অভিভাবকহীন প্রথম দূরপাল্লার ভ্রমণের অংশ বিশেষ (স্মৃতির পাতা থেকে)

71946068_1338812139627865_3484388348838019072_n

প্রাণের বন্ধু মাধবের বড়মামা ডাক্তার। মধ্য প্রদেশের ডোঙ্গরগড়ে রেলে চাকরি করেন। বি.কম. পার্ট ওয়ান পরীক্ষার শেষে বেড়াতে যাওয়া ও প্রচন্ড নকশাল আন্দোলনের ঝামেলা থেকে কিছুদিন মুক্তি পাওয়ার আশায়, আমি ও মাধব ডোঙ্গরগড়ে যাওয়া ঠিক করলাম। যদিও বড়মামাকে খুব গম্ভীর ও রাশভারী মানুষ বলেই মনে হতো। যাইহোক্, সেইমতো আমার ও মাধবের ওখানে যাওয়া পাকা হয়ে গেল।

যেদিন আমাদের যাওয়ার কথা, ঠিক তার আগের দিন রাতে দোতলায় সামনের বারান্দায় পরপর মশারি খাটিয়ে আমরা শুয়ে আছি। আমাদের বাড়ির সামনে একটা মাঝখানে টিনের দরজা দেওয়া অল্প উচ্চতার পাঁচিল ছিল। গভীর রাতে, তখনও ভোর হতে অনেক দেরি আছে, টর্চের তীব্র আলো আমাদের বারান্দায় পড়তে, আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। বাবা ও মা’রও ঘুম ভেঙে গেছে। নীচের রাস্তায় ভারী বুটের আওয়াজ। হঠাৎ শুনলাম কে যেন বললো, “এই বাড়ি স্যার”। টিনের দরজা না খুলে, পাঁচিল টপকে বেশ কয়েকজন লাফিয়ে ভিতরে প্রবেশ করায় বুঝলাম পুলিশ এসেছে। বাবা বললেন “ওদের একটু বুঝিয়ে বলবো, যে এ  বাড়ির কেউ নকশালী করে না”? আমি ফিস্ ফিস্ করে আলো জ্বালতে ও কথা বলতে বারণ করলাম। আমি জানি এত রাতে কথা বলতে গেলে, আমরা কেন এত রাতে জেগে আছি, সে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। বাবারও সত্যবান চক্রবর্তীর মতো অবস্থা হবে। সত্যবান চক্রবর্তী একজন নিরীহ প্রৌঢ় ভদ্রলোক, কিছুদিন আগে তাঁর বাড়িতে পুলিশ এসে কাউকে না পেয়ে তাঁর ওপর অকথ্য অত্যাচার করে গেছে। আবার এও বুঝতে পারছি,  যে ওরা ওপরে উঠে এলে, আমার ও পাশের ফ্ল্যাটের গোবিন্দর অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে, কারণ এই বাড়িতে যুবক বলতে আমরা দু’জনই বাস করি। এইসময় হঠাৎ শুনলাম ওদের মধ্যে কে একজন বললো, “এই বাড়ি নয় স্যার, প্রদীপদের পাশের বাড়ি”। প্রদীপ নকশাল হিসাবে পরিচিত ছিল। ওদের বাড়িটা ছিল, আমাদের বাড়ির ঠিক দু’টো বাড়ি আগে। আমাদের বাড়ির রঙ সাদা, আমাদের একটা বাড়ি আগের বাড়িটার, অর্থাৎ প্রদীপদের বাড়ির ঠিক পাশের তিনতলা বাড়িটার রঙও সাদা। ওই লোকটার কথা শোনার সাথে সাথে সবাই আবার পাঁচিল টপকে লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে, প্রদীপদের পাশের বাড়িটার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো।

নিদ্রাহীন সারাটা রাত কাটিয়ে খুব ভোরে দাঁত মাজার অছিলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক ঝলক তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তায় সার সার অবাঙালি সি.আর.পি. তে ভর্তি। একজন মহিলা, লোকের বাড়ি কাজ করতে যাবার সময়, তাকে ওরা বাধা দিল। ভয়ে ভয়ে সে জানালো, যে সে লোকের বাড়ি কাজ করতে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের একজন গম্ভীর গলায় জানালো— “অটোর নেই”। অর্থাৎ অর্ডার নেই। পরে শুনেছিলাম ওদের কাছে খবর ছিল, প্রদীপের পাশের বাড়িতে অনেকে লুকিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও সেই বাড়িতে কাউকেই পাওয়া যায় নি। একটু বেলা হলে সকলে ফিরে গেলে, আবার সব স্বাভাবিক হলো। আজই আমাদের ডোঙ্গরগড় যাবার দিন, আজ কোন ঝামেলা হলে সব পণ্ড হয়ে যেত।

এই প্রথম একা একা দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। বেশ একটা হীরো হীরো, সাবালক সাবলক ভাব নিয়ে দু’জনে গীতাঞ্জলীতে ডোঙ্গরগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যাওয়ার আগে ভাইকে লালু-ভুলুর যত্ন নিতে বলে গেলাম। লালু-ভুলু সাদা খরগোশ। লালু মেয়ে, আমার খরগোশ। ভুলু ছেলে, ভাইয়ের খরগোশ। একটা ফাঁক ফাঁক কাঠের বাক্সে, যাতে করে কেক, পাঁউরুটি নিয়ে যাওয়া হয়, খরগোশ দু’টোকে রাখা হতো।

অবসন্ন বিকেল কেটে, একসময় রাত নেমে এল। টু-টায়ার বগিতে মুখোমুখি একদিকে মাধবের, উল্টোদিকে আমার আপার বার্থ। সারাদিন মুখোমুখি কখনও জানালার ধারে, কখনও প্যাসেজের দিকে বসেই কেটেছে। বেশ মনে আছে, অনেক রাত পর্যন্ত নীচে একপাশে কোনমতে বসে গল্প করে কাটালাম। ওপরের বার্থে কেউ নেই, বার্থের লোক নিশ্চই ট্রেন মিস্ করেছে, ইত্যাদি নানারকম আলোচনার পর, দু’জন ওপরে উঠে শুয়ে পড়লো। দেখলাম, দেখেও চুপ করে থাকলাম। আরও অনেক পরে ওই দু’জনকে ডেকে নীচে নেমে আসতে বললে, ওরা অবাক হয়ে গেল। গোটা ট্রেনটায় অন্ধকারে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। আমরা রিজার্ভ করা বার্থ থাকতেও কষ্ট করে কেন জেগে বসেছিলাম, ওরা ভেবে না পেয়ে নীচে নেমে এলো।

বড়মামার কোয়ার্টার্সটা বিশাল। সামনে ও দু’পাশে পুরো ফাঁকা জায়গা। পিছনটা পাঁচিল ঘেরা ছোট্ট জায়গা, কিছু শাকসবজি লাগানো হয়েছে। বড়মামার বড় মেয়ে তার দাদুর কাছে বম্বেতে থাকে। ছোট মেয়ে মুনা ও বাবুল, দু’জনেই বেশ ছোট। ওখানে পৌঁছে কিরকম একটা মন খারাপ করা অস্বস্তি হতে লাগলো। কাউকে চিনি না, বড়মামাও বেশ গম্ভীর রাশভারী মানুষ বলে জানি। একটু পরেই বড়মামা অফিস থেকে এসে, আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। ডানদিকের একটা ঘর আমাদের দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘরটার একদিকের দরজা দিয়ে অন্যান্য ঘরে যাওয়া যায়। অন্য একটা দরজা দিয়ে পিছনের ঘেরা সবজি বাগানটায় যাওয়া যায়। বাড়ির ভিতরে একটা বাথরূম-পায়খানা, আর একটা পায়খানা ওই ঘেরা সবজি বাগানটার একপাশে। এটা কিন্তু আমাদের এখানকার খাটা পায়খানার মতো। একটা সিমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে, এই পায়খানাটায় ঢুকতে হতো।

প্রথম দিন নতুন পরিবেশে ভালোই কাটলো। সন্ধ্যার আগে আমি আর মাধব ঘুরতে বেরলাম। একটু দূরে বোমলাই পাহাড় নামে একটা পাহাড় ছিল। চারিদিকের অন্যান্য পাহাড়গুলোর তুলনায় এই পাহাড়টা অনেকটাই উঁচু। এই পাহাড়টার ওপরে একটা মন্দির আছে। সম্ভবত মন্দিরের দেবীর নাম বোমলাই। আশেপাশে কয়েকটা ছোট ছোট ঢিবি পাহাড় আছে, দূরে সাতপুরা রেঞ্জ। রাতে বড়মামা ও মামি, আমাদের লুডো খেলতে ডাকলেন। আমি আবার আসার সময় সঙ্গে করে একটা চাইনিজ চেকার নিয়ে এসেছি। এই খেলাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। একসময় অনেকেই আমাকে হারাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বেশ মনে আছে, এই খেলায় আমাকে কেউ হারাতে পারে না শুনে বাকসাড়ার একটা ছেলে, এতদিন পরে আর তার নাম মনে করতে পারছি না, আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। আমাকে কেউ হারাতে পারে না, একথা আমি নিজে কোনদিন বলিনি। তবে ব্যাতড়ে আড্ডা মারতে গিয়ে মাঝে মধ্যে খেলা হতো, একথা সত্যি আমাকে কেউ কোনদিন হারাতে পারেনি। ওরাই আমার খেলার প্রশংসা করে একথা বলতো, আর তাতেই গ্যাস খেয়ে, উত্তেজিত হয়ে এই ছেলেটা আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ব্যাতড়েই একজনের বাড়িতে খেলা হবে। ঠিক হলো, যে হারবে সে মুরগির দাম দেবে। যারা দর্শক, অর্থাৎ আমার ফ্যানেরা, তেল, মশলা, চাল ইত্যাদির দাম দেবে। দু’জনের খেলা অনেকক্ষণ চলার পর, আমিই জয়ের হাসি হেসেছিলাম। মুরগির ঝোল, ভাতও সেদিন কথামতো হয়েছিল। যাহোক্, বড়মামাকে চাইনিজ চেকার খেলার কথা বলতে, তাঁরা লুডো খেলাতেই আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

পরদিন সকালে চা খেয়ে বাথরূমে যাবার আগে মাধবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন বাথরূমটায় যাব”? মাধব জানালো, দিনের বেলায় ছেলেরা বাইরের বাথরূমটা ব্যবহার করে। সেইমতো আমিও সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ভিতরে ঢুকে লক্ষ্য করলাম, নীচে কোন টব বা গামলা জাতীয় কিছু নেই। গর্তের নীচে পরিস্কার চকচকে লাল সিমেন্টের মেঝে। আবার বাইরে এসে মাধবকে ব্যাপারটা জানাতে, ও বললো কোন অসুবিধা নেই ওখানেই যা। বুঝতে পারছি না, যে ও আমার সাথে ইয়ার্কি করছে কী না। যদিও ওর এই জাতীয় ইয়ার্কি করার স্বভাব নয়, তবু ভয় হচ্ছে ওখানে যাবার পর আবার না লজ্জায় পড়তে হয়। শেষপর্যন্ত ওর জোর গলায় অভয়বাণী শুনে ও প্রাকৃতিক ডাকে, যা আছে কপালে ভেবে ওখানেই গেলাম। একটু ভয় ভয় ভাব নিয়ে সবে বসেছি, বস্তুটা শরীর ত্যাগ করে লাল মেঝেয় পড়ার আগেই নীচে কিরকম একটা আওয়াজ হওয়ায়, নীচে তাকিয়ে দেখি দুটো শুয়োর গর্তের নীচে, আর একটা গুঁতোগুঁতি করে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। একটা তো পারলে প্রায় বস্তুটা মাটিতে পড়ার আগেই শরীর থেকে টেনে নিতে চায়। ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কী করবো ভাবছি। এই অবস্থায় বাইরে যাওয়াও সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে আবার বসলাম। বস্তুটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, মেঝে আবার আগের মতো লাল চকচকে। পরে মাধব জানালো এখানে এটাই ব্যবস্থা, সব বাড়িতেই এই একই ব্যবস্থা। জিজ্ঞাসা করলাম, “কোনদিন শুয়োরগুলোর যদি খিদে না থাকে, বা শরীর খারাপ করে”? মাধব জানালো শুয়োরের অভাব নেই, কারো না কারো খিদে থাকবেই, কাজেই চিন্তার কোন কারণ নেই। এরপর থেকে এই অদ্ভুত ব্যবস্থায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

বেশ কাটছিল। সকালে চা জলখাবার খেয়ে দু’জনে ঘুরতে বেরোতাম। চারিদিক ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে স্নান করা। দুপুরে ভালোমন্দ খেয়ে একটু ভাতঘুম। বিকালে আবার বেরোনো। পাহাড়ে ওঠা, রেল লাইন ধরে হাঁটা, এবং শেষে একটা দোকানে গরম গরম সিঙাড়া ও চা খেয়ে বাড়ি ফেরা। ইতিমধ্যে আমার অনুরোধে বড়মামা ও মাইমাও চাইনিজ চেকার খেলা শুরু করেছেন। এখন লুডো খেলা প্রায় বন্ধ। অনেক রাত পর্যন্ত চাইনিজ চেকার খেলা হতো। বড়মামার এই খেলাটাতে কিরকম নেশা ধরে গেছিল।

একদিন ওখানকার সবথেকে উঁচু পাহাড়টায় যাওয়ার প্ল্যান করলাম। বড়মামা জানালেন ওই পাহাড়ে প্রচুর বড় বড় বুনো মৌমাছির চাক আছে, কাজেই সতর্ক হয়ে যেতে হবে। মৌমাছির ঝাঁক আক্রমণ করলে, মুখটা ঢাকা দিয়ে মুখটাকে বাঁচাতে হবে। সকালবেলা চা, জলখাবার খেয়ে দু’জনে বোমলাই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বোমলাই ঢিবি পাহাড় হলেও বেশ উঁচু। দু-চারটে মৌমাছিকে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঘুরপাক খেতেও দেখলাম। কিন্তু কোন মৌচাক নজরে পড়লো না। ফেরার পথে আমি ও মাধব, একে অপরের সিগারেট মুখে ফিল্মী কায়দায় ছবি তুললাম। দু’একদিনের মধ্যে সেইসব ছবি হাতেও পেয়ে গেলাম। মাধবের অসতর্কতায় সেই দু’টো ছবি বড়মামার হাতে চলে গেল। অনেক ছবির মধ্যে থেকে সেই দুটো ছবি বার করে নিতে ভূলে গিয়ে, সব ছবি মাধব বড়মামাকে দেখতে দিল। বড়মামা, মাইমা, মুনা ও বাবুল গোল হয়ে বসে সেই সব ছবি দেখতে শুরু করলো। বিপদ বুঝে আমি মাধবকে ইশারা করলাম, কিন্তু তখন আর ছবিগুলো ফেরৎ নেবার উপায় নেই। বিপদ বুঝে আমি পাশের নিজেদের ঘরে চলে গেলাম। মাধব বোকার মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরেই বড়মামাকে একটু জোর গলায় ধমকের সুরে কথা বলতে শুনে ঘাবড়ে গেলাম। পরে মাধবের কাছে শুনলাম, ওই ফটোদুটো মুনা ও বাবুলকে দেখতে না দেওয়ায়, তারা দেখতে চাইছিল। তাই বড়মামা তাদের ধমক দিচ্ছিলেন। তিনি কিন্তু আমাদের এ বিষয়ে একটি কথাও বললেন না।

একদিন হরকিষাণ নামে একটা পয়েন্টসম্যান এসে খবর দিল, মার্টিন একটা বাঘ মেরেছে। হরকিষাণ দিনে অনেকবার বড়মামার বাড়িতে আসতো। সে বড়মামর অনেকটা ব্যক্তিগত খানসামা গোছের ছিল। বড়মামা আমাদের বাঘটা দেখতে যেতে বললেন। আমরা হরকিষাণকে বাঘ না বনবিড়াল জিজ্ঞাসা করায়, সে বেশ জোর গলায় জানালো—“না বাবু শের”। বড়মামা জানালেন, পাশ দিয়ে সাতপুরা রেঞ্জ যাওয়ায় বাঘ আসার সম্ভাবনা আছে।

আমরা বাঘ দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। বড়মামা বললেন, এখানকার সব লোক তাঁকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। বাঘের চামড়াটা চাইলে হয়, মার্টিন তাঁকে বাঘের চামড়াটা দিয়ে দিতে পারে।

আমরা দু’জনে হরকিষাণের সাথে মার্টিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মার্টিন একজন খৃষ্টান মেথর। তার নাকি বন্দুক আছে এবং তার বন্দুকের নিশানাও নাকি অব্যর্থ। কয়েক দিন ধরেই এর ছাগল, তার মুরগি খোয়া যাচ্ছিল। আধ খাওয়া ছাগল পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। গতকাল রাতে বাঘের ডাকের আওয়াজ শুনে, মার্টিন অন্ধকারে আওয়াজ লক্ষ্য করে আন্দাজে গুলি চালায়। তাতেই বাঘটা মারা গেছে।

শুনে তো আমরা অবাক। এখানে এমন একজন জিম করবেটের ছোট ভাই আছে, ভাবতেই পারছিলাম না। প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে মার্টিনের কোয়ার্টার্সের কাছে গিয়ে দেখি বেশ ভিড়। নিশ্চিত হলাম বাঘ না হলেও, কিছু একটা মেরেছে। কিন্তু ততক্ষণে মার্টিনের কোয়ার্টার্সের বাইরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাইরে তখনও অনেক কৌতুহলী লোকের ভিড়। দরজাটার নীচের দিকে চৌকাঠ না থাকায় অনেকটা ফাঁক। প্রায় শুয়ে পড়ে ওই ফাঁক দিয়ে দেখলাম, একটা প্রকান্ড চিতাবাঘ শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে আবার দরজা খুলে দিলে ভিতরে গিয়ে দেখি, বাড়ির দালানে বাঘটা পাশ ফিরে পড়ে আছে। গলার কাছে একটা গুলি লাগার গর্ত, সেখানে কালো হয়ে রক্ত জমে আছে। লেজটা বেশ মোটা। হাত দিয়ে দেখে বোঝা গেল, বড় বড় লোমের জন্য লেজটা অত মোটা মনে হয়। বড় বড় গোল গোল কালো রঙের ছোপগুলো দেখে মনে হচ্ছে, যেন তুলি দিয়ে আঁকা। একটু পরে বাঘটাকে বাইরে নিয়ে আসা হলে, মার্টিন বাঘের গায়ে পা দিয়ে, বন্দুক কাঁধে ছবি তুললো। কিন্তু বড়মামার বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে বাঘ ও মার্টিন, উভয়কেই তুলে নিয়ে গেল।

এরমধ্যে আমার জন্মদিন এল। কথায় কথায় মাধবকে বলেছিলাম, ও বোধহয় মাইমাকে বলেছিল। ওই দিন দেখলাম বড়াখানার ব্যবস্থা হয়েছে, এবং আমাকে একটা বেশ বড় মাছের মুড়ো দেওয়া হয়েছে। মাছের মুড়ো আমি পছন্দও করি না, গুছিয়ে খেতেও পারি না। বিপদ বুঝে অনেক চেষ্টায় মাধবকে মুড়োটা তুলে দিয়ে বিপদমুক্ত হলাম। মাইমা বোধহয় ভাবলেন, আমাকে একা মুড়োটা দেওয়ায় লজ্জা পেয়েছি। ফলে বিপদ আরও বাড়লো। এরপর থেকে বেশ কয়েকবার আমাদের দু’জনকে দু’টো মাছের মুড়ো দেওয়া হলো।

এই জাতীয় বিপদ আমার জীবনে বার বার আসে। আগেও এসেছে, এখনও আসে। আমি কোনকালে ঘড়ি পরি না, মিষ্টি খেতে মোটেই ভালবাসি না, অথচ যত রাজ্যের লোক দেখি সবাইকে ছেড়ে আমার কাছে ক’টা বাজে জানতে চায়, আমাকে আদর করে মিষ্টি খেতে দিয়ে বিব্রত করে। একবার মামার বাড়ি সোদপুরে গেছি, দুপুরে খাবার পাতে দাদুকে একটা মাছের মুড়ো দেওয়ায়, দাদু সেটা আমার পাতে তুলে দেন। আমি বিপদ বুঝে নানা যুক্তি খাড়া করে সেটা পুনরায় দাদুর পাতে ফেরৎ পাঠাতে চেষ্টা করি।

যুক্তিগুলো অবশ্য বেশ হাস্যকর ছিল। যেমন, অল্প বয়সে মাছের মুড়ো খেয়ে কী হবে? মাছের মুড়ো খেলে চোখ ভালো থাকে, সেটা আমার থেকে তাঁর খাওয়া বেশি প্রয়োজন। বুড়ো বয়সে পুষ্টির প্রয়োজন অনেক বেশি, তাই মুড়োটা দাদুরই খাওয়া উচিৎ। কিন্তু বাস্তবে কোন যুক্তিই কাজে না লাগায়, মুড়োটা আমার পাতেই স্থান পায়। বাধ্য হয়ে মুড়োটাকে ছোট ছোট অংশে ভেঙ্গে থালার চারপাশে ফেলে, মুড়োটা খেয়েছি ভান করতে হয়।

যাইহোক, একদিন আমি আর মাধব রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ পার হয়ে এসে, একটা জায়গায় একটা হনুমানকে রেললাইনের ধারে বসে টিক গাছের পাতা খেতে দেখলাম। এই এক অদ্ভুত জীব। এরা টিক পাতা খায়, পেঁপে পাতা খায়, অথচ আতার মতো সুস্বাদু ফল খায় না। এই এলাকায় প্রচুর আতা হয়। এখানকার লোকেদের ধারণা, ফলটার নাম সীতাফল বলে, হনুমান এই ফল খায় না। এখানকার সাধারণ লোকের বুদ্ধিও জীবটার মতোই, এবং সাধারণ লোকের সংখ্যাই বেশি। আমাদের হঠাৎ কী দুর্বুদ্ধি হলো, হনুমানটাকে কে টিপ করে পাথর ছুঁড়ে মারতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। একটা করে রেললাইনের পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, এবং যথারীতি অধিকাংশই লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। যে দু’-একটা তার গায়ে লাগার মতো সঠিক নিশানায় যাচ্ছে, হনুমানটা তার শরীরটাকে অদ্ভুত ভাবে বাঁকিয়ে, সেগুলো থেকে আত্মরক্ষা করছে। অদ্ভুত ব্যাপার, হনুমানটা কিন্তু ওই জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও সরছে না, বা আমাদের আক্রমণ করার চে্ষ্টাও করছে না। হঠাৎ দেখি ছোট ছোট গাছের আড়ালে, প্রচুর হনুমান। আমরা ভয় পেয়ে দ্রুত পা চালালাম। এইভাবে আরও অনেকক্ষণ রেল লাইন ধরে এগিয়ে যাবার পর, আকাশ কালো করে মেঘ জমতে শুরু করলো। একটু পরেই ঠান্ডা বাতাস, বুঝলাম কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা দ্রুত ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু আমরা ততক্ষণে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ পার হয়ে চলে এসেছি। সামান্য পথ ফেরার পরেই, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো, তার সাথে তীব্র হাওয়া। আমরা ওই অবস্থায় লাইন ধরে হেঁটে ফিরছি। বৃষ্টির ফোঁটা চোখে মুখে সুচের ফলার মতো বিঁধছে, কোথাও একটা দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই। আরও কিছুটা পথ আসার পর, পিছন থেকে একটা মালগাড়ি আসতে দেখলাম। মালগাড়িটা আমাদের অতিক্রম করে যখন চলে যাচ্ছে, তখন গার্ডের বগিটাতে একজনকে বসে থাকতে দেখে হাত নাড়লাম। উনিই সম্ভবত গার্ড। আমরা কোথায় যাব জিজ্ঞাসা করায়, জানালাম ডোঙ্গরগড় রেলওয়ে স্টেশনে যাব। তিনি গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমাদের তাঁর বগিতে তুলে নিলেন। বাকি পথ আমরা কোথায় থাকি, কী করি, এখানে কার কাছে এসেছি, ইত্যাদি গল্প করতে করতে ডোঙ্গরগড় রেলওয়ে স্টেশনে গাড়ি এলে, গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের নামিয়ে দিলেন। কষ্ট অনেকটা লাঘব হলেও, একবারে ভিজে কাক হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফেরার পথে অবশ্য ভিজে পোষাকেই অন্যান্য দিনের মতো সিঙাড়া আর চা খাওয়া হলো।

সুবীর কুমার রায়

০৫-১২-২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s