তরে সে শুধু বললো ওগুলো সব বড় গাড়ি, তোমরা একটাও ছোট ট্যুরিস্ট গাড়িকে এখনও যেতে দেখেছো? এটাও সত্য, এখনও পর্যন্ত আমাদের মতো কোন গাড়িকে না যেতে দেখেছি, না ওপর থেকে আসতে দেখেছি। আগামীকাল বা পরশুর কথা ভেবে সোনমের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বাধ্য হলাম। বরফের ওপর শুয়ে বসে ঘুরেফিরে আরও অনেকটাই সময় কাটানো হলো। এবার আবার সেই পারোর উদ্দেশ্যেই যাত্রা করলাম।

পথে গাড়ি থেকেই পারোর হোটেল সীজনসে ফোন করে আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা জানিয়ে, আজ সকালে আমাদের ছেড়ে আসা ঘরদুটো একই শর্তে আমাদের জন্য পরিস্কার করে রেখে দিতে বলা হলো। পুরাতন রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে একসময় আমরা আমাদের পরিচিত হোটেলটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে, যে যার ঘরে নিজেদের মালপত্র রেখে নীচে নেমে এলাম। চেলালা বা হা শহরে যখন যাওয়াই গেল না, তখন ঘরে বসে সময় নষ্ট না করে পারোর যতটা ঘুরে দেখা যায়। এবার সেই বিখ্যাত রিনপুং জোং। জোং কথার অর্থ হলো বৌদ্ধ মন্যাস্ট্রি ও দুর্গ, এই রিনপুং কথার অর্থ নাকি রত্নের স্তুপ। এই জোং-এ প্রবেশের জন্যও মাথাপিছু তিনশ’ টাকা করে টিকিট কাটতে হলো। পারো শহরের এই জোংটিও আয়তনে বেশ বিশাল। পুনাখাতেও দেখেছি আবার এখানেও দেখছি, এই জোংগুলি ঠিকভাবে খুটিয়ে দেখতে গেলে, হাতে একটা গোটা দিন সময় নিয়ে আসতে হয়। মেঝে থেকে ওপরে ছাদের সিলিং পর্যন্ত গঠন ও রঙের কাজ এক কথায় অপূর্ব। হাতে অনেক সময় থাকায় সিঁড়ি ভেঙে জোং-এর ভিতর গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতিটা অংশ, বিশেষ করে তৈলচিত্রগুলি দেখলাম। জোংটির বিশালত্ব দেখলে অবাক হতে হয়। তবে একটা কথা আমার মনে হলো, পুনাখার সৌন্দর্যের কাছে পারোর এই জোং কিছুই না। এটা আমার ব্যক্তিগত মত, আর সকলের মতামত অন্যরকম হতেই পারে। আরও বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখে ও ছবি তুলে, একসময় আমরা বাইরে গাড়ির কাছে এসে হাজির হলাম। সোনম গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সোজা মিউজিয়ামে নিয়ে গিয়ে হাজির করলো। কিন্তু মিউজিয়ামটি সম্ভবত বিকাল চারটে পর্যন্ত খোলা থাকে। আমরা টিকিট কাউন্টারে গিয়ে হাজির হলে দেখলাম কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশের সিকিউরিটি গার্ড জানালেন, যে সময় হয়ে যাওয়ায় আজ আর ভিতরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তখনও বন্ধ করে দেওয়ার সময় পার হয়ে যায়নি, তবু কোন দর্শনার্থী না থাকায় বোধহয় একটু আগেই কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে মিউজিয়ামের ভিতর ঢুকতে বোধহয় একশ’ টাকা করে টিকিট লাগে। আমার সঙ্গীরা বোধহয় নিতান্তই ক্লান্ত, কারণ ভিতরে ঢুকতে না পারার জন্য কাউকেই বিশেষ দুঃখ পেতে দেখলাম না। আজকের মতো আমাদের পারো ঘুরে দেখা পর্ব মোটামুটি শেষ, একসময় আমরা আমাদের হোটেলের সামনে চলে এলাম। সোনম গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

কথামতো আমাদের আগামীকাল হা থেকে পারোতে ফেরার কথা ছিল। কপাল মন্দ, তাই আজই আমাদের পারোতে ফিরে আসতে হলো। এই অবস্থায় আগামী পরশুর পরিবর্তে আগামীকালই তাক্তসাং, অর্থাৎ টাইগার নেস্ট্ যাওয়া ঠিক করে, সোনমকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সোনম আমাদের বেশ সকাল সকাল তৈরি হয়ে থাকতে বলে গেছে। আমি আর তরুণ সন্ধ্যার পর এক ফাঁকে বেরিয়ে একটু ঘুরেফিরে আগামীকাল সকালের জলখাবার ও তাক্তসাং যাবার হাঁটা পথের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ড্রাই ফুড, লজেন্স, কমলা লেবু, ইত্যাদি কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। এখানে বেশ বড় বড় সুন্দর সব দোকান এবং মহিলারাই দোকানগুলো চালান। জিনিসপত্রও প্রচুর, কিন্তু পছন্দের জিনিসটি খুঁজেপেতে কাউন্টারে নিয়ে আসার দায়িত্ব ক্রেতার। খুঁজে না পেলে, অথবা হাজার প্রয়োজনেও মহিলা কর্মচারীদের উঠে গিয়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে দেখলাম না। অনেকগুলো বিস্কুটের ছোট ছোট প্যাকেট একটা পলিথিনের বেশ বড় সিল্ড প্যাকেটে রাখা আছে, ওর থেকে অল্প কিছু বিস্কুটের প্যাকেট নেওয়ার জন্য বড় প্যাকেটের সিল কেটে, আমাদের প্রয়োজনীয় প্যাকেট নিয়ে, বাকি অংশ নির্দিষ্ট তাকে গুছিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হলো। একটা বেশ ঝাঁচকচকে বড় দোকানে দেখলাম একটা তাকে যত বিস্কুটের প্যকেট আছে, তার অধিকাংশই ব্যবহারের মেয়াদ অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। আবার প্যাকেটের গায়ে নির্দিষ্ট বিক্রয় মূল্যের থেকে বেশি মূল্য দাবি করতেও কোন কোন দোকানে দেখলাম। একটু রাতের দিকে কালকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া পিঠের ব্যাগ গুছিয়ে রেখে, রাতের খাবার খেতে ড্রাগন হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এই ড্রাগন হোটেলে থাকার ব্যবস্থাও আছে, এবং তার ভাড়াও কিছু কম। কিন্তু আমাদের আর নেওয়ার সুযোগ না থাকায়, অনুরোধ সত্ত্বেও অহেতুক আর  দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। রাতের খাওয়া সেরে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে নিজেদের হোটেলে ফিরে এলাম। আগামীকাল বেশ সকাল সকাল বেরোতে হবে, তাই কিছুক্ষণ গুলতানি করে যে যার শয্যায় লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়াই শ্রেয় বিবেচনা করা হলো।

আজ ২০১৯ সালের সতেরোই জানুয়ারী। আজ আমাদের বেশ ভোরে টাইগার নেস্টের উদ্দেশ্যে বেরোনোর কথা। কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডায় সীমার তৈরি চা খেয়ে, সামান্য প্রাতরাশ সেরে সবার তৈরি হতে হতেই একটু বেলা হয়ে গেল। হোটেলের নীচে সোনম কিন্তু ঠিক সময় তার গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বলে জানিয়ে দিয়েছে। পারো শহর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার পথ দূরে, সম্ভবত ‘রামথাংখা’ নামক জায়গা থেকে টাইগারস্ নেস্টের উদ্দেশ্যে হাঁটা পথের শুরু। আমরা নীচে গিয়ে গাড়িতে বসলাম। আমাদের গাড়ি প্রায় ঘন্টাখানেক সময় পরে আমাদের নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে উপস্থিত হলো। বেলা অনেকটাই বেড়ে গেছে। আমাদের মূল সমস্যা একটাই, আমাদের সাথে তিনজন মহিলা আছে, যাদের মধ্যে দু’জনের প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়স, এবং হাঁটুর রীতিমতো সমস্যা। শুধু তাই নয়, তিনজনের মধ্যে দু’জন আগে কিছু ট্রেক করে থাকলেও, একজন আবার ট্রেকের সাথে পূর্বপরিচিত নয়। আমি জীবনে কিছু হয়তো ট্রেক করেছি, কিন্তু বাইপাস অপারেশন করা সাড়ে ছেষট্টি বছর বয়সে, মনোবল এখনও কিছু সঞ্চিত থাকলেও, শারীরিক বল যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, অস্বীকার করি কিভাবে?

যাইহোক, গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই কাউন্টার থেকে মাথাপিছু পাঁচ শত টাকা করে টিকিট কিনে নিলাম। টিকিট ছাড়া ওপরে যাওয়া যায় কী না জানি না। যাওয়া হয়তো যায়, কিন্তু টিকিট ছাড়া তাক্তসাং অর্থাৎ টাইগারস্ নেস্টের জোং-এর ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ওপরে গিয়ে টিকিট কাটার কোন ব্যবস্থা আছে কী না, জানা নেই। এরপরে লাঠি পিছু পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় বেশ শক্তপোক্ত পাঁচটা লাঠি নিয়ে নেওয়া হলো। ফেরার পথে ফেরৎ দিয়ে দিতে হবে। একশ’ টাকা দিলে অবশ্য লাঠির মালিকানা পাওয়া যায়।

যাত্রা শুরুর আগে কেউ বললো এখান থেকে প্রায় চার মাইল পথ, কেউ বললো সাড়ে চার কিলোমিটার পথ, কেউ আবার বললো ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতা অতিক্রম করে, ১০২৩২ ফুট উচ্চতায় এই বিখ্যাত জোংটি অবস্থিত। এটাকেই ভুটানের বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থান বলে মনে করা হয়। তিব্বতি ভাষায় তাক্তসাং কথার অর্থ নাকি বাঘের গুহা, বাঘ নিয়ে অবশ্য অনেক গল্প শোনা যায়। অষ্টম শতাব্দীতে গুরু পদ্মসম্ভব (গুরু রিনপোচে) তিব্বত থেকে বাঘিনীর পিঠে করে নাকি এই তাক্তসাং গুহায় এসে তিন বৎসর, তিন মাস, তিন সপ্তাহ, তিন দিন, তিন ঘন্টা তপস্যা করেন। পরবর্তীকালে ১৬৯২ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে প্রচলিত। বাঘ নিয়ে আরও গল্প আছে, এখন সেকথা থাক, তবে এতটা পথ এই খাড়াই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হবে শুনে, মহিলাদের মুখ চোখে বেশ দুশ্চিন্তার মেঘ চোখে পড়লো। আমরা এগিয়ে চললাম, ড্রাইভার সোনম, নীচে গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে বলে জানালো। সামান্য একটু পথ ওপরে উঠে একটু সমতল মতো জায়গায় দেখলাম, কয়েকটা ঘোড়া নিয়ে মালিকরা যাত্রীর আশায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঝ রাস্তায় অসুবিধায় পড়লে ঘোড়া পাওয়া যাবে কি যাবে না ভেবে, তাদের সাথে কথা বললাম। জানা গেল, মোটামুটি মাঝামাঝি দূরত্বে ক্যাফেটারিয়া পর্যন্ত ঘোড়া যায়, তারপরে আর যেতে দেওয়া হয় না। ঘোড়াকে যেতে দেওয়া হয় না, না ঘোড়া যেতে পারে না, ঠিক বোঝা গেল না। তবে ফেরার পথে কোন অবস্থাতেই ঘোড়ার পিঠে মানুষ তোলা হয় না। প্রতিটি ঘোড়ার জন্য ছয় শত টাকা করে ভাড়া দিতে হবে। ঘোড়া যাওয়া আসার গল্প শুনে, রাস্তা সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা করে নিয়ে, তিনজন মহিলার জন্য তিনটি ঘোড়া মোট পনেরোশ’ টাকায় ঠিক করে দেওয়া হলো। একটা ঘোড়ার দায়িত্ব আবার একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চার হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো। যাহোক্ ওরাও খুশি, আমরাও খুশি। ঘড়িতে এখন সকাল পৌনে দশটা, ওদের ঘোড়া এগিয়ে চললো, আমরা ক্যাফেটারিয়ার কাছে আমাদের জন্য ওদের অপেক্ষা করতে বলে দিলাম।

আমি আর তরুণ ধীরে সুস্থে এগিয়ে চললাম। অল্প রাস্তায় অনেকটা উচ্চতায় উঠতে হওয়ায়, স্বাভাবিক ভাবেই রাস্তা বেশ খাড়াই। প্রচুর গাছপালাযুক্ত লালচে মোরাম জাতীয় রাস্তা হলেও, ছোট বড় মেজ সেজ পাথরে ভর্তি। রাস্তায় অনেক বিদেশি ও বিদেশিনীর দেখা পেলাম। কেউ ঘোড়ার পিঠে, কেউ আবার নিজের পায়ে, তবে হেঁটে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সকলের দলের সাথেই, সেই আলখাল্লার মতো ওদের জাতীয় পোষাক পরিহিত গাইড আছে। বুঝতে পারছি, আমার হাঁটার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যের এবার বেশ অভাব। পিঠে যেটুকু মাল আছে, সেটাই বেশ ভারী ও কষ্টকর বলে মনে হচ্ছে। তরুণ আমার থেকে প্রায় বছর ছয়েকের ছোট, কাজেই ওর কষ্ট আমার মতো না হলেও, ওর হাঁটার মধ্যেও কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে লজেন্স মুখে দিয়ে এগতে হচ্ছে। একটা অল্প বয়সি ছেলে মেয়ের বেশ বড় একটা দলকে দেখছি বারবার রাস্তার পাশে পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। যদিও বিশ্রামের থেকে নিজেদের মধ্যে গুলতানি করতে, ও সেলফি তুলতেই তারা বেশি ব্যস্ত। একসময় আমাদের অতিক্রম করে তারা আবার এগিয়েও যাচ্ছে। বয়স বোঝা মুশকিল, তবে খুব বেশি বয়স নয়, এমন এক বিদেশি যুগলকে বারকতক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগতে দেখার পর দেখলাম, গাইডের সাথে সম্ভবত স্ত্রীকে এগিয়ে যেতে দিয়ে, স্ত্রীকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে, ভদ্রলোক ফিরে গেলেন। যাঁরা বেশ ভোর বেলা বেরিয়েছিলেন, তাঁদের এখনও কিন্তু ফেরার সময় হয়নি। তবে মাঝেমাঝেই উলটো দিক থেকে কিছু যাত্রীকে নীচের দিকে নেমে যেতে দেখছি, জানি না, তাঁরা শেষপর্যন্ত যেতে অক্ষম হয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে যাচ্ছেন কী না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দশ-বারো বছরের ছেলেটাকে, যে আমাদের দলের একজনের ঘোড়ার সাথে ওপরে গিয়েছিল, তার ঘোড়া নিয়ে নীচে ফিরে যেতে দেখলাম। সে জানালো, যে আমাদের দলের তিনজনকেই তারা ক্যাফেটারিয়ার কাছে ভালভাবে নামিয়ে দিয়েছে। এইভাবে গাছপালা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তা ভেঙে, একটা জায়গায় এসে আমরা একটা অল্পবয়সি ছেলে মেয়ের দলের সাক্ষাৎ পেলাম। এরা সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, সবাই ওদের দেশে আই.টি. সেক্টরে কাজ করে। তারা জানালো, যে তারা থিম্পুতে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে এসেছিল। টাইগারস্ নেস্ট্ না গেলে ভুটান আসা নাকি সার্থক হয় না, তাই তারা টাইগারস্ নেস্ট্ দেখে দেশে ফিরে যাবে। অনেকক্ষণ তাদের সাথে কথা বলে, তাদের দেশ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সময় কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। এইভাবে আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে, আমরা ক্যাফেটারিয়া অঞ্চলে এসে পড়লাম। উজ্জ্বল নানা রঙের রঙিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে গোটা জায়গাটা সাজানো, তবে ঠিক এই জায়গায় কিন্তু ক্যাফেটারিয়াটা অবস্থিত নয়। কাপড়ের ওপর সংস্কৃত ও সম্ভবত অন্য কোন ভাষায়, বুদ্ধের বাণী লেখা। বামদিকে টাইগারস্ নেস্ট্ যাওয়ার রাস্তা, ডানদিকের বাঁধানো সরু রাস্তা কিছুটা নীচে ক্যাফেটারিয়া পর্যন্ত গেছে। রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো অঞ্চলে নিজ দলের কাউকে না দেখে, কিছু ছবি তুলে ক্যাফেটারিয়া পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও কারো সন্ধান পেলাম না। ক্যাফেটারিয়ায় জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওখানে তিনজন মহিলার কোন দল আসেনি। এবার চিন্তা শুরু হলো। ওরা তবে গেল কোথায়? এতক্ষণে আমরা অর্ধেক পথ মাত্র এসেছি। এই পথটা ওরা ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাইয়ের মতো ঘোড়ায় চেপে আসলেও, বাকি অর্ধেক পথ ও গোটা ফেরার পথটা কিন্তু হেঁটে যেতে হবে। তরুণ বললো আমাদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ওরা নিশ্চই এগিয়ে গেছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, সময়ের অপচয় কিছুটা হলেও কমলো। তরুণের কথায় এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা পথ ভেঙে ওপরে উঠে দেখলাম, দুটো বেঞ্চিতে ওরা বসে আছে। আমরাও বসে সবাইকে কমলা লেবু দিলাম। আরও কিছুক্ষণ বসে, ওদের তাড়া দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাম। ওদের মুখ চোখ, ওদের হাঁটার গতি ও চলার ছন্দ জানিয়ে দিচ্ছে, যে ওরা এর মধ্যেই বেশ ক্লান্ত। পাথুরে রাস্তা ভেঙে ওদের সাথে সাথে কখনও হাত ধরে সাহায্য করে, কখনও মৌখিক উৎসাহ দিয়ে, ওদের এগিয়ে নিয়ে চলেছি। ধীরে ধীরে ওদের গতি ক্রমশঃ কমতে শুরু করলেও, বেলা কিন্তু বাড়তে লাগলো। হঠাৎ উলটো দিক থেকে একটা বাঙালি ছেলেদের দল এসে হাজির হলো। মুখোমুখি এসেই তাদের কথা শুরু হলো। এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, অন্যকে নিরুৎসাহ করার মধ্যেই যাঁরা নিজেদের ভ্রমণ, বিশেষ করে ট্রেকিং-এর সার্থকতা খুঁজে পান। এরাও দেখলাম সেই প্রজাতির মানুষ। মহিলাদের খুব কষ্ট করে চড়াই ভাঙতে দেখে তারা সাহেবি কেতায় শুরু করে দিল — আপনাদের হ্যাটস্ অফ্! ধীরে ধীরে এগিয়ে যান। খুব কষ্টকর রাস্তা কাকিমা। সামনেই সাতশ’ ষাটটা সিঁড়ি ভেঙে আপনাদের মন্দিরে যেতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বাড়িতে চুয়ান্নটা সিঁড়ি ভেঙে আমার ফ্ল্যাটে উঠতে হয়। দিনে বেশ কয়েকবার আমাকে উপর নীচে যাতায়াত করতে হলেও, আমার উনি আবার সিঁড়ি ভাঙার ভয়ে, নানা অজুহাতে নীচে নামতে চান না। এহেন একজন মানুষকে হঠাৎ সাতশ’ ষাটটা সিঁড়ি ভাঙার গল্প শোনালে, তার মানসিক অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। তাদেরকে কোনরকমে বিদায় করে আমরা এগিয়ে চললাম।

ধীরে ধীরে হাত ধরে, প্রয়োজন মতো সাহায্য করে, একসময় আমরা সেই জায়গাটায় এসে পৌঁছলাম, যেখান থেকে মন্দিরগুলোর গঠনশৈলী সবথেকে পরিস্কারভাবে দেখে মুগ্ধ হতে হয়, সাথে আবার শ’য়ে শ’য়ে পাথুরে সিঁড়ি নীচে নেমে যেতে দেখে আতঙ্কিতও হতে হয়। একটা নিরেট তেলতেলে শক্ত পাথরের প্রায় খাঁজহীন পাহাড় যেন অনেক ওপর থেকে সোজা নীচ পর্যন্ত নেমে গেছে, আর তার প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়, কেউ যেন কিছুটা জায়গা তরোয়াল দিয়ে কেটে সমান করে এমন ভাবে মন্দিরগুলো (জোং) তৈরি করেছে, যে দেখে মনে হবে, মন্দিরগুলো পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে। আতঙ্কের আরও কারণ আছে। অনেক সিঁড়ি ভেঙে নামার পর, তুলনায় সংখ্যায় কিছু কম হলেও, আবার কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে জোং-এর প্রান্তে যেতে  হবে। আহা! আমাদেরও যদি একটা করে বাঘ বা বাঘিনী, নিদেন পক্ষে গুপি-বাঘার মতো জুতো থাকতো, তাহলে বেশ হতো। বিভিন্ন রঙের রঙিন কাপড় বাঁধা একটা ব্রিজ মতো পার হয়ে, আমরা গুনে গুনে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে শুরু করলাম। বাঁপাশে একটা ঝরনার জল, অনেকটা জায়গায় বেশ উঁচু বরফ হয়ে জমে আছে। অল্প কিছু সিঁড়ি ভেঙে নামার পরেই, মহিলাদের সিঁড়ি ভাঙায় সাহায্য করতে গিয়ে, সিঁড়ির সংখ্যা গোনার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। আগেই শুনেছিলাম সাতশ’ সিঁড়ি ভাঙতে হয়, একটু আগে বাঙালি ছেলেদের দলটার কাছে শুনলাম, সাতশ’ ষাটটা সিঁড়ি। এখন তো দেখে মনে হচ্ছে সংখ্যাটা কিছু বেশি হলেও হতে পারে।

ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় নিয়ে পাশের রেলিং ধরে বা আমাদের কাঁধ ও হাতের ওপর চাপ দিয়ে নামতে সাহায্য করে, একসময় আমরা ওদের দু’জনকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা পর্ব শেষ করতে সমর্থ হলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে, এবার শুরু হলো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার পালা। ওদের অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে, কষ্টও হচ্ছে, কিন্তু আমি জানি, এই কষ্টের রেশ কয়েকদিন পরেই মুছে যাবে, কিন্তু সারা জীবন এই জায়গায় আসা ও তার আনন্দের রেশ বেঁচে থাকবে। হাত ধরে টেনে টেনে বিকেল প্রায় সোয়া তিনটে নাগাদ ওদের ওপরে উঠিয়ে নিয়ে আসতেও সমর্থ হলাম। বেশ বিকেল হয়ে গেছে, ফেরার পথে এবার আবার অনেক বেশি সংখ্যক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। তাছাড়া ফেরার পথে সমস্ত পথটাই ওদের হেঁটে যেতে হবে। তাই এখানে আর বেশি সময় ব্যয় করা চলবে না। কাউন্টারে টিকিট দেখাতে, আমাদের হাতে একটা ছোট তালা দিয়ে পাশের লকারে ক্যামেরা, মোবাইল ইত্যাদি সবকিছু রেখে তালা দিয়ে দিতে বলা হলো। অনেকগুলো লকার, কিন্তু অধিকাংশেরই তালা দেওয়ার আঙটাটি ভাঙা। যাইহোক মালপত্র ভিতরে রেখে ওপরে উঠে, একে একে সবক’টা মন্দির দেখে নিলাম। মূল মন্দিরটির বিরাট বুদ্ধমুর্তিটির মাথা ছাড়া বাকি অংশটি সোনার তৈরি বলে মনে হলো। এত শান্ত পরিবেশে আরও বেশ কিছুটা সময় কাটাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু উপায় না থাকায়, ওদের একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিয়ে, কাউন্টারের কাছে নেমে এলাম। লকার থেকে মালপত্র বের করে নিয়ে চাবি ও তালা ফেরৎ দিয়ে দিলাম। সঙ্গে অল্প জল থাকলেও, কিছুটা জল ভরে নেবার ইচ্ছা ছিল। পাশে হোলি ওয়াটার লেখা খাবার জলের জায়গা থাকলেও, জুতো খুলে সেখান থেকে মগে করে জল ভরে আনা বেশ অসুবিধাজনক। ঘড়িতে এখন প্রায় পৌনে চারটে বাজে, তাই ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় জলের যথেষ্ট অভাব, তাই এখানে খাবার জলের ব্যবস্থাটা অনেক সহজলভ্য হওয়া উচিৎ বলে মনে হলো।

এবারও প্রথমে সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে, তবে পরবর্তী পর্যায়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তে, মহিলাদের কথা ভেবে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মন্দির অঞ্চলে এক অল্প বয়সি স্বামী স্ত্রী ছাড়া, অল্প কয়েকজনকে দেখা গেল। তবে তারা স্থানীয় মানুষ বলেই মনে হলো। একদল সম্ভবত ভারতীয় অবাঙালি যাত্রীকে এতক্ষণে ওপরে উঠে আসতে দেখলাম। আসার পথে অনেককেই ওপরে ওঠার জন্য হেঁটে আসতে দেখেছিলাম, যাদের এখন পর্যন্ত আর এখানে আসতে দেখলাম না। বুঝলাম অনেকেই মাঝপথ থেকে বা শেষ প্রান্ত থেকে, ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। নীচে নামার সিঁড়িও একসময় শেষ হলো, আমাদের বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মতো সমান উচ্চতার সিঁড়ি হলেও তবু একরকম ছিল, কিন্তু এই সিঁড়ির উচ্চতা তো একেকটা একেক মাপের। এবার ওঠার পালা, নিজে প্রায় পিছন ফিরে হেঁটে, স্ত্রীর হাত ধরে টেনে ওপরে তোলা শুরু করলাম। তরুণেরও প্রায় একই অবস্থা। ও নিজেও সীমার হাত ধরে প্রায় একই প্রক্রিয়ায় ওপরে উঠছে। ওরা আমাদের থেকে সামান্য এগিয়ে গেছে। তরুণের কন্যা পুপু অনেকটা এগিয়ে গেছে, ও এখন নজরের বাইরে। ধীরে ধীরে রোদের তেজ কমছে, অন্ধকার হয়ে গেলে বিপদের সম্ভবনা প্রবল, তাই সঙ্গিনীকে একটু দ্রুত পা চালাতে বললাম। যদিও জানি বাস্তবে সেটা প্রায় অসম্ভব। অনেকটা সময় ধরে অনেক কসরত করে, অনেক সিঁড়ি ভাঙার পর, ওপর থেকে তরুণ জানালো, যে সিঁড়ি ভাঙা পর্ব শেষ। তাতে উপকার কতটুকু হলো জানি না, তবে মনে হলো ওর মুখে শুধু ফুল চন্দন নয়, সাথে কিছু গুঁজিয়াও পড়ুক।

বেশ বুঝতে পারছি যে বেলা ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসছে, দিনের আলো দ্রুত কমতে শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু করার কিছু নেই। বারবার ‘আর একটু গতি বাড়াও’ বলতে বলতে, আমরা দুটি মাত্র প্রাণী, খুব ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি। সীমার হাঁটুর অবস্থাও বেশ খারাপ, কিন্তু ওর যেটা আছে, সেটা বেড়াবার প্রবল আগ্রহ ও অসম্ভব মনের জোর। তাছাড়া ওর এর আগের কিছু ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতাও আছে। ওদের গতি আমাদের থেকে কিছু বেশি হওয়ায়, ধীরে ধীরে ওরাও চোখের আড়ালে চলে গেছে। এইভাবে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলেও আর চার দিন পরেই পূর্ণিমা, তাই হালকা একটা আলোর ভাব আছে। তবে এই ভাঙাচোরা পাথুরে নির্জন জঙ্গলের পথ চলার পক্ষে সেই আলো কিন্তু মোটেই পর্যাপ্ত নয়। পিছন থেকে কারও গলার আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। শেষ অবাঙালি দলটার ফিরতে দেরি আছে, কিন্তু সেই অল্প বয়সি দম্পতি এখনও কেন এসে পৌঁছলো না, বুঝতে পারছি না।

এইভাবে আরও কিছুটা পথ পার হয়ে দেখলাম একটা বেশ বড় পাথর, আর রাস্তাটা যেন তার দু’দিক দিয়ে দু’টো ভাগ হয়ে গেছে। সঙ্গিনীকে দাঁড়াতে বলে, সরেজমিনে পরীক্ষা করে বাঁদিকের রাস্তাটাই আমাদের পথ বলে স্থির সিদ্ধান্তে এসে, বাঁদিকের পথ ধরে আবার এগিয়ে চললাম। এখানে কয়েকটা এবড়ো খেবড়ো সিঁড়ির মতো ধাপ থাকায়, আরও নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। স্ত্রীর হাত বেশ শক্ত করে ধরে, আমার দেখানো জায়গায় পা ফেলে ফেলে নামতে বলে কয়েক পা মাত্র নেমেছি, এমন সময় নীচে, খুব কাছ থেকেই তরুণের ডাক শুনতে পেলাম। বুঝলাম ওদের দেখা না গেলেও, ওরা আমাদের খুব কাছাকাছিই আছে। ওদের দাঁড়াতে বলে সামান্য পথ এগিয়েই ওদের দেখা পেলাম, ও তরুণের মুখে সেই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক বাক্যটি শুনলাম— “সুবীরদা, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি”। এই অন্ধকারে জঙ্গলের পথে পথ হারানোর সব রকম বিপদের কথা ছেড়ে, আমার যেটা প্রথম মনে হলো— আবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হলে এই দুই মহিলা কি করবে? তরুণ জানালো সামনে কোন রাস্তা নেই। আমি সবাইকে দাঁড় করিয়ে, কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যে, ডানদিকে একটা পায়ে হাঁটা সরু রাস্তার মতো পথ, আগাছার জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। বামদিকের রাস্তাটা অধিকতর চওড়া হলেও সেটা একটু এগিয়েই যেন শেষ হয়ে গেছে, কাজেই সেটা আমাদের ফেরার রাস্তা হতে পারে না।

প্রায় সাত দিন হলো ভুটানে আছি। সন্ধ্যার পর থেকে সর্বত্র ভীষণ ঠান্ডা, সকালে রাস্তার পাশে ও গাড়ির ওপর বরফ জমে থাকে। একমাত্র পুনাখার উত্তাপ সামান্য কিছু অধিক হলেও, সন্ধ্যার পর রাস্তায় হাঁটা খুব একটা সুখের ছিল না। অন্ধকারে তরুণের মোবাইলের আলোয় দাঁড়িয়ে, কি করা উচিৎ ভাবছি। এখনও ক্যাফেটারিয়ার কাছে এসে পৌঁছতে পারিনি, অর্থাৎ এখনও নীচে গাড়ির কাছে পৌঁছতে অর্ধেকের বেশি পথ বাকি। এমন সময় নীচ থেকে পুপুর চিৎকার শুনলাম। সে জানতে চাইছে, আমরা কোথায় আছি। জানা গেল, সে ক্যাফেটারিয়ার কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চিৎকার করে তাকে জানালাম যে আমরা পথ গুলিয়ে ফেলেছি, সে যেন আর না এগিয়ে ওখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। পাহাড়ি হাঁটা পথে যেখানে ঘোড়ার যাতায়াত আছে, সেখানে ঘোড়ার মল পথ চিনতে সাহায্য করে। ক্যাফেটারিয়ার আগে সে সুযোগ পাওয়ার সম্ভবনা নেই, ক্যাফেটারিয়ার পরেও এই অন্ধকারে সেই দুর্মূল্য বস্তুটির দেখা পাওয়ার আশা কম।

শেষপর্যন্ত আবার সেই ওপরের বড় পাথরটার কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগতে যাবো, এমন সময় আমাদের ঠিক পিছনে, অর্থাৎ আমরা যে পথ ধরে এখানে এসে হাজির হয়েছি, একজনকে মোবাইল জ্বালতে দেখা গেল। ভদ্রলোক আমাদের ঠিক পিছনে বাঁকের মুখে থাকায়, তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়নি, তবে ওই পথ দিয়ে আমরাও এসেছি, কাজেই উনি এইমাত্র এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন বোঝা গেল। পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী তাঁকে ভাইসাব বলে ডাকায়, তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁকে আমাদের বিপদের কথা বলাতে, তিনি জানালেন যে আমরা ঠিক রাস্তাতেই এসেছি, তবে ভুল করে বাইপাস দিয়ে আসায়, চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি আমাদের এগিয়ে যেতে বলে জানালেন, যে তিনি বাজার আনতে নীচে যাচ্ছেন। তাঁর জন্য নীচে গাড়ি অপেক্ষা করছে। বাজার নিয়ে তিনি আবার ওপরে ফিরে যাবেন। এপথে তিনি প্রায় রোজই যাতায়াত করেন, এবং নীচে নামতে তাঁর পৌনে এক ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগে। আমার স্ত্রী আমাদের একটু সাহায্য করতে বলায়, তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে তাঁর সাথে এগিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বাঘের গুহা থেকে আসছেন, কাজেই তাঁর চিতা বাঘের মতো গতির সাথে আমরা তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারবো কেন? যথারীতি আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ায়, তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে আমার স্ত্রীকে বললেন, আপনি খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এরপর তিনি আমাকে আমার স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিতে বলে, তিনি আমার স্ত্রীকে বললেন, যে ঠিক তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে তাঁর কাঁধের দু’দিকে শক্ত করে ধরতে। এবার ইঞ্জিন যেমন করে রেলের কামরা টেনে নিয়ে যায়, সেইভাবে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এগতে শুরু করলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নিজের হাঁটার গতি অনেক কমে গেলেও, আমার স্ত্রীর হাঁটার গতি বাধ্য হয়ে অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেল।

এতক্ষণ নিজে ব্যস্ত থাকায়, তরুণকে কোনরকম সাহায্য করার সুযোগ ছিল না। ঠিকভাবে ও ঠিক জায়গায় পা না ফেলার জন্য, একটু আগেই সীমা একবার লালচে ঢালু জমির ওপর গড়িয়ে পড়ে গেছে। আমি আর তরুণ চেষ্টা করেও তাকে সোজা করে দাঁড় করাতে পারছিলাম না। শেষে অনেক চেষ্টায় পিছন থেকে বগলের তলা দিয়ে তার হাত চেপে ধরে দাঁড় করাতে হয়েছে। সীমার অবস্থাও বেশ খারাপ, তরুণকে সীমার হাত ছেড়ে দিতে বলে, আমি তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমি নিজে দীর্ঘ দিনের স্পন্ডিলোসিসের রোগী, ডান হাতে এমনিই একটা যন্ত্রণার ব্যাপার আছে, তার ওপর এতক্ষণ ডান হাতের ওপর অত চাপ সহ্য করায়, যন্ত্রণাটা বেশ বেড়েছে। ভদ্রলোক মোবাইলের আলোয় পথ দেখিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, মাঝেমাঝে শুধু পা সোজা ও শক্ত রাখতে বলছেন। ওর গতি আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে, হাঁটার ভঙ্গিমাও বেশ সাবলীল বলে মনে হলো। সীমাকে শক্ত করে ধরে, ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। ওই ভদ্রলোকের কায়দায় তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, সেই শক্তি বা দম আমার কোথায়?

একসময় ক্যাফেটারিয়ার কাছে চলে এলাম। এখানেই পুপু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, এবার সেও আমাদের সঙ্গী হলো। ওই ভদ্রলোকের মোবাইলে নীচ থেকে বারবার ফোন আসলেও তিনি কিন্তু বিরক্ত হননি, বা আমাদের ছেড়ে চলে যাননি, বরং নিজে থেকে বললেন যে ভয় পেয় না, দরকার পড়লে আমি পিঠে করে নীচে নামিয়ে নিয়ে যাব। পুপুর কাছে জানা গেল, যে অনেক্ষণ আগে সোনম একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিল, যে আমরা এখন কোথায়। পুপু জানিয়েছিল, যে সে নিজে ক্যাফেটারিয়ার কাছে থাকলেও, সঙ্গীরা এখনও এসে পৌঁছয়নি। সোনম জানিয়েছিল এরপর অন্ধকার নেমে আসবে, আমরা যেন ক্যাফেটারিয়ায় থাকার ব্যাপারে একটু কথা বলে চেষ্টা করে দেখি।

আরও অনেকটা পথ এইভাবে নেমে আসার পর, সোনম আবার ফোন করলো। আমরা তাকে একবার ওপরে চলে আসতে বললাম। সত্যি কী না জানি না, তবে সে জানালো, যে সে নাকি দু’বার অনেক ওপর পর্যন্ত উঠে এসেও, আমাদের সাক্ষাৎ পায়নি। ওই ভদ্রলোক জানালেন, যে তিনি অধিকাংশ বাইপাস ব্যবহার করায় সোনম হয়তো আমাদের খুঁজে পায়নি। ভদ্রলোকটির হাতে মোবাইলটা দিয়ে সোনমের সাথে একটু কথা বলে আমরা ঠিক কোথায় আছি তাকে একটু জানাতে বললাম। উনি নিজেদের ভাষায় কথা বলে সোনমকে আমাদের অবস্থানটা জানিয়ে দিলেন। আমরা আবার এগিয়ে চললাম। জঙ্গলের পথ, প্রচন্ড ঠান্ডা হলেও উত্তেজনা ও শারীরিক পরিশ্রমে, ঠান্ডা সেরকম অনুভুত হচ্ছে না।

এইভাবে আরও কিছুটা পথ চলার পরে টর্চ হাতে সোনম এসে হাজির হলো। সে এত দ্রুত কিভাবে চলে এলো বুঝলাম না। তাহলে কি ও আমাদের সাহায্য করতে এসে কাছেপিঠেই কোথাও ছিল, নাকি আমরা নীচে রাখা গাড়ির কাছাকাছি কোথাও এসে গেছি? মনে মনে প্রার্থনা করলাম, দ্বিতীয়টাই যেন সত্য হয়।

সোনম এসেই সীমাকে অনেকটা ওই ভদ্রলোকের কায়দায় ধরে, নীচে নামতে শুরু করলো। বারবার সে সীমাকে পা সোজা করে হাঁটতে বলছে। সেই একবারে ওপরের তাক্তসাং জোং থেকে এতটা পথ নিজের হাতের ওপর ওদের চাপ সহ্য করে করে এসে, আমি নিজেও বেশ ক্লান্ত। তবে মাইলের পর মাইল উতরাইয়ের পথ হাঁটতে, আমার কোনদিনই তেমন বিশেষ কোন কষ্ট হয় না। ভারমুক্ত হয়ে আমার হাঁটায় স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত আলোর প্রয়োজনে আমি নিজের মোবাইল ব্যবহার করিনি। না, এখন দিবসও নয়, বা মনের হরষেও আলো জ্বালার প্রয়োজন অবশ্যই নয়, আলো না জ্বালায় স্বল্পালোকে হাঁটতে কিছু অসুবিধাও হচ্ছিল একথা সত্য। কিন্তু আমি চাইছিলাম না, যে সবক’টা মোবাইলের ব্যাটারি এক সাথে শেষ হয়ে যাক, কারণ এখনও কতটা পথ, বিশেষ করে কতক্ষণ সময় আলো জ্বেলে হাঁটতে হবে কে জানে?

আসার পথে বারবার লক্ষ্য করেছি, যে সোনমের কথা বুঝতে না পারলে বা ওর ইচ্ছা বা বক্তব্যকে উপেক্ষা করলে, ও ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়। এখনও সে বারবার আমায় মোবাইল জ্বালতে বলছে। ‘পড়েছি সোনমের হাতে, মোবাইল জ্বেলে চলো সাথে’ পন্থাই অবলম্বন করা শ্রেয় বিবেচনা করে, মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ওদের সাথে চললাম। আরও বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে এঁকেবেঁকে হাঁটতে হাঁটতে, একসময় মনে হলো নীচে নেমে এসেছি। কিন্তু গাড়ি রাখার বড় ফাঁকা অঞ্চলটা তখনও চোখে না পড়ায় বুঝলাম, আমরা শেষপ্রান্তে এসে পড়লেও এখনও কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে পৌঁছইনি।

এইভাবে নেমে এসে আমরা একসময় আধো-অন্ধকারের একটা ভৌতিক পরিবেশে, সেই ফাঁকা নির্জন জায়গাটার একপাশে আমাদের সাদা গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আর কোন গাড়িতো দূরের কথা, একটা মানুষ পর্যন্ত কোথাও নেই। ধীরে ধীরে সেই ঘেরা জায়গাটার ভিতর দিয়ে, যার সামনে থেকে যাওয়ার সময় লাঠি ভাড়া করেছিলাম, যার ভিতর দিয়ে ওপরে ওঠার পথে যাওয়ার সময় মেলার মতো বিভিন্ন পসরা নিয়ে মেয়েদের বিক্রি করতে দেখেছিলাম, হেঁটে গিয়ে গাড়ির সামনে হাজির হলাম। কেউ কোথাও নেই, যে লাঠিগুলো ফেরৎ দেবো। সোনম আমাদের পাঁচটা লাঠি একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমি এবার ভদ্রলোকের কাছে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা চাইলে, তিনি জানালেন যে তাঁর কোন হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার নেই। তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করাতে তিনি প্রথমে এড়িয়ে গিয়েও শেষে বললেন ‘প্রেমা’। তাঁর নাম বলার ভঙ্গি দেখে, তিনি সত্যই তাঁর সঠিক নাম বললেন বলে মনে হলো না। আমি তাঁকে আমাদের এইভাবে সাহায্য করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে তিনি শুধু বললেন, “ধন্যবাদ কিস লিয়ে, এ তো হামারা ফর্জ থা”। আমি আর কোন প্রশ্ন করলাম না। আমার হৃদয়ে তিনি মানব প্রেমের প্রতীক হয়েই চিরদিন অবস্থান করুন।

আমাদের সাথে এখন কোন লাগেজ নেই, তাই গাড়ির ছ’টা সিটই এখন ফাঁকা। ওই ভদ্রলোকের সাথে নিজেদের ভাষায় সোনমের কিছু কথা হলো। বুঝলাম তাঁর গন্তব্য স্থলে সোনম তাঁকে পৌঁছে দিয়ে যাবে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। আমাদের যাওয়ার পথে একসময় একটা বড় হোটেলের মতো বাড়ির সামনে তিনি নেমে গেলেন। জানি না, তাঁর কথামতো আজই আবার তিনি ওপরে ফিরে যাবেন কী না। তাঁর একটা ছবি নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাঁর মতো প্রচার বিমুখ একজন মানুষের, যিনি নিজের নাম পর্যন্ত বলতে চান না, ওই রাতে ওই অবস্থায় ছবি তোলার কথা বলাটা কিরকম হাস্যকর বেমানান মনে হলো।

রাত প্রায় পৌনে ন’টার সময় আমরা হোটেলের সামনে নামলাম। সোনমকে জিজ্ঞাসা করলাম ভদ্রলোক তার পরিচিত কী না। সোনম জানলো, উনি তাক্তসাং গুহার একজন লামা। সোনম গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আজ আর রাতের খাবারের জন্য বাইরে না গিয়ে, এই সীজনস্ হোটেলেই খেয়ে নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু এই হোটেলে কোন খাবার না পাওয়ায়, আমি আর তরুণ একটু দূরের ‘হোটেল ড্রাগন’-এ গেলাম রাতের খাবার কিনে আনতে। আজ মহিলারা খুবই পরিশ্রান্ত, তাই ওদের আর নতুন করে কষ্ট দিতে সঙ্গে যেতে বললাম না। খাবার নিয়ে হোটেলে ফিরে এসে আমার ঘরে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রাতের খাবার খাওয়ার সময়, আমি তাক্তসাং থেকে ফেরার পথে নেওয়া সিদ্ধান্তটা পেশ করলাম। আমি জানি তরুণ বা সীমা, কেউই আমার নেওয়া কোন সিদ্ধান্তকে অমান্য করবে না, অতীতেও কোনদিন করেনি।

আগামীকাল আমাদের জয়গাঁও ফিরে, কাছাকাছি কোন একটা ট্যুরিস্ট স্পটে চলে গিয়ে, শেষ দিনটা ঘুরেফিরে দেখে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ছিল। এই ব্যাপারে সবথেকে বেশি উৎসাহ ছিল বন্ধুপত্নী সীমার। কিন্তু আমি জানালাম যে আগামীকাল নতুন কোথাও না গিয়ে, এই পারো শহরেই থেকে যাবো। ফেরার আগে একটা দিন অন্তত সকলেরই একটা পরিপূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। তাছাড়া এতটা পথ পাড়ি দিয়ে শুধুমাত্র উত্তর বঙ্গের কোন একটা জায়গা দেখতে যাওয়ার কোন যুক্তিও নেই। তার থেকে আগামীকাল পারোতেই থেকে যাবো। ভুটানে থাকার পারমিটও আমাদের আছে। কাল বরং বিশ্রাম নিয়ে স্থানীয় দোকান বাজারে ঘুরে কাটিয় দিয়ে পরশু তরতাজা শরীরে জয়গাঁও ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। আগেই বলেছি যে কষ্ট হলেও নতুন জায়গা দেখার আগ্রহ সীমার মতো কাউকে দেখিনি। তবু এক্ষেত্রেও ও আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিলো। সোনমকে ফোন করে আমাদের সিদ্ধান্তর কথা জানিয়ে দেওয়া হলো। আজ স্বাভাবিক ভাবেই সবাই খুব ক্লান্ত, ঠান্ডাও পড়েছে বেশ ভালো, তাই আর কিছুক্ষণ সবাই আজকের ঘটনাবহুল দিনটার পোস্টমর্টেম করে, যে যার ঘরে লেপ কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের আঠারো তারিখ। আজ আমাদের পূর্ণ বিশ্রামের দিন, তাই ঠান্ডার মধ্যে সাতসকালে ওঠার কোন তাড়া নেই। অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেলা করেই তরুণ চা নিয়ে এসে ডেকে দিয়ে গেল। মুখ ধুয়ে, বাথরূম সেরে গরম জলে বেশ করে স্নান সেরে বাইরে এসে শুনলাম, যে সোনম তার গাড়ি নিয়ে নীচে অপেক্ষা করার প্রাত্যহিক সংবাদটা ইতিমধ্যেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। কালকের পরিশ্রমে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে বয়স্ক মহিলারা আজ আর বেরতে চাইছে না। আমি বললাম গাড়ি যখন আছেই, তখন ঘুরতে না যাওয়ার কোন মানে হয় না। শরীর খারাপ লাগলে বা ইচ্ছা না করলে নীচে নেমে দেখতে না গিয়ে, গাড়িতে বসে থাকলেই হলো। একটা দিনের পুরো গাড়ি ভাড়া দিয়ে ঘরে বসে থাকার কোন মানে হয় না। একে একে সবাই তৈরি হয়ে নিয়ে নীচে নেমে দেখি সোনম তার গাড়ি নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাদের প্রাতরাশ সেরে নিতে বলে জানালো, যে সে আজ পারোর কিছু স্পট দেখাবে। পাহাড়ের অনেক ওপরে একটা মন্যাস্টারি জাতীয় কিছু দেখিয়ে, সে জানালো যে ওখান থেকে পারো শহরটাকে খুব সুন্দর লাগে। আবার কোন জোং দেখতে যাওয়ার অর্থ, মাথাপিছু তিন বা পাঁচ শত টাকার ধাক্কা। অতো ওপরে উঠে জোং দেখতে যাওয়া মানেই সিঁড়ি ভাঙা, তাই মহিলারা খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করলো না। ড্রাগন হোটেলে বসে আমি তাদের বললাম যে অনেক উচ্চতা থেকে পারো শহরটাকে সুন্দর দেখা যাবে। অসুবিধা হলে বা বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হলে, গাড়িতে বসে থাকলেই হলো। যাহোক জলখাবার খেয়ে রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে বসলাম।

বেশ কিছু পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের গাড়ি এসে কিচু লাখাং জোং-এর কাছে দাঁড়ালো। জনমানব শুন্য এই জায়গার জোংটি দেখে বেশ পুরাতন ও রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট অভাব আছে বলে মনে হলো। এখানেও টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে জীর্ণ পাঁচিল ঘেরা জোং-এর ভিতর প্রবেশ করতে হবে। জোংটির অবস্থা দেখে আমাদের কেউই অত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে, জোং দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো না। আমরা বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায় দেখে, ছবি তুলে, চারপাশটা একটু ঘুরে ফিরে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। মুখে কিছু না বললেও, সোনমকে দেখে বোঝা গেল, যে আমাদের জোং-এর ভিতর প্রবেশ না করে টিকিট কাউন্টার থেকে ফিরে যাওয়াটা সে খুব ভালভাবে নেয়নি।

কিছুক্ষণ পরে একটা নির্জন রাস্তার একটা গাছের পাশে সোনম তার গাড়ি দাঁড় করালো। রাস্তার ডানপাশে কিছুটা দূরে গাছপালায় ঢাকা একটা বড় বাড়ি, সম্ভবত কোন হোটেল। সোনম আমাদের জিজ্ঞাসা করলো, এটা আমনকোরা নামে একটা পাঁচতারা হোটেল, আমরা দেখতে রাজি আছি কী না। পাঁচতারা হোটেলে একরাত থেকে অনেকেই গর্ব বোধ করলেও, আমি জীবনে কোনদিন থাকা তো দূরের কথা, ভিতরে ঢুকেও দেখিনি বলে কিন্তু লজ্জা বা সংকোচ বোধ করি না। আমাদের গাড়িটা দাঁড়াতে দেখে একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে আমাদের গাড়ির কাছে দাঁড়ালেন। উনি সোনমের সাথে নিজেদের ভাষায় কিছু কথা বলে, মোবাইলে কারো সাথে কথা বললেন। এবার তিনি আমাদের ভিতরে যেতে অনুরোধ করলেন, অনুমতি দিলেনও বলা যেতে পারে। আমরা গাছপালা ঘেরা, একপাশে বরফ জমে থাকা ভিতরে যাওয়ার রাস্তা ধরে হোটেলটির কাছে হাজির হয়ে দেখলাম, অন্য একজন ভদ্রমহিলা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন যে আমরা হোটেলের চারপাশটা ঘুরে দেখতে চাই, না হোটেলের ঘর দেখতে চাই। আমি তাঁকে জানালাম যে আমরা ট্যুরিস্ট, ভারতবর্ষ থেকে এসেছি, এই হোটেলটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। তিনি আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে চাবি খুলে একটা ঘরে প্রবেশ করে, ঘরের সমস্ত কিছু ঘুরে ঘুরে বর্ণনা করে দেখালেন। আমার কাছে অন্তত এই অভিজ্ঞতাটাও একটা অতিরিক্ত পাওয়া বলে মনে হলো। হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ আমি প্রতিদিন পনেরোশ’ টাকা ভাড়ার একটা ঘরে উঠে, প্রতিদিন পনেরোশ’ ইউ.এস্. ডলার ভাড়ার একটা ঘর দেখতে এসেছি। এবার আমরা হোটেলটার চারিপাশে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে দেখলাম। সত্যিই সময় নিয়ে ঘুরে দেখার মতোই বটে। একসময় আমরা বিদায় নিয়ে বাইরে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম।

গাড়ি ছেড়ে দিলো। কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা দ্রুগিয়াল জোং-এর কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ওপরে গিয়ে এই জোংটির কাছে পৌঁছনো যায়। জনমানবহীন নির্জন এই স্থানটিতে একটি জোং ও একটি ভাঙাচোরা দুর্গ আছে। দুর্গটিকে দুর্গ না বলে দুর্গের প্রায় ধ্বংসস্তুপ বলা বোধহয় ঠিক হবে। পরিত্যক্ত জোংটি মেরামতির কাজ চলছে। সোনম জানালো যে ২০০৪ সালের ভয়াবহ ভুমিকম্পে দুর্গ, ও দুর্গ সংলগ্ন জোংটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্গটির একদিকে দেখলাম একটা বন্ধ দরজা। দরজাটা পালটানো হয়েছে কী না জানি না, তবে ওই দরজা কখনই একটা দুর্গের উপযুক্ত নয়। যাইহোক্, দরজাটার সামনে অল্প কিছুটা উন্মুক্ত অঞ্চল। আমি তরুণ আর সোনম সেখানে বসে অনেকটা সময় কাটালাম। পাশ দিয়ে একটা সরু ভাঙাচোরা পাথরের সিঁড়ি জঙ্গলের পথে নীচে নেমে গেছে। এখানে বসে সোনম তার মতো করে অনেক গল্প শোনালো। তিব্বতের সাথে গোলমালের সময় এই পথেই সৈনরা নাকি দুর্গে যাতায়াত করতো। ভারতীয় ছাড়া অন্য কোন দেশের নাগরিক এখানে ছবি তুললে কঠিন সাজা হয় বলেও শুনলাম। এখানে কোন মানুষ নেই, সি সি টিভি আগে তো থাকার প্রশ্নই ছিল না, এখনও নেই। কাজেই কেউ এখানকার ছবি তুলছে কী না, তুললেও সে ভারতীয় না মঙ্গোলীয়, কে ঠিক করছে জানি না। তবে শেষ দিনে পাশাপাশি বসে সোনমের মুখে তার দেশের গল্প শুনতে বেশ ভালোই লাগছে। সোনম জানালো, যে এই জোংটি নাকি দু-দু’বার নতুন করে সংস্কার করা হয়েছিল, কিন্তু রাজার পছন্দ না হওয়ায়, রাজার নির্দেশে দু’বারই ভেঙে ফেলে, আবার নতুন করে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। রাজার ইচ্ছা, জোংটি ঠিক যেরকম দেখতে ছিল, হুবহু সেরকমই যেন করা হয়। তারজন্য প্রয়োজনে পুরাতন জোং-এর ছবি জোগাড় করে  নিখুঁত কাজ করতে হবে। ভালো লাগলো শুনে, পুরাতন ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এটাই প্রয়োজন। আরও কিছু সময় কাটিয়ে, রাস্তায় নেমে গাড়ির কাছে এসে সঙ্গীদের ডেকে নিলাম। এখানে এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা, সম্ভবত তাঁদের নাতি নাতনিদের নিয়ে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। তাঁদের মুখ চোখ দেখলে বোঝা যায়, যে তাঁদের দিনগুলো কতো ঝামেলাহীন, টেনশনহীন, আনন্দে কাটে। সম্ভবত তাঁদের দিনগুলো রেশন কার্ডের, ভোটার বা আধার কার্ডের, কেরোসিন, ব্যাঙ্কের কে.ওয়াই.সি., কর্পোরেশনের ট্যাক্স, ইত্যাদির জন্য লাইন দিয়ে কাটাতে হয় না। বৃদ্ধ বৃদ্ধা, ও বাচ্চাগুলোর ছবি তুলে আরও কিছুটা সময় কাটলো। এবার আমাদের আবার এগিয়ে যাওয়ার পালা।

একসময় আমরা একটা জায়গায় এসে গাড়ি থেকে নামলাম। সোনম জানালো যে এটা মিলিটারিদের এলাকা। এখানে অনেকগুলো খচ্চর ছাড়া, উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু দেখার আছে বলে হলো না। সোনম জানালো এইগুলো মিলিটারির ঘোড়া। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে ঘোড়াই হোক বা খচ্চরই হোক, তাদের দেখতে বেশ সুন্দর সন্দেহ নেই, কিন্তু সাস্থ্য দেখে মনে তো হলো না, যে এগুলো মিলিটারিরা ব্যবহার করেন। অবশ্য একথাও সত্য, যে এখন পর্যন্ত পুনাখায় বেশ কিছু গাধা ছাড়া, কোথাও কোন ঘোড়া বা খচ্চর চোখে পড়েনি।

এখানে অযথা আর সময় নষ্ট না করে, আমরা এগিয়ে চললাম। একসময় আমরা সাংচেন চোখর(Sangchen Chokhor) নামে একটা প্রতিষ্ঠান দেখতে এলাম। সোনমের কথায় এটা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে নাকি প্রায় তিনশ’ লামাকে বৌদ্ধ ধর্মের ওপর উচ্চশিক্ষা দেওয়া হয়। সে যাইহোক, এটা একটা শান্ত, নির্জন, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জোং-এর মতোই। তবে নোটিস বোর্ডে শিক্ষা সংক্রান্ত কাগজ দেখে মনে হলো, আর পাঁচটা জোং-এর সাথে সবরকম মিল থাকলেও, বাস্তবে এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বটে। বিভিন্ন বোর্ডের লেখা থেকে মর্ম উদ্ধার করার উপায় নেই, যেমন একটা বোর্ডে দেখলাম Gyelchen Ku Ngae Lhakhang লেখা। অন্যান্য জোংগুলোর মতো এখানেও মুর্তি, তৈলচিত্র ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর ভাবে সাজানো। তবে নির্জন একপ্রান্তে অবস্থিত হওয়ার জন্যই বোধহয়, খুব শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ। আজকের মতো, শুধু আজকের মতোই নয়, এবারের মতো ভুটান দেখার ইতি। কাল সকালেই আবার সেই ফুন্টশলিং হয়ে জয়গাঁও ফিরে যাওয়া, তাই এখানে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে, ছবি তুলে,  হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

দিনটা বেশ ভালোই কাটলো। হোটেলের নীচে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বিদায় নেওয়ার আগে সোনম জানালো, যে ফুন্টশলিং যাওয়ার পথে এক জায়গায় রাস্তা মেরামতির কাজ হচ্ছে। কাজ শুরু হয়ে গেলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে, কাজেই আগামীকাল একটু সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়াই ভালো। কাল যখন আমাদের ফিরে যেতেই হবে, তখন অকারণে দেরি করেও লাভ নেই। তাই বেশ সকাল সকাল ফুন্টশলিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, আমরা হোটেলে প্রবেশ করলাম। সোনম হাত নেড়ে বিদায় নিলো। আগামীকাল সকালে সময় হবে না, তাই ঘরে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা মালপত্র গোছাতে বসলাম।

গোছগাছ পর্ব শেষ হলে, নিজেরা কিছুক্ষণ গুলতানি করে সময় কাটালাম। আজকের আড্ডায় আর অন্যান্য দিনের হইচই আনন্দ বিশেষ চোখে পড়লো না। একসময় আমি আর তরুণ হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে, কাল সকালে আমাদের হোটেল ছেড়ে দেবার কথা জানিয়ে দিলাম।

আজ একটু তাড়াতাড়িই ড্রাগন হোটেলে রাতের খাবার খেতে যাওয়া হলো। আজ বাইরে বেশ ঠান্ডা পড়ায়,  খুব বেশি সময় নষ্ট না করে, খাওয়া হয়ে গেলে নিজেদের হোটেলে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পরে যে যার ঘরে চলে গেলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের উনিশ তারিখ। কথামতো বেশ সকাল সকাল সীমার হাতের চা খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়ে,  প্রাতরাশ না করেই, ফুন্টশলিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। বিদায় ভুটান, তোমার সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে, সারাটা জীবন তোমার কথা মনে থাকবে। আজ আমাদের জয়গাঁওতে থাকার কথা। গাড়ি এগিয়ে চললো। থিম্পু থেকে পারো আসার সময়, সোনম বেশ কিছু জায়গায় পথের পাশে একবারে সোজা করে কাটা পাহাড়ের অংশ দেখিয়ে জানিয়েছিল, যে রাস্তা তৈরির সময় পাশের পাহাড়কে এইভাবে কাটা হয়েছিল। এইসব জায়গাগুলোয় অনবরত ধস নামে। জানা গেছে এইভাবে একবারে সোজাভাবে প্রায় নব্বই ডিগ্রি অবস্থায় পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে থাকার কারণে, এই অঞ্চলগুলো এতো ধসপ্রবণ। রাস্তার পাশে পাশে ‘স্লাইড এরিয়া ড্রাইভ উইথ কশন্’ লেখা বোর্ডও যথেষ্টই চোখে পড়লো। সোনম জানালো, যে কোন একটা বিদেশি সংস্থাকে দিয়ে নাকি পাহাড়ের ঢালকে নতুন করে কেটে, এই ত্রুটি সংশোধন করা হচ্ছে।

যাইহোক আবার সেই চুখা, ওয়াংখা হয়ে গাড়ি এগিয়ে যাওয়ার পথে সোনম জিজ্ঞাসা করলো, যে আমরা কি দিয়ে নাস্তা করবো। জলখাবার তৈরি করতে অনেকটা সময় চলে যায়, কাজেই আগে থেকে ফোন করে কি খাবো জানিয়ে দিলে, আমরা পৌঁছেই গরম গরম খাবার পেয়ে যাবো। আমরা হাতে গড়া রুটি ও সবজি খাবো বলে জানালাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে সোনম ফোন করে পাঁচজনের জন্য রুটি সবজি বানাবার কথা বলে দিল। আরও অনেক পথ অতিক্রম করে আমাদের গাড়ি আবার সেই গেদুর হোটেলটায় এসে দাঁড়ালো। আমরা হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসলাম। তরুণকে দেখে মনে হলো, যে সে রুটি সবজির পরিবর্তে তার অতি প্রিয় গ্রাউন্ড আপেল খাওয়ার সুযোগ পেলে বোধহয় বেশি খুশি হতো, কিন্তু বেচারার বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। তাই লজ্জায় মনের ইচ্ছা প্রকাশ না করে, মাথা নীচু করে রুটি সবজির অপেক্ষায় বসে থাকলো। রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, গরম গরম রুটি সবজি, ডিমের অমলেট ও কফি খেয়ে, একসময় আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। না, রাস্তায় কোথাও মেরামতির কাজ হতে দেখলাম না, তাই কোন ঝামেলা ছাড়াই কামজি হয়ে আমরা নির্বিঘ্নে ফুন্টশলিং এসে পৌঁছলাম। গাড়ি ফুন্টশলিং মন্যাস্টারির কাছে দাঁড় করানো হলো। যাওয়ার সময় এটা দেখার সুযোগ হয়নি। মন্যাস্টারিটা ঘুরে ঘুরে দেখে, এক জায়গায় এসে বসা গেল। এবার সোনমের পাওনা মেটাতে হবে। ওর সাথে আমাদের ছাব্বিশ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছিল। পারোতে একটা দিন বেশি ছিলাম। অর্থাৎ আরও তিন হাজার দু’শ টাকা। পথে একজনকে দিয়ে মোবাইল থেকে পারমিটের প্রিন্টআউট, জেরক্স্, ইত্যাদি ও গাড়িভাড়া বাবদ সোনম চারশ’ টাকা দিয়েছিল। অর্থাৎ মোট উনত্রিশ হাজার ছয় শত টাকা। তারমধ্যে এক হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া আছে। আমরা তাকে আরও উনত্রিশ হাজার টাকা দিলাম। সে খুশি হয়ে আমাদের ভুটান গেটের কাছে আমাদের ছেড়ে, মালপত্র নামিয়ে দিয়ে, হাত মিলিয়ে বিদায় জানালো। আমরা চুনি মানস বিদেশ মঙ্গলের বাংলার বাসিন্দা, তাই আমরা ভুটান গেট পেরিয়ে অতি পরিচিত সেই পানের পিক্, পলিথিন প্যাকেট, ফলের খোসা, জড়ো করে রাখা আখের ছিবড়ে দক্ষতার সাথে কাটিয়ে, জয়গাঁওয়ের সেই পুরাতন ও পরিচিত হোটেল সত্যমে এসে ঘর দখল করলাম। ভুটান গেট থেকে বেরিয়ে নিজেদের দেশের জয়গাঁওয়ে ঢোকার সময় লক্ষ্য করেছিলাম, যে কিছু ফুটপাথের স্টল ছাড়া, আর সমস্ত দোকান বন্ধ। হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গতকাল রাতে দোকানদারদের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় আজ সমস্ত দোকান বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। যাওয়ার দিনও বন্ধের মধ্যে শিয়ালদহ যেতে হয়েছিল, আগামীকাল শিয়ালদহ ফেরার কথা, জানি না কালও এখানে বন্ধ্ উৎসব পালিত হবে কী না। তবে চোখ বুজেও বেশ বলে দেওয়া যায়, যে আমরা বাংলা মায়ের কোলে ফিরে এসেছি।

মালপত্র ঘরে রেখে, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে, হোটেল খোলা পাবো কি পাবো না ভাবতে ভাবতে, চললাম সেই হোটেল ডুয়ার্সে দুপুরের আহার সারতে। আজকের খাতিরটা যেন একটু বেশিই মনে হলো। পরিপাটি করে বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হলো। গত দশদিনের মধ্যে একদিন শুধু পুনাখার বাজো শহরে চিড়ের পোলাওয়ের মতো ফ্রায়াড রাইস খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাই আজ দলের সবাই দেখলাম খুব খুশি, তার ওপর আবার পাতে আলু পোস্ত ও গন্ধরাজ লেবুর টুকরো দেওয়া হয়েছে। যাহোক্, বেশ তৃপ্তি করে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে, আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আজ যেন চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার ঠিক পরের দিনটা বলে মনে হচ্ছে। আজ হাতে কোন কাজ নেই, নেই ঘুরতে যাওয়ার তাগাদা। আজ তাই পূর্ণ বিশ্রামের দিন, আজ তাই জমিয়ে একটা ভাতঘুম দেবার দিন। ঘুম থেকে উঠে একদফা চা খেয়ে, সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরলাম। বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় ঘুরে সময় কাটিয়ে, চা খেয়ে, একসময় আবার সেই হোটেলের ঘরে। একটু রাত হলে আবার সেই হোটেল ডুয়ার্সে গেলাম রাতের আহার সারতে। খাওয়া শেষে হোটেলে ফিরে এসে, বেশ কিছুক্ষণ পরে যে যার বিছানা নিলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের কুড়ি তারিখ। একটু বেলা করেই আজ সবাই ঘুম থেকে উঠলো। হোটেলের ঠিক নীচে ফুটপাথ থেকে চা জলখাবার খেয়ে, এক চক্কর ঘুরে টুকটাক কিছু পছন্দের ও অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে,  হোটেলে ফিরে এলাম। দুপুর বারোটায় হোটেল ছেড়ে দেবার কথা, অথচ আজ হাসিমারা থেকে বিকাল চারটে আটচল্লিশে আমাদের ট্রেন ছাড়ার কথা। এতক্ষণ সময় সঙ্গে এতো মালপত্র নিয়ে কি করা যায় ভেবে না পেয়ে, শেষে হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে, আমাদের সমস্যার কথা জানালাম। ভদ্রলোক হেসে ফেলে বললেন, “আপনাদের কি দুপুর ঠিক বারোটায় ঘর ছেড়ে দিয়ে মালপত্র নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার কথা একবারও কেউ বলেছে? আপনারা তো বাইরে খেতে যাবেন, যাবার সময় আমাদের কাউন্টারের পাশে সব মালপত্র রেখে চলে যান, ফিরে এসে সময় মতো মালপত্র নিয়ে হাসিমারা স্টেশনে চলে যাবেন”। তাই ঠিক হলো। তবে খেতে যাওয়ার আগে আমাদের জানানো হলো, যে আমরা যেন যেকোন একটা ঘরে সমস্ত মালপত্র রেখে ঘর লক্ করে খেতে যাই। আরও ভালো প্রস্তাব, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

একটু বেলা করেই সেই ডুয়ার্স হোটেলে খেতে গেলাম। খাওয়া শেষে কাউন্টারের ভদ্রলোকের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে হোটেলে ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরে মালপত্র নিয়ে নীচে নেমে, আড়াইশ’ টাকা ভাড়ায় একটা বড় অটো নিয়ে সমস্ত মালপত্র সমেত পাঁচজনে দিব্য হাসিমারা রেলওয়ে স্টেশনে চলে এলাম। আপার ক্লাস ওয়েটিং রূমে বাকি সময়টা কাটিয়ে দিয়ে, ট্রেন এলে নির্দিষ্ট বগির নিজেদের বার্থ দখল করে, মালপত্র সাজিয়ে রেখে গুছিয়ে বসলাম। এবারেও আসার সময়ের মতোই একই কিউবিক্যালের ছটি বার্থের মধ্যে, একটি আপার বার্থ ছাড়া বাকি পাঁচটাই আমাদের দখলে। ধীরে ধীরে রাত বাড়লে খেয়েদেয়ে যে যার বার্থে চলে গেলাম।

আজ জানুয়ারী মাসের একুশ তারিখ। সকাল আটটা কুড়িতে আমাদের ট্রেনের শিয়ালদহ স্টেশনে ঢোকার কথা। সামান্য বিলম্বে ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে এসে থামলে, আমরা মালপত্র নিয়ে প্রি-পেড ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে এগলাম। এবার সত্যিই ঘরে ফেরার পালা।

সুবীর কুমার রায়

২৬-০৩-২০১৯

 

 

ডিজিটাল ভারত {লেখাটি প্রতিলিপি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত।}

36271711_998507660324983_1780579280690872320_n   মেনকা নামে খোনা গলায় কথা বলা এক অত্যন্ত দরিদ্র মহিলা আমাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করেছিল। কোন শব্দ ‘র’ দিয়ে শুরু হলে, সে উচ্চারণ করতে পারতো না। কিন্তু শব্দের মাঝে বা শেষে ‘র’ থাকলে  দিব্যি উচ্চারণ করতে পারতো। শুধু এই কারণে, সে রাম বলতে না পারলেও মরা বলতে পারতো। তাকে আমি খুব দ্রুত মরামরামরামরা বলতে বললে দিব্যি বলতে পারতো, কিন্তু মরামরার ম এর পরে একটু শ্বাস নিতে বললে কিন্তু মআ হয়ে যেত। এতে ওর ভবিষ্যতে স্বর্গবাসে, বা ভূতের ভয় পেলে, অসুবিধা দেখা দেবে কী না জানি না, তবে আমাদের কোন অসুবিধার কারণ হতো না। কিন্তু আম অর্থাৎ রাম, দেবতা হয়েও, হয়তো বা এহেন চরম অপরাধের জন্যই তাকে নির্মম বিপদে ফেললেন। আমাদের বাড়ি রামরাজাতলা নামে একটা জায়গায় ছিল। এখানে বছরের কয়েক মাস ধরে বিরাট ধুমধাম করে রাম পূজো হয়। সকলের মুখে মুখে রামরাজাতলা একদিন রামতলা নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছিল।

সে যাহোক এহেন মেনকাদি একদিন কি কারণে হাওড়া গিয়েছিল। রামতলা থেকে বাস ও মিনিবাস হাওড়া যায়, কাজেই তার কোন অসুবিধা হয়নি। ফেরার পথে লোককে জিজ্ঞাসা করে করে সে মিনিবাসে ওঠে। টিকিট কাটার সময় সে কন্ডাক্টারকে একটা আমতলার টিকিট দিতে বললে, কন্ডাক্টার তাকে টিকিটও দেয়। আমতলায় তাকে নামতে বললে সে জানায় এখানে নয়, যে আমতলায় আম পূজো হয়, সেই আমতলায় যাবো। হাওড়া থেকে আমতলা ও.পি. পর্যন্ত এই মিনিবাসটা রামতলার প্রায় কাছে, সাঁত্রাগাছি মোড় নামে একটা জায়গা থেকে, বাঁদিকে ঘুরে আমতলা আউট পোস্ট পর্যন্ত যেত। যাহোক শেষপর্যন্ত তার বিবরণে আমতলা রহস্য সমাধান করতে পারায়, দয়ালু কন্ডাক্টার তাকে মিনিবাস থেকে নামতে বারণ করে, এবং ফেরার পথে রামতলার কাছাকাছি স্টপেজ, সাঁত্রাগাছি মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যায়।

কথাপ্রসঙ্গে একদিন মেনকাদিকে মা হঠাৎ বলে যে “দাদা চাঁদে জমি কিনছে, ওখানেই বাড়ি করবে”। মেনকাদি প্রথমে অবিশ্বাসের সুরে বলে, “চাঁদে কেউ জমি কেনে নাকি, ওখানে কি মানুষ থাকে”? আমরা ওর কথা শুনে খুব হাসাহাসি করলাম। ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “কিন্তু আমি তাহলে কি করে ওখানে কাজ করতে যাবো”? মা বললেন, “চিন্তা করছো কেন, দাদাতো সিঁড়ি করে দেবে”। উত্তরে সে শুধু বললো, “রোজরোজ আমি অতো সিঁড়ি ভাঙতে পারবুনি বাপু, তোমরা তাহলে অন্য কোন কাজের লোক দেখে নিও”।

এই মেনকা দি মাঝেমধ্যেই সামান্য কিছু টাকা পয়সা চাইতো। অত্যন্ত গরীব হওয়ায়, ও মাকে তাঁর কাজে সাহায্য করায়, আমরা দিয়েও দিতাম। সত্যিকথা বলতে কি, আমাদের সে খুব ভালোওবাসতো। তাকে মাঝেমাঝে মাথা বেছে দিতে বলতাম। মাথা বেছে দেওয়া মানে, চুলটা একটু নেড়েচেড়ে দেওয়া। মুশকিল একটাই ছিল, ও কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর নিজের দুই আঙুলের নখ দিয়ে উকুন মারার মতো করতো, যে কেউ দেখলে ভাবতেই পারে, যে আমার মাথায় উকুনের চাষ আছে। তবে দশ-পনেরো মিনিট মাথা বাছার পরে, দুঃসাধ্য যেকোন পড়া অবলীলাক্রমে মুখস্থ করে ফেলা, বা  যেকোন কঠিন অঙ্কের সমাধান করে ফেলা, কিছুমাত্র কঠিন কাজ বলে মনে হতো না।

একদিন সে আমাকে বললো, “আঙা সনকার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তোকে কিন্তু বরের আংটিটা দিতে হবে”।

অলকা আর সনকা নামে ওর দুটো মেয়ে আছে শুনেছিলাম, তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “অলকার বিয়ে না দিয়ে সনকার বিয়ে ঠিক করতে গেলে কেন”?

উত্তরে সে শুধু বললো, “আমি কি আর ঠিক করেছি? দুই মেয়ের মধ্যে সনকা তো একটু চাখাচোখা, তাই ঘটক ওকেই বিয়ের জন্য পছন্দ করেছে। তোকে কিন্তু বরের আংটিটা দিতেই হবে?”

জিজ্ঞাসা করলাম “ঘটক নিজেই ওকে বিয়ে করছে”?

“না, তা কেন? ঘটক নিজে ওর সম্বন্ধ এনেছে। আংটি দিবি তো আঙা”?

“পাত্র কি করে”?

“তা আমি কি করে জানবো, আমি কি তোদের মতো নেকাপড়া শিকেচি”?

“পাত্রের বয়স কতো, দেখতেই বা কেমন”?

“আমি কি পাত্রকে দেখেছি যে বলবো? ঘটক তো বললো দেখতে বেশ ভালো, তোমার সনকার সাথে মানাবে”।

“পাত্র থাকে কোথায়”?

“ঘটক তো বললো ওদের বাড়ি আছে, মাটির ছোট বাড়ি হলেও নিজেদের”।

“হ্যাঁগো, জামাই বেঁচে আছে তো”?

ও বোধহয় বলতে যাচ্ছিল যে তা আমি কি করে জানবো, ঘটক জানে। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,   “যাঃ, কি যে বলিস, বেঁচে না থাকলে ঘটক কি আর বিয়ের সম্বন্ধ করতো”?

মেয়ের বিয়ের জন্য কয়েকদিন কামাই করে যেদিন সে আবার কাজে যোগ দিলো, সেদিনই তার কাছ থেকে জানতে পারলাম যে জামাই নাকি চোর, বিয়ের আসর থেকেই পুলিশ তাকে বালা পরিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। আংটি না দেওয়ার জন্য নিশ্চিন্ত বোধ করলাম।

এরও কয়েক মাস পরে শুনলাম, বর এখনও জেলে থাকায় সনকা নাকি আবার কাকে বিয়ে করেছে। এবারের সম্বন্ধটাও ঘটকের দেওয়া কী না জিজ্ঞাসা করলাম না, সেটাও সম্ভবত ঘটক জানে।

আমি চাকরি বাকরি করে আধবুড়ো হয়ে যাওয়ার পরও কিন্তু, মেনকাদি তার এই আঙাকে ভোলেনি। মাঝেমাঝে আমার বাড়িতে এসে মাথায় মাখার জন্য একটু নারকেল তেল, বা সামান্য কিছু সাহায্য চাইতো। সামান্য কিছু খাবার ও সাহায্য, সাথে মাথায় মাখার একটু নারকেল তেল পেয়ে তার মুখটা কিরকম উজ্জ্বল হয়ে যেত, আজও ভুলতে পারলাম কই? জানি না সে আজও বেঁচে আছে কী না। যে লোকেই থাকুক, সে ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক।

সুবীর কুমার রায়

৩০-১২-২০১৮

 

দুই মেরু {লেখাটি গল্পগুচ্ছ, ও Sahitya Shruti পত্রিকায় প্রকাশিত।}

43951291_1089996314509450_8725371820129124352_n   কাশী নামে একটা বছর দশ-বারো বয়সের ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে জুটলো। কোথা থেকে কার সৌজন্যে তার এই বাড়িতে প্রবেশ, আজ আর মনে করতে পারি না। তবে ছেলেটা বেশ ভালো ছিল, ও টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা, হঠাৎ প্রয়োজনে কাছাকাছি দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে দেওয়া, সে হাসিমুখে করতো। ও আমাদের বাড়ির ছেলের মতো ছিল, এবং আমাদের খুব ভালওবাসতো।

আমাদের বাড়ি থেকে বড়রাস্তা পাঁচ মিনিটেরও পথ নয়। লোক বসতি ও যানবাহন প্রচুর হলেও, সামান্য বৃষ্টি হলেই,  নির্দিষ্ট বেশ কিছুটা রাস্তায় এক কোমড় জল জমে যেত। এই বড় রাস্তার ওপর ‘কর কাফে’ নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। এখনকার মতো তখন আধুনিক কায়দার রেস্টুরেন্ট, বা আধুনিক সব অদ্ভুত নামের খাবার পাওয়া যেত না। রেস্টুরেন্ট বলতে এই ‘কর কাফে’, ও আরও কিছু দূরে একই মালিকের ‘ওরিয়েন্টাল কেবিন’ ছাড়া আর কিছু ছিল না। এই দুই দোকানের কিমা কাটলেট্ ও ব্রেস্ট কাটলেট্ সম্ভবত পঁয়ত্রিশ পয়সা ও পঁচাত্তর পয়সা দাম ছিল, ও খেতেও মন্দ ছিল না। এছাড়া বড় রাস্তার ওপর উনুন জ্বেলে গরম তেলে ভাজা রামপ্রসাদের আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি বা ফুলুরি,  সে তো অমৃত ছিল।

যাহোক, সপ্তাহে প্রায় দু’-তিন দিন এই কিমা কাটলেট, না পেলে ব্রেস্ট কাটলেট বা মোগলাই পরোটা, সাথে গরম গরম চা, আমাদের ভাই-বোনেদের সান্ধ্য আড্ডার আসর মাতাতো। কাশীর ওপরেই এইসব অমৃত আহরণ করার দায়িত্বটা পাকাপাকি ভাবে অর্পণ করা হয়েছিল। প্রায় রোজই করকাফে তে যাওয়ার ফলে, দোকানের লোকজনও তাকে নিয়মিত ও বড় খদ্দের হিসাবে চিনে ফেলেছিল। সে কোন্ বাড়ি থেকে খাবার কিনতে আসে তা তারা জানতো না ঠিকই, জানার প্রয়োজনও ছিল না, কারণ কাশী প্রতিদিনই নগদ টাকায় খাবার কিনতো। তবে যে বাড়ি থেকেই তার আগমন হোক না কেন, তারা যে এই দোকানের বড় খদ্দের, ও ধার বাকির রাস্তায় হাঁটেন না, এইটুকু বৈষয়িক বুদ্ধি দোকানের সকলেরই অবশ্যই ছিল। আর তাই কাশীর পছন্দের চাহিদা মতো চপ বা কাটলেট না থাকলে, তারা নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে অধিক মূল্যের কোন খাদ্যবস্তু তার হাতে দিয়ে বাকি টাকা পরে এসে দিয়ে যেতে বলতো।

এক প্রচন্ড দুর্যোগের দিনে, সন্ধ্যার পর দাদা ক্যানিং থেকে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরলো। বিকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। ভালো করে স্নান সেরে চা জলখাবার খেয়ে মোমবাতির আলোয় গুছিয়ে বসে কিছুক্ষণ পরে দাদা হঠাৎ বলে বসলো, “এই ওয়েদারে চপ্-কাটলেট কিছু খেতে পারলে বেশ হতো, কিন্তু সারাদিন যা বৃষ্টি হয়েছে, তাতে কর কাফের কাছে যা জল জমে, এতক্ষণে বোধহয় জলে ডুবে গেছে। মোমবাতির আধো আলো আধো অন্ধকারে এই আবহাওয়ায় বসে, ওর বোধহয় মনে মনে ক্যান্ডেল লাইট চপাহারের বাসনা জেগেছে।

কাশীর ‘কর কাফে’ যাওয়ার ব্যাপারে কোনদিনই আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করিনি, আজও নয়। সেটাই স্বাভাবিক, আমাদের যদি চপ কাটলেটে এতো আসক্তি থেকে থাকে, তাহলে ওর দোষটা কোথায়? সেও তো প্রায় সমপরিমাণে ভাগ পেয়ে থাকে। অতি উৎসাহে সে বেশ চিৎকার করেই বলে উঠলো, “আমি একবার গিয়ে দেখবো বড়মামা, দোকান খোলা থাকলে আমি ঠিক নিয়ে আসবো”।

ওর কথা শুনে ভিতরের ঘর থেকে বাবা ওকে এই ওয়েদারে দোকানে পাঠাতে বারণ করলেন। আবহাওয়াটা কোন সমস্যা নয়, আসল সমস্যা জল জমা। অভিজ্ঞতা বলছে, সারাদিন যা বৃষ্টি হয়েছে, তাতে কর কাফের কাছে কাশীর গলা পর্যন্ত জল জমে থাকতে বাধ্য। ইচ্ছা থাকলেও আমরাও ওকে দোকানে পাঠাতে সাহস করছিলাম না। কিন্তু কাশীর উৎসাহ ও বার বার “কিচ্ছু হবে নাগো, আমি মাথার ওপরে হাত তুলে ঠিক নিয়ে আসতে পারবো, দেখো একটুও ভিজবে না” বলায়, আমরাও শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। কাশী ছাতা নিয়ে ব্যাগ হাতে দশ টাকার একটা নোট নিয়ে দুগ্গা দুগ্গা করে বেড়িয়ে গেল।

বাবাকে আর জানাতে সাহস হলো না, যে কাশীকে দোকানে পাঠানো হয়েছে। আমরা মোমবাতির আলোয় আধো আলো আধো অন্ধকারে কাশীর প্রতীক্ষায় বসে থাকলাম। ধীরে ধীর ঘড়ির ছোট কাঁটা সাতের ঘর ছেড়ে আটের ঘরে গিয়ে ঠেকলো, কাশীর দেখা নেই। ধীরে ধীরে ঘড়ির ছোট কাঁটাটা যখন নয়ের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে, তখন আমরা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম, কারণ কাশী মোটেই পালাবার ছেলে নয়। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, বাবা যাতে জানতে না পারেন, তাই চুপিসারে কাশীর খোঁজে বেরোবো বলে ছাতা নিয়ে তৈরি হয়েছি, এমন সময় শ্রীমান কাশী একটা আধভেজা বিশাল ঠোঙা, ও একটা পাঁচ টাকার নোট হাতে ফিরে এসে আমাদের আসন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করলো।

জানা গেল যে কর কাফের ভিতর জল ঢুকে যাওয়ায়, সে প্রায় তার বুক সমান জল পেরিয়ে অনেক কসরত করে স্টেশনের কাছ থেকে পাঁচ টাকার আলুর চপ কিনে, ওই একই ভাবে জল ভেঙে ফিরে এসেছে। তখন দশ পয়সা আর পাঁচ পয়সা মূল্যের দু’রকম সাইজের আলুর চপ সর্বত্র পাওয়া যেত। দশ পয়সা মূল্যের আলুর চপ পাওয়া যায়নি বলে,  সে পাঁচ পয়সা দামের পাঁচ টাকার চপ নিয়ে এসেছে। পাঁচ টাকার, অর্থাৎ মাত্র একশ’টা বরফশীতল আলুর চপ, সে এরকম একটা ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দিনে রাত প্রায় সোয়া ন’টার সময় এনে হাজির করেছে।

একসাথে অতগুলো চপ কিনলে ফুচকা খাওয়ার মতো দু-চারটে ফাউ পাওয়ার হক, অবশ্যই আশা করা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সংখ্যাটা সেঞ্চুরির থেকে অনেকটাই কম। কারণ হিসাবে কাশী জানালো, চপওয়ালার কাছে আর চপ ছিল না। সে একটা দশ টাকার নোট নিয়ে চপ কিনতে গিয়েছিল। আমাদের সকলের, হয়তো বা চপওয়ালারও গত জন্মের অনেক পুণ্যের ফল, যে তার কাছে ওই কয়েকটাই অবিক্রিত ঠান্ডা চপ পড়ে ছিল।

এতক্ষণের টেনশনে দাদা এতটাই ভীত ও উত্তেজিত হয়ে ছিল, যে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে, টেবিল থেকে প্রায় শেষ হয়ে আসা জ্বলন্ত মোমবাতিটা নিয়ে, দশ-বারো ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কাশীকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। মোমবাতিটা কৃত্রিম উপগ্রহের মতো যাত্রা শুরু করেও, মাঝপথে নিভে গিয়ে গোটা বাড়ি তমসাচ্ছন্ন করে দিয়ে, যুদ্ধ সমাপ্তির পথ সুগম করে দিল। শেষে অনেক খুঁজেপেতে দেশলাই বার করে মোমবাতি জ্বালা হলো। বারো-চোদ্দটা মতো ঠান্ডা চপ গলাধঃকরণ করে, বাকিগুলো ফেলে দিয়ে, সেদিনের চপ ভক্ষণ পালার সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।

*************************************************************************************

একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় বাবা একটা বছর বারো-তেরোর ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে হাজির করলেন। জানা গেল যে সে হাওড়া স্টেশনে বাবার কাছে ভিক্ষা চাওয়ায়, বাবা ছেলেটির দুঃখ, কষ্ট, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতটাই উতলা ও চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, যে ছেলেটিকে সঙ্গে করে একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়ে না নিয়ে আসা ছাড়া, দ্বিতীয় কোন উপায় খুঁজে পাননি।

বাবা নিজেই ছেলেটির পরিচয় দিয়ে জানালেন, যে এই উড়িয়া ছেলেটির নাম শিবো, ভদ্র ঘরের ছেলে, তবে খুবই গরীব। তাঁর কাছে কিছু সাহায্য চাওয়ায় তিনি সাহায্যের ভাণ্ডার উজাড় করে তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমাদের বাড়িতে থাকবে, মা’কে হাতে হাতে তাঁর কাজে একটু সাহায্য করবে। এখানেই শেষ নয়, তিনি ছেলেটিকে সাহায্যের জন্য এক বিশাল পরিকল্পনাও অতটুকু সময়ের মধ্যেই বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি শিবোকে লেখপড়াও শেখাতে চান।

আমরা সবাই আপত্তি জানিয়ে বললাম, যে অজানা অচেনা একটা ছেলেকে হুট করে বাড়িতে নিয়ে এসে স্থান দেওয়া খুবই ঝুঁকি সম্পন্ন। যেকোন সময় বাড়ির কিছু হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়বে, চাই কি আরও বড় কোন ক্ষতি করাটাও অসম্ভব নয়। কোন বড় অসামাজিক দল, একে এই জাতীয় কাজে ব্যবহার করছে, তাও হতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রয়োজনে তাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হোক। আমাদের এই যুক্তি ধোপে টিকলো না। একনায়কতন্ত্র শাসনের এটাই সমস্যা। বাবা জানালেন, অহেতুক কাউকে আগেই সন্দেহ করাটা ঠিক নয়। দু’-চার দিন দেখাই যাক না, সেরকম বুঝলে চলে যেতে বললেই হবে। অতএব পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই, শিবো এই বাড়ির নাগরিকতা পেয়ে গেল।

নতুন একটা সাবান দিয়ে তাকে ভালো করে স্নান করে আসতে বলা হলো। পুণ্যস্নান সেরে বাইরে আসলে, তাকে আমাদের একটা হাফপ্যান্ট ও টিশার্ট পরতে দেওয়া হলো। আর সকলকে নির্দেশ দেওয়া হলো যে আজ যেন তাকে কেউ কোন কাজ করতে না বলে, কারণ ছেলেটি অভুক্ত ও ক্লান্ত, তার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। সেইমতো শিবো নতুন ঢাউস প্যান্ট ও টিশার্ট পরে, মাদুর পেতে শুয়ে পড়ে বিশ্রাম নিতে শুরু করলো। আমাদের খাওয়ার আগে তাকে ডেকে তুলে রুটি তরকারি খেতে দেওয়া হলো। পারলে বাবা হয়তো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার খাওয়ার তদারকি করতেন, কিন্তু আমাদের অপছন্দের কারণ হতে পারে ভেবে, আর সেটা করলেন না। শিবো চন্দ্র খানপাঁচেক রুটি, তরকারি সহযোগে উদরস্থ করে, আবার তার মাদুরে পরিপাটি করে শুয়ে পড়লেন, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার যোগনিদ্রায় নিমগ্ন হলেন। বাবা শুধু বললেন “দেখছিস ও কতটা ক্লান্ত, সন্ধ্যে থেকে এক নাগাড়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে”।

পরদিন সকালে উঠে শ্রীমান শিবো চন্দ্র দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে চা বিস্কুট খেয়ে, উচ্চৈঃস্বরে “হাগুচি হাগুচি হাগুচি, মরি মরি পাতালগুচি, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ” বলে পড়ে যাওয়ার মতো করে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। এর অর্থ আমাদের জানা নেই, তবে এতক্ষণে প্রকাশ পেলো, যে তিনি নাকি ওড়িয়া যাত্রায় অভিনয় করতেন। এহেন একজন যাত্রা সম্রাটের দেখা দৈবাৎ মেলে। আমাদের বাড়িতে তিনি অবস্থান করছেন ভেবে বেশ গর্বও হলো।

বাবা অফিসে চলে গেলে বাধা দেবার কেউ নেই বুঝে, মা তাকে টুকটাক ফাইফরমাশও করলেন। সকালের জলখাবার, দুপুরের আহার সেরে, তিনি আবার একপ্রস্থ নিদ্রামগ্নও হলেন, তবে এই সময়ের মধ্যে আরও বার দু’-তিন হাগুচি হাগুচি শোনার ও দেখার সৌভাগ্যও আমাদের সকলের হলো। আহা, কি বলিষ্ঠ অভিনয়! সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফেরার পথে বাবা না আবার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কিছু বই তার উচ্চ শিক্ষার্থে কিনে নিয়ে আসেন, আমরা সেই আশঙ্কায় সারাটা দিন কাটালাম।

সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে বাবা অফিস থেকে ফিরে প্রথমেই তার কুশল সংবাদ নিলেন। এরও বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবা শিবোর হাতে একটা সিকি দিয়ে চীপ ভ্যারাইটি স্টোরের পথ নির্দেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার জন্য এক বান্ডিল বিড়ি নিয়ে আসতে পারবি? সবুজ সূতোর বিড়ি চাইবি। হারিয়ে যাবি নাতো”? চীপ ভ্যারাইটি স্টোর, আমাদের বাড়ি থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিটেরও পথ নয়, তাছাড়া শিবোও হারিয়ে যাবার পাত্র বলে মনে হয় না। শিবো সম্মতি জানিয়ে পয়সা নিয়ে চলে গেল।

সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত বাড়তে লাগলো, শিবো ফিরে এলো না। ক্রমে রাত আটটা, ন’টা পার হয়ে যখন দশটা বাজলো, তখন সবাই একটা বিষয় একমত হলাম, যে শিবো সিকিটা নিয়ে পগার পার হয়ে গেছে। বাবা মানসিক ভাবে বেশ ভেঙে পড়ে বার বার বলতে লাগলেন, “ছেলেটা চার আনা পয়সার লোভ সামলাতে পারলো না? সত্যি মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না”।

রাত যখন প্রায় এগারোটা বাজে, শিবো আর কিছু নিয়ে পালিয়ে গেছে কী না, তার সন্ধানে আমরা লেগে পড়লাম। রাত প্রায় সোয়া এগারোটার সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখা গেল শিবো চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন। মুঠো করা হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত একটা বিড়ি। মুঠো করা হাতেই বিড়িটা বার দু’-তিন সুখটান দিয়ে ফেলে দিয়ে, সে ভিতরে ঢুকলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম “কোথায় গিয়েছিলি, এতটুকু ছেলে তুই বিড়ি খাস, তোর লজ্জা করে না”? উত্তরে সে পরিস্কার জানালো, “তাতে কি হয়েছে? আমরা বলে মায়ের পেট থেকে পড়েই বিড়ি খাই”।

এতক্ষণে গোটা ঘটনাটা জানা গেল। শিবো এখান থেকে বড় রাস্তায় গিয়ে জুয়া খেলেছে। একটা কাঠের গোল চাকতির একবারে শেষপ্রান্তে ছোট ছোট পেরেক মারা, মাঝে একটা জিভছোলা লাগানো। প্রতিটা পেরেকের মাঝে কিছু না কিছু আঁকা বা লেখা আছে। কোন কোন পেরেকের মাঝে পয়সার উল্লেখ করা আছে। চাকতিটাকে জোরে ঘোরালে, থামার সময় জিভছোলাটা যে ঘরে এসে থামবে, সেই ঘরে কোন পয়সার উল্লেখ থাকলে, জুয়ারি ততো পয়সা পাবে। শিবো ওই সিকি দিয়ে এই খেলা খেলে, যা পয়সা লাভ করেছে, তাই দিয়ে এক বান্ডিল বিড়ি কিনে, শ্যামলী সিনেমা হলে নাইট শোয়ের টিকিট কেটে সিনেমা দেখে ফিরে এসেছে।

সব শুনে বাবাতো তাকে তখনই বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বার করে দিতে গেলেন। আমরাই এবার বাবাকে বারণ করলাম। এতো রাতে সে কোথায় যাবে ইত্যাদি বোঝাতে, তিনি রাজি হলেন বটে, তবে হুকুম হলো কাল সকালেই যেন তাকে বার করে দেওয়া হয়। হলোও তাই, আমরা এক মহান যাত্রা সম্রাটের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হলাম।

সুবীর কুমার রায়

২৬-১২-২০১৮

 

 

মূর্খ পণ্ডিত {লেখাটি প্রতিলিপি-বাংলা, Sahitya Shruti, ও গল্প গুচ্ছ পত্রিকায় প্রকাশিত।}

36271711_998507660324983_1780579280690872320_n চাকরির শুরু থেকে সেভিংস্, কারেন্ট, ড্রাফ্ট্, পে অর্ডার, এম.টি., এফ.ডি., ইত্যাদি নিয়ে এগারোটা বছর বেশ ছিলাম। কিন্তু ওই যে, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’, কবি বাক্য তো আর মিথ্যা হতে পারে না। দুনিয়ায় এতো লোক থাকতে শনির দৃষ্টি আমার ওপরেই পড়লো। প্রমোশন নিয়ে গ্রামে যেতেই হলো। তা আবার যে সে পোস্ট নয়, একবারে রুরাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার, অনেকে আবার বলেন ফিল্ড অফিসার, স্থানীয় মানুষদের কথায় ফিলটার বাবু। আমার মতো একজন বিশেষজ্ঞ মানুষের অভাবে, একটা গোটা ব্লকের দু’-দু’টো অঞ্চলের প্রায় আশিটা গ্রাম, ও অপর  একটা অঞ্চলের একটা গ্রামের অসংখ্য মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা নাকি প্রায় স্তব্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার মতোই ওই জেলার বিভিন্ন শাখায়, প্রায় পঁচাত্তর জন করণিক প্রমোশন নিয়ে বিভিন্ন গ্রামের উন্নতি সাধন করতে গেছে।

প্রথম দিন অফিসে ঢোকার আগেই ভিতর থেকে তাঁত চলার মতো কিসের একটা আওয়াজ পেলাম। আগেই শুনেছিলাম, যে অফিসের ওই ছোট্ট বাড়িটা নাকি, আগে একটা বইয়ের দোকান ছিল।  ভিতরে ঢুকে দেখি বাড়িটা ছোট হলেও, তার ভিতরে আগ্রা বা রাজস্থানের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মোটা মোটা থামের মতো খান তিনেক থাম। গ্রামের লোক যাতে অতি সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় ফিলটার বাবুটির সাথে সাক্ষাৎ করতে পারে, তাই আমার বসার জায়গাটা একবারে দরজার কাছে। গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ না আসায়, গোটা বাড়িটায় মাদুরের চারপাশে কঞ্চির ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো পাখা, দড়ি দিয়ে পালা করে দু’জন ছেলে টেনে যাচ্ছে। প্রতিটা মাদুরের পাখায় এমনভাবে দড়ি বাঁধা, যে ছেলেটি তার হাতের দড়ি ধরে টানলে, সবকটা পাখা একসাথে দুলে দুলে কর্মচারীদের হাওয়া খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। বাইরে থেকে এটার আওয়াজকেই তাঁত চলার আওয়াজ ভেবেছিলাম। একবারে রাজারাজরা জমিদারদের মতো সুব্যবস্থা। কিন্তু এইজাতীয় কাজে ধারণাহীন আমার সমস্যাটা দেখা দিলো অন্যভাবে।

যে অঞ্চলে যে কর্মীটি তার কপাল গুণে বা দোষে পোস্টিং পেলো, তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই ধরে নেওয়া হলো, যে সে ওই অঞ্চলের প্রচলিত ব্যবসা বা চাষাবাদ সম্বন্ধে একজন যথার্থ বিশারদ। যেমন যে কর্মীটি ফুল চাষের জন্য বিখ্যাত কোন অঞ্চলে পোস্টিং পেলো, ধরে নেওয়াই হলো, যে তার মতো ফুল চাষে পাণ্ডিত্য, দুনিয়ায় আর দ্বিতীয় কারো নেই।

আমি কপালগুণে যেখানে পোস্টিং পাই, সেটা একটা নদী ও মোহানা এলাকায় অবস্থিত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার অত্যন্ত গরীব মানুষগুলো নদী বা সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো, এবং এরজন্য তাদের নাইলন জাল ও নৌকার প্রয়োজন হতো। এছাড়া পান চাষ, শুয়োর পালন, বিভিন্ন রকম সামগ্রীর দোকান করা, ইত্যাদি ছিল গরীব মানুষগুলোর একমাত্র রুজি রোজগারের উপায়।

আমি কিছু শুয়োর দেখে থাকলেও, কোনদিন শুয়োরের মাংস খাইনি। পান সিগারেটের দোকান থেকে কিছু পান কিনে খেলেও, পান চাষের পদ্ধতি বা কি কি করণীয়, সে বিষয় কোন ধ্যানধারণা আমার ছিল না। ছিপ দিয়ে কিছু পুঁটি, বাটা, বা তেলাপিয়া মাছ ধরে থাকলেও, এবং বেশ কয়েকবার নৌকা চেপে থাকলেও, নৌকা চেপে জাল নিয়ে মাছ ধরতেও যাইনি। অভিজ্ঞতাহীন এহেন আমাকে কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই, বিস্তীর্ণ এলাকার অতগুলো গ্রামের দারিদ্রসীমার নীচের গরীব মানুষগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভুত উন্নতি সাধনে, যোগ্যতম ব্যক্তি হিসাবে চুন চুনকে চয়ন করা হলো।

কথামতো তফসিলি জাতি, উপজাতি, বা সংখ্যা লঘু অঞ্চলে, বছরে নয়শত আই.আর.ডি.পি সরকারি ঋণ দিতে হবে। আমার দু’টো অঞ্চল, ও অপর অঞ্চলের গ্রামটি এই শ্রেণীভুক্ত হওয়ায়, নিয়ম অনুযায়ী আমাকে ওই নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক বৎসরে নয়শত নতুন ঋণ দিতে হবে। গত বছরের প্রচুর লোন প্রপোজ্যাল এখনও বিতরণের অপেক্ষায় পড়ে আছে, তার ওপর এ বছরের বান্ডিল বান্ডিল লোন প্রপোজ্যাল অনুমোদনের অপেক্ষায় পড়ে আছে। কাজে যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই, এই গন্ধমাদন পর্বতের বোঝা আমার কাঁধে এসে পড়ায়, ভয় পেয়ে গেলাম। কি করতে হয়, তাও আমার জানা নেই, দেখিয়ে বা বুঝিয়ে দেওয়ার লোকও নেই।

দিনকতক পরেই গ্রাম সেবকের সাথে জমে থাকা নতুন কিছু লোন প্রপোজ্যাল ইনসপেকশন করতে একজনের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের বেশ কিছু লোন আবেদনকারী এসে হাজির হয়েছে। আমাকে দেখেই তারা দাঁড়িয়ে উঠে হাতজোড় করে “নতুন ফিলটার বাবু আয়েটে” বলে অভ্যর্থনা করলো। একসাথে এতোগুলো গরীব গ্রাম্য মানুষের সাথে এই আমার প্রথম পরিচয়। বি.ডি.ও. অফিস থেকে লোন আবেদন আমাদের কাছে পাঠানো হয়। আবেদন পত্রে সবকিছু বর্ণনা করা থাকে। আমার কাজ আবেদনকারীর সাথে কথা বলে বিচার করে দেখা, যে ওই জাতীয় কাজে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কী না, সে সত্যিই ওই কাজ করতে চায় কী না, বা করতে পারবে কী না, ইত্যাদি ইত্যাদি। যাতে সে টাকাগুলো নষ্ট না করে লোনের টাকায় নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে ও ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করতে সক্ষম হয়।

বেশ চলছিল, বিশেষজ্ঞের মতো কিছু প্রশ্ন করে তাদের বাজিয়ে নিয়ে মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। প্রশ্নোত্তরের নির্দিষ্ট ফর্মে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরে আবেদনকারীর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হলে, নিজে সাক্ষর করে আবেদনকারীকে দিয়ে সাক্ষর করিয়ে, গ্রাম সেবককে সাক্ষর করার জন্য দিচ্ছিলাম। যাইহোক একসময় একজন আবেদনকারীর সাথে আমার কথোপকথন শুরু হলো। আমার পাণ্ডিত্বের নমুনা দিতেই এতো কথার অবতারণা।

“কিসের ব্যবসা করতে চাও”?

“আঁজ্ঞে মুরগির ব্যবসা হুজুর”।

“মুরগির ব্যবসা কতদিন করছো”?

“আঁজ্ঞে অনেক বছর ধরে হুজুর”।

“বাড়িতে এখন কতগুলো মুরগি আছে”?

“তা হুজুর বিশ-পঁচিশটা হবে”।

“বাড়ি গেলে মুরগিগুলো দেখাতে পারবে? এইক’টা মুরগি নিয়ে কি ব্যবসা হয় নাকি”?

“আঁজ্ঞে নিশ্চই পারবো ফিলটারবাবু। টাকা পেলে বড় করে করবো”।

এইভাবে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের উত্তর লিপিবদ্ধ করে তাকে দিয়ে সাক্ষর করিয়ে যখন গ্রামসেককে দিলাম, তখন তিনি বললেন, “এটা ভুল হয়েছে স্যার, ও মুরগির ব্যবসা করে না ও মুগরির ব্যবসা করে”।

বোঝ ঠ্যালা, মুগরিটা আবার কি পদার্থ? এতক্ষণে জানা গেল মুগরি হচ্ছে বাঁশ কেটে সরু সরু কাঠি তৈরি করে, তাই দিয়ে মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি করা। আমাদের এখানে যাকে ঘুর্ণি বলে। ফর্মটা ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে ফর্ম পুরণ করলাম।

মাঝে মাঝে নৌকার ইনসপেকশনে যেতে হতো। প্রায় মোহানার কাছে নদীর পাড়ে, পরপর অনেক নৌকা বাঁধা থাকতো। মাছ ধরার প্রকৃত সময়, নৌকার মালিকরা নদীর পাড়ে বাঁশ হোগলা ইত্যাদি দিয়ে, পরপর ঘর তৈরি করে থেকে যেত। আমি সেখানে গিয়ে নৌকা দেখতে চাইলে, “হাই সেটা আমার নৌকা” বলে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিত। সেটা যে ওর নৌকা, বোঝার কোন উপায় ছিল না। তাছাড়া নৌকার কাছে যেতে গেলে, এক হাঁটু জল কাদা ভেঙে যেতে হবে। ফলে বিশ্বাস করা ছাড়া, দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। নিয়ম রক্ষার জন্য তাদের কথা মতো অনুসন্ধান রিপোর্ট লিখে রাখতাম। নৌকা মাপার একককে পদ বলে, এটাই ছিল আমার নৌকা সম্বন্ধে জ্ঞানের দৌড়। কিন্ত এই আমাকেই, নাইলন জাল বা নৌকা তৈরির জন্য নাইলন সুতো বিক্রেতা বা নৌকা প্রস্তুতকারককে ডেলিভারি অর্ডার দিতে হতো।

একদিন এক ঋণ গ্রহীতা এসে আমায় ধরলো, তাকে তার নৌকায় লাগাবার জন্য একটা ভুটভুটি মেশিন, অর্থাৎ মোটর কেনার লোন দিতে হবে। পূর্বের নৌকার লোনের টাকা সে প্রায় নিয়মিত পরিশোধ করে, কাজেই ভুটভুটি কেনার লোন তাকে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তার নৌকায় কি জাতীয় মোটর লাগাতে হবে, তার দামই বা কতো হওয়া উচিৎ, কার কাছে জানতে যাবো। অনেকভাবে কাটাবার চেষ্টা করেও যখন সফল হলাম না, তখন বাধ্য হয়ে বললাম, যে তার নৌকাটা আগে একবার দেখাতে হবে। সে তো সাথে সাথে রাজি হয়ে গিয়ে বললো কবে ‘ইনকুমারি’  করতে যাবেন বলুন। নৌকা কোথায় আছে জানতে চাওয়ায়, সে জানালো যে তার নৌকা জলদা খটিতে আছে। আমাকে প্রতিদিন নদী পেরিয়ে অফিস যাতায়াত করতে হতো। আমি পরিস্কার জানিয়ে দিলাম যে আমার পক্ষে জলদা খটিতে গিয়ে নৌকার ইনকোয়্যারি করতে যাওয়া সম্ভব নয়, তাকে এই নদীতে তার নৌকা নিয়ে আসতে হবে। সে অনেকভাবে তার অসুবিধার কথা জানিয়ে, শেষে নিমরাজি হয়ে ফিরে গেল। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম এই ভেবে, যে জলদা খটি থেকে এই নদীর যা দূরত্ব, তাতে ‘ভিক্ষা চাইনা মা কুত্তা সামলাও’ নীতি মেনে, সে আর এই ঝামেলায় যাবে না।

ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলাম। দিন কতক পরে অফিস আসার পথে আমি আর আমার এক সহকর্মী নদী পার হওয়ার জন্য মৃগেনের নৌকায় উঠতে যাবো, এমন সময় পিছন থেকে “ও ফিলটারবাবু  নৌকা দেখবেন বলেছিলেন যে” শুনে পিছন ফিরে দেখি একজন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে সে বললো নৌকা দেখবেন বলেছিলেন, তাই নিয়ে এসেছি। আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কার নৌকা? সে আমাকে দিন কতক আগের কথোপকথন উল্লেখ করে, জলদা খটি থেকে তার নৌকা নিয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা করলো। বাধ্য হয়ে তার নৌকার দিকে এগিয়ে গেলাম। সহকর্মীটি এই নৌকায় যেতে রাজি হলো না, সে মৃগেনের নৌকাতেই নদী পার হয়ে অফিস যাবে বলে জানালো। আমি নৌকায় গিয়ে ওঠার পর লোকটি আমায় বললো “ফিলটারবাবু চলেন আপনাকে আমার নৌকায় খানিকটা ঘুরিয়ে আনি। এটাতো আপনাদেরই দয়ায় পাওয়া”। কে কবে  একে নৌকাটা দিয়েছিল জানি না, শুধু জানি যে এই মানুষটা ঋণের টাকা শোধ করে। আমি বললাম যে আমার হাতে অত সময় নেই, অফিস যেতে হবে, তুমি ওপারের ঘাটে নৌকা লাগাও।

যদিও এটা শখের বোটে চড়া নয়, তবু নৌকা বিশেষজ্ঞ ফিলটারবাবুটি যখন ভুটভুটি দেওয়া যাবে কী না দেখবার জন্য তার নৌকায় উঠেছে, তখন ‘ইনকুমারি’ তো একটা করতেই হয়। তাই বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাইয়ের মতো এটা সেটা কিছু প্রশ্ন করে, গম্ভীর গলায় সর্বজ্ঞের মতো জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার এটা কতো পদের নৌকা”?

“আঁজ্ঞে এগারো পদ বাবু”।

আমার তো নৌকাটা দেখে খুব একটা বড় বলে মনে হলো না, তাই বিজ্ঞের মতো বললাম,  “অসম্ভব, এটা নয় পদের বেশি হতেই পারে না”।

“কি বলছেন বাবু? মেপে দেখেন, এটা এগারো পদের নৌকা”।

মনে মনে নৌকাটা কতটা লম্বা হতে পারে একটা হিসাব করে নিয়ে বললাম, “মেপে দেখার দরকার নেই, তোমায় ঠকিয়েছে এটা নয় পদের বেশি হতেই পারে না”।

“না বাবু, এটা এগরো পদের নৌকা, ঠিক আছে আমি আপনাকে মেপে দেখাচ্ছি”। সে নৌকার ওপর  পাতা পাটাতনগুলো সরিয়ে, আমাকে গুণে দেখাতে শুরু করলো। আমার ধারণা ছিল নৌকা কতটা  লম্বা, তার ওপর কত পদের নৌকা নির্ভর করে। যদিও কতটা লম্বা হলে কত পদের হয়, তাও আমার জানা ছিল না। কিন্তু এখন বুঝলাম, যে পরপর ছয় বা আট ইঞ্চি মতো যে তক্তাগুলো জুড়ে জুড়ে নৌকাটা তৈরি হয়, নীচ থেকে নৌকার ওপর পর্যন্ত তক্তার সংখ্যা বা উচ্চতার ওপর নৌকার মাপ বা পদ নির্ভর করে। তবু ফিলটারবাবু এই সহজ ব্যাপারটা না জানলে বিপদ আছে, তাই “হ্যাঁ তাই তো দেখছি, তবু তুমি অন্য কাউকে দিয়ে একবার ভালো করে মাপিয়ে নিও” বলে,  ‘ইনকুমারি’ পর্বের ইতি টানলাম। ভুটভুটি কেনার টাকা তাকে দিয়েছিলাম, ঋণের টাকার কিস্তিও সে মোটামুটি নিয়মিত শোধও করতো।

দিন যায়, হঠাৎ একদিন একজন কাগজে মোড়া কি একটা জিনিস নিয়ে এসে, মোড়ক থেকে বার করে আমার টেবিলে রাখলো। চুনমাখা গয়না পরা লোমশ কি একটা পদার্থ দেখে, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি? “শুয়োরের কান বাবু, শুয়োরটা মরে গেল, তাই কানটা কেটে নিয়ে এলাম। আপনি যা ব্যবস্থা করার করেন”।

শুয়োরের লোন দেওয়ার সময় বীমা করাতে হয়। বীমা কোম্পানি থেকে প্রতিটা শুয়োরের কানে একটা করে ট্যাগ পাঞ্চ করে লাগিয়ে দিয়ে যায়। কোন কারণে শুয়োর মরে গেলে, ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ওই ট্যাগ সমেত দরখাস্ত করে ক্ষতিপুরণ চাইতে হয়। আমার মতো শুয়োর বিশেষজ্ঞ একজন দক্ষ ফিলটারবাবুর, শুয়োরের জীবনচক্র সম্বন্ধে হাতের তালুর মতো পরিস্কার ধারণা থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। একটা শুয়োর কত বছর বয়সে বাচ্চা দেয়, এক একবারে কতগুলো বাচ্চা হয়, কতদিন অন্তর শুয়োরের বাচ্চা হয়, বাচ্চা কত বড় হলে কেটে খাবার উপযুক্ত হয় বা বিক্রি করা লাভজনক হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি, আমার কাছে জলের মতো পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।

একটা কাগজে কানের ট্যাগটার নাম্বার লিখে রেখে, যদিও সেটা ঋণ গ্রহীতার লেজারের পাতায়ও লেখা আছে, কাটা কানটা একটা ছোট খামে ঢুকিয়ে, আঠা দিয়ে মুখ বন্ধ করে সেই খামটা আবার অপর একটা খামে রেখে, সেটার মুখও বন্ধ করে দিলাম। শাখার আর্মড গার্ড, নীমা তামাং কার্সিয়াং-এর বাসিন্দা। তার সাথে আমার বেশ মধুর সম্পর্ক। সে আমায় বললো, তাদের ধর্মে শুয়োর ছোঁয়া নিষিদ্ধ, তা নাহলে সে পোস্ট অফিসে গিয়ে বীমা কোম্পনিতে সেটা পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে আসতো। অন্য কেউ এই উৎকৃষ্ট কাজটা করতে না চাওয়ায়, বাধ্য হয়ে খামটা আমার অফিস ব্যাগে পুরে রাখলাম।

পরের দিন থেকে শুয়োরের কানটা আমার সাথে আমার ব্যাগের ভিতর করে চোদ্দ কিলোমিটার বাস, তারপরে নদী পার হয়ে চার কিলোমিটার রাস্তা ভ্যান রিক্সায় যাতায়াত শুরু করলো। কানটাকে যথাস্থানে আর পাঠানোর সময় করে উঠতে পারি না। শেষে একদিন সম্ভবত কানের দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে, অফিস আসার পথে কান সমেত ব্যগটা আমায় না জানিয়ে আমায় ছেড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে গেল। মহা ঝামেলায় পড়লাম। আবেদন পত্রের সাথে ট্যাগ সমেত কান জমা না দিলে তো ক্ষতিপুরন পাওয়া যাবে না। ব্যাগ ফিরৎ পাওয়ার আশায় ও কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই, আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল।

বীমা কোম্পানির এজেন্ট ছেলেটির সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, আজ ছাব্বিশ সাতাশ বছর পরে এখনও আছে। তাকে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বললাম। সে আমাকে পরামর্শ দিল যে আমি যেন ব্যাঙ্কের প্যাডে ঋণ গ্রহীতার নাম, ট্যাগ নম্বর উল্লেখ করে, আমার কাছ থেকে ট্যাগটা হারিয়ে গেছে জানিয়ে ইনসুরেন্স কোম্পানিকে একটা চিঠি লিখি। যেহেতু আজ পর্যন্ত কোন ক্লেম এই শাখা থেকে করা হয়নি, তাই তারা ক্ষতিপুরনের টাকা দিয়ে দিতেও পারে। তাই করা হলো, এবং শেষপর্যন্ত টাকা পাওয়াও গেল। টাকা না পাওয়া গেলে আমার পকেট থেকেই টাকাটা গুনাগার দিতে হতো।

সবশেষে আর একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি, যদিও এই ঘটনাটা লিখতে নিজেরই খারাপ লাগছে, লজ্জা করছে। তবু ঘটনাটা না বললে ব্যাঙ্কের গ্রামের শাখায় ডেভেলপমেন্ট অফিসারদের, যারা দু’দিন আগেও শহরের বুকে ডেবিট-ক্রেডিট, ড্রাফ্ট-পে অর্ডার, ক্যাশ-ক্লিয়ারিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, কাজের ধরণের বর্ণনাটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

একদিন এক ঋণ গ্রহীতা এসে আমায় বললো ফিলটারবাবু, আপনার সাথে একটা কথা আছে। আমি একটা বিপদে পড়েছি, আপনিই পারেন আমায় সুপরামর্শ দিতে। জানা গেল, লোকটির একটি ডেয়ারি লোন আছে। লোকটি আমায় বললো ফিলটারবাবু, আমার গরুটা কিছুতেই গাভিন হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও কিছু না হওয়ায়, এ. আই. পর্যন্ত করালাম, কিন্তু তাতেও কিছু ফল না হওয়ায়,  ভাবছি একটা ষাঁড় দেই। আপনি অভিজ্ঞ মানুষ, তাই ভাবলাম আপনার কাছ থেকে সুপরামর্শ নিয়ে আসি। কাজের চাপে দম ফেলার সময় নেই, তারমধ্যে অতগুলো গ্রাম পেরিয়ে উনি আর কোন পরামর্শদাতা খুঁজে পেলেন না, আমার কাছে এসেছেন পরামর্শ করতে। এতো রাগ হলো, যে ভাবলাম বলি, না মনের কথাটা আর বললাম না, পাঠক-পাঠিকারাই বুঝে নিন।

এরও অনেক পরে, ফিরে আসার পর একদিন বাড়ির কাছের বাজারে গিয়ে একজন সবজি বিক্রেতাকে বললাম, “লাউ কতো করে”? লোকটি বেশ গম্ভীর হয়ে বললো “এটা লাউ নয়, এটা  চালকুমড়ো”। কথাটা শুনে হাসি পেল, এই বিদ্যে নিয়ে আমি প্রায় আশিটা গ্রামের প্রভুত উন্নতি করে এসেছি, বলা ভালো করতে বাধ্য হয়েছি, তাও আবার পান, নৌকা, জাল, শুয়োর, ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়। এটা শুধু আমার নয়, অধিকাংশ কর্মীর কপালেই এই দুর্ভাগ্য জুটেছিল। এটাই সিস্টেম,  আমরা সেই হাস্যকর সিস্টেমের দাস মাত্র।

সুবীর কুমার রায়

২২-১২-২০১৮

পটু সুন্দরী (স্মৃতির পাতা থেকে)

Tajpur মা’র কাজের সুবিধার জন্য, সম্ভবত স্বামী পরিতক্তা একটা বউকে, দিদি হাসনাবাদ থেকে নিয়ে এল। যতদূর মনে পড়ে, তার নাম বোধহয় মালতী ছিল। তবে আমরা তাকে পটু বলে ডাকতাম। সুকুমার রায়ের কুমড়ো পটাশ এর মতো অনেকটা দেখতে হওয়ায়, যদিও তার কানদুটো হিজিবিজবিজের কানের আকৃতির ছিল, পটাশ থেকে আদর করে পটু নামকরণ। যেমন নোংরা, তেমনি বিদঘুটে দেখতে, আর তেমনি তার গায়ে দুর্গন্ধ। এই পটুকে কিছু বললে খুব রেগে যেত, ও বিড়বিড় করে কী সব বলতো। হয়তো বলা হলো— “ভালো করে স্নান করতে পারো না, গায়ে এত গন্ধ”?

সঙ্গে সঙ্গে ও বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, “আসে আসে আমার আসে”। মাঝে মাঝে ঠোঁট উলটে কাঁদতেও বসতো। তার খাওয়া ছিল রাক্ষসের মতো। তিন-চারজনের খাবার সে একাই খেত।

গরমের সময় আমরা রাতে বাইরের বারান্দায় শুতাম। ঘরেও অবশ্য কেউ কেউ শুতো। পটু রাতে ভিতরের লম্বা ডাইনিং স্পেসে শুতো। ওই ডাইনিং স্পেসে একটা বিরাট মিটসেফ ছিল। এই মিটসেফের ওপরে চালের টিন, মুড়ির টিন ইত্যাদি থাকতো। আর তার ওপর দাঁড়িয়েই ছোটবেলায় আমি মধু চুরি করে খেতে গেছিলাম। সেই টিনগুলোই কী না জানি না, তবে এখনও তিনটে টিন থাকে। ট্রেনে যেমন ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের ঢাকনা দেওয়া মুড়ির টিন হয়।

প্রায়ই ভোরবেলা ডাইনিং স্পেসে মুড়ি পড়ে থাকতে দেখা যেত। সন্দেহটা স্বাভাবিক ভাবেই পটুর ওপর গিয়ে পড়লো। ওকে হাতে নাতে ধরার জন্য আমি আর ভাই, রাতে তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থেকেও, অকৃতকার্য হলাম। বহু চেষ্টা করেও তাকে বামাল সমেত ধরতে না পেরে, শেষে আমার বুদ্ধিমতো অন্য ভাবে চেষ্টা শুরু হলো।

মিটসেফটা বেশ উঁচু, তার ওপর মুড়ির টিন, সেটাও বেশ উঁচু। একটা পিন দিয়ে ঢাকনা ও মুড়ির টিনের গায়ে দুটো তীর চিহ্ন এঁকে দিয়ে ঢাকনা ও টিনের গায়ের তীর চিহ্ন দুটো মুখোমুখি রেখে, ঢাকনা বন্ধ করে রখা হলো। ঠিক হলো, রাতে পটু ঢাকনা খুলে মুড়ি খেয়ে ঢাকনা বন্ধ করলে তীর চিহ্ন দুটো কিছুতেই মুখোমুখি থাকবে না। যদিও এই পন্থায় চুরি ধরা পড়লেও চোর ধরা সম্ভব নয়, তবু এতেও কিছু সুফল পাওয়া গেল না। পটু অনেক সাবধানী হয়ে গেছে। শেষে শেষ চেষ্টা হিসাবে এক মক্ষম পন্থা আবিস্কার করলাম। এটা দীর্ঘমেয়াদি পন্থা। যেদিন যখন ও মুড়ি চুরি করতে যাবে, তৎক্ষণাত ও ধরা পড়বেই।

একটা ভারী চামচের হাতলে একটা আধহাত সুতো বেঁধে, সুতোর অপর প্রান্তে একটা দেশলাই কাঠি বাঁধা হলো। এবার মুড়ির টিনটা সামনের দিকে হেলিয়ে, টিনের পিছন দিকে দেশলাই কাঠিটা টিনের নীচে রেখে, টিনটা সোজা করে দেওয়া হলো। এবার মিটসেফের পিছন দিক দিয়ে চামচটা ঝুলিয়ে দিয়ে, মিটসেফের নীচের তাকে বাসন রাখার জায়গায় আর সব বাসনের মধ্যে একটা পেতলের বড় পাত্রকে এমন ভাবে রাখা হলো, যে ওপর থেকে চামচটা পড়লে, ঠিক ওই পিতলের পাত্রের ভিতরেই পড়বে। টিনের নীচের সরু বিটটায় দেশলাই কাঠিটা আটকে থাকায়, টিনটা সামনের দিকে কাত না করলে নিজে থেকে চামচটা নীচে পড়ে যাবার কোন সম্ভবনাই রইলো না। রাতে ঐ ভারী চামচ ওপর থেকে পেতলের পাত্রে পড়লে, ভীষণ জোরে শব্দ হবে। আসলে মুড়ির টিনটা সোজা অবস্থায় থাকলে, তার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে মুড়ি বার করা পটুতো কোন ছাড়, একটা লম্বা লোকের পক্ষেও সম্ভব নয়। কাজেই পটুকে মুড়ি খেতে হলে ঢাকনা খোলা বা মুড়ি বার করার জন্য টিনটাকে সামনের দিকে কাত করতেই হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে চামচের টানে দেশলাই কাঠিটা টিনের তলার সরু বিটের থেকে মুক্ত হয়ে যাবে, এবং চামচটা সজোরে নীচে নেমে এসে পাত্রে পড়বে। নিস্তব্ধ গভীর রাতে অত ভারী একটা চামচ, পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ফুট ওপর থেকে পেতলের পাত্রে পড়লে, বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙ্গে যেতে বাধ্য।

কিন্তু এই খুড়োর কল দেখে আমার ভাই এতটাই উচ্ছাসিত হয়ে পড়লো, যে জোরে জোরে “তোর কী বুদ্ধিরে রাঙাদা, কী একটা জব্বর প্ল্যান করেছিস রে” ইত্যাদি বলতে শুরু করলো। আর তার ফল? সম্ভবত কিছু সন্দেহ হওয়ায়, পটু মুড়ি খাওয়া বন্ধ করে দিল। শেষে পটুকে একদিন বলা হলো, “পটু, রাতে উঠে তুমি মুড়ি খাও”? পটু তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললো, “না আমি রাতে উঠে মুড়ি খাই না”। আবার বলা হলো, “হ্যাঁ তুমি রাতে উঠে মুড়ি খাও”। পটু এবার একটু চুপ করে থেকে বললো, “কে বলেছে মুড়ি খাই”? “কেন কাল রাতে তো তুমি ঘুমের মধ্যে বলছিলে, কখন উঠে মুড়ি খাব, কখন উঠে মুড়ি খাব”। শুনে পটু শুধু বললো “বলসিলাম নাকি”?

এই পটুর মাথায় প্রায়ই উকুন হতো। তাকে এই নিয়ে খুব কথাও শুনতে হতো। আমরা বলতাম “সারা মাথায় উকুন আর উকুনের ডিমে ভরা, লজ্জা করে না”? তারপরে কী ভাবে উকুনের ডিমটা ক্রমে মুরগির ডিম, কাকের ডিম, ইত্যাদি হতে হতে ছাগলের ডিম, বাঁদরের ডিমে গিয়ে যখন পৌঁছালো, পটু ক্ষোভে দুঃখে ডিম খাওয়াই প্রায় ছেড়ে দিল।

তবে হ্যাঁ, এই পটুর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। সারাদিন পড়াশোনা না করে আড্ডা ও অন্যান্য নানা ভাবে সময় কাটতো, রাতেও রেডিও নিয়ে সময় কেটে যেত। খুব বেশি রাত জাগতেও পারতাম না। একদিন বুঝলাম অনার্স না রাখতে পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই বোধহয় নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার প্রথম ভাবনা চিন্তা। কাজেই ঠিক করলাম রাতে পড়তে হবে। কিন্তু রোজই একটু রাত হলেই ঘুম পেয়ে যায়, প্রতিজ্ঞা করতাম কাল থেকে ঠিক পড়বো। মাসের পর মাস কেটে যায়, কিন্তু সেই কাল আর আমার জীবনে আসে না। রাতে শুতে যাবার আগে পটু সুন্দরী হঠাৎ রোজ মন্দিরে যাওয়া শুরু করলেন, আর তারপর তার পেটাতরের সুগন্ধে, পরবর্তী ঘন্টা তিনেক ঘুম তো দূরের কথা, বাড়িতে টেকাই দায় হয়ে উঠতো। ফলে রাত জাগতে আমার আর কোন অসুবিধাই হতো না।

মুণি, ঋষি ও গুরুজনেরা যতই বলুন, ভোরে উঠে পড়াশোনা করা সবচেয়ে ভালো, আমি বিশ্বাস করতাম, রাতে পড়াই সব থেকে ভালো। কারণ রাতে কারো সাথে কথা বলার, গল্প করার বা আড্ডা মারার সুযোগ নেই। আমাদের সময় ইন্টারনেট বা টি.ভি. তো দূরের কথা, রাত এগারোটায় রেডিওর অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে যেত। এখনকার মতো চব্বিশ ঘন্টা রেডিওর অনুষ্ঠান, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। মোবাইল তো দূরের কথা, দশ ফুটোর চাকা লাগানো একমাত্র কালো ফোন আছে, এমন বাড়ি খুঁজে বার করাও বেশ মুশকিল ছিল। কাজেই পড়া ছেড়ে অন্য কোনভাবে সময় কাটানোর কোন সুযোগ না থাকায়, আমি রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটায় পড়তে বসে, গভীর রাত পর্যন্ত পড়া শুরু করলাম। পটুর কৃপায় রাত জাগতে আর অসুবিধা হতো না। ফলে আমি পাশ করেছিলাম, অনার্সও পেয়েছিলাম।

শেষে পটু একদিন তার বাড়ি ফিরে যাবার জন্য পাগল হয়ে গেল। তার বাড়ি হাসনাবাদে। শ্যামবাজারে গিয়ে হাসনাবাদের বাসে তাকে তুলে দিয়ে আসতে কেউ রাজি না হওয়ায়, ভাঙ্গা কুলো এই আমাকেই, তাকে বাসে তুলে দিয়ে আসতে শ্যামবাজার যেতে হলো। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে পটুকে বাসের সামনের দরজা দিয়ে উঠিয়ে, আমি পিছনের দরজা দিয়ে বাসে উঠে দাঁড়ালাম। বাড়ি থেকে বেরোবার আগেই তাকে বলে দিয়েছিলাম, যে রাস্তায় বা বাসে সে যেন আমার সাথে একটাও কথা না বলে। শেষে শ্যামবাজারে তাকে বাস থেকে নামিয়ে, একসাথে না হেঁটে আগে আগে হেঁটে গিয়ে, হাসনাবাদ যাবার বাসে তুলে দিয়ে, বাস কন্ডাক্টারকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে, তাকে হাসনাবাদে নামিয়ে দিতে বললাম। পরে খবর পেয়েছিলাম যে সে ভালোভাবে বাড়ি ফিরে গেছে।

সুবীর কুমার রায়

১৪-১২-২০১৮

 

 

অভিভাবকহীন প্রথম দূর পাল্লার ভ্রমণের অংশ বিশেষ (স্মৃতির পাতা থেকে) {লেখাটি যাযাবর পত্রিকায় প্রকাশিত।}

43951291_1089996314509450_8725371820129124352_nপ্রাণের বন্ধু মাধবের বড়মামা ডাক্তার। মধ্য প্রদেশের ডোঙ্গরগড়ে রেলে চাকরি করেন। বি.কম. পার্ট ওয়ান পরীক্ষার শেষে বেড়াতে যাওয়া ও প্রচন্ড নকশাল আন্দোলনের ঝামেলা থেকে কিছুদিন মুক্তি পাওয়ার আশায়, আমি ও মাধব ডোঙ্গরগড়ে যাওয়া ঠিক করলাম। যদিও বড়মামাকে খুব গম্ভীর ও রাশভারি মানুষ বলেই মনে হতো। যাইহোক্, সেইমতো আমার ও মাধবের ওখানে যাওয়া পাকা হয়ে গেল।

যেদিন আমাদের যাওয়ার কথা, ঠিক তার আগের দিন রাতে দোতলায় সামনের বারান্দায় পরপর মশারি খাটিয়ে আমরা শুয়ে আছি। আমাদের বাড়ির সামনে একটা মাঝখানে টিনের দরজা দেওয়া অল্প উচ্চতার পাঁচিল ছিল। গভীর রাতে, তখনও ভোর হতে অনেক দেরি আছে, টর্চের তীব্র আলো আমাদের বারান্দায় পড়তে, আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। বাবা ও মা’রও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। নীচের রাস্তায় ভারী বুটের আওয়াজ। হঠাৎ শুনলাম কে যেন বললো, “এই বাড়ি স্যার”। টিনের দরজা না খুলে, পাঁচিল টপকে বেশ কয়েকজন লাফিয়ে ভিতরে প্রবেশ করায় বুঝলাম পুলিশ এসেছে। বাবা বললেন ওদের একটু বুঝিয়ে বলবো, যে এ বাড়ির কেউ নকশালী করে না”? আমি ফিস্ ফিস্ করে আলো জ্বালতে ও কথা বলতে বারণ করলাম। আমি জানি এত রাতে কথা বলতে গেলে, আমরা কেন এত রাতে জেগে আছি, সে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। বাবারও সত্যবান চক্রবর্তীর মতো অবস্থা হবে। সত্যবান চক্রবর্তী একজন নিরীহ প্রৌঢ় ভদ্রলোক, কিছুদিন আগে তাঁর বাড়িতে পুলিশ এসে কাউকে না পেয়ে তাঁর ওপর অকথ্য অত্যাচার করে গেছে। আবার এও বুঝতে পারছি,  যে ওরা ওপরে উঠে এলে, আমার ও গোবিন্দর অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে, কারণ এই বাড়িতে যুবক বলতে আমরা দু’জনই বাস করি। এইসময় হঠাৎ শুনলাম ওদের মধ্যে কে একজন বললো, “এই বাড়ি নয় স্যার, প্রদীপদের পাশের বাড়ি”। প্রদীপ নকশাল হিসাবে পরিচিত ছিল। ওদের বাড়িটা ছিল, আমাদের বাড়ির ঠিক দু’টো বাড়ি আগে। আমাদের বাড়ির রঙ সাদা, আমাদের একটা বাড়ি আগের বাড়িটার, অর্থাৎ প্রদীপদের বাড়ির ঠিক পাশের তিনতলা বাড়িটার রঙও সাদা। ওই লোকটার কথা শোনার সাথে সাথে সবাই আবার পাঁচিল টপকে লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে, প্রদীপদের পাশের বাড়িটার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো।

নিদ্রাহীন সারাটা রাত কাটিয়ে খুব ভোরে দাঁত মাজার অছিলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক ঝলক তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তায় সার সার অবাঙ্গালি সি.আর.পি. তে ভর্তি। একজন মহিলা, লোকের বাড়ি কাজ করতে যাবার সময়, তাকে ওরা বাধা দিল। ভয়ে ভয়ে সে জানালো, যে সে লোকের বাড়ি কাজ করতে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের একজন গম্ভীর গলায় জানালো— “অটোর নেই”। অর্থাৎ অর্ডার নেই। পরে শুনেছিলাম ওদের কাছে খবর ছিল, প্রদীপের পাশের বাড়িতে অনেকে লুকিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও সেই বাড়িতে কাউকেই পাওয়া যায় নি। একটু বেলা হলে সকলে ফিরে গেলে, আবার সব স্বাভাবিক হলো। আজই আমাদের ডোঙ্গরগড় যাবার দিন, আজ কোন ঝামেলা হলে সব পন্ড হয়ে যেত।

এই প্রথম একা একা দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। বেশ একটা হীরো হীরো, সাবালক সাবলক ভাব নিয়ে দু’জনে গীতাঞ্জলীতে ডোঙ্গরগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যাওয়ার আগে মাকাকে লালু-ভুলুর যত্ন নিতে বলে গেলাম। লালু-ভুলু সাদা খরগোশ। লালু মেয়ে, আমার খরগোশ। ভুলু ছেলে, ভাইয়ের খরগোশ। একটা ফাঁক ফাঁক কাঠের বাক্সে, যাতে করে কেক, পাঁউরুটি নিয়ে যাওয়া হয়, খরগোশ দু’টোকে রাখা হতো।

অবসন্ন বিকেল কেটে, একসময় রাত নেমে এল। টু-টায়ার বগিতে মুখোমুখি একদিকে মাধবের, উল্টোদিকে আমার আপার বার্থ। সারাদিন মুখোমুখি কখনও জানালার ধারে, কখনও প্যাসেজের দিকে বসেই কেটেছে। বেশ মনে আছে, অনেক রাত পর্যন্ত নীচে একপাশে কোনমতে বসে গল্প করে কাটালাম। ওপরের বার্থে কেউ নেই, বার্থের লোক নিশ্চই ট্রেন মিস্ করেছে, ইত্যাদি নানারকম আলোচনার পর, দু’জন ওপরে উঠে শুয়ে পড়লো। দেখলাম, দেখেও চুপ করে থাকলাম। আরও অনেক পরে ওই দু’জনকে ডেকে নীচে নেমে আসতে বললে, ওরা অবাক হয়ে গেল। গোটা ট্রেনটায় অন্ধকারে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। আমরা রিজার্ভ করা বার্থ থাকতেও কষ্ট করে কেন জেগে বসেছিলাম, ওরা ভেবে না পেয়ে নীচে নেমে এলো।

বড়মামার কোয়ার্টার্সটা বিশাল। সামনে ও দু’পাশে পুরো ফাঁকা জায়গা। পিছনটা পাঁচিল ঘেরা ছোট্ট জায়গা, কিছু শাকসবজি লাগানো হয়েছে। বড়মামার বড় মেয়ে তার দাদুর কাছে বম্বেতে থাকে। ছোট মেয়ে মুনা ও বাবুল, দু’জনেই বেশ ছোট। ওখানে পৌঁছে কিরকম একটা মন খারাপ করা অস্বস্তি হতে লাগলো। কাউকে চিনি না, বড়মামাও বেশ গম্ভীর রাশভারী মানুষ বলে জানি। একটু পরেই বড়মামা অফিস থেকে এসে, আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। ডানদিকের একটা ঘর আমাদের দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘরটার একদিকের দরজা দিয়ে অন্যান্য ঘরে যাওয়া যায়। অন্য একটা দরজা দিয়ে পিছনের ঘেরা সবজি বাগানটায় যাওয়া যায়। বাড়ির ভিতরে একটা বাথরূম-পায়খানা, আর একটা পায়খানা ওই ঘেরা সবজি বাগানটার একপাশে। এটা কিন্তু আমাদের এখানকার খাটা পায়খানার মতো। একটা সিমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে, এই পায়খানাটায় ঢুকতে হতো।

প্রথম দিন নতুন পরিবেশে ভালোই কাটলো। সন্ধ্যার আগে আমি আর মাধব ঘুরতে বেরলাম। একটু দূরে বোমলাই পাহাড় নামে একটা পাহাড় ছিল। চারিদিকের অন্যান্য পাহাড়গুলোর তুলনায় এই পাহাড়টা অনেকটাই উঁচু। এই পাহাড়টার ওপরে একটা মন্দির আছে। সম্ভবত মন্দিরের দেবীর নাম বোমলাই। আশেপাশে কয়েকটা ছোট ছোট ঢিবি পাহাড় আছে, দূরে সাতপুরা রেঞ্জ। রাতে বড়মামা ও মামি, আমাদের লুডো খেলতে ডাকলেন। আমি আবার আসার সময় সঙ্গে করে একটা চাইনিজ চেকার নিয়ে এসেছি। এই খেলাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। একসময় অনেকেই আমাকে হারাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বেশ মনে আছে, এই খেলায় আমাকে কেউ হারাতে পারে না শুনে বাকসাড়ার একটা ছেলে, এতদিন পরে আর তার নাম মনে করতে পারছি না, আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। আমাকে কেউ হারাতে পারে না, একথা আমি নিজে কোনদিন বলিনি। তবে ব্যাতড়ে আড্ডা মারতে গিয়ে মাঝে মধ্যে খেলা হতো, একথা সত্যি আমাকে কেউ কোনদিন হারাতে পারেনি। ওরাই আমার খেলার প্রশংসা করে একথা বলতো, আর তাতেই গ্যাস খেয়ে, উত্তেজিত হয়ে এই ছেলেটা আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ব্যাতড়েই একজনের বাড়িতে খেলা হবে। ঠিক হলো, যে হারবে সে মুরগির দাম দেবে। যারা দর্শক, অর্থাৎ আমার ফ্যানেরা, তেল, মশলা, চাল ইত্যাদির দাম দেবে। দু’জনের খেলা অনেকক্ষণ চলার পর, আমিই জয়ের হাসি হেসেছিলাম। মুরগির ঝোল, ভাতও সেদিন কথামতো হয়েছিল। যাহোক্, বড়মামাকে চাইনিজ চেকার খেলার কথা বলতে, তাঁরা লুডো খেলাতেই আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

পরদিন সকালে চা খেয়ে বাথরূমে যাবার আগে মাধবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন বাথরূমটায় যাব”? মাধব জানালো দিনের বেলায় ছেলেরা বাইরের বাথরূমটা ব্যবহার করে। সেইমতো আমিও সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ভিতরে ঢুকে লক্ষ্য করলাম, নীচে কোন টব বা গামলা জাতীয় কিছু নেই। গর্তের নীচে পরিস্কার চকচকে লাল সিমেন্টের মেঝে। আবার বাইরে এসে মাধবকে ব্যাপারটা জানাতে, ও বললো কোন অসুবিধা নেই ওখানেই যা। বুঝতে পারছি না যে ও আমার সাথে ইয়ার্কি করছে কী না। যদিও ওর এই জাতীয় ইয়ার্কি করার স্বভাব নয়, তবু ভয় হচ্ছে ওখানে যাবার পর আবার না লজ্জায় পড়তে হয়। শেষপর্যন্ত ওর জোর গলায় অভয়বাণী শুনে ও প্রাকৃতিক ডাকে, যা আছে কপালে ভেবে ওখানেই গেলাম। একটু ভয় ভয় ভাব নিয়ে সবে বসেছি, বস্তুটা শরীর ত্যাগ করে লাল মেঝেয় পড়ার আগেই নীচে কিরকম একটা আওয়াজ হওয়ায়, নীচে তাকিয়ে দেখি দুটো শুয়োর গর্তের নীচে, আর একটা গুঁতোগুঁতি করে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। একটা তো পারলে প্রায় বস্তুটা মাটিতে পড়ার আগেই শরীর থেকে টেনে নিতে চায়। ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কী করবো ভাবছি। এই অবস্থায় বাইরে যাওয়াও সম্ভভব নয়। বাধ্য হয়ে আবার বসলাম। বস্তুটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঝে আবার আগের মতো লাল চকচকে। পরে মাধব জানালো এখানে এটাই ব্যবস্থা, সব বাড়িতেই এই একই ব্যবস্থা। জিজ্ঞাসা করলাম, “কোনদিন শুয়োরগুলোর যদি খিদে না থাকে, বা শরীর খারাপ করে”? মাধব জানালো শুয়োরের অভাব নেই, কারো না কারো খিদে থাকবেই, কাজেই চিন্তার কোন কারণ নেই। এরপর থেকে এই অদ্ভুত ব্যবস্থায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

বেশ কাটছিল। সকালে চা জলখাবার খেয়ে দু’জনে ঘুরতে বেরোতাম। চারিদিক ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে স্নান করা। দুপুরে ভালোমন্দ খেয়ে একটু ভাতঘুম। বিকালে আবার বেরোনো। পাহাড়ে ওঠা, রেল লাইন ধরে হাঁটা, এবং শেষে একটা দোকানে গরম গরম সিঙাড়া ও চা খেয়ে বাড়ি ফেরা। ইতিমধ্যে আমার অনুরোধে বড়মামা ও মাইমাও চাইনিজ চেকার খেলা শুরু করেছেন। এখন লুডো খেলা প্রায় বন্ধ। অনেক রাত পর্যন্ত চাইনিজ চেকার খেলা হতো। বড়মামার এই খেলাটাতে কিরকম নেশা ধরে গেছিল।

একদিন ওখানকার সবথেকে উঁচু পাহাড়টায় যাওয়ার প্ল্যান করলাম। বড়মামা জানালেন ওই পাহাড়ে প্রচুর বড় বড় বুনো মৌমাছির চাক আছে, কাজেই সতর্ক হয়ে যেতে হবে। মৌমাছির ঝাঁক আক্রমণ করলে, মুখটা ঢাকা দিয়ে মুখটাকে বাঁচাতে হবে। সকালবেলা চা, জলখাবার খেয়ে দু’জনে বোমলাই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বোমলাই ঢিবি পাহাড় হলেও বেশ উঁচু। দু-চারটে মৌমাছিকে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঘুরপাক খেতেও দেখলাম। কিন্তু কোন মৌচাক নজরে পড়লো না। ফেরার পথে আমি ও মাধব, একে অপরের সিগারেট মুখে ফিল্মী কায়দায় ছবি তুললাম। দু’একদিনের মধ্যে সেইসব ছবি হাতেও পেয়ে গেলাম। মাধবের অসতর্কতায় সেই দু’টো ছবি বড়মামার হাতে চলে গেল। অনেক ছবির মধ্যে থেকে সেই দুটো ছবি বার করে নিতে ভূলে গিয়ে, সব ছবি মাধব বড়মামাকে দেখতে দিল। বড়মামা, মাইমা, মুনা ও বাবুল গোল হয়ে বসে সেই সব ছবি দেখতে শুরু করলো। বিপদ বুঝে আমি মাধবকে ইশারা করলাম, কিন্তু তখন আর ছবিগুলো ফেরৎ নেবার উপায় নেই। বিপদ বুঝে আমি পাশের নিজেদের ঘরে চলে গেলাম। মাধব বোকার মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরেই বড়মামাকে একটু জোর গলায় ধমকের সুরে কথা বলতে শুনে ঘাবড়ে গেলাম। পরে মাধবের কাছে শুনলাম, ওই ফটোদুটো মুনা ও বাবুলকে দেখতে না দেওয়ায়, তারা দেখতে চাইছিল। তাই বড়মামা তাদের ধমক দিচ্ছিলেন। তিনি কিন্তু আমাদের এ বিষয়ে একটি কথাও বললেন না।

একদিন হরকিষাণ নামে একটা পয়েন্টসম্যান এসে খবর দিল, মার্টিন একটা বাঘ মেরেছে। হরকিষাণ দিনে অনেকবার বড়মামার বাড়িতে আসতো। সে বড়মামর অনেকটা ব্যক্তিগত খানসামা গোছের ছিল। বড়মামা আমাদের বাঘটা দেখতে যেতে বললেন। আমরা হরকিষাণকে বাঘ না বনবিড়াল জিজ্ঞাসা করায়, সে বেশ জোর গলায় জানালো—“না বাবু শের”। বড়মামা জানালেন, পাশ দিয়ে সাতপুরা রেঞ্জ যাওয়ায় বাঘ আসার সম্ভাবনা আছে।

আমরা বাঘ দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। বড়মামা বললেন, এখানকার সব লোক তাঁকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। বাঘের চামড়াটা চাইলে হয়, মার্টিন তাঁকে বাঘের চামড়াটা দিয়ে দিতে পারে।

আমরা দু’জনে হরকিষাণের সাথে মার্টিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মার্টিন একজন খৃষ্টান মেথর। তার নাকি বন্দুক আছে এবং তার বন্দুকের নিশানাও নাকি অব্যর্থ। কয়েক দিন ধরেই এর ছাগল, তার মুরগি খোয়া যাচ্ছিল। আধ খাওয়া ছাগল পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। গতকাল রাতে বাঘের ডাকের আওয়াজ শুনে, মার্টিন অন্ধকারে আওয়াজ লক্ষ্য করে আন্দাজে গুলি চালায়। তাতেই বাঘটা মারা গেছে।

শুনে তো আমরা অবাক। এখানে এমন একজন জিম করবেটের ছোট ভাই আছে, ভাবতেই পারছিলাম না। প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে মার্টিনের কোয়ার্টার্সের কাছে গিয়ে দেখি বেশ ভিড়। নিশ্চিত হলাম বাঘ না হলেও, কিছু একটা মেরেছে। কিন্তু ততক্ষণে মার্টিনের কোয়ার্টার্সের বাইরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাইরে তখনও অনেক কৌতুহলী লোকের ভিড়। দরজাটার নীচের দিকে চৌকাঠ না থাকায় অনেকটা ফাঁক। প্রায় শুয়ে পড়ে ওই ফাঁক দিয়ে দেখলাম, একটা প্রকান্ড চিতাবাঘ শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে আবার দরজা খুলে দিলে ভিতরে গিয়ে দেখি, বাড়ির দালানে বাঘটা পাশ ফিরে পড়ে আছে। গলার কাছে একটা গুলি লাগার গর্ত, সেখানে কালো হয়ে রক্ত জমে আছে। লেজটা বেশ মোটা। হাত দিয়ে দেখে বোঝা গেল, বড় বড় লোমের জন্য লেজটা অত মোটা মনে হয়। বড় বড় গোল গোল কালো রঙের ছোপগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন তুলি দিয়ে আঁকা। একটু পরে বাঘটাকে বাইরে নিয়ে আসা হলে, মার্টিন বাঘের গায়ে পা দিয়ে, বন্দুক কাঁধে ছবি তুললো। কিন্তু বড়মামার বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে বাঘ ও মার্টিন, উভয়কেই তুলে নিয়ে গেল।

এরমধ্যে আমার জন্মদিন এল। কথায় কথায় মাধবকে বলেছিলাম, ও বোধহয় মাইমাকে বলেছিল। ওই দিন দেখলাম বড়াখানার ব্যবস্থা হয়েছে, এবং আমাকে একটা বেশ বড় মাছের মুড়ো দেওয়া হয়েছে। মাছের মুড়ো আমি পছন্দও করি না, গুছিয়ে খেতেও পারি না। বিপদ বুঝে অনেক চেষ্টায় মাধবকে মুড়োটা তুলে দিয়ে বিপদমুক্ত হলাম। মাইমা বোধহয় ভাবলেন, আমাকে একা মুড়োটা দেওয়ায় লজ্জা পেয়েছি। ফলে বিপদ বাড়লো। এরপর থেকে বেশ কয়েকবার আমাদের দু’জনকে দুটো মাছের মুড়ো দেওয়া হলো।

এই জাতীয় বিপদ আমার জীবনে বার বার আসে। আগেও এসেছে, এখনও আসে। আমি কোনকালে ঘড়ি পরি না, মিষ্টি খেতে মোটেই ভালোবাসি না, অথচ যত রাজ্যের লোক দেখি সবাইকে ছেড়ে আমার কাছে ক’টা বাজে জানতে চায়, আমাকে আদর করে মিষ্টি খেতে দিয়ে বিব্রত করে। একবার মামার বাড়ি সোদপুরে গেছি, দুপুরে খাবার পাতে দাদুকে একটা মাছের মুড়ো দেওয়ায়, দাদু সেটা আমার পাতে তুলে দেন। আমি বিপদ বুঝে নানা যুক্তি খাড়া করে সেটা পুনরায় দাদুর পাতে ফেরৎ পাঠাতে চেষ্টা করি।

যুক্তিগুলো অবশ্য বেশ হাস্যকর ছিল। যেমন, অল্প বয়সে মাছের মুড়ো খেয়ে কী হবে? মাছের মুড়ো খেলে চোখ ভালো থাকে, সেটা আমার থেকে তাঁর খাওয়া বেশি প্রয়োজন। বুড়ো বয়সে পুষ্টির প্রয়োজন অনেক বেশি, তাই মুড়োটা দাদুরই খাওয়া উচিৎ। কিন্তু বাস্তবে কোন যুক্তিই কাজে না লাগায়, মুড়োটা আমার পাতেই স্থান পায়। বাধ্য হয়ে মুড়োটাকে ছোট ছোট অংশে ভেঙ্গে থালার চারপাশে ফেলে, মুড়োটা খেয়েছি ভান করতে হয়।

একদিন আমি আর মাধব রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ পার হয়ে এসে, একটা জায়গায় একটা হনুমানকে রেললাইনের ধারে বসে টিক গাছের পাতা খেতে দেখলাম। এই এক অদ্ভুত জীব। এরা টিক পাতা খায়, পেঁপে পাতা খায়, অথচ আতার মতো সুস্বাদু ফল খায় না। এই এলাকায় প্রচুর আতা হয়। এখানকার লোকেদের ধারণা, ফলটার নাম সীতাফল বলে, হনুমান এই ফল খায় না। এখানকার সাধারণ লোকের বুদ্ধিও জীবটার মতোই, এবং সাধারণ লোকের সংখ্যাই বেশি। আমাদের হঠাৎ কী দুর্বুদ্ধি হলো, হনুমানটাকে কে টিপ করে পাথর ছুঁড়ে মারতে পারে, তার প্রতিযোগীতা শুরু করলাম। একটা করে রেললাইনের পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, এবং যথারীতি অধিকাংশই লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। যে দু’-একটা তার গায়ে লাগার মতো সঠিক নিশানায় যাচ্ছে, হনুমানটা তার শরীরটকে অদ্ভুত ভাবে বাঁকিয়ে, সেগুলো থেকে আত্মরক্ষা করছে। অদ্ভুত ব্যাপার, হনুমানটা কিন্তু ওই জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও সরছে না, বা আমাদের আক্রমণ করার চে্ষ্টাও করছে না। হঠাৎ দেখি ছোট ছোট গাছের আড়ালে, প্রচুর হনুমান। আমরা ভয় পেয়ে দ্রুত পা চালালাম। এইভাবে আরও অনেকক্ষণ রেল লাইন ধরে এগিয়ে যাবার পর, আকাশ কালো করে মেঘ জমতে শুরু করলো। একটু পরেই ঠান্ডা বাতাস, বুঝলাম কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা দ্রুত ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু আমরা ততক্ষণে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ পার হয়ে চলে এসেছি। সামান্য পথ ফেরার পরেই, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো, তার সাথে তীব্র হাওয়া। আমরা ওই অবস্থায় লাইন ধরে হেঁটে ফিরছি। বৃষ্টির ফোঁটা চোখে মুখে সুচের ফলার মতো বিঁধছে, কোথাও একটা দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই। আরও কিছুটা পথ আসার পর, পিছন থেকে একটা মালগাড়ি আসতে দেখলাম। মালগাড়িটা আমাদের অতিক্রম করে যখন চলে যাচ্ছে, তখন গার্ডের বগিটাতে একজনকে বসে থাকতে দেখে হাত নাড়লাম। উনিই সম্ভবত গার্ড। আমরা কোথায় যাব জিজ্ঞাসা করায়, জানালাম ডোঙ্গরগড় রেলওয়ে স্টেশনে যাব। তিনি গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমাদের তাঁর বগিতে তুলে নিলেন। বাকি পথ আমরা কোথায় থাকি, কী করি, এখানে কার কাছে এসেছি, ইত্যাদি গল্প করতে করতে ডোঙ্গরগড় রেলওয়ে স্টেশনে গাড়ি এলে, গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের নামিয়ে দিলেন। কষ্ট অনেকটা লাঘব হলেও, একবারে ভিজে কাক হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফেরার পথে অবশ্য ভিজে পোষাকেই অন্যান্য দিনের মতো সিঙাড়া আর চা খাওয়া হলো।

সুবীর কুমার রায়

০৫-১২-২০১৮